॥ এহসানুল হক জসীম ॥
জাতির এক সঙ্কট মুহূর্তে আশাহীন-দিশাহীন জাতিকে মুক্তির নেশায় উজ্জীবিত করতে এবং পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে শিার আলো পৌঁছে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের তির প্রেক্ষাপটে সান্ত্বনাস্বরূপ যে বিশ্ববিদ্যালয়; সময়ের ব্যবধানে এ সংগ্রামী ভূমিকায় ’৪৭-এর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক বেশি।
সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ’বঙ্গভঙ্গ’ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশই ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করেন। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মর্মাহত হয়ে পড়েন। বঙ্গভঙ্গের ফলে কয়েক বছরের মুসলিমসমাজে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা উবে যায়। তারা বিুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি তার সাথে দেখা করেন। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা সব দিক থেকে দারুণভাবে তিগ্রস্ত হবে। বঙ্গভঙ্গ আবার চালু করা হোক, না হয় এর ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেনÑ
"The Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca."
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলেও আবারো বাধার সৃষ্টি করেন হিন্দু নেতারা। তাদের কাছে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা করতে থাকেন প্রচণ্ড বিরোধিতা। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার বঙ্গভঙ্গ: তৎপরর্তী সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অম্বিকা চরণ মজুমদার, কিশোরী মোহন চৌধুরী প্রমুখ। তারা স্মারকলিপি পেশ করেন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, "The Muslim of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a University."
এ ক্ষেত্রে অন্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ এবং হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাস আলী তার সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রƒপ শুরু করেন।
বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা যথাসময়ে লন্ডনের ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক গৃহীত হয়। ফলে সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা গভর্নরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কিম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করে। এই পত্রে বাংলার মুসলিমদের স্বার্থ ও প্রয়োজন মেটানোর দিকে ল রাখার বিশেষ নির্দেশ ছিল। পত্রে এ মর্মে একটি নির্দেশও ছিল, যাতে শিা েেত্র মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় সভ্যতা সংস্কৃতি রায় সফল হয়। সেই ল্েয বলা হয় : "There might be a faculty of Arabic and Islamic Studies in the University."
ভারত সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের ল্েয বাংলা সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার আর নাথানের নামে এর নাম হয় ’নাথান কমিটি’। কমিটি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাংলা সরকারের কাছে পেশ করেছিল।
নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জমিবিশিষ্ট একটি মনোরম এলাকারও সুপারিশ করে। জনমত যাচাইয়ের ল্েয ১৯১৩ সালে এ কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সচিব কর্তৃক রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে স্কিমটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে সংপ্তিভাবে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার জন্য আবারো প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১৯১৬ সালে ভারত সরকার বাংলা সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয সর্বনিম্নœ খরচের সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে থাকায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব পেশের পর আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আশ্বাস দেয়া হয়, "The promise Lord Hardinge made that the University would be founded in Dacca."
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে নাÑ এমন অজুহাতেও কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তার জমিদারির বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেন। জমি অধিগ্রহণের পাশাপশি আর্র্থিক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি টাঙ্গাইলে তার জমিদারির একটি বিরাট অংশ বিক্রি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে এগিয়ে আসেন। ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড চেমসফোর্ড চ্যান্সেলরের ভাষণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ অসুবিধা পরীা-নিরীার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পইে রিপোর্ট প্রদান করে। এটা কি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, না ‘টিচিং’ এবং ‘এফিলিয়েটেড’ থাকবে? জনমত যাচাইয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন একবার রাজশাহীতে আসে। তখন একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল তাদের সাথে দেখা করে এই দাবি করে যে, পূর্ব বাংলার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এফিলিয়েটেড বা সংযুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে টিচিং কাম এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে সে জন্য হিন্দু নেতারা বিরোধিতা করতে থাকেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতা এর পে অভিমত ব্যক্ত করেন। নাথান কমিটির সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত ও সুপারিশ সাপেে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল প্রণীত হয়, যা ১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুসলমানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশে সম হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয়, তা আজ ফুলে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সব জাতি ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি আরবি ও ইসলামি শিা বিভাগ খোলা হবে। এ পরিপ্রেেিত কমিশন যে বক্তব্য তুলে ধরে, তা স্মরণীয়Ñ "We do not forget that the creation of the University was largely due to the demand of Muslim community of Eastern Bengal for greater facilities for higher education."
বঙ্গভঙ্গের আগে এবং তা রদে পূর্ব বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উচ্চশিার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। বেশির ভাগ কলেজ কলকাতা বা তার আশপাশেই অবস্থিত ছিল। পূর্ব বাংলায় কলেজ খুব কম ছিল। উচ্চশিার জন্য গোটা আসামে মাত্র দু’টি কলেজ ছিল সিলেটের এমসি কলেজ এবং গৌহাটির কটন কলেজ। গৌহাটিতে তখন একটি ল কলেজও ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ দরিদ্র মুসলমান কৃষকসন্তানদের জন্য উচ্চশিার সুযোগ সৃষ্টি করে সম্ভাবনাময় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থানের বছর কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই এই প্রধান শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। অভ্যুত্থানে শিতি মধ্যবিত্তরা যোগ দেয়নি। ইংরেজরা এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তারা চেয়েছিল ভারতীয়দের একাংশকে সভ্যতা ও ভব্যতার শিা দিয়ে ’মহৎ বর্বরে’ রূপান্তরিত করতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু ছাত্ররা স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবে না, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। ইংরেজদের সে উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকে। জাতি মাতৃভাষাকে রার জন্য শুধু রক্ত ঝরায়নি; পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এ জাতিকে স্বাধীনতার সোনালি সকালটিও উপহার দিয়েছে।
লেখক : গবেষক ও মিডিয়াকর্মী
ehsan.jasim@yahoo.com
জাতির এক সঙ্কট মুহূর্তে আশাহীন-দিশাহীন জাতিকে মুক্তির নেশায় উজ্জীবিত করতে এবং পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে শিার আলো পৌঁছে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বঙ্গভঙ্গের তির প্রেক্ষাপটে সান্ত্বনাস্বরূপ যে বিশ্ববিদ্যালয়; সময়ের ব্যবধানে এ সংগ্রামী ভূমিকায় ’৪৭-এর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক বেশি।
সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ’বঙ্গভঙ্গ’ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশই ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করেন। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ মর্মাহত হয়ে পড়েন। বঙ্গভঙ্গের ফলে কয়েক বছরের মুসলিমসমাজে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা উবে যায়। তারা বিুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি তার সাথে দেখা করেন। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেন বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানেরা সব দিক থেকে দারুণভাবে তিগ্রস্ত হবে। বঙ্গভঙ্গ আবার চালু করা হোক, না হয় এর ক্ষতিপূরণস্বরূপ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেনÑ
"The Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca."
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিলেও আবারো বাধার সৃষ্টি করেন হিন্দু নেতারা। তাদের কাছে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা করতে থাকেন প্রচণ্ড বিরোধিতা। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার বঙ্গভঙ্গ: তৎপরর্তী সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জি, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অম্বিকা চরণ মজুমদার, কিশোরী মোহন চৌধুরী প্রমুখ। তারা স্মারকলিপি পেশ করেন, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা হয়। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, "The Muslim of Eastern Bengal were in large majority cultivators and they would be benefited in no way by the foundation of a University."
এ ক্ষেত্রে অন্য হিন্দু নেতাদের মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভূমিকা ছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ এবং হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাস আলী তার সমাজ ও রাজনীতি বইয়ে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্রƒপ শুরু করেন।
বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা যথাসময়ে লন্ডনের ‘ভারত সচিব’ কর্তৃক গৃহীত হয়। ফলে সরকার ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল এক পত্রে বাংলা গভর্নরকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক খতিয়ানসহ একটি পরিপূর্ণ স্কিম প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করে। এই পত্রে বাংলার মুসলিমদের স্বার্থ ও প্রয়োজন মেটানোর দিকে ল রাখার বিশেষ নির্দেশ ছিল। পত্রে এ মর্মে একটি নির্দেশও ছিল, যাতে শিা েেত্র মুসলমানদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্ররা নিজেদের ধর্মীয় সভ্যতা সংস্কৃতি রায় সফল হয়। সেই ল্েয বলা হয় : "There might be a faculty of Arabic and Islamic Studies in the University."
ভারত সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের ল্েয বাংলা সরকার ১৯১২ সালের ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার আর নাথানের নামে এর নাম হয় ’নাথান কমিটি’। কমিটি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে পুর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাংলা সরকারের কাছে পেশ করেছিল।
নাথান কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪৫০ একর জমিবিশিষ্ট একটি মনোরম এলাকারও সুপারিশ করে। জনমত যাচাইয়ের ল্েয ১৯১৩ সালে এ কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সচিব কর্তৃক রিপোর্ট চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ফলে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে স্কিমটি চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে সংপ্তিভাবে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করার জন্য আবারো প্রস্তাব করা হয়। ফলে ১৯১৬ সালে ভারত সরকার বাংলা সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয সর্বনিম্নœ খরচের সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হতে থাকায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। ফলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব পেশের পর আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আশ্বাস দেয়া হয়, "The promise Lord Hardinge made that the University would be founded in Dacca."
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। এ পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে নাÑ এমন অজুহাতেও কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তার জমিদারির বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেন। জমি অধিগ্রহণের পাশাপশি আর্র্থিক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি টাঙ্গাইলে তার জমিদারির একটি বিরাট অংশ বিক্রি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে এগিয়ে আসেন। ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড চেমসফোর্ড চ্যান্সেলরের ভাষণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ অসুবিধা পরীা-নিরীার জন্য একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। এই কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি মতামত ও পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পইে রিপোর্ট প্রদান করে। এটা কি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে, না ‘টিচিং’ এবং ‘এফিলিয়েটেড’ থাকবে? জনমত যাচাইয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন একবার রাজশাহীতে আসে। তখন একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল তাদের সাথে দেখা করে এই দাবি করে যে, পূর্ব বাংলার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এফিলিয়েটেড বা সংযুক্ত থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে টিচিং কাম এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে সে জন্য হিন্দু নেতারা বিরোধিতা করতে থাকেন। অবশ্য কিছুসংখ্যক উদার মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতা এর পে অভিমত ব্যক্ত করেন। নাথান কমিটির সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মত পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে স্বায়ত্তশাসিত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতামত ও সুপারিশ সাপেে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বিল প্রণীত হয়, যা ১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পেশ করা হয়। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুসলমানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশে সম হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে। তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম নেয়, তা আজ ফুলে সুশোভিত হয়ে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ভারত ও বাংলা সরকার এবং নাথান কমিটি এ মর্মে ঐকমত্য পোষণ করে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সব জাতি ও শ্রেণীর ছাত্রদের জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তবে মুসলমান ছাত্রদের জন্য একটি আরবি ও ইসলামি শিা বিভাগ খোলা হবে। এ পরিপ্রেেিত কমিশন যে বক্তব্য তুলে ধরে, তা স্মরণীয়Ñ "We do not forget that the creation of the University was largely due to the demand of Muslim community of Eastern Bengal for greater facilities for higher education."
বঙ্গভঙ্গের আগে এবং তা রদে পূর্ব বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উচ্চশিার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। বেশির ভাগ কলেজ কলকাতা বা তার আশপাশেই অবস্থিত ছিল। পূর্ব বাংলায় কলেজ খুব কম ছিল। উচ্চশিার জন্য গোটা আসামে মাত্র দু’টি কলেজ ছিল সিলেটের এমসি কলেজ এবং গৌহাটির কটন কলেজ। গৌহাটিতে তখন একটি ল কলেজও ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ দরিদ্র মুসলমান কৃষকসন্তানদের জন্য উচ্চশিার সুযোগ সৃষ্টি করে সম্ভাবনাময় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে।
১৮৫৭ সালে সিপাহি অভ্যুত্থানের বছর কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই এই প্রধান শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। অভ্যুত্থানে শিতি মধ্যবিত্তরা যোগ দেয়নি। ইংরেজরা এ বিষয়টিকে সামনে রেখেই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তারা চেয়েছিল ভারতীয়দের একাংশকে সভ্যতা ও ভব্যতার শিা দিয়ে ’মহৎ বর্বরে’ রূপান্তরিত করতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু ছাত্ররা স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবে না, এমন নিশ্চয়তা ছিল না। ইংরেজদের সে উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন গতিতে সম্মুখপানে অগ্রসর হতে থাকে। জাতি মাতৃভাষাকে রার জন্য শুধু রক্ত ঝরায়নি; পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে এ জাতিকে স্বাধীনতার সোনালি সকালটিও উপহার দিয়েছে।
লেখক : গবেষক ও মিডিয়াকর্মী
ehsan.jasim@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন