এমএ নোমান
সার্টিফিকেট হারিয়ে আমার এক আত্মীয় এলেন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আবদার নিয়ে। বললাম, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পরে, আগে থানায় গিয়ে একটি জিডি করতে হবে। ‘থানা’ কথাটি শুনেই তার জবান বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বেচারার সারা শরীর ঘেমে ভিজতে লাগল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, থানা- পুলিশ!! ভাই, দরকার নেই আমার সার্টিফিকেটের।
কয়েকদিন আগে সচিবালয়ে একজন কর্মকর্তার কক্ষে বেশ ক’জন সাংবাদিকসহ আড্ডা দিচ্ছিলাম। মিডিয়াতে প্রকাশিত ও প্রচারিত পুলিশের অমানবিক ও অতি-দানবীয় ভূমিকার খণ্ডচিত্র তুলে ধরে ওই কর্মকর্তা বললেন, আরে ভাই শুনুন, ছেলেমেয়েদের বায়না মেটাতে ছুটির দিনে গিয়েছিলাম জাদুঘরে। গেটে পুলিশ দেখে আমার তিন বছরের ছেলে কোনো অবস্থায়ই আর ভেতরে ঢুকতে চাইছে না। বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। অদূরেই দাঁড়ানো পুলিশ কনস্টেবলটির দিকে ইঙ্গিত করে সে চিত্কারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল—‘বাবা! ওই যে আসছে। মারবে। তাড়াতাড়ি চল।’ অগত্যা জাদুঘরে না গিয়ে ফিরে এলাম।
‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’—আমার জানামতে এ বাক্যটি বিশ্বের সব দেশেই পরিচিত। কোনো নাগরিক বিপদে পড়লে প্রথমে পুলিশকে অবহিত করে। পুলিশ তার জীবন বিপন্ন করে হলেও নাগরিক অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার ধারণা, হয়তো এ কারণেই পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশেই। এখানে কেউ বিপদে পড়লে এমনকি ডাকাতের কবলে পড়লেও নতুন করে আরেকটি বিপদে পড়ার ভয়ে পুলিশের ধারেকাছে যেতে চায় না। বিপদে পড়ে পুলিশের কাছে গিয়ে উপকার পেয়েছেন—আমার এক যুগের পেশাগত জীবনে এমন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাইনি।
বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডন থেকে একদল মুসল্লি তাবলিগ জামাতে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কাকরাইল মসজিদ থেকে হাঁটতে বেরিয়ে তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। টহল পুলিশের কাছে কাকরাইল মসজিদের ঠিকানা জানতে চাইলে পুলিশ উল্টো তাদের পাসপোর্ট আছে কিনা জানতে চায়। ভাষার মারপ্যাঁচে পড়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাদের পল্টন থানায় নিয়ে আটকে রাখে। পরে কাকরাইল মসজিদের মুরব্বিরা থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এ সংবাদ দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও বেশ হইচই হয় ওই সময়। মিরপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিদেশে পুলিশের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সংসদে বলেছিলেন—মাননীয় স্পিকার, আমাদের দেশের পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখলে মাথা হেঁট হয়ে যায়। কিছুদিন আগে বিদেশে গিয়ে হোটেল থেকে বেরুনোর পর রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে পুলিশের কাছে গিয়ে বলি, ‘আই এমপি বাংলাদেশ। লস রোড, গো হোটেল।’ আমার এ কথা শুনে পুলিশ আমাকে অত্যন্ত আদর-যত্ন করে গাড়িতে উঠিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে। গাড়িতে আমার কোনো কষ্ট হয়ে থাকলে সে জন্য তারা আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। অথচ আমাদের দেশে পুলিশ সবার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। অনেক পুলিশের আচরণ হিংস্র প্রাণীকেও হার মানায়।
কানাডার দৃষ্টিনন্দন হ্যালিফেক্স শহরে কিছু দিন কাটানোর পর মনট্রিলে নিকটাত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে চড়েছি। বাসটি ভোর রাতে মনট্রিল বাস টার্মিনালে থামল। সিদ্ধান্ত নিলাম ভোর হওয়ার আগে বাস থেকে নামব না। কিন্তু আমি ছাড়া বাসে কোনো যাত্রী নেই। সবাই নেমে যার যার পথ ধরেছে। শেষ পর্যন্ত আমিও নেমে যাত্রী ছাউনিতে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছি। হঠাত্ কালো পোশাক পরা একজন পুলিশ এসে নিজের পরিচয় পেশ করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমার অসুবিধার কথা জানতে চাইল। আমি কোথায় যাব তাও জানতে চাইল। বললাম, শহরেই ওয়েস্ট জেরিতে আমার খালাম্মার বাসায় যাব। পুলিশ সদস্যটি বললেন, যদি আমার আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে তারা প্রস্তুত আছে। রাজি হয়ে তাদের গাড়িতে উঠে বসলাম। বিদেশে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখে এর আগেও বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে। তাই মনে মোটেও ভয় ছিল না। বাসায় পৌঁছে পুলিশ সদস্যটি খালুজির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, আমাদের ধারণা হয়েছে আপনার অতিথি এ শহরে নতুন এসেছেন। তাই তাকে আমরা নিয়ে এসেছি। আপনাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি এবং আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মনে পড়ে গেল মিরপুরের ওই এমপির জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের কথা।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সাম্প্রতিক অতিউত্সাহী ভূমিকায় খোদ সরকারি মহলেও সমালোচনার ঝড় বইছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছেন, পুলিশ বিভাগ আগাগোড়াই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতেই পুলিশ এখন সাংবাদিক এবং বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের ঠেঙ্গানোর বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, আমার পুলিশ ভাইয়েরা রাতদিন রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়ে গেছে। তার এ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি তার ডান পা দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখুন, আগের সরকারের সময় পুলিশই পিটিয়ে আমার এ পা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের সরকারের সময় পুলিশ এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের কারও পা ভাঙেনি। ওইদিন এক সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, পুলিশ এখন পা ভাঙে না। গুলি করে হত্যা করে।
লেখক : সাংবাদিক
কয়েকদিন আগে সচিবালয়ে একজন কর্মকর্তার কক্ষে বেশ ক’জন সাংবাদিকসহ আড্ডা দিচ্ছিলাম। মিডিয়াতে প্রকাশিত ও প্রচারিত পুলিশের অমানবিক ও অতি-দানবীয় ভূমিকার খণ্ডচিত্র তুলে ধরে ওই কর্মকর্তা বললেন, আরে ভাই শুনুন, ছেলেমেয়েদের বায়না মেটাতে ছুটির দিনে গিয়েছিলাম জাদুঘরে। গেটে পুলিশ দেখে আমার তিন বছরের ছেলে কোনো অবস্থায়ই আর ভেতরে ঢুকতে চাইছে না। বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। অদূরেই দাঁড়ানো পুলিশ কনস্টেবলটির দিকে ইঙ্গিত করে সে চিত্কারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল—‘বাবা! ওই যে আসছে। মারবে। তাড়াতাড়ি চল।’ অগত্যা জাদুঘরে না গিয়ে ফিরে এলাম।
‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’—আমার জানামতে এ বাক্যটি বিশ্বের সব দেশেই পরিচিত। কোনো নাগরিক বিপদে পড়লে প্রথমে পুলিশকে অবহিত করে। পুলিশ তার জীবন বিপন্ন করে হলেও নাগরিক অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার ধারণা, হয়তো এ কারণেই পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশেই। এখানে কেউ বিপদে পড়লে এমনকি ডাকাতের কবলে পড়লেও নতুন করে আরেকটি বিপদে পড়ার ভয়ে পুলিশের ধারেকাছে যেতে চায় না। বিপদে পড়ে পুলিশের কাছে গিয়ে উপকার পেয়েছেন—আমার এক যুগের পেশাগত জীবনে এমন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাইনি।
বেশ কয়েক বছর আগে লন্ডন থেকে একদল মুসল্লি তাবলিগ জামাতে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কাকরাইল মসজিদ থেকে হাঁটতে বেরিয়ে তারা রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। টহল পুলিশের কাছে কাকরাইল মসজিদের ঠিকানা জানতে চাইলে পুলিশ উল্টো তাদের পাসপোর্ট আছে কিনা জানতে চায়। ভাষার মারপ্যাঁচে পড়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ তাদের পল্টন থানায় নিয়ে আটকে রাখে। পরে কাকরাইল মসজিদের মুরব্বিরা থানায় গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন। এ সংবাদ দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও বেশ হইচই হয় ওই সময়। মিরপুর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিদেশে পুলিশের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সংসদে বলেছিলেন—মাননীয় স্পিকার, আমাদের দেশের পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখলে মাথা হেঁট হয়ে যায়। কিছুদিন আগে বিদেশে গিয়ে হোটেল থেকে বেরুনোর পর রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে পুলিশের কাছে গিয়ে বলি, ‘আই এমপি বাংলাদেশ। লস রোড, গো হোটেল।’ আমার এ কথা শুনে পুলিশ আমাকে অত্যন্ত আদর-যত্ন করে গাড়িতে উঠিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে। গাড়িতে আমার কোনো কষ্ট হয়ে থাকলে সে জন্য তারা আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। অথচ আমাদের দেশে পুলিশ সবার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। অনেক পুলিশের আচরণ হিংস্র প্রাণীকেও হার মানায়।
কানাডার দৃষ্টিনন্দন হ্যালিফেক্স শহরে কিছু দিন কাটানোর পর মনট্রিলে নিকটাত্মীয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বাসে চড়েছি। বাসটি ভোর রাতে মনট্রিল বাস টার্মিনালে থামল। সিদ্ধান্ত নিলাম ভোর হওয়ার আগে বাস থেকে নামব না। কিন্তু আমি ছাড়া বাসে কোনো যাত্রী নেই। সবাই নেমে যার যার পথ ধরেছে। শেষ পর্যন্ত আমিও নেমে যাত্রী ছাউনিতে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছি। হঠাত্ কালো পোশাক পরা একজন পুলিশ এসে নিজের পরিচয় পেশ করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমার অসুবিধার কথা জানতে চাইল। আমি কোথায় যাব তাও জানতে চাইল। বললাম, শহরেই ওয়েস্ট জেরিতে আমার খালাম্মার বাসায় যাব। পুলিশ সদস্যটি বললেন, যদি আমার আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে তারা প্রস্তুত আছে। রাজি হয়ে তাদের গাড়িতে উঠে বসলাম। বিদেশে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখে এর আগেও বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে। তাই মনে মোটেও ভয় ছিল না। বাসায় পৌঁছে পুলিশ সদস্যটি খালুজির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, আমাদের ধারণা হয়েছে আপনার অতিথি এ শহরে নতুন এসেছেন। তাই তাকে আমরা নিয়ে এসেছি। আপনাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি এবং আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মনে পড়ে গেল মিরপুরের ওই এমপির জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তব্যের কথা।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সাম্প্রতিক অতিউত্সাহী ভূমিকায় খোদ সরকারি মহলেও সমালোচনার ঝড় বইছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলেছেন, পুলিশ বিভাগ আগাগোড়াই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, নিজেদের দুর্নীতি ও অনিয়ম আড়াল করতেই পুলিশ এখন সাংবাদিক এবং বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের ঠেঙ্গানোর বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, আমার পুলিশ ভাইয়েরা রাতদিন রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে অনেক কষ্ট করে দায়িত্ব পালন করে। পুলিশ এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়ে গেছে। তার এ বক্তব্যের সমর্থনে তিনি তার ডান পা দেখিয়ে বললেন, এই যে দেখুন, আগের সরকারের সময় পুলিশই পিটিয়ে আমার এ পা ভেঙে দিয়েছে। আমাদের সরকারের সময় পুলিশ এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের কারও পা ভাঙেনি। ওইদিন এক সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, পুলিশ এখন পা ভাঙে না। গুলি করে হত্যা করে।
লেখক : সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন