শনিবার, ২৩ জুন, ২০১২

সমালোচনাকে বাঁকা চোখে দেখা উচিত নয়


 সুধীর সাহা 

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মানুষ ভাল নেই। বিদ্যুত্, গ্যাস, পানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, শহরের যানজট, মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক অবস্থা, দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ ব্যবস্থা সবকিছুকে এক সাথে হিসাবের মধ্যে নিলে বলতেই হবে বাংলাদেশের মানুষ সুখে নেই। এই মানুষগুলোর আরো একটু ভাল থাকার কথা ছিল। এমনটাই আভাস ছিল সাড়ে তিন বছর আগে যখন বর্তমান সরকার প্রথম ক্ষমতায় বসে। সরকার যা যা চেয়েছিল, জনগণ যা যা অথবা যেভাবে চেয়েছিল বাস্তবে তেমনটা হয়নি। আশা ও প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু করুণ বাস্তবতা তার অনেকটাই ফিরিয়ে দেয়নি। কোন সংসার যদি ভাল না যায় তবে তার জন্য সিংহভাগ দায়িত্বই ঐ সংসারটির প্রধান কর্মকর্তার। তাতে কারও কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। অথচ ঐ সংসারে আরো কিছু সদস্য আছে। সংসারের গৃহিণী আছে, পুত্র-কন্যা-সন্তানরা আছে। তাদের মিলিত প্রচেষ্টারও কিন্তু দায়িত্ব থাকবে। হয়তোবা অন্য সবার দায়িত্বটা প্রধান কর্তাব্যক্তির দায়িত্ব থেকে একটু কম, কিন্তু তাদেরকে দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়ার উপায় নেই। বাংলাদেশের বর্তমান  পরিস্থিতির জন্য তাই প্রধানভাবে দায়ী করা যাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে। এরপর যাকে দায়ী করা যাবে সে আর অন্য কেউ নয় স্বয়ং বিরোধী দলের রাজনীতি। এরপরের খানিক দায়িত্ব নিতে হবে সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনীকে।
সরকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও কোন কোন ক্ষেত্রে আবার বিফল হয়েছে। সফলতার গল্প করে লাভ নেই। সফলতা করার জন্য সরকার ক্ষমতায় এসেছে। মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য রক্ষকের ভূমিকায় যার আগমন সেই সরকার দ্বারা কতটুকু ভালো হলো, কতটুকু উপকার হলো তার তালিকা দেয়া বা ব্যাখ্যা দেয়ার মধ্যে সরকারের তেমন কোন বাহবা নেয়ার সুযোগ নেই। কেননা সেগুলোই তার দায়িত্ব। যেমন আছে তার ক্ষমতা, তেমনই আছে তার এই সকল দায়িত্ব। বরং যেসব দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ হয়েছে তার তালিকা প্রকাশ করা এবং কেন সেই সকল কাজে সরকার সফলতা পায়নি তা বিশ্লেষণ করে জনগণের আস্থা অর্জন করার মধ্যেও সরকারের আর এক ধরনের সফলতা বটে।
আমাদের দেশের সরকারগুলো মুখে গণতান্ত্রিক সরকার বললেও সমালোচনা গ্রহণ করার মত মহানুভবতা দেখাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। সরকারের কাজের প্রশংসা না করলেই তারা বেঁকে বসেন। কাজটি আরো ভাল করার কোন পরামর্শ গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের নেই। যার ফলে সরকারের ক্ষমতাধরদের চারপাশে শুধু প্রশংসা করার জন্যই লোক থাকে। আর তাদের মিথ্যা প্রশংসা শুনে সরকার বাহাদুরের বাহাদুর লোকজন আত্মতুষ্টিতে বিহ্বল হয়ে পড়ে। ফলে যা হবার তাই হয়। সরকার এক খারাপ কাজ শেষ করে আর এক খারাপ কাজে হাত দিতে সচেষ্ট হয়। ঘটনাচক্রে যদি কেউ একজন সমালোচনা করে বসে তবে সরকারি লোক তাকে সরকার বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পুনরায় আত্মতুষ্টি লাভ করে। এতো গেল সরকার বাহাদুরের কথা; কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় এ দেশের বিরোধী রাজনীতিও। এর একটি বড় কারণ হল সরকার বা বিরোধী দল কেউ ঠিক জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা করে না। তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ইচ্ছা-অভিলাষ চরিতার্থ করার কাজেই তারা ব্যস্ত থাকে।
সিভিল প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন সরকারেরই অংশ। তবে এই দু’টি প্রশাসনই সরাসরিভাবে জনগণের সাথে জড়িয়ে আছে। জনগণের ভাল করাটাও তাদের হাতে আর খারাপ করাটাও তাদের হাতে। জেলার দায়িত্বে থাকে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার। এরা কোন রাজনৈতিক অথবা সামরিক কর্মকর্তা নয়। সরকার ঐ জেলায় যাই করতে চায় তাই হয় এদের মাধ্যমে। এদের পাশাপাশি সরকারি অন্যান্য কর্মকর্তাও আছে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐ জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। কেন্দ্রে আছে কেন্দ্রীয় পুলিশ প্রশাসন, সচিবালয় এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব-মন্ত্রী, এমপি এবং উপজেলা প্রশাসন। আর সবার উপরে থাকে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির সচিবালয়। এমন বিধান সব দেশে প্রায় একই রকম। তবে আধুনিক বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই সরকারের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত করা হয়েছে। সেসব দেশে সরকার শুধু নীতি-নির্ধারণের কাজটিই করে, আর প্রয়োগটি হয় প্রাইভেট সেক্টর থেকে। কিন্তু আমাদের দেশে সিভিল প্রশাসনের ব্যাপ্তি এবং ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই সরকারের ব্যর্থ কাজের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হবে সিভিল এবং পুলিশ প্রশাসনকেও। সরকারকে সঠিক বুদ্ধি দিয়ে ভাল কাজ করার ক্ষেত্রে উত্সাহ না দেয়ার জন্য সচিবালয়ের ব্যর্থতা সবার উপরে থাকবে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কোন সুরাহা আজ অবধি হয়নি, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়াজনিত সমস্যার সমাধান হয়নি আজও, সৌদি অ্যাম্বাসির কর্মকর্তা হত্যার ক্ষেত্রেও তেমন কোন অগ্রগতি নেই, গুম বা গুপ্ত হত্যা চলছে সারা দেশে। নিরাপত্তার অভাব এখন অনুভব করছে বাংলাদেশে সর্বস্তরের মানুষ। এর জন্য কি পুলিশকে দায়ী করা যায় না? অপরাধী যেই হোক পুলিশ কি তা খুঁজে বের করতে পারবে না? যদি তাই হয়, তবে সেই পুলিশ প্রশাসনকে কি ব্যর্থতার দোষে দোষী করা যাবে না? তবে তারপরও কোন্ যুক্তিতে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে প্রশংসা করেন? কোন্ যুক্তিতে তিনি বলতে পারেন ‘পুলিশ আগের থেকে ভাল হয়েছে।’ অন্যদিকে কোন্ যুক্তিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলতে পারেন ‘পুলিশ থেকে দূরে থাকেন।’ পুলিশের ব্যর্থতা কি ব্যর্থতা নয়? আর সেই ব্যর্থ বাহিনী যার কন্ট্রোলে তিনি কি ব্যর্থ নন? তবে সেই ব্যর্থতা প্রকাশ না করে জোর গলায় উল্টো কথা বলা কি আরো দোষের কাজ নয়?
n লেখক:সাবেক সেনা কর্মকর্তা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন