বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

রোজার আগে সরকারকে যা মনে রাখতে হবে

মোহাম্মদ হেলাল


আমদানি মূল্য কিংবা উৎপাদন খরচ নয়, চাহিদা আর সরবরাহের ফারাকই দাম ওঠানামা করায়। বাজার অর্থনীতি মানেই বাজারের অর্থনীতি। চাহিদা এবং সরবরাহের অর্থনীতি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে চাহিদা ও সরবরাহের সমতার ভিত্তিতে বাজারের ভারসাম্য দাম ঠিক হয়। এই দামে ক্রেতারা সম্মিলিতভাবে যেটুকু কিনতে চায়, আর বিক্রেতারা সম্মিলিতভাবে যেটুকু বিক্রি করতে চায়, উভয়ই সমান হয়। এই দুয়ের মধ্যে ফারাক সৃষ্টি হলে সাধারণত দামের ওঠানামার দ্বারা তা দূর হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে ভারসাম্যে পৌঁছাতে হয় চাহিদা কমাতে হয়, নইলে সরবরাহ বাড়াতে হয় অথবা দুটোই করতে হয় একসঙ্গে। দাম বেড়ে গিয়ে আপনাআপনি তা হয়ে যায়। লাভবান হন সরবরাহকারীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকলে বাড়তি সরবরাহ কাটাতে চাহিদা বাড়াতে হয় দাম কমিয়ে। পচনশীল না হলে সরবরাহও কমতে পারে কম দামের ফলে। এ ক্ষেত্রে লাভবান হন ভোক্তারা। চাহিদা আর সরবরাহের এই দামনির্ভর সমন্বয় কিন্তু সার্ভিসের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি। যেমন, একজন রিকশাওয়ালা যাত্রীর তুলনায় রিকশার সংখ্যা কম দেখলে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। ফলে যাদের রিকশায় যাওয়া বেশি জরুরি, তারা বেশি ভাড়া দিয়ে যায়। অন্যরা বিকল্প খোঁজে। আবার ছুটির দিনে উল্টোটাও ঘটে। তার মানে এই সমন্বয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়ও। যেমন, পবিত্র রমজানের এক-দেড় মাস আগে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে একটা দাম ঠিক হয়েছিল চিনি কিংবা তেলের। যখন রোজা আসি আসি করছে কিংবা রোজা আসার পর এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। লোকজনের ক্ষোভ, রোজায় চাহিদা বাড়ে ব্যবসায়ীরা জানেন, তাঁরা বেশি পরিমাণে সরবরাহ করেন না কেন। ব্যবসায়ীরা আবার বাড়তি সরবরাহ বেশি দামে করার দাবি করে দাম বাড়ার পক্ষে যুক্তি দেন। 
প্রশ্ন হলো, চাহিদা বেড়ে গেলেও দাম আগের পর্যায়ে রাখতে হলে কী করতে হবে। যেটুকু চাহিদা বেড়েছে, ঠিক তার সমপরিমাণ সরবরাহ বাড়াতে হবে। তবে তা হতে হবে অবশ্যই আগের দামে। যদি সরবরাহের উৎস বিশ্ববাজার হয়, তবে একই দামে সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হয় অনেক সময়। সে কারণেই ভোজ্যতেল কিংবা চিনির দাম রমজানে একই পর্যায়ে থাকবে—প্রত্যাশা করেন ভোক্তারা। প্রথম আলোর ২১ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত খবর—আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে দাম কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন কয়েক দফা সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়—এর ভিত্তিও এ ধরনের প্রত্যাশা। কিন্তু সরবরাহ একই দামে এলেও যদি পরিমাণে চাহিদার চেয়ে কম হয়, তাহলে কিন্তু দাম বাড়বে। তার মানে বিশ্ববাজার থেকে কোন দ্রব্য কত দামে কেনা হলো, অভ্যন্তরীণ বাজারের দাম নির্ধারণে তাৎক্ষণিক তা বিচার্য বিষয় নয়। বিষয় হলো বাজারে ওই দ্রব্যের যে দাম আমরা দেখতে চাই, সেই দামের বিপরীতের চাহিদাকে মেটাতে পারছে কি না সৃষ্ট সরবরাহ, না পারলে দাম বাড়বেই। 
মোট কথা, বিশ্ববাজার থেকে যত কম দামেই কেনা হোক না কেন, দেশের বাজারে ঘাটতি থাকলে দাম বাড়বেই। তেমনিভাবে বিশ্ববাজার থেকে বেশি দামে কিনলেও দেশের বাজারে দাম কমবে যদি উদ্বৃত্ত থাকে। গত রমজানে চিনির দাম ৬৫ টাকা স্থির করা হয়েছিল। কিন্তু এই দামে সর্বসাধারণের যে চাহিদা, তা মেটানোর মতো সরবরাহ বাজারে ছিল না। তার মানে ব্যাখ্যা একটাই, পর্যাপ্ত আমদানি হয়নি। অথবা আমদানি পর্যাপ্ত হলেও বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরবরাহ বাড়েনি। এবার সরকার নির্ধারিত দামের অনেক নিচে বিক্রি হচ্ছে চিনি। কেন এমনটি ঘটছে। দরকার পর্যাপ্ত গবেষণার! না। কারণ একটাই। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি। ফলে নিত্যপণ্যের দামের স্থিতির জন্য দরকার চাহিদা আর সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় সাধনে সরকারের কার্যকর ভূমিকার। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। 
গত রমজানের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছিল, পর্যাপ্ত চিনি আমদানি হয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। আমদানির যে ফিগার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দিয়েছিল, সেখানে জাহাজে করে আসছে এবং এলসি খোলা হয়েছে এমন অপরিশোধিত চিনিকেও গণনায় ধরা হয়েছিল। আমরা জানি, বেশ কয়েকটা রিফাইনারি কোনো চিনি আমদানি করেনি গত বছর রমজানের আগে। অন্যদিকে সরকার টিসিবি এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩০ হাজার টনের মতো চিনি কিনে রমজানের আগে নিজের স্টক বাড়িয়েছিল। এগুলো রমজানে ছাড়ার জন্য রাখলেও তা কিন্তু রমজানের আগে বাজারের সরবরাহ কমিয়েছিল। বিভিন্ন দীর্ঘসূত্রের ফলে সরকারের কেনা চিনি বাজারে ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। প্রশ্ন হলো, সরকার চিনি কিনবে ভালো কথা, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কেন? আর অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কিনলেও তা আরও অনেক আগে নয় কেন? সেই ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের বিশ্ববাজার থেকে আরও বেশি পরিমাণে চিনি কিনে আনার সময় ও সুযোগ থাকত। এই পথে না হেঁটে সরকার নিজে কার্যকর সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে চিনির দাম বেড়েছিল।
তবে মাঝেমধ্যে মিডিয়া এবং সরকারের দেওয়া তথ্যও স্পেকুলেশন তৈরি করে দাম বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে। গত রমজানের আগে খুচরা, পাইকারি ব্যবসায়ী ও রিফাইনাররা জেনেছিল যে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চিনি কিনছে। আরও জেনেছিল যে বেশ কটি রিফাইনারি আমদানি ও পরিশোধন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। এগুলোকে তারা চিনির বাজারে সংকটের আলামত হিসেবে ধরে নিয়েছিল। ফলে তাদের অনেকেই ভবিষ্যতে বিক্রির জন্য চিনি খানিকটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। এভাবে কম আমদানিজনিত সরবরাহ আরও কমে গিয়ে বাজারে দাম আরও বেড়েছিল। আবার ভোক্তারা অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ রমজানে আরও দাম বাড়ার ভয়ে রমজানের আগে বেশি কেনার চেষ্টা করেছিলেন। বাজারের নিয়মে তাই হওয়ার কথা। তবে এর সবকিছুর মূলেই ছিল চিনির কম আমদানি কিংবা কম আমদানির খবর। তবে আমদানি সত্যি সত্যি বেশি হলে কম আমদানির খবরজনিত স্পেকুলেশন বেশিক্ষণ থাকার কথা ছিল না, ফলে এ থেকে সৃষ্ট দাম বৃদ্ধি অল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তার মানে আমদানি আসলেই কম হয়েছিল। এবার চিনির অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় সরকার কেজিপ্রতি দাম ৫৫ টাকা স্থির করলেও তা বর্তমানে ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আগেই বলেছি, চাহিদার বৃদ্ধির বিপরীতে সমানতালে সরবরাহ না বাড়লে দাম বাড়বে বাজার অর্থনীতিতে। তার পরও যদি আমরা জোর করে দাম আগের জায়গায় কিংবা কোনো একটা লেভেলে রাখতে চাই, তবে সেটা করার উপায় আছে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোলের মাধ্যমে। এক, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা। রেশনিংয়ের মাধ্যমে চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে তা সরবরাহের লেভেলে রাখা, যা আমাদের দেশে এখন আর করা হয় না। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ভোগ-লালসা কমিয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। মন্ত্রীর মত অনুযায়ী চাহিদা না বাড়লে দাম বাড়ত না। একেবারেই খাঁটি কথা। কিন্তু তা তো সমস্যা তৈরি হওয়ার আগের চিকিৎসা। আর তিনি যাঁদের কম খেতে বলছিলেন, তাঁদের অনেকেই ভোজ্যতেলের মতো জিনিসও ছটাকে কিনে খান। ফলে এমন আধমরাদের ভোগ-লালসা কমাতে বলা একেবারেই অযৌক্তিক ছিল। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য পরোক্ষভাবে এই কথাই ছিল যে চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বেই। দুই, দাম নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো একটা দাম বেঁধে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা। মুখে যা-ই বলুক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই নম্বর পন্থাই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই পথের একটা সমস্যা হলো, দাম ঠিক রাখতে পারলেও সবাই পণ্য কিনতে পারে না। আর ঠিকমতো কন্ট্রোল করতে না পারলে বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে পণ্য বিক্রি হয় না। বাস্তবে তাই হয়েছিল, ১৬-১৭ কোটি মানুষের এই গরিব দেশে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই অসম্ভব। আর ভয়ভীতির ফলও দীর্ঘ মেয়াদে শুভ হয় না। 
সরকারকে মনে রাখতে হবে, দেশের চিনির ৮০-৮৫ শতাংশ জোগান দেয় এই প্রাইভেট রিফাইনাররা। এদের দিয়ে জোর করে কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। লাভ-লোকসান যা-ই হোক, সরকার উৎপাদন করবেই। জনগণের ভর্তুকিতে চললে তা সম্ভব। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে তা লোকসান কাঁধে নিয়ে কেউ উৎপাদন কিংবা আমদানি করবে না। আবার যদি এরা কোনো কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি আমদানি না করে, তবে ডিও হোল্ডারদের বাদ দিয়ে ডিলার নিয়োগ করেও অবস্থার অবনতি বৈ উন্নতি সম্ভব নয়। আমদানি কম হলে দাম বেঁধে দিয়ে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব নয়। চিনি ও ভোজ্যতেল উভয়েরই দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল গত বছর। তেলের দাম ব্যবসায়ীরা মেনেছিলেন কিন্তু চিনিরটা মানেননি। কেন মানলেন না, তা একটু ভেবে দেখা দরকার। একই ব্যবসায়ীর অর্ধেকটা ভালো আর অর্ধেকটা খারাপ কিংবা তেলের ব্যবসায়ী ভালো, কিন্তু চিনির ব্যবসায়ী খারাপ, এ কী করে হয়। এবারের রমজানের আগে বাজার নিয়ন্ত্রণের সময় এই বিষয়গুলো সরকারের মাথায় রাখা উচিত। 
মোহাম্মদ হেলাল: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন