ইউসুফ রাজা গিলানি
সম্প্রতি আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে একটি খবর গরম হতে হতে শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি কিছু চিন্তার দাবি রাখে মনে হলো। সে জন্য এ লেখা। খবরটি চাউর হয়েছে এভাবে যে প্রধানমন্ত্রী কোনো এক সভায় বিরোধী দলের নেতাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তিনি যেন আগে আয়নায় নিজের মুখটি দেখেন। বিষয়টি ছিল দুর্নীতি, ধরপাকড়, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছিলেন যে এসব ক্ষেত্রে অরাজক অবস্থা সৃষ্টির পেছনে বিরোধী দলের নেত্রী তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) চেয়ে দক্ষতায় এগিয়ে আছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব আসতে দেরি হলো না। তাঁদের একজন নেতা বললেন, প্রধানমন্ত্রীরই আগে আয়নায় নিজের মুখটি দেখা উচিত।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের সে বিখ্যাত গানটি আছে না, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে।’ বলা বাহুল্য, এ পড়শি যিনি আয়নায় নিজের মুখ দেখছেন তাঁরই প্রতিবিম্ব এবং শুধু মুখ দেখার কথা এখানে বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে নিজের বিবেককে দেখার কথা। আয়না আক্ষরিক অর্থে যাকে দেখে তাকে প্রতিবিম্বিত করে; আর গূঢ় অর্থে সেটি, লালন সাঁইয়ের চিন্তা অনুযায়ী, ভেতরের সত্তাটির উন্মোচন করে। আয়না এ অর্থে একটি প্রতীক।
শেক্সপিয়ারের নাটক রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড-এ আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে একটি প্রসঙ্গ আছে, যেটা আজকের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক। রিচার্ডের তখন ক্ষমতা থেকে পতন হয়েছে (১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর আপন চাচাতো ভাই হেনরি বলিংবব্রুকের কাছে (রাজা চতুর্থ হেনরি) কাছে তিনি রাজমুকুট সঁপে দিয়েছেন। পতিত রাজা হিসেবে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে তাঁর ইচ্ছা হলো। আয়না আনা হলো; কিন্তু আয়নায় নিজের চেহারায় দুর্দশার কোনো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে আয়নাটি তিনি সজোরে মেঝেতে ছুড়ে মারেন। সেটি ভেঙে খানখান হয়ে গেলে তখন তিনি বললেন, এখন ঠিকই পতিত রাজার দুর্দশা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়ানো বলিংব্রুক তাঁকে শুধরে দিয়ে বলেন, আপনার দুর্দশার ছায়া আপনার মুখের ছায়াকে ভেঙে দিয়েছে কেবল, এর বেশি নয়। অর্থাৎ, আয়না ভেঙে গেলেও সেটি যে বস্তুকে প্রতিবিম্বিত করছে, তার কোনো পরিবর্তন হয় না। তখন রাজা রিচার্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, কথাটি ঠিক, এ বাইরের আস্ফাালন কিছুই নয়, কারণ আমার দুঃখগুলো সব ভেতরেই জমে আছে (“মাই গ্রিফ লাইজ অল উইদিন”)।’
রিচার্ডের মনে আয়না নিয়ে এ ধন্ধের ওপর সমালোচক গ্রাহাম হোল্ডারনেস (শেক্সপিয়ার: দ্য হিস্ট্রিজ) বলছেন, রিচার্ড আয়নার মধ্য দিয়ে দেখতে চান তাঁর পতনের ইতিহাস, কিন্তু আয়না আক্ষরিক অর্থে শুধু দেখাতে পারে তাঁর রাজকীয় মসৃণ চেহারাটি। এটা হলো আয়নার বাইরের দিক, আর ভেতরের দিকে আয়না হলো ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। আয়নাকে ইতিহাসের প্রতীকী প্রতিবিম্ব হিসেবে দাঁড় করিয়ে হোল্ডারনেসের আলোচনা এগিয়ে যায়, আর আমরা তাঁর চিন্তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিরে আসি।
সাহিত্যকে জীবনের আয়না হিসেবে দেখার ধারণা এরিস্টটলের চিন্তাপ্রসূত এবং এ ধারণাটি এখনো মোটামুটি শক্ত অবস্থানে টিকে আছে, কিন্তু আয়নাকে ইতিহাসের প্রতিবিম্ব হিসেবে ফোটানোর চিন্তাটির সঙ্গে জঙ্গম রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংযোগ আছে। যখন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে বলছেন, আয়নায় নিজের মুখটি আগে দেখুন, তখন তিনি আসলে বলছেন, আয়নায় নিজের শাসনকালের ছবিটি দেখুন। ঠিক প্রধানমন্ত্রীকেও আয়নায় নিজের মুখটি দেখতে বলার প্রয়াসের মধ্যে তাঁর আগের এবং বর্তমান শাসনকালকে অবলোকন করার কথা বলা হচ্ছে।
আয়নার ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে বা বিরোধী দলের নেতা প্রধানমন্ত্রীকে কী দেখতে বলছেন, সেটা হলো একটা কথা; কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁরা নিজ নিজ আয়নার ভেতর দিয়ে কোন কোন ইতিহাস দেখছেন। কোন কোন ইতিহাস বললাম এ জন্য যে এটা এখন পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং তাঁদের নিজ নিজ দল বস্তুত বাংলাদেশের দুটি ইতিহাস দেখেন। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তাঁদের স্পষ্ট দুটি দৃষ্টিভঙ্গি বা আয়না আছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরিচালনায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। এটিই একমাত্র বর্ণনা হতে পারত। কিন্তু ইতিহাস শুধু ঘটনার সন্নিবেশন নয়, ইতিহাস ঘটনার পুনঃপুন মূল্যায়ন তো বটেই, ঘটনার পুনর্নির্মাণও। একাত্তরের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে (যেটি প্রথমে তিনি নিজের নামে প্রচার করেছিলেন এবং পরমুহূর্তে ভুল সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর নামে ঘোষণা করেন) পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ’৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যার পর আরেকটি প্রতিপক্ষ ঐতিহাসিক বর্ণনা তৈরি হয়, যাকে সাধারণভাবে ইতিহাসের বিকৃতি বলা হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিকৃতি বললে এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা চাপা পড়ে যায়; তার চেয়ে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বললে এর তাত্ত্বিক ব্যাপারটি বোঝা যায়।
কারণ শুধু ইতিহাসের বিকৃতি বলে এ ব্যাপারটিকে ছেড়ে দিলে সেটি শুধু বঙ্গবন্ধুর জায়গায় (রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমানের অভিষিক্ত হওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে; অর্থাৎ, ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বললে কারা কেন এবং কোন চিন্তা এ পুনর্নির্মাণের সাংগঠনিক শক্তি, সেটা প্রমাণিত হবে। তাত্ত্বিকভাবে বললে, যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে ইসলাম ধর্মকে তুল্যমূল্য করে দেখতেন, যাঁরা বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াকে ইসলাম ধর্মের পরাজয় মনে করতেন এবং যাঁরা সাধারণভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি কখনো উদাসীন ছিলেন বা কখনো অবজ্ঞা পোষণ করতেন এবং যাঁদের মধ্যে একদিকে মধ্যম থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনা লক্ষ করা যায় এবং যাঁদের মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি একধরনের অপ্রস্তুতিমূলক আচ্ছন্নতাবোধ ছিল বা আছে এবং যাঁদের একটি অংশ পরবর্তী সময়ে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাঁরাসহ কতিপয় বামপন্থী দল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সূচনালগ্নে অস্বস্তিতে ছিল। এঁদের এ রকম সুনির্দিষ্ট অবস্থান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা দেখা যায়। এবং তাঁরা প্রায় অনেকটা অনৈতিহাসিকভাবে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর্বটিকে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের কাঠামোয় সাজিয়ে তাঁকে এ ঘরানার প্রবক্তা করে তোলেন। যদিও ’৭৫-এর আগস্টের আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে (জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারটি) কখনো প্রতিপক্ষতার দিক থেকে আলোচিত বিষয় ছিল না, কিন্তু ওই মাসের পর থেকে জিয়াউর রহমান স্বয়ং ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে থাকলে এবং একপর্যায়ে রাজনৈতিক দল গঠন করলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের সাংগঠনিক কাজটির সূচনা হয়। অর্থাৎ ইতিহাস পুনর্নির্মাণের প্রবক্তরা একজন নেতা খুঁজে পান। এবং এরই ধারাবাহিকতায় আজকে দুটি ভিন্ন পরস্পর বিবদমান ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ইতিহাসবোধ তৈরি হয়েছে সেটি হচ্ছে ধারবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। এটি এ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উদার চর্চা ঘটবে বিধায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। এটির অর্থনৈতিক অভীপ্সা হচ্ছে দরিদ্রের মুখে হাসি ফোটানো। অন্যদিকে বিএনপির প্রণোদনায় আকাঙিক্ষত সমাজটি হচ্ছে ধর্মীয় বলয়ের আওতায় বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ তথা ভাষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে সমন্বিত করা। বেশির ভাগ সাম্প্রদায়িক চেতনায় পুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী এ বলয়ের মধ্যে একীভূত হয়েছে বলে পরিদৃষ্ট হয়।
কিন্তু এ দুটি দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুতর সংকটের মধ্যে পড়েছে। ইতিহাস পুনর্নির্মাণনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির সংকটটা হলো তাঁদের প্রাক-বাংলাদেশ রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগহীনতা। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটাও যদি ধরে নিই, সেটি তো আকাশ থেকে ঘটেনি, তার জন্য দীর্ঘ আন্দোলনের একটা প্রস্তুতিপর্ব গেছে, যেখানে কান্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটি অস্বীকার করার ফলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণটা ইতিহাস বিকৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এবং এটা লক্ষণীয় যে ক্রমবর্ধমান ইতিহাস সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে এ ইতিহাস-বিকৃতি নগ্নভাবে ধরা পড়ছে, ফলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের উদ্যোগটি, দুই দশকের ব্যবধানে, ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছে।
অন্যদিকে ধারাবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হচ্ছে চেতনার (স্পিরিট) সঙ্গে বৈষয়িক ও রাষ্ট্রীয় সমাজের লেনদেনকে তুল্যমূল্য করে ফেলা। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বৈষয়িক সমাজ, বিশেষ করে অর্থনীতির কার্যকারণকে যে প্রভাবিত করা যাবে না, এটা এ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহল অনুধাবন করতে চায় না। দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য, পুঁজির বাজার, আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, পোশাকশিল্পসহ বহু ক্ষেত্র আছে, যেখানে আদর্শিক উচ্চারণ দিয়ে এদের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এগুলো একেবারে নিরেট বাস্তব কার্যকারণের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, ম্যাকিয়াভেলি এবং পরবর্তী সময়ে মিশেল ফুকোর চিন্তার অনুসারে বলতে হয়, চেতনা অর্থনীতির মধ্যে প্রবিষ্ট করে এমন কোনো ব্যাপার নয়। ধানের উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি হচ্ছে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ব্যাপার, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে কিন্তু সে ধান রোপণ ও গজানোর ব্যাপারে উদাসীন থেকে গেলে ধানের বাজারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। সে জন্য এটা একান্তই জরুরি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত ও অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাসহ প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হবে। তা হলেই কেবল ধারাবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি স্থায়ী মহাবর্ণনায় পরিণত হবে।
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের সে বিখ্যাত গানটি আছে না, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে।’ বলা বাহুল্য, এ পড়শি যিনি আয়নায় নিজের মুখ দেখছেন তাঁরই প্রতিবিম্ব এবং শুধু মুখ দেখার কথা এখানে বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে নিজের বিবেককে দেখার কথা। আয়না আক্ষরিক অর্থে যাকে দেখে তাকে প্রতিবিম্বিত করে; আর গূঢ় অর্থে সেটি, লালন সাঁইয়ের চিন্তা অনুযায়ী, ভেতরের সত্তাটির উন্মোচন করে। আয়না এ অর্থে একটি প্রতীক।
শেক্সপিয়ারের নাটক রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড-এ আয়নায় মুখ দেখা নিয়ে একটি প্রসঙ্গ আছে, যেটা আজকের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক। রিচার্ডের তখন ক্ষমতা থেকে পতন হয়েছে (১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর আপন চাচাতো ভাই হেনরি বলিংবব্রুকের কাছে (রাজা চতুর্থ হেনরি) কাছে তিনি রাজমুকুট সঁপে দিয়েছেন। পতিত রাজা হিসেবে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে তাঁর ইচ্ছা হলো। আয়না আনা হলো; কিন্তু আয়নায় নিজের চেহারায় দুর্দশার কোনো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে আয়নাটি তিনি সজোরে মেঝেতে ছুড়ে মারেন। সেটি ভেঙে খানখান হয়ে গেলে তখন তিনি বললেন, এখন ঠিকই পতিত রাজার দুর্দশা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। কিন্তু তাঁর সামনে দাঁড়ানো বলিংব্রুক তাঁকে শুধরে দিয়ে বলেন, আপনার দুর্দশার ছায়া আপনার মুখের ছায়াকে ভেঙে দিয়েছে কেবল, এর বেশি নয়। অর্থাৎ, আয়না ভেঙে গেলেও সেটি যে বস্তুকে প্রতিবিম্বিত করছে, তার কোনো পরিবর্তন হয় না। তখন রাজা রিচার্ড বললেন, ‘হ্যাঁ, কথাটি ঠিক, এ বাইরের আস্ফাালন কিছুই নয়, কারণ আমার দুঃখগুলো সব ভেতরেই জমে আছে (“মাই গ্রিফ লাইজ অল উইদিন”)।’
রিচার্ডের মনে আয়না নিয়ে এ ধন্ধের ওপর সমালোচক গ্রাহাম হোল্ডারনেস (শেক্সপিয়ার: দ্য হিস্ট্রিজ) বলছেন, রিচার্ড আয়নার মধ্য দিয়ে দেখতে চান তাঁর পতনের ইতিহাস, কিন্তু আয়না আক্ষরিক অর্থে শুধু দেখাতে পারে তাঁর রাজকীয় মসৃণ চেহারাটি। এটা হলো আয়নার বাইরের দিক, আর ভেতরের দিকে আয়না হলো ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। আয়নাকে ইতিহাসের প্রতীকী প্রতিবিম্ব হিসেবে দাঁড় করিয়ে হোল্ডারনেসের আলোচনা এগিয়ে যায়, আর আমরা তাঁর চিন্তার সূত্র ধরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিরে আসি।
সাহিত্যকে জীবনের আয়না হিসেবে দেখার ধারণা এরিস্টটলের চিন্তাপ্রসূত এবং এ ধারণাটি এখনো মোটামুটি শক্ত অবস্থানে টিকে আছে, কিন্তু আয়নাকে ইতিহাসের প্রতিবিম্ব হিসেবে ফোটানোর চিন্তাটির সঙ্গে জঙ্গম রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংযোগ আছে। যখন প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে বলছেন, আয়নায় নিজের মুখটি আগে দেখুন, তখন তিনি আসলে বলছেন, আয়নায় নিজের শাসনকালের ছবিটি দেখুন। ঠিক প্রধানমন্ত্রীকেও আয়নায় নিজের মুখটি দেখতে বলার প্রয়াসের মধ্যে তাঁর আগের এবং বর্তমান শাসনকালকে অবলোকন করার কথা বলা হচ্ছে।
আয়নার ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে বা বিরোধী দলের নেতা প্রধানমন্ত্রীকে কী দেখতে বলছেন, সেটা হলো একটা কথা; কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাঁরা নিজ নিজ আয়নার ভেতর দিয়ে কোন কোন ইতিহাস দেখছেন। কোন কোন ইতিহাস বললাম এ জন্য যে এটা এখন পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং তাঁদের নিজ নিজ দল বস্তুত বাংলাদেশের দুটি ইতিহাস দেখেন। বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তাঁদের স্পষ্ট দুটি দৃষ্টিভঙ্গি বা আয়না আছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরিচালনায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। এটিই একমাত্র বর্ণনা হতে পারত। কিন্তু ইতিহাস শুধু ঘটনার সন্নিবেশন নয়, ইতিহাস ঘটনার পুনঃপুন মূল্যায়ন তো বটেই, ঘটনার পুনর্নির্মাণও। একাত্তরের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে (যেটি প্রথমে তিনি নিজের নামে প্রচার করেছিলেন এবং পরমুহূর্তে ভুল সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর নামে ঘোষণা করেন) পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ’৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যার পর আরেকটি প্রতিপক্ষ ঐতিহাসিক বর্ণনা তৈরি হয়, যাকে সাধারণভাবে ইতিহাসের বিকৃতি বলা হয়। কিন্তু ইতিহাসের বিকৃতি বললে এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা চাপা পড়ে যায়; তার চেয়ে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বললে এর তাত্ত্বিক ব্যাপারটি বোঝা যায়।
কারণ শুধু ইতিহাসের বিকৃতি বলে এ ব্যাপারটিকে ছেড়ে দিলে সেটি শুধু বঙ্গবন্ধুর জায়গায় (রাষ্ট্রপতি) জিয়াউর রহমানের অভিষিক্ত হওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে; অর্থাৎ, ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বললে কারা কেন এবং কোন চিন্তা এ পুনর্নির্মাণের সাংগঠনিক শক্তি, সেটা প্রমাণিত হবে। তাত্ত্বিকভাবে বললে, যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে ইসলাম ধর্মকে তুল্যমূল্য করে দেখতেন, যাঁরা বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াকে ইসলাম ধর্মের পরাজয় মনে করতেন এবং যাঁরা সাধারণভাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি কখনো উদাসীন ছিলেন বা কখনো অবজ্ঞা পোষণ করতেন এবং যাঁদের মধ্যে একদিকে মধ্যম থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনা লক্ষ করা যায় এবং যাঁদের মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি একধরনের অপ্রস্তুতিমূলক আচ্ছন্নতাবোধ ছিল বা আছে এবং যাঁদের একটি অংশ পরবর্তী সময়ে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাঁরাসহ কতিপয় বামপন্থী দল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সূচনালগ্নে অস্বস্তিতে ছিল। এঁদের এ রকম সুনির্দিষ্ট অবস্থান থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা দেখা যায়। এবং তাঁরা প্রায় অনেকটা অনৈতিহাসিকভাবে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর্বটিকে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের কাঠামোয় সাজিয়ে তাঁকে এ ঘরানার প্রবক্তা করে তোলেন। যদিও ’৭৫-এর আগস্টের আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে (জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারটি) কখনো প্রতিপক্ষতার দিক থেকে আলোচিত বিষয় ছিল না, কিন্তু ওই মাসের পর থেকে জিয়াউর রহমান স্বয়ং ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে থাকলে এবং একপর্যায়ে রাজনৈতিক দল গঠন করলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের সাংগঠনিক কাজটির সূচনা হয়। অর্থাৎ ইতিহাস পুনর্নির্মাণের প্রবক্তরা একজন নেতা খুঁজে পান। এবং এরই ধারাবাহিকতায় আজকে দুটি ভিন্ন পরস্পর বিবদমান ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ইতিহাসবোধ তৈরি হয়েছে সেটি হচ্ছে ধারবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। এটি এ ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উদার চর্চা ঘটবে বিধায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। এটির অর্থনৈতিক অভীপ্সা হচ্ছে দরিদ্রের মুখে হাসি ফোটানো। অন্যদিকে বিএনপির প্রণোদনায় আকাঙিক্ষত সমাজটি হচ্ছে ধর্মীয় বলয়ের আওতায় বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ তথা ভাষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে সমন্বিত করা। বেশির ভাগ সাম্প্রদায়িক চেতনায় পুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী এ বলয়ের মধ্যে একীভূত হয়েছে বলে পরিদৃষ্ট হয়।
কিন্তু এ দুটি দৃষ্টিভঙ্গিই গুরুতর সংকটের মধ্যে পড়েছে। ইতিহাস পুনর্নির্মাণনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির সংকটটা হলো তাঁদের প্রাক-বাংলাদেশ রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগহীনতা। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কথাটাও যদি ধরে নিই, সেটি তো আকাশ থেকে ঘটেনি, তার জন্য দীর্ঘ আন্দোলনের একটা প্রস্তুতিপর্ব গেছে, যেখানে কান্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটি অস্বীকার করার ফলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণটা ইতিহাস বিকৃতিতে পর্যবসিত হয়েছে। এবং এটা লক্ষণীয় যে ক্রমবর্ধমান ইতিহাস সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে এ ইতিহাস-বিকৃতি নগ্নভাবে ধরা পড়ছে, ফলে ইতিহাস পুনর্নির্মাণের উদ্যোগটি, দুই দশকের ব্যবধানে, ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হয়ে আসছে।
অন্যদিকে ধারাবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হচ্ছে চেতনার (স্পিরিট) সঙ্গে বৈষয়িক ও রাষ্ট্রীয় সমাজের লেনদেনকে তুল্যমূল্য করে ফেলা। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বৈষয়িক সমাজ, বিশেষ করে অর্থনীতির কার্যকারণকে যে প্রভাবিত করা যাবে না, এটা এ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহল অনুধাবন করতে চায় না। দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য, পুঁজির বাজার, আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, পোশাকশিল্পসহ বহু ক্ষেত্র আছে, যেখানে আদর্শিক উচ্চারণ দিয়ে এদের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এগুলো একেবারে নিরেট বাস্তব কার্যকারণের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, ম্যাকিয়াভেলি এবং পরবর্তী সময়ে মিশেল ফুকোর চিন্তার অনুসারে বলতে হয়, চেতনা অর্থনীতির মধ্যে প্রবিষ্ট করে এমন কোনো ব্যাপার নয়। ধানের উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি হচ্ছে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ব্যাপার, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে কিন্তু সে ধান রোপণ ও গজানোর ব্যাপারে উদাসীন থেকে গেলে ধানের বাজারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। সে জন্য এটা একান্তই জরুরি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত ও অক্ষুণ্ন রাখার জন্য অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাসহ প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে হবে। তা হলেই কেবল ধারাবাহিকতাসম্পন্ন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি স্থায়ী মহাবর্ণনায় পরিণত হবে।
অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম: বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন