সাজজাদ হোসাইন খান
আরাকান শব্দটি উচ্চারিত হলেই মহাকবি আলাউল এবং ‘পদ্মাবতী' কাব্যের কথা উঠে আসে। কবি সাহিত্যিক গুণীজন পরিবৃত রোসাঙ্গ রাজদরবার এক সময় বিশ্ব পরিব্রাজকদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছিল। মাগন ঠাকুর, দৌলত কাজি, কবি আশরাফ এবং মহাকবি আলাউলের মত অনেক জ্ঞানীগুণী এবং রাজ আমত্য রোসাঙ্গ রাজদরবার মুখর রাখত। বিশেষ করে ‘বঙ্গ' সাহিত্য চর্চায়। যে কারণে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকান ভিন্ন একটি অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। আরাকান সাম্রাজ্যে বাঙ্গালী মুসলমানদের বিশেষ অবস্থান ছিল। আলাওল লিখছেন- ‘কহিতে বহুল কথা দুঃখ আপনার/ রোসাঙ্গে আসিয়া হৈলোঁ রাজ আসোয়ার/ বহু মুসলমান সব রোসাঙ্গে বৈসেন্ত/ সদাচারী পন্ডিত গুণবন্ত।' এ থেকে প্রতীয়মান হয় আরাকানের সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে মুসলমানদের বিশেষ একটা অবস্থান ছিল। কলহ-বিবাদ ষড়যন্ত্রও ছিল আরাকান সাম্রাজ্যে। মোগল যুবরাজ শাহ সুজার হত্যার ঘটনার সাথেও জড়িত ছিল আরাকান রাজা। এসব আলাউলের ‘পদ্মাবতী' রচনাকালে, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এক সময় আরাকান রাজ্যে রাজকলহ বৃদ্ধি পায়। এমনও সময় গেছে রোসাঙ্গ রাজ সিংহাসনে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন রাজার অভিষেক হতো।
স্বাধীন আরাকান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরাকানের যুবরাজ নরমিখ্লা। তিনি নামধারণ করেছিলেন মুহম্মদ সোলাইমান শাহ। এটি ঘটেছিল ১৪৩০ সালে। তখন থেকেই আরাকানে একটা ইসলামী আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। যে কারণে বাঙালি মুসলিমদের প্রভাব বলয় বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেখানকার আদি রোহিঙ্গারা ইসলামে দীক্ষিত হয় বিপুলভাবে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত রাজ-রাজাদের সময়কার মুদ্রায় আরবি হরফে কলেমা লেখা রয়েছে। অন্য পৃষ্ঠায় রাজার নাম এবং সময় উৎকলিত। বিশেষ করে ম্রাউক রাজবংশের মুদ্রায়। এ ধারা পরবর্তী সময়েও চলমান ছিল। আরাকান রাজনীতিতে ইসলাম, মুসলমান কতটা সম্পৃক্ত ছিল তা আন্দাজ করতে তেমন বেগ পেতে হয় না। ম্রাউক-উ-বংশের রাজা থ্রি তু ধম্মাকে হত্যার পর থেকেই আরাকানে দেখা দেয় গোলযোগ। যা চলে প্রায় একশ বছর। রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল ১৬৩০ সালে। এই দুর্বলতার সুযোগে বার্মার রাজা (বর্তমানে মিয়ানমার) ভোদাপায়া আরাকান আক্রমণ করে এবং অধিকার করে। যার পরিণাম ‘আরাকান' বার্মার একটি প্রদেশ। সেটি ১৭৮৪ সালের ইতিহাস। তখন থেকেই আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দাগণ অর্থাৎ রোহিঙ্গা মুসলমানগণ অত্যাচারিত, অবহেলিত। যার জের অদ্যাবধি প্রলম্বিত। জাতিগত বিদ্বেষ আরাকানের সমাজ ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে বহুকাল থেকে। এক সময় মগ জলদস্যুদের অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই মগরা ছিল ব্রহ্মদেশের, বর্তমানে মিয়ানমার। সে অঞ্চলের কোন কোন মানুষের বর্বরতা-দস্যুতা ইতিহাস খ্যাত। বাঙালি মুসলমানরা যেমন আরাকানে বসতি গেড়েছিল, পাশাপাশি রাখাইন জনগোষ্ঠীও আরাকানে উপস্থিত হয়েছিল। তারা ছিল ভারতের ‘মগধ' রাজ্য থেকে আগত, বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। স্থানীয় রোহিঙ্গারা তো ছিলই। পরবর্তী সময় মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সাথে ব্যাপকভাবে মিশে যায়। বর্তমানের জাতিগত বিদ্বেষের শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানরা সেই আদি রোহিঙ্গাদের অংশ। স্বাধীন আরাকান রাজ্যে জাতিগত বৈরিতা তেমন একটা লক্ষ্যগোচর হয়নি। তখনকার সৃষ্ট সাহিত্যে এসবের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। রোসাঙ্গ যখন ‘পেগুর' করতলগত হয় সম্ভবত তখন থেকেই বিদ্বেষের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। পেগু ছিল তৎকালীন বার্মার রাজধানী।
রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে পরবাসী। তাদেরকে সে দেশের নাগরিক বলেই স্বীকার করতে নারাজ মিয়ানমারের মানুষজন। বিশেষ করে রাখাইন বৌদ্ধরা। যে জন্যে নানা ছুতানাতায়ই তারা চড়াও হচ্ছে রোহিঙ্গাদের উপর। তাদের ঘর ছাড়া করছে, আগুনে পুড়িয়ে মারছে, হত্যা করছে নারী-শিশুসহ সবাইকে। তারপর লুটে নিচ্ছে ধন-সম্পদ। কিছুদিন পর পরই আরাকানের অবস্থা অশান্ত হচ্ছে। বর্তমানে সে অঞ্চলের রাখাইন শহরে চলছে ভয়াবহ দাঙ্গা। স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে, বিতাড়িত করছে দেশ থেকে। এর আগেও কয়েকবার এমন কান্ড ঘটিয়েছে রাখাইনরা। এই রায়ট বা লুণ্ঠনের ব্যাপারে মিয়ানমার প্রশাসন শক্ত কোন ভূমিকা নিচ্ছে বলে মনে হয় না। তাদের পদক্ষেপ ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র অবস্থা। খবর আসছে, মিয়ানমারের আইনশৃক্মখলা বাহিনী রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার পরিবর্তে আক্রমণকারী রাখাইনদের উৎসাহিত করছে। যদি সত্যি সত্যি খবরটি সঠিক হয় তাহলে এমন আচরণ অবশ্যই নিন্দনীয়। এছাড়া মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী নামে পরিচিত ‘সুকি'র ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে নিজ দেশে অশান্তির লেলিহান শিখা লাফাচ্ছে তখন তিনি বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত তাও আবার শান্তির নামে, নোবেল গ্রহণের জন্য। আনন্দের বার্তা এটি। কিন্তু তার দেশের এক প্রান্তে মানবতা লাঞ্ছিত, ঘরের দরজায় অশান্তি, সেখানে বিদেশ বিভুয়ে ঘোরাফেরা কতটা যুক্তিগ্রাহ্য। এই ক'দিন আগেও সামরিক জান্তা শাসিত ছিল মিয়ানমার, তখনও রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়েছে, খুন-জখমের শিকার হয়েছে। এখনতো সে অবস্থা আছে বলে মনে করে না বিশ্ববাসী। কারণ বর্তমানে গণতন্ত্রের (?) আবহ দেশে। প্রচার-প্রোপাগান্ডায়তো এমনটাই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্ব মানুষকে অন্য রকম বার্তা পৌঁছাচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগণ মিয়ানমারেরই নাগরিক। এ সত্য অস্বীকারের কোন অবকাশ নেই। তাই একজন নাগরিকের জান-মাল রক্ষার সার্বিক দায়-দায়িত্ব সে দেশের সরকারের উপরই বর্তায়। এই বোধটুকু তাদের আছে বলেতো মনে হয় না। পরিস্থিতি যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে তাতে মনে হয় রাখাইন বৌদ্ধদের আচরণ মধ্যযুগের মগদের অসভ্যতাকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। কয়েক বছর আগেও তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। যার পরিণতিতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন রক্ষার্থে সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। এদের অনেকেই উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে শরণার্থী ক্যাম্পে। এই অবিচারেরই এখন পর্যন্ত কোন গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসা সম্ভব হয়নি। কারণ মিয়ানমার প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং অগ্রহণযোগ্য মনোভঙ্গির কারণে। বর্তমানে আবার নতুন সমস্যা, একই অঞ্চল থেকে। তাই বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত এবং কর্তব্য এ ব্যাপারে শক্ত একটি অবস্থানে আসা। ঘরের পাশে আগুন জ্বললে সে আগুন নিজ ঘরে লাগাটা অসম্ভব কিছু নয়। তাই ঘর রক্ষার্থে হলেও প্রতিরোধমূলক অবস্থায় অবস্থান করা দরকার। তবে মৃত্যুপথযাত্রী রোহিঙ্গাদের প্রবেশকে বাধাগ্রস্ত করে সমস্যা সমাধানের কল্পনা করা আহমকি ব্যতিরেকে আর কিছু নয়। এ পন্থা চরম অমানবিক আচরণও বটে। ভীতসন্ত্রস্ত রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার ব্যবস্থা হচ্ছে। তারা কোথায় যাবে? দেশে ফিরলে নিশ্চিত মৃত্যু। পুশব্যাকের নামে রোহিঙ্গাদের বাঘের মুখে ঠেলে দেয়ার প্রক্রিয়া নিয়েছে বর্তমান সরকার। অনেক রোহিঙ্গা আরাকানে ফিরে না গিয়ে সাগরে ভাসছে, অর্ধাহারে-অনাহারে। কেউ মৃত্যুপথযাত্রী। এমন অবিবেচক পন্থা কোন অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের প্রবেশ পথ উন্মুক্ত রাখা দরকার। তবে তা অবশ্যই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন গত একাত্তরে বাংলাদেশীরাও ভারতে প্রবেশ করেছিল, এমনি একটি জুলুম-অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে। তখন ভারত যদি প্রবেশের সকল পথে পাহারা বসাতো, পুশব্যাক করতো, তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াতো?
মিয়ানমারে বর্তমানে গণতান্ত্রিক সরকার। যদিও চরিত্রগত দিক থেকে পার্থক্য সামান্য, রীতি নীতির বিস্তার এখনো তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না। তবে আরাকানের ঘটনা এবং মিয়ানমার সরকারের অবস্থান ভিন্ন কোন চিন্তার অবকাশ দিচ্ছে না। তারপরও ভাল কিছু প্রত্যাশা করতে দোষ কি। সময়টি এখন উর্বর। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টি নতুনভাবে বিশ্ব দরবারে তোলা যেতে পারে। এবং এর একটা স্থায়ী সমাধানেও পৌঁছা যেতে পারে হয়তো। এজন্যে অবশ্য নিজের শক্তিমত্তা এবং কূটনীতিকে শাণিত করতে হবে।
একসময় বার্মার সাথে বাংলাদেশের মানুষের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ক অটুট ছিল ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত। রুজি রোজগারের উদ্দেশ্যে রেঙ্গুন প্রবাসী হতো অনেকেই। দেখা যেতো প্রায় গ্রাম থেকেই দু' একজন রেঙ্গুনে অবস্থান করছেন। বার্মা এবং রেঙ্গুন শব্দটি তখন অতি পরিচিত ছিল। এদের অনেকেই সেখানে থেকে গেছেন, বিয়ে-শাদী করে। বার্মার তথা রেঙ্গুনের অনেকেরই আদি পুরুষ বাংলাদেশী বা বাঙালি। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেও রেঙ্গুনের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই রেঙ্গুন একসময় খুলনা সিলেটের মতো কাছের শহর ছিল। এখন কত দূর। সে দেশের একশ্রেণীর মানুষের বৈরী মনোভঙ্গি এই দূরত্বটিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আরাকান জ্বলছে, মনে হয় মহাকবি আলাউলের পদ্মাবতী কাব্যে আগুন লেগেছে। দৌলত কাজী মাগন ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার খাতিরে হলেও এই বৈরীতার অবসানের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রোসাঙ্গ-রোহিঙ্গা আবার মুখরিত হোক এটিই সবার কাম্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন