সংবিধানের
১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
জনগণের সামনে সত্য আড়াল করছে। তারা অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় আছে। এভাবে
তারা জনগণকে কার্যত ভাঁওতা দিচ্ছে। সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেছেন,
‘প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ইসি পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া অসাংবিধানিক।’ তাঁর কথায়,
গত ৪০ বছরে এই প্রথম অসাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া
হয়েছে। ‘সংবিধানের কোথাও অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিধান নেই।’ অন্যদিকে
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেছেন, প্রজ্ঞাপনে ১১৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইনের
উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে এটা সাংবিধানিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি,
গত ৪০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম ‘উদারতার’ সঙ্গে এটা করা হয়েছে। এমনটা আগে
কখনো দেখা যায়নি।
উভয় পক্ষের বক্তব্যের চেতনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে বলা যায়, উভয় পক্ষ জেনে বা না জেনে অর্ধসত্য উচ্চারণ করছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অর্ধসত্য মিথ্যা অপেক্ষা ভয়ংকর। এতে আমজনতা তো বটেই, শিক্ষিতজনেরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
১১৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’ সরকার আইন না করে চালাকি করে বলেছে, ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রজ্ঞাপন করা হলো। একটি আইন হলে তার বিধান থাকে। এর আওতায় প্রজ্ঞাপন হয়। অথচ এখন আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘এই মুহূর্তে স্থায়ী আইন করার দরকার নেই। প্রজ্ঞাপনই আইনের কাজ সেরেছে।’ এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত ধরে নিলে সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তার উপায় নেই।
১১৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটনে আমাদের সাংবিধানিক বিবর্তন ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৫৬ সালের অবিভক্ত পাকিস্তানের সংবিধানে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ১৩৭ অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে না হয়। সে কারণে লেখা হয়েছিল, এদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ‘ডিসক্রিশন’ বা একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে। ১৯৬২ সালের ১৪৭ অনুচ্ছেদে এই ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা হয়। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদটি আমরা সম্ভবত ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ থেকে গ্রহণ করেছিলাম। তাহলে এখন আমরা দেখব, ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্কের বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছিল। প্রথম যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন।’ এ প্রসঙ্গে এটা বলা আবশ্যক যে, বর্তমান সরকার একটা ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের রেওয়াজ ভেঙে দিয়েছে। কেন তিনজনের পরিবর্তে পাঁচজনের দরকার পড়ল, সেই ব্যাখ্যা সরকারের কোনো মহল থেকে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলও অন্তত এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে নজরে পড়েনি। ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তনে ভারতের অনেক রাজ্য বাংলাদেশের তুলনায় বড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এক সদস্যের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর তারা শুধু একজন সিইসি দিয়ে চলেছে। এরপর তারা দুজন কমিশনার বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাও আইন দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তারা স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেনি। আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার পরও মাত্র দুজনকে দিয়ে ইসি পুনর্গঠন করা সম্ভব ছিল। যাক এ প্রসঙ্গ। কী করে ‘আইন’ এল, সে কথাই বলি। ১৫ জুন ১৯৪৯। ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্ক চলছে। অধ্যাপক সাক্সেনা সংশোধনী এনেছেন। এতে তিনি বলেছেন, সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগ এতে হস্তক্ষেপ করবে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা যেমন চাইবেন, তেমনটা হবে। তাই তিনি বললেন, যাঁর নাম সিইসি হিসেবে প্রস্তাব করা হবে, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মতো সংসদে শুনানির মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন ড. আম্বেদকার। তিনি একটি মধ্যপন্থা উদ্ভাবন করলেন। বললেন, সিইসি নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে সংসদ যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য একটি আইন তৈরি করার বিধান রাখা হোক। অতঃপর ৩২৪ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হলো সংসদের ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন। এই কথাটি আমরা ধার করেছি ১৯৭২ সালে। এবং এ কথা এখন রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে, গত ৪০ বছরে এই আইনটি তৈরি করা হয়নি।
এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শফিক আহমেদ ও মওদুদ আহমদ কীভাবে আইন তৈরি করাসংক্রান্ত ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রেক্ষাপট আড়াল করে আমজনতাকে ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন। সরকারি মহল থেকে আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের’ ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘“আইন” অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ আবার ‘প্রচলিত আইন’ নামেও সেখানে একটি সংজ্ঞা আছে। এতে বলা আছে, ‘প্রচলিত আইন মানে সংবিধান তৈরির আগে এই ভূখণ্ডে যে আইন বহাল ছিল।’ এখানে একটি খটকা আছে। আমাদের সংবিধানে ভুল বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘আইন’ সংজ্ঞায়িত হয়েছে কি না, সেটা বিচার্য। কারণ, আমাদের সংবিধানে যা উক্তরূপ ‘আইন’ ব্যাখ্যা, ১৯৪৯ সালের ভারতের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদ ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের ২১৮ অনুচ্ছেদে তা-ই হলো ‘প্রচলিত আইন’। ভারত ও পাকিস্তানের মূল সংবিধানে (পাকিস্তান কিন্তু ১৯৬২ সালে এই ব্যাখ্যাটি ফেলে দেয়) শুধু ব্রিটিশ ভারতে কার্যকর থাকা আইন, উপ-আইন, আদেশ ইত্যাদিকেই ‘প্রচলিত আইন’ হিসেবে নিয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯২ ধারায় ‘প্রচলিত আইন’ একই লক্ষ্যে লেখা হয়েছিল। সুতরাং, আইন ও প্রচলিত আইন নামে দুটি দফা ’৭২-এর সংবিধানে কেন লেখা হলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষ-এ ‘প্রচলিত আইন’ বলতে ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দুটি বিষয়কেই (আইন ও প্রচলিত আইন) কিন্তু একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এবং সেটাই সঠিক। সুতরাং, সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আইনমন্ত্রীর বর্ণিত ‘আইন’ আসলে সংবিধান প্রণয়নের আগের যেকোনো আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের অন্যত্র বর্ণিত ‘আইন’কে প্রজ্ঞাপন অর্থে ব্যবহার করা যাবে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের ১৫২ অনুচ্ছেদের মতো তাদের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমার জানামতে ভারতের মন্ত্রিসভা বিভাগের কোনো প্রজ্ঞাপনকে তারা সংসদের প্রণীত আইনের মর্যাদা দেয়নি, এক করে দেখেনি।
তবে মওদুদ আহমদের দাবি অনুযায়ী, সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে অনুসন্ধান কমিটির কথা না বলা থাকলেও তাকে অসাংবিধানিক বলা যাবে না। কারণ, প্রজ্ঞাপনটি ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ না করলেও সেটা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের চেতনানাশক নয়। সুতরাং, একটি অনুসন্ধান কমিটি (যার সদস্যরা তাঁদের মূলসাংবিধানিক পদেও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না) গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু যে ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তারা এটা করেছে, সেটা ছিল দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রশ্নেও একটা ফাঁকি আছে। সেটা হলো সিইসি ও ইসি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছিল। সুতরাং যা হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই হয়েছে। দুই দলের একটি বিষয়ে মিল, তারা কেউ ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদে আইন পাস করতে চায় না। সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কার্যকরভাবে খর্বনা করতে তাদের মধ্যে এত কিছুর পরও অশুভ আঁতাত অটুট। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আর্থার কোয়েসলারের একটি উক্তি হচ্ছে, ‘দুটো অর্ধসত্য থেকে একটি পূর্ণসত্য তৈরি হয় না।’
দুই বড় দলের অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে সত্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
উভয় পক্ষের বক্তব্যের চেতনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে বলা যায়, উভয় পক্ষ জেনে বা না জেনে অর্ধসত্য উচ্চারণ করছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, অর্ধসত্য মিথ্যা অপেক্ষা ভয়ংকর। এতে আমজনতা তো বটেই, শিক্ষিতজনেরাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
১১৮ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’ সরকার আইন না করে চালাকি করে বলেছে, ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রজ্ঞাপন করা হলো। একটি আইন হলে তার বিধান থাকে। এর আওতায় প্রজ্ঞাপন হয়। অথচ এখন আইনমন্ত্রী বলছেন, ‘এই মুহূর্তে স্থায়ী আইন করার দরকার নেই। প্রজ্ঞাপনই আইনের কাজ সেরেছে।’ এ ধরনের বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত ধরে নিলে সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তার উপায় নেই।
১১৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা কিংবা ভুল ব্যাখ্যার যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটনে আমাদের সাংবিধানিক বিবর্তন ও ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৫৬ সালের অবিভক্ত পাকিস্তানের সংবিধানে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে এককভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ১৩৭ অনুচ্ছেদটি এমনভাবে লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতিকে যাতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে না হয়। সে কারণে লেখা হয়েছিল, এদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ‘ডিসক্রিশন’ বা একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে। ১৯৬২ সালের ১৪৭ অনুচ্ছেদে এই ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা হয়। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদটি আমরা সম্ভবত ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ থেকে গ্রহণ করেছিলাম। তাহলে এখন আমরা দেখব, ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্কের বিষয়টি কীভাবে আলোচিত হয়েছিল। প্রথম যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, তাতে লেখা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন।’ এ প্রসঙ্গে এটা বলা আবশ্যক যে, বর্তমান সরকার একটা ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের রেওয়াজ ভেঙে দিয়েছে। কেন তিনজনের পরিবর্তে পাঁচজনের দরকার পড়ল, সেই ব্যাখ্যা সরকারের কোনো মহল থেকে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলও অন্তত এই সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে বলে নজরে পড়েনি। ভারতকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আয়তনে ভারতের অনেক রাজ্য বাংলাদেশের তুলনায় বড়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও সাংবিধানিকভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এক সদস্যের। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর তারা শুধু একজন সিইসি দিয়ে চলেছে। এরপর তারা দুজন কমিশনার বৃদ্ধি করে। কিন্তু তাও আইন দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে তারা স্থায়ী পদ সৃষ্টি করেনি। আমাদের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার পরও মাত্র দুজনকে দিয়ে ইসি পুনর্গঠন করা সম্ভব ছিল। যাক এ প্রসঙ্গ। কী করে ‘আইন’ এল, সে কথাই বলি। ১৫ জুন ১৯৪৯। ভারতীয় গণপরিষদে বিতর্ক চলছে। অধ্যাপক সাক্সেনা সংশোধনী এনেছেন। এতে তিনি বলেছেন, সিইসি নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ হলো নির্বাহী বিভাগ এতে হস্তক্ষেপ করবে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা যেমন চাইবেন, তেমনটা হবে। তাই তিনি বললেন, যাঁর নাম সিইসি হিসেবে প্রস্তাব করা হবে, তাঁকে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের মতো সংসদে শুনানির মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের গণপরিষদের সভাপতি ছিলেন ড. আম্বেদকার। তিনি একটি মধ্যপন্থা উদ্ভাবন করলেন। বললেন, সিইসি নিয়োগ-প্রক্রিয়ার বিষয়ে সংসদ যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য একটি আইন তৈরি করার বিধান রাখা হোক। অতঃপর ৩২৪ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হলো সংসদের ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি সিইসি নিয়োগ দেবেন। এই কথাটি আমরা ধার করেছি ১৯৭২ সালে। এবং এ কথা এখন রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে, গত ৪০ বছরে এই আইনটি তৈরি করা হয়নি।
এ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শফিক আহমেদ ও মওদুদ আহমদ কীভাবে আইন তৈরি করাসংক্রান্ত ঐতিহাসিক সত্যতা ও প্রেক্ষাপট আড়াল করে আমজনতাকে ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন। সরকারি মহল থেকে আমাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘আইনের’ ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘“আইন” অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ আবার ‘প্রচলিত আইন’ নামেও সেখানে একটি সংজ্ঞা আছে। এতে বলা আছে, ‘প্রচলিত আইন মানে সংবিধান তৈরির আগে এই ভূখণ্ডে যে আইন বহাল ছিল।’ এখানে একটি খটকা আছে। আমাদের সংবিধানে ভুল বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ‘আইন’ সংজ্ঞায়িত হয়েছে কি না, সেটা বিচার্য। কারণ, আমাদের সংবিধানে যা উক্তরূপ ‘আইন’ ব্যাখ্যা, ১৯৪৯ সালের ভারতের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদ ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের ২১৮ অনুচ্ছেদে তা-ই হলো ‘প্রচলিত আইন’। ভারত ও পাকিস্তানের মূল সংবিধানে (পাকিস্তান কিন্তু ১৯৬২ সালে এই ব্যাখ্যাটি ফেলে দেয়) শুধু ব্রিটিশ ভারতে কার্যকর থাকা আইন, উপ-আইন, আদেশ ইত্যাদিকেই ‘প্রচলিত আইন’ হিসেবে নিয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯২ ধারায় ‘প্রচলিত আইন’ একই লক্ষ্যে লেখা হয়েছিল। সুতরাং, আইন ও প্রচলিত আইন নামে দুটি দফা ’৭২-এর সংবিধানে কেন লেখা হলো, তা খুঁজে বের করতে হবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও আনিসুজ্জামানের আইন শব্দকোষ-এ ‘প্রচলিত আইন’ বলতে ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত দুটি বিষয়কেই (আইন ও প্রচলিত আইন) কিন্তু একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। এবং সেটাই সঠিক। সুতরাং, সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে আইনমন্ত্রীর বর্ণিত ‘আইন’ আসলে সংবিধান প্রণয়নের আগের যেকোনো আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের অন্যত্র বর্ণিত ‘আইন’কে প্রজ্ঞাপন অর্থে ব্যবহার করা যাবে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের ১৫২ অনুচ্ছেদের মতো তাদের ৩৬৬ (১০) অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমার জানামতে ভারতের মন্ত্রিসভা বিভাগের কোনো প্রজ্ঞাপনকে তারা সংসদের প্রণীত আইনের মর্যাদা দেয়নি, এক করে দেখেনি।
তবে মওদুদ আহমদের দাবি অনুযায়ী, সংবিধানে ১১৮ অনুচ্ছেদে অনুসন্ধান কমিটির কথা না বলা থাকলেও তাকে অসাংবিধানিক বলা যাবে না। কারণ, প্রজ্ঞাপনটি ১১৮ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ না করলেও সেটা সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের চেতনানাশক নয়। সুতরাং, একটি অনুসন্ধান কমিটি (যার সদস্যরা তাঁদের মূলসাংবিধানিক পদেও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না) গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি কিছুটা ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু যে ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তারা এটা করেছে, সেটা ছিল দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রশ্নেও একটা ফাঁকি আছে। সেটা হলো সিইসি ও ইসি নিয়োগের ফাইল প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়েছিল। সুতরাং যা হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই হয়েছে। দুই দলের একটি বিষয়ে মিল, তারা কেউ ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় সংসদে আইন পাস করতে চায় না। সিইসি নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কার্যকরভাবে খর্বনা করতে তাদের মধ্যে এত কিছুর পরও অশুভ আঁতাত অটুট। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আর্থার কোয়েসলারের একটি উক্তি হচ্ছে, ‘দুটো অর্ধসত্য থেকে একটি পূর্ণসত্য তৈরি হয় না।’
দুই বড় দলের অর্ধসত্য বলার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশে সত্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন