মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

চিকিৎসকেরা মিছিল-মিটিংয়ে, রোগীরা অপেক্ষায়



আলী ইমাম মজুমদার | তারিখ: ২৮-১১-২০১২

এই শিরোনামটি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের। আবার কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম ‘নির্বাচন করছেন চিকিৎসকেরা-পরিবেশ নষ্ট হাসপাতালের’। এ শিরোনামে খবরগুলো এসেছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন উপলক্ষে। কোনো পেশাজীবী সংস্থা গঠিত হয় তার সদস্যদের পেশাগত সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবারের জন্য। আর এ নেতৃত্ব নির্ধারণ বা বদল হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। এটাই স্বাভাবিক। তবে গত দুই দশকের অধিক কাল ধরে এ সংগঠন ও নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
চিকিৎসা সেবাধর্মী ও মর্যাদাকর একটি পেশা। রোগকাতর মানুষ চিকিৎসকের সান্নিধ্যে এলেই ভালো হতে শুরু করেন বলে একটি কথা রয়েছে। রোগ নিরাময়ের অন্যতম সহায়ক রোগীর মনোবল। চিকিৎসকের সান্নিধ্য তাকে তা দেয়। চিকিৎসক আমাদের সবার দরকার। সন্দেহ নেই চেম্বার, বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসকেরা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন গভীর মমত্ববোধ ও নিষ্ঠা নিয়ে। রোগী ভালো হয়ে উঠলে চিকিৎসক পরিতৃপ্ত হন—এটাও লক্ষ করেছি অনেক ক্ষেত্রে।
সরকারি-বেসরকারি সব চিকিৎসক সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, যা সংক্ষেপে বিএমএ নামে পরিচিত। সরকারি চিকিৎসকও সরকারি চাকরিজীবী বটে। সরকারি চাকরির সব বিধিবিধান তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সরকারি চাকরিজীবীদের কোনো সংগঠনের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবিদাওয়া জানাতে পারার কথা নয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা কীভাবে তা চালিয়ে যাচ্ছেন, এ প্রশ্ন অনেকবার উঠলেও অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
বিএমএ নেতৃত্বের জন্য মূলত দুটি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর একটি হচ্ছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, যা সংক্ষেপে স্বাচিপ আর অন্যটি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে ড্যাব নামে পরিচিত। স্বাচিপ ও ড্যাব দুটি সংস্থাই অত্যন্ত খোলামেলাভাবে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কার্যত অঙ্গসংগঠন হিসেবেই পরিচিত হয়। তাদের কার্যক্রমে রাখঢাক নেই। মূল দলের সভা-সমিতিতেও তারা প্রকাশ্যে যোগ দেয়। তাহলে দেখা যায়, সরকারি চাকরি করে সরাসরি করছেন রাজনীতি। এটা বিধিসম্মত নয় বলে সবারই জানা। এমনকি তাদেরও। তবে তারা তা উপভোগ করছে যখন যারা ক্ষমতায় থাকছে তাদের প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতায়।
আরেকটি অস্বাভাবিক বিষয় হলো, হাসপাতালগুলো শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশেও সাইলেন্স জোন বলে পরিচিত। এর ধার দিয়ে গাড়ি চলাচলেও কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার নির্দেশনা রয়েছে। আর এ হাসপাতালে চিকিৎসকেরা করছেন মিছিল, দিচ্ছেন স্লোগান। এর আঙিনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশেও ভাষণ দিচ্ছেন বক্তা-শ্রোতারা (তাঁরাও চিকিৎসক) দিচ্ছেন করতালি। তাহলে দেখা যায়, গুরুতর অসুস্থ রোগীর জন্য পরিবেশদূষণে পিছিয়ে নেই আমাদের চিকিৎসকেরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ হাসপাতালগুলো অবশ্যই সরকারি। যাদের জন্য রাষ্ট্রের এত টাকা ব্যয়, তারা রোগী। আর করদাতাও তারাই। তারা অপেক্ষায় থাকছে কখন মিটিং-মিছিল শেষ করে চিকিৎসকেরা এসে তাদের দেখবেন।
এ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিজয়ী হয়ে বিএমএ নেতৃত্ব লাভ করতে পারলে সেই নেতাদের বহুমাত্রিক স্ফীতি বেশ কিছুকাল ধরে আমরা দেখছি। ষোলোকলা পূর্ণ করতে অবশ্য সরকারি দলের সমর্থনপুষ্ট দল হতে হবে। সরকারি সব চিকিৎসকের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে তাদের প্রভাব অপরিসীম। আর যে চিকিৎসক তাঁর এ ধরনের কোনো প্রয়োজনে বিএমএ নেতাদের সহায়তা চান, তা জোটে ক্ষেত্রবিশেষে দলীয় কঠোর আনুগত্য আর অনেক ক্ষেত্রেই মণিকাঞ্চনের প্রভাবে—এ জনশ্রুতি প্রবল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ তাঁর সহকর্মীরা হয়ে যান এঁদেরই অংশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও যে এ ধরনের ক্ষেত্রে এসব নেতার অঙ্গুলি হেলনেই ব্যবস্থা নেয়, এটাও অজানা নয়। অবশ্য সরকারি সমর্থনপুষ্ট দলের বাইরে থেকে বিএমএ নেতৃত্ব এলে হয়তো বা একটা সহাবস্থানের নীতি নিয়ে নেবে উভয় পক্ষ।
বেশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নের সুযোগ পান। সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় হয় বিশাল অঙ্কের টাকা। তেমনি বিশাল এগুলোর পরিচালনা ব্যয় চিকিৎসক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রোগীদের পথ্য-খাবার, ওষুধ ইত্যাদির জন্য। এর বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত বলে অনেকে মনে করেন। পল্লি অঞ্চল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকার সামর্থ্যের মধ্যে প্রভূত ব্যয় করে চলছে। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ে ব্যয় হয়ে গেছে বহু টাকা। নিয়োগ পেয়েছেন কয়েক হাজার চিকিৎসক ও কর্মচারী। এর আবশ্যকতাও রয়েছে। প্রয়োজন হলে আরও নিয়োগ দেওয়া হোক। কিন্তু এ দুর্ভাগা জাতি খুব কম ক্ষেত্রেই পল্লি স্বাস্থ্যকেন্দ্র কেন, উপজেলায়ও যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পান না। প্রায়শই দোষ দেওয়া হয় চিকিৎসাসামগ্রী, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ ইত্যাদির অপ্রতুলতার। কিন্তু মূল সমস্যা, চিকিৎসকেরা কর্মস্থলে থাকেন না; থাকতে চান ঢাকায়।
এটা সম্প্রতি আমাদের জাতীয় সংসদেও আলোচিত হয়েছে। জবাব দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্যত তাঁর অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করে দায়ী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। শুধু ঢাকা বা বড় শহরের চাহিদার হিসেবে নিয়োগ দিলে তো এত চিকিৎসক নিয়োগের আবশ্যকতা থাকে না। নির্মাণ করতে হয় না শত শত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু এগুলো আমরা করেছি জনস্বার্থে এবং আরও করার দাবি আছে। চিকিৎসক কর্মস্থলে না থাকলে সেগুলো ঠিকমতো চলার কোনো সুযোগই নেই। তবে ঢাকা বা কতিপয় বড় শহরের বাইরে চাকরি করবেন না তো সরকারি চাকরিতে এলেন কেন—এ সহজ প্রশ্নটা কেউ তাঁদের কখনো করেছেন কি না জানি না। আর সে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কীভাবে চলবে আর কে চালাবে, এটা অচিরেই মীমাংসা হওয়া আবশ্যক। কেন্দ্রীভূত প্রশাসন এ সমস্যার মুখে অসহায় এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ওই পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকসহ অন্য কর্মচারীদের নিয়োগ থেকে বরখাস্ত করার সব ক্ষমতা জেলা বা উপজেলা পরিষদকে দেওয়া যায় কি না, এটা ভাবার বিষয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য এভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ সরকারি নিয়মে বেতন-ভাতা, পেনশন, পদোন্নতি ইত্যাদি পাবেন এবং সরকার এসব কেন্দ্র পরিচালনার সব ব্যয়ই বহন করবে। এ ধরনের ব্যবস্থা দেশের আরও কতিপয় বিভাগের জন্যও চালু করার আবশ্যকতা রয়েছে।
দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ হয়েছে। সরকারি চাকরিতে দলীয়করণের বিষয়টি নিয়ে সীমাহীন লেখালেখিও হয়েছে। আর এটা নিশ্চিত, সবচেয়ে বেশি দলীয়করণ হয়েছে চিকিৎসকদের চাকরিতে। দুঃখজনকভাবে এ দলীয়করণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরই সহকর্মীরা এবং অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই। বিশালসংখ্যক চিকিৎসকের কাছে এ ধরনের দলাদলি অপছন্দনীয় হলেও শুধু নিজের পদ-পদবি আর পছন্দের কর্মস্থল বেছে নিতে বা টিকিয়ে রাখতে এ দলাদলিতে তাঁরা জড়িয়ে পড়ছেন। একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনায় আনে আমূল পরিবর্তন। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও বিজ্ঞ অধ্যাপকদের হটিয়ে সে স্থানে বসে যান স্রেফ দলবাজি করা কিছু চিকিৎসক।
আবার গণেশ ওল্টালে ঘটে ঠিক তার বিপরীতটা। এতে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজবঞ্চিত হচ্ছে মেধাবী, দক্ষ ও উপযুক্ত চিকিৎসকের সেবা থেকে। ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কি আমরা শুধু সরকারি চিকিৎসাসেবা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটগুলোর মেরুদণ্ডই ভেঙে দিচ্ছি না? অন্য বেসামরিক চাকরিগুলোর মতো এখানেও দলাদলির ফলে চেইন অব কমান্ড আজ বিপন্ন। হয়তো বা কিছু বেশি দলাদলিই হয় চিকিৎসাসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে। জ্ঞানীগুণী অধ্যাপক তাঁর কনিষ্ঠ সহকারী অধ্যাপককে অনেক ক্ষেত্রে সমঝে চলতে হয় শেষোক্ত জন, নেতা বা তাদের সহচর বলে। এর কুফল দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। অবশ্য চিরস্থায়ীই হবে—যদি এটা চলতেই থাকে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং এর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই, তবে অবশ্যই প্রশ্ন থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মূল প্যানেল দুটির প্রকাশ্য রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে। আরও প্রশ্ন থাকবে বিএমএ কোন যুক্তিতে চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি ও পদায়নে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও শীর্ষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বড় বড় সরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করা নিয়ে। পাশাপাশি প্রশ্ন থাকে, এসব সাইলেন্স জোন বলে চিহ্নিত স্থাপনায় চিকিৎসকেরা কীভাবে মিছিল-মিটিং করতে পারেন? কীভাবেই বা দিতে পারেন স্লোগান? বিএমএ সদস্য, ভোটদাতা এমনকি দু-একজন প্রার্থীও থাকতে পারেন দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে। এসব খ্যাতনামা হাসপাতাল যেমন: ইউনাইটেড, স্কয়ার, বারডেম, ল্যাবএইড, অ্যাপোলোর মতো বেসরকারি হাসপাতালে ভোটপ্রার্থী দলের নেতা-কর্মীরা কি এমনতর স্লোগানসহ একটি মিছিল কিংবা হাসপাতাল আঙিনায় কোনো সভা করতে পারবেন? জবাব হবে অত্যন্ত সোজা। আর তা হচ্ছে ‘অবশ্যই নয়’।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন