মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : দেয়াললিখন পড়ুন

মাহমুদুর রহমান



দিন দশেক আগে ঘাটাইলে (টাঙ্গাইল-৩) উপনির্বাচন হয়ে গেল। বিরোধী দলবিহীন সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এক প্রার্থীর মধ্যে। বহিষ্কৃত প্রার্থী রানা দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে নৌকার প্রার্থী লেবুকে নির্বাচনে পরাজিত করেছেন। সেই রানা অবশ্য নির্বাচনের দু’দিন পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে ধন্য হয়েছেন। শেখ হাসিনাও নিশ্চয়ই সাক্ষাত্কারে আর আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে খামোকা বিব্রত হতে চাননি।
তবে, গত দু’বছরে যতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার অধিকাংশেই জয় পেয়েছে বিরোধীদলীয় অথবা বিদ্রোহী প্রার্থী। ইলেকশন কমিশনে দলীয় লোক বসানো হয়েছে, পুলিশসহ প্রশাসনের ভূমিকা আওয়ামী ক্যাডারের মতো, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে, শেয়ার বাজার-হলমার্ক-ডেসটিনির লুট করা টাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পকেট স্ফীত হয়েছে, একতরফা সংসদে মহাজোটের গলাবাজিতে টেকা যাচ্ছে না। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ২০০৮ সালের প্রতারিত জনগণ সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীনদের প্রতি তাদের রাগ ও ঘৃণা সুদসমেত উগরে দিচ্ছে। নৌকার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াচ্ছে, সেটা আর কোনো বিবেচ্য বিষয় থাকছে না। দুর্নীতি আর জুলুমের প্রতীককে ডুবিয়ে দেয়াই সাধারণ ভোটারদের কাছে এখন বড় কথা। চার বছর আগের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে দেশ-বিদেশের প্রভাবশালীরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। মইন-মাসুদের নিরাপদ প্রস্থান নির্ভর করছিল শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ওপর। সুতরাং, বিএনপিকে হারাতে
তত্কালীন সামরিক জান্তা সেনাবাহিনীকে সর্বতোভাবে ব্যবহার করেছে। হুদা’র নির্বাচন কমিশন গঠিতই হয়েছিল বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করে বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার মন্দ অভিপ্রায়ে। তিন নির্বাচন কমিশনার চোখ বুজে মইন-মাসুদের তাবত্ নির্দেশ পালন করেছেন। করিত্কর্মা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ‘সুচারুরূপে’ পালন করে সুশীল(?) সংগঠন টিআইবিতে ঢুকেছেন। তিনি এখন প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সম্মানিত সদস্য। এই পুরস্কার প্রাপ্তির পেছনের কারণ দেশের জনগণ বুঝতে পারে।
অপর নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জে. (অব.) সাখাওয়াত কিছুদিন নিভৃতচারী থাকার পর দৃশ্যমান হয়েছেন। প্রথম আলো ক্যাম্পের সুশীল(?) এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তাকে আজকাল বিভিন্ন টক শোতে দেখা যাচ্ছে, জাতিকে নানা বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্রে নির্বাচন কমিশন সম্পৃক্ত হওয়ার সময় তার ভূমিকা কী ছিল, সে প্রশ্নের জবাব তাকেও একদিন দিতে হবে। এখন বাতাস বুঝে সাধু সাজার প্রচেষ্টা দেখে জনগণ অবশ্য আমোদ পাচ্ছে। এই শ্রেণীর সুবিধাবাদী সুশীলদের(?) চরিত্র দেশবাসীর চেনা হয়ে গেছে। জরুরি সরকারের বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনের তৃতীয় কর্তা ছহুল হোসাইনকে তুলনামূলকভাবে মিডিয়াতে কম দেখা যাচ্ছে। মহাজোটের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদ প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই তিনি মোটামুটি পারিবারিক জীবনের গণ্ডিতেই আটকে আছেন। কালেভদ্রে দুই-একটি পত্রিকায় তার মন্তব্য চোখে পড়লেও সেগুলো সম্ভবত অতিউত্সাহী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব মাত্র।
২০০৫ সাল থেকেই ‘বিএনপি ঠেকাও’ প্রজেক্ট নিয়ে বিদেশিরা মাঠে নেমেছিলেন। ঢাকাস্থ কূটনীতিকদের ‘টিউজ ডে গ্রুপ’ নিয়ে সে সময় ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই কথিত ‘মঙ্গলবার গোষ্ঠীর’ সুশাসন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার চেষ্টা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনীহায় তখন ভণ্ডুলও হয়েছিল। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদ দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। জেনারেল সাদিক হাসান রুমীর নেতৃত্বাধীন ডিজিএফআই’র সঙ্গে তখন থেকে দেশি ও বিদেশি চারদলীয় জোট সরকারবিরোধীদের বিশেষ সম্পর্ক থাকার বিষয়টি দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তার সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
সাক্ষ্য প্রদানকালে মেজর জেনারেল (অব.) রুমী অন্তত দুটি তাত্পর্যপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। প্রথমত তিনি স্বীকার করেছেন যে মইন-মাসুদের ‘মাইনাস-টু’ প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। এ মাসের ১৮ তারিখে বিশেষ আদালতে জেনারেল রুমী বলেছেন, জেনারেল মইনের নির্দেশে ২০০৭ সালের ১৭ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গিয়ে তাকে দেশত্যাগের জন্য তিনি চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। দ্বিতীয়ত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সময় তিনি ডিজিএফআই’র আর এক বিতর্কিত কর্মকর্তা লে. কর্নেল সাইফ জোয়ারদারসহ যুক্তরাজ্যে ছিলেন। জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এক বানোয়াট চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেফতার করে ডিজিএফআই সদর দফতরে নিয়ে নির্যাতন করার বিষয়ে লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ, মেজর জেনারেল (অব.) আমিন, ব্রি. জে. (অব.) বারীর সঙ্গে এই লে. কর্নেল (অব.) সাইফ জোয়ারদারের বিরুদ্ধেও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সুতরাং, ক্যুদেতা সংঘটিত হওয়ার কালে জেনারেল রুমী এবং লে. কর্নেল সাইফের একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারটি কেবল কাকতালীয় হিসেবে মেনে নেয়া কষ্টকর। জেনারেল রুমী সম্পর্কে এক পুরনো ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়ে বেগম খালেদা জিয়া তখন ক্যান্টনমেন্টের বাসগৃহে বসবাস করছেন। এক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মইনুল রোডের বাড়ির বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম। যতদূর স্মরণে পড়ে শফিক রেহমান, মারুফ কামাল খান, শিমুল বিশ্বাস এবং আরও দুই-একজনও সেদিন উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় ভেতর থেকে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে যে লোকটি বেরিয়ে এলেন, তাকে দেখে রাগ সংবরণ করতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে বললাম, পাঁচ বছর ডিজিএফআই’র প্রধানের দায়িত্ব পালনের নামে নানারকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে এখানে আবার কোন সর্বনাশ সাধনের উদ্দেশ্যে এসেছেন? জেনারেল রুমী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বিব্রত মুখে মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিলেন।
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সেই রুমীকে আজ রাজসাক্ষীর ভূমিকায় দেখে আমি অন্তত আশ্চর্য হই না। আসলে, এক-এগারোর রহস্যের পুরোটা কোনোদিনই হয়তো জনগণের জানা হবে না। যাই হোক, ২০০৭ এর জানুয়ারি মাসের প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিবিদদের যোগাযোগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জানুয়ারির ৬ এবং ৭ তারিখে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে যথাক্রমে পিএসও জেনারেল জাহাঙ্গীর এবং সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেন। এরপর কানাডীয় হাইকমিশনার বারবারা রিচার্ডসনের বাসভবনে কূটনীতিকদের বৈঠক এবং জাতিসংঘের মহাসচিবের নামে ইউএনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা ডেসালিয়েনের বিতর্কিত পত্র প্রকাশের পটভূমিতে ১১ তারিখের ক্যুদেতা’র ঘটনা দেশবাসী জানেন। পরবর্তী বছরখানেকের মধ্যে ‘মাইনাস টু’ নানারকম কৌশল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘মাইনাস ওয়ান’-এ পরিণত হয়।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দীর্ঘ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে ইন্ডিয়া লবির সহায়তাক্রমে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতা সাপেক্ষে নির্বাচনের মাত্র তিন সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেই তাকে সম্ভবত নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল যে, তিনিই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। তার সেক্যুলার রাজনীতির প্রচারণা ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত ৯/১১ পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বে যথেষ্ট কাজে এসেছিল। নির্বাচনের একতরফা ফলাফল ঘোষণার পর তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেম্স্ মরিয়ার্টি এবং ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনীতিকবৃন্দ তাদের সন্তুষ্টি গোপন করেননি। কত তাড়াতাড়ি বিএনপি পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের ভাগ্য বরণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে চলেছে, কূটনীতিকমহলে তার চর্চা হতে থাকে। শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণ ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চরিত্র বুঝতে কূটনীতিকদের ভুল হয়েছিল। মহাজোট সরকারের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন করেও তারা ঠকেছেন। তথাকথিত জঙ্গিবাদ নিয়েও তাদের বিশ্লেষণে বড় রকম গলদ ছিল।
সর্বোপরি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী মনমানসিকতা তারা চিনতে পারেননি। সম্ভবত এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বিশদভাবে লেখাপড়া না করাতেই এই বিপত্তি হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জেনারেল খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল কারণ দেশপ্রেমিক সৈনিক-জনতা তাকে ভারতপন্থী সাব্যস্ত করেছিল। জেনারেল মইনের বিএনপি দখলের দুরাশা পূর্ণ না হওয়ার পেছনেও ভারত ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কমপক্ষে দশ বছর ক্ষমতায় থাকার অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে তিনি অবশেষে দেশান্তরী হয়েছেন। ভারতের সেনাপ্রধানের ছয় ঘোড়া উপহার তাকে জনরোষ থেকে ব+াঁচাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান জনবিচ্ছিন্নতার পেছনেও ভারতপ্রীতি অন্যতম কারণ। দিল্লির বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষের হাজার বছরের সংগ্রামের গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। বিএনপির ভারতপন্থীরাও সেই ইতিহাস ভুলে গেলে অন্যান্য দালালের মতোই মাশুল দেয়া থেকে মুক্তি পাবেন না।
এবার জঙ্গিবাদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা শেখ হাসিনার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মেয়াদকালেই আরম্ভ হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে যে গুটিকয় বাংলাদেশী নাগরিক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তারাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে ভ্রান্ত উগ্রবাদের বীজ বহন করে এনেছিলেন। জেএমবি, হুজি, ইত্যাকার সংগঠন আওয়ামী সরকারের মেয়াদকালেই জন্ম নিয়েছিল। একমাত্র বাংলাভাইয়ের উত্থানের জন্য বিএনপি সরকারকে দোষারোপ করা যেতে পারে। ২০০৫ সালে দেশব্যাপী বোমা বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়ায় ওইসব ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান আরম্ভ হলে মুফতি হান্নান, শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাই এবং তাদের সহযোগীরা গ্রেফতার হয়। জঙ্গিগোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য গ্রেফতার এড়াতে সপরিবারে আত্মাহুতিও দেন।
গ্রেফতারকৃতদের বিচার বিএনপি আমলেই সম্পন্ন হয় এবং মইন-ফখরুদ্দীন সরকার দ্রুততার সঙ্গে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড কার্যকর করে। অর্থাত্ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল, বেগম খালেদা জিয়া তার মেয়াদের মধ্যেই তাদেরকে দমন করতে সক্ষম হন।। এই সাফল্য সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিদের সহায়তা প্রদানের আওয়ামী প্রচারণাকে বিএনপি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি।
ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং ব্রাসেলসের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং সমর্থকবৃন্দ ওইসব রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং আইন প্রণেতাদের কাছে বিএনপিকে একটি পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলরূপে চিত্রিত করে। এসব কর্মকাণ্ডের বিপরীতে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতগণ (এদের মধ্যে অনেকেই এখন বেগম খালেদা জিয়ার প্রভাবশালী উপদেষ্টা) এবং বিএনপির নেতা-কর্মীরা যথাক্রমে সরকার ও দলের পক্ষে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতিতে আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করলে আওয়ামী লীগের প্রতি বিদেশি সমর্থকদের সন্তোষের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাদের কাছ থেকে বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ব্যাপক দুর্নীতি এবং ভিন্নমতের ওপর নির্যাতন চালানোর অলিখিত, একতরফা লাইসেন্স গ্রহণ করেন।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে। কী কারণে জানি না, ওয়াশিংটন এবং দিল্লির যৌথ সমর্থনে বলীয়ান শেখ হাসিনার মনে এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয় যে তার ২০২১ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকার স্বপ্ন পূরণে একমাত্র বাধা ড. ইউনূস। অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিতের মতো তিনিও হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে বেগম খালেদা জিয়া আর কখনও প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরূপে আবির্ভূত হতে পারবেন না। আত্মঘাতী ইউনূস বধ প্রকল্পই শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজকের এই বন্ধুহীন অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
এদিকে দেশের অভ্যন্তরে চার বছর মোটামুটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করলেও বিগত এক মাসে জামায়াত-শিবিরের প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি সরকারি নীতিনির্ধারকদের দৃশ্যত বিচলিত করে তুলেছে। এতদিন ধরে দলীয় লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ বেপরোয়া পুলিশ বাহিনী হঠাত্ করেই ময়দানে নিজ দলের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী লড়াকু তরুণদের মুখোমুখি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে দেখে হতচকিত হয়ে পড়েছে। আমাদের মতো রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে অধিকাংশেরই ধারণা ছিল, চার বছর ধরে একতরফা মার খেয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের মনোবল নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু, রাজনীতির মাঠের পরিস্থিতির এই দ্রুত, অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন সমাজের সব অংশকে বিস্মিত করেছে। ঘাবড়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে তাই জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার অগণতান্ত্রিক দাবি উঠেছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীও তার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের শরিয়া আইনে বিচারের হুমকি দিয়ে দেশবাসীকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর হুমকি এবং মহাজোটের সংসদ সদস্যদের জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি, উভয়ই বাস্তবতাবিবর্জিত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একটি দল। এ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে তারা সংবিধান থেকে আল্লাহ্র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস উঠিয়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনরায় আমদানি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং মহাজোটের সঙ্গী-সাথীরা যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন। শরিয়া আইন চালু করার হুমকি প্রধানমন্ত্রীর মনের কথা যে নয়, সেটা আওয়ামী নেতারাই সর্বাগ্রে কবুল করেছেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন জামায়াত এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দকে সম্ভব হলে বিনাবিচারে হত্যা করার অবচেতন মনের অসুস্থ আকাঙ্ক্ষাই প্রধানমন্ত্রীর শরিয়া আইন ও কিসাস সংক্রান্ত বেফাঁস মন্তব্যের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। কাজেই সে প্রসঙ্গ থাক। বরঞ্চ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবির প্রসঙ্গে আসি।
ভোটের হিসাবে দলটির সারাদেশে ৭-৮ শতাংশ সমর্থন আছে। অর্থাত্ জনসংখ্যার বিচারে জামায়াতে ইসলামী দলের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা এক কোটির ঊর্ধ্বে। এমন একটি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার অর্থ হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে অবধারিত জঙ্গিবাদের দিকে উত্সাহিত করা। বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কায় সর্বদা অস্থির পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মহাজোট সরকারের এ ধরনের হঠকারী উদ্যোগ প্রতিহত করতে এগিয়ে আসবে বলেই আমার ধারণা। এমনকি আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারতও এজাতীয় মনোভাবকে উত্সাহিত করবে বলে আমার মনে হয় না। খোদ ভারতেই বহু ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে। ক’দিন আগে মহারাষ্ট্রের উগ্র, সাম্প্রদায়িক নেতা বাল থ্যাকারে মৃত্যুবরণ করলে ভারতজুড়ে শোকের মাতম বয়ে গেছে। এমতাবস্থায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইস্যুতে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি কোনো বিবেচনাতেই ভারতের স্বার্থের অনুকূলে যেতে পারে না। এই বাস্তবতার আলোকেই বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতে ইসলাম এবং সরকারের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা নিরসনে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। যেহেতু হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করার পেছনে মার্কিনিদের সমর্থন ছিল তাই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেও সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে সরকারের এমন চিন্তা-ভাবনা ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনোক্রমেই বিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে না।
স্মরণে রাখা দরকার, আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামী দলই লাভবান হয়েছে। মিসরে ছয় দশকেরও অধিক সময় ধরে অব্যাহত সংগ্রামের পরিণতিতেই ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা ইসলামিক ব্রাদারহুড রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে। জামাল আবদেল নাসের থেকে হোসনি মোবারক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে এই ইসলামপন্থী দলটিকে মিসরে যে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে বিশ্বে তার তুলনা মেলা কঠিন। হাসান-আল-বান্না ও সৈয়দ কুতুবের মতো বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে হত্যা এবং ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। জয়নাব গাজ্জালীর মতো অসীম সাহসী নারী নেত্রীকে কারাগারে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সে তুলনায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী, ভ্রান্ত রাজনীতি অনুসরণ সত্ত্বেও বাংলাদেশে এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী তেমন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়নি। সেই মিসরে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র হোসনি মোবারকের ক্ষমতা থেকে অপসারণ মেনে নিতে পশ্চিমা দেশগুলো বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা উপলব্ধি করেছে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো পুতুল সরকারকে অনন্তকাল রক্ষা করা যায় না।
বাংলাদেশে বিগত চার বছরে সুশাসন শিকেয় তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে ভিন্নমত শায়েস্তার যে কৌশল ক্ষমতাসীনরা নিয়েছিল, তা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেই আঘাত করছে। সর্বব্যাপী অপশাসনের ফলে সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতাসীন মহলের এই চরম অজনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়েই জামায়াত-শিবির দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি না হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস অর্জন করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের জনগণ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সেই পাকিস্তান জামানা থেকেই সংগ্রাম করে চলেছে। কোনো অত্যাচারী স্বৈরশাসকই এ দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় স্থায়ী হতে পারেনি। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় বাকশাল শাসন মাত্র ছয় মাস টিকেছিল। জেনারেল এরশাদ আওয়ামী লীগের সহায়তাক্রমে নয় বছরের কাছাকাছি সময় রাষ্ট্রপতির পদ ধরে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। বৃদ্ধ বয়সে আবারও জেলে যাওয়ার ভয়ে পেন্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দোল খেয়ে সকাল-বিকাল ভিন্ন কথা বলছেন। বর্তমান সরকারের বৈধ মেয়াদ পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হবে। চতুর্থ সংশোধনীর মতো অগণতান্ত্রিক কোনো কৌশল প্রয়োগ করে শেখ হাসিনা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাইলে তার পরিণতি সবার জন্যই দুঃখবহ হতে বাধ্য। কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়ক শক্তি ব্যবহার করে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বপ্নও মরীচিকা হয়েই থাকবে। অতএব, জনসমর্থন পুরোপুরি হারিয়ে কেবল কোনো বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তাক্রমে ক্ষমতায় টিকে থাকার আকাশকুসুম কল্পনা পরিত্যাগ করাই ক্ষমতাসীনদের জন্য শ্রেয়। সরকারের যাবতীয় অপকর্মের বিরুদ্ধে জনগণ ক্রমেই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। তারা সামান্যতম সুযোগ পেলেই যে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করছে, ঘাটাইল উপনির্বাচন তার সর্বশেষ উদাহরণ।
অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের জনসভায় সাধারণ জনগণের ক্রমেই বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ এ দেশেও সঠিক নির্দেশনা পেলে গণবিপ্লবের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত সপ্তাহে দক্ষিণের বিভাগীয় সদর বরিশালের বিশাল জনসভা, শাসক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে যে উত্তাল সমুদ্রের রূপ পরিগ্রহ করেছিল সে সংবাদটি আশা করি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছে। দেয়ালের লিখন ঠিকমত পড়তে পারলে নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করা উচিত যে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবার এবং দলের মঙ্গল নিহিত রয়েছে। জনমত উপেক্ষা করে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা করায়ত্ত করার শিশুসুলভ জিদ ধরে বসে থাকলে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন