কাজী সিরাজ
গত ১১ জুন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণসমাবেশ বানচাল করতে লীগ সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ওরা গণতন্ত্রের কথা বলে! অথচ কি নির্লজ্জের মতো অপরের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে চলেছে অব্যাহতভাবে। আর এ গর্হিত অগণতান্ত্রিক কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'দলানুগত' একটা অংশকে ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় ক্যাডারের মতো। সমাবেশ পণ্ড করতে সরকারি বাহিনী কাজ শুরু করে কয়েক দিন আগে থেকেই_ শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, দেশজুড়ে। গণগ্রেফতারের মাধ্যমে এক সন্ত্রস্ত অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। কি ঢাকায়, কি ঢাকার বাইরে_ বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির পরিচিত কোনো মুখই ঘরে থাকতে পারেনি। পালিয়ে বেড়িয়েছে এখানে-ওখানে। গণগ্রেফতার থেকে সাধারণ মানুষও রেহাই পায়নি। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়ি তো বটেই। তাদের কর্মস্থল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় কার্যালয়েও পুলিশ বার বার হানা দিয়েছে বলে বিভিন্ন দৈনিকে খবর বেরিয়েছে। পথে পথে বাধাও সৃষ্টি করা হয়, যাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরা সমাবেশে যোগদান করতে না পারেন। ১২ জুন ২০১২-এর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, '... সমাবেশের আগের দিন রবিবার রাতে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর, নোয়াখালী, খাগড়াছড়িসহ দেশের অনেক এলাকায় ঢাকামুখী লঞ্চ, বাস ও অন্যান্য যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুলিশ। হাইওয়েগুলোতে বসানো হয় পাহারা। তল্লাশির নামে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ কার্যত সিল করে দেয় পুলিশ। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঢাকার হোটেলগুলো ছিল শূন্য। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের পর পুলিশকে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়।... রবিবার রাত থেকেই গাবতলী, সাভার, যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর, শীতলক্ষ্যা দ্বিতীয় ব্রিজ, শ্যামপুর, জুরাইন, বাবুবাজার, আবদুল্লাপুর, টঙ্গী, কমলাপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে যানবাহনে ব্যাপক তল্লাশি চালায় র্যাব ও পুলিশ।' কিন্তু এই নোংরা খেলায় সরকার আসলে হেরে গেছে। জেল, জুলুম, হয়রানি ও নানা ধরনের ভয়ভীতির পরও গণসমাবেশ হয়েছে বিশাল। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখা হয়েছে, ২টা ২০ মিনিটে সমাবেশ শুরু হওয়ার আগেই মতিঝিল শাপলা চত্বর, আরামবাগ, ফকিরাপুল মোড়, বিজয়নগর মোড়, কাকরাইল, মৎস্য ভবন, মৌচাক ও মালিবাগ মোড় পর্যন্ত অবস্থান নেয় ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী ও জনগণ। সরকারের মুখে এটাকে জনগণের একটা চপেটাঘাতই বলা যেতে পারে বলে মন্তব্য করছেন পর্যবেক্ষকরা। বিরোধী দলের ওপর জনগণের সমর্থন নেই_ দেশে-বিদেশে এই মিথ্যা ধারণা দেওয়ার জন্য সরকারের এ অপপ্রয়াস সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য শুভ বার্তা নয়। সরকারের জন্যও তা সুখকর হবে না। সরকার চক্রান্তমূলক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে সমাবেশে দ্বিগুণ লোক হতো। তাতে ওইদিনই সরকারের পতন হয়ে যেত না। কিন্তু বাধা দিয়ে সরকার, তার বিপদের পথটাই প্রশস্ত করেছে বলে মনে হয়। সমাবেশে যোগদান করতে না পারা মানুষের মুখে মুখে সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে ঘৃণার বারুদ ছড়িয়ে পড়েছে, এমন ঘৃণার বারুদেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিকভাবে ছাইভস্ম হয়েছে অনেক স্বৈরশাসক। মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব বসন্তের' ঘটনা তো বেশি দিনের পুরনো নয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংগঠন ও সভা-সমাবেশ, মিছিল করা নাগরিক সাধারণের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত বিষয়। আমাদের সংবিধানেও তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকার স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দুই মাস আগের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচিতেও সরকার একই নোংরা আচরণ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের আমলেও (১৯৯৬-২০০১) বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ কাঁচপুরে আটকে দিয়েছিল তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগ। আখেরে, পরবর্তী নির্বাচনে তার ফলাফল ভালো হয়নি। এ আচরণ আওয়ামী লীগের মধ্যে অতীতেও দেখা গেছে।
স্বাধীনতার পর পর দেশে তেমন শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল ছিল না। চিরবিদ্রোহী মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তেমন কোনো শক্তি ছিল না। জাসদ গড়ে উঠেছিল তারুণ্যের শক্তির ওপর নির্ভর করে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি শাসক দলের জন্য ত্রাস হিসেবে আবিভর্ূত হলেও জাতীয় কোনো ভিত্তি ছিল না। সারা দেশে জাসদই একটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠছিল। কিন্তু তাও বরদাশত করেনি আওয়ামী লীগ। অসম বিরোধী পক্ষের ওপর কি নির্মম আচরণ করা হয়েছিল তা এখন ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। পাতা উল্টালে তরুণ প্রজন্মও জেনে নিতে পারে বামপন্থি গেরিলা নেতা সিরাজ সিকদারসহ জাসদের অনেক নেতা-কর্মীর মর্মন্তুদ হত্যাকাহিনী। বিরোধী পক্ষকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী। ১৯৭৪ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কায়েম করা হয়েছিল একদলীয় বাকশালী শাসন। কিন্তু সাফল্য আসেনি তাতে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিপথে চালিত করেছিল বলে রাজনৈতিক মহলে এখনো গুঞ্জন আছে, তাদের কিছু না হলেও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার। ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ-এ 'শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে' শিরোনামে এক নিবন্ধে অমিত রায় লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্তা হলো শহরের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের সমর্থনই মুজিবকে নেতা বানিয়েছিল_ ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে মুজিব তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন এবং সেদিন থেকেই নিজেকে অতীতের পাতায় তুলে দিয়েছিলেন। সর্বব্যাপী গণঅসন্তোষ উপলব্ধি করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।... তার মেরুদণ্ডহীন সমর্থকরা তাকে বুঝিয়েছিল যে, অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশা, শিল্প-কারখানার অব্যবস্থা, অপরিমেয় মজুদদারি ও চোরাকারবার এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যাদি মুজিবী খ্যাতির মুখে কিছুই নয়।' কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তা মেলেনি। কোনো ব্যবস্থাই বাকশালী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কোনো রাজনৈতিক দলকে নয়, ভয় করেছিলেন জনগণকে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যারা পরামর্শক তারা তাকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন না। সঠিক পরামর্শ পেলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে বর্তমান অস্বাভাবিক সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি সৃষ্টি করতেন না। প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র, গণতন্ত্রের চাদর পরে স্বৈরাচারী আচরণ সম্পর্কে দেয়ালের লিখন কি প্রধানমন্ত্রী পড়তে পারছেন না।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচির মহাসমাবেশও হয়েছিল বিশাল। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারেনি তারা। কারণ আন্দোলনের গতি তারা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের ডাকা সমাবেশে এত লোক হয়, কিন্তু কোনো পজিটিভ রেজাল্ট আসছে না কেন, এমন প্রশ্ন উঠছে। এর জবাব বোধহয় এটাই হতে পারে যে, এসব সমাবেশে যে লোকসমাগম হয় তার একটি বড় অংশ সরকারবিরোধী, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের লোক নয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে এর থেকে অনেক কম লোক নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ একটা কর্মীনির্ভর দল বলে। বিএনপি কর্মীনির্ভর দল নয়, সমর্থকনির্ভর দল। সমর্থকদের একটি বড় অংশ আবার নেগেটিভ সমর্থক। আওয়ামী লীগ পছন্দ করে না, আবার নিজের আদর্শের শক্তিশালী কোনো দল নেই। তাই বিএনপির সমর্থক। আওয়ামী লীগেও তেমন সমর্থক (বিশেষ করে সাবেক মস্কোপন্থি কমিউনিস্টরা) আছে। সরকার বিএনপির এ দুর্বল দিকের সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। মঞ্চে-ময়দানে, চেয়ারে, সামনে যাদের দেখা যায় তাদের অধিকাংশের 'আমলনামা' ভালো নয়। একটা দুর্নীতিবাজ বা জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি মহৎ কাজ। মহৎ কাজের জন্য সৎ লোকের প্রয়োজন। যাদের হারানোর কোনো ভয় নেই, তারাই রাজনৈতিক আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনপির অধিকাংশ নেতা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, এমনকি শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলেও সাহস দেখিয়েছিলেন এ কথা সত্য। তখন তাদের পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সুতীব্র। এখন অর্থ-বিত্তের ভারে তারা নুইয়ে পড়েছেন। তাই সর্বদা হারানোর ভয়ে অস্থির। ঝুঁকি নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মাঠের লড়াইয়ের চেয়ে কারাগারের নিরাপদ ঠিকানায় তারা নিশ্চিন্ত। বলার আগেই তারা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়ার লোক। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারবিরোধী যেসব মানুষ বিএনপির ডাকা সভা-সমাবেশে আসেন তারা মঞ্চে যাদের দেখেন তাদের আস্থায় নিতে পারেন না, রীতিমতো ভয় পান। দলকে শুদ্ধ করে এসব 'চিজদের' হটিয়ে দুর্গন্ধমুক্ত লোকদের সামনে নিয়ে না এলে, বিএনপি কিছু করতে পারবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন না। বিএনপির বড় সমাবেশ দলটির সবলতা নয়, সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার স্মারক। সরকার জনগণের ভয়েই আতঙ্কিত। জনগণকে রুখার জন্যই খারাপ পন্থা অনুসরণ করছে। কিন্তু এ পথে গিয়ে পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসক 'নিশ্চিন্ত নিবাসে' প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দেশ-জাতির স্বার্থে নয়, স্রেফ ক্ষমতার কাঙালিপনা থেকেই দুই নেত্রী দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তাদের দুজনের ব্যাপারে জনগণের নেতিবাচক মনোভঙ্গির পরও কেউ কেউ দুই নেত্রীকে আলোচনা-সংলাপে বসানোর কথা বলছেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে সর্বজনমান্য কিছু ব্যক্তি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন। বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এ বি এম মূসা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. জহির ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সমঝোতা না হলে সংঘাত অনিবার্য। ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়ার দুই মাস পর 'যুদ্ধের' ঘোষণা তারই ইঙ্গিত করে।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, সরকারের অসাংবিধানিক স্বৈরাচারী আচরণ। প্রধানমন্ত্রী এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ যোগ করেছেন। হরতাল কার্যক্রমকে আইনের আওতায় আনার তার সর্বশেষ হুঁশিয়ারিতে কিন্তু ফ্যাসিবাদী মানসিকতার গন্ধ আছে। পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত যত হরতাল হয়েছে (১৯৯১-৯৬ আমলে আওয়ামী লীগ একাই করেছিল ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ) তাতে রাজপথে দলীয় লোকরা পিকেটিং না করে উচ্চাঙ্গসংগীত গেয়েছে কবে? হরতালে গাড়ি পোড়ানো, মানুষ মারা সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এখন এসব কাজ শুধু হরতাল অবরোধকারীরাই করে না, হরতালকারীদের ফাঁসানোর জন্য সরকারি লোকজনও তা করতে পারে বলে ধারণা জন্মাচ্ছে। যেমন_ গত হরতালে সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে বিরোধী জোটের প্রায় অর্ধশত নেতাকে মামলায় জড়ানোর বিষয়কে জনগণ 'বিশ্বাসের চোখে' দেখছে না। এমকে আনোয়ার, খোন্দকার মোশাররফ, মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, গয়েশ্বর রায়, কর্নেল (অব.) অলি প্রমুখ সত্তর প্লাস-মাইনাস বয়সের লোকগুলো কি এ ধরনের কাজ করতে পারেন? হয়রানি করার জন্যই এসব মামলা করা হয়েছে বলে বিরোধী দলের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণ ও সরকারি আচরণে আতঙ্কিত অভিজ্ঞজনরা ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী কি তার পিতার পথ ধরেই হাঁটছেন? সেই পথে গিয়ে একই মুদ্রার অপর পিঠ বর্তমান বিরোধী দলকে হয়তো ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে- কিন্তু ক্ষুব্ধ, দ্রোহী জনগণকে? জনগণ তো কখনো কারও পরাভব মানে না, পরাজিত হয় না। তেমন অবস্থায় সারা দেশে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা সামাল দেবে কে?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
গত ১১ জুন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের গণসমাবেশ বানচাল করতে লীগ সরকারের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ওরা গণতন্ত্রের কথা বলে! অথচ কি নির্লজ্জের মতো অপরের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে চলেছে অব্যাহতভাবে। আর এ গর্হিত অগণতান্ত্রিক কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'দলানুগত' একটা অংশকে ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় ক্যাডারের মতো। সমাবেশ পণ্ড করতে সরকারি বাহিনী কাজ শুরু করে কয়েক দিন আগে থেকেই_ শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, দেশজুড়ে। গণগ্রেফতারের মাধ্যমে এক সন্ত্রস্ত অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। কি ঢাকায়, কি ঢাকার বাইরে_ বিরোধী দলের বিশেষ করে বিএনপির পরিচিত কোনো মুখই ঘরে থাকতে পারেনি। পালিয়ে বেড়িয়েছে এখানে-ওখানে। গণগ্রেফতার থেকে সাধারণ মানুষও রেহাই পায়নি। বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়ি তো বটেই। তাদের কর্মস্থল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং দলীয় কার্যালয়েও পুলিশ বার বার হানা দিয়েছে বলে বিভিন্ন দৈনিকে খবর বেরিয়েছে। পথে পথে বাধাও সৃষ্টি করা হয়, যাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরা সমাবেশে যোগদান করতে না পারেন। ১২ জুন ২০১২-এর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, '... সমাবেশের আগের দিন রবিবার রাতে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, গাজীপুর, নোয়াখালী, খাগড়াছড়িসহ দেশের অনেক এলাকায় ঢাকামুখী লঞ্চ, বাস ও অন্যান্য যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পুলিশ। হাইওয়েগুলোতে বসানো হয় পাহারা। তল্লাশির নামে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথ কার্যত সিল করে দেয় পুলিশ। পুলিশের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঢাকার হোটেলগুলো ছিল শূন্য। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের পর পুলিশকে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়।... রবিবার রাত থেকেই গাবতলী, সাভার, যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুর, শীতলক্ষ্যা দ্বিতীয় ব্রিজ, শ্যামপুর, জুরাইন, বাবুবাজার, আবদুল্লাপুর, টঙ্গী, কমলাপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে যানবাহনে ব্যাপক তল্লাশি চালায় র্যাব ও পুলিশ।' কিন্তু এই নোংরা খেলায় সরকার আসলে হেরে গেছে। জেল, জুলুম, হয়রানি ও নানা ধরনের ভয়ভীতির পরও গণসমাবেশ হয়েছে বিশাল। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লেখা হয়েছে, ২টা ২০ মিনিটে সমাবেশ শুরু হওয়ার আগেই মতিঝিল শাপলা চত্বর, আরামবাগ, ফকিরাপুল মোড়, বিজয়নগর মোড়, কাকরাইল, মৎস্য ভবন, মৌচাক ও মালিবাগ মোড় পর্যন্ত অবস্থান নেয় ১৮ দলীয় জোটের নেতা-কর্মী ও জনগণ। সরকারের মুখে এটাকে জনগণের একটা চপেটাঘাতই বলা যেতে পারে বলে মন্তব্য করছেন পর্যবেক্ষকরা। বিরোধী দলের ওপর জনগণের সমর্থন নেই_ দেশে-বিদেশে এই মিথ্যা ধারণা দেওয়ার জন্য সরকারের এ অপপ্রয়াস সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য শুভ বার্তা নয়। সরকারের জন্যও তা সুখকর হবে না। সরকার চক্রান্তমূলক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করলে সমাবেশে দ্বিগুণ লোক হতো। তাতে ওইদিনই সরকারের পতন হয়ে যেত না। কিন্তু বাধা দিয়ে সরকার, তার বিপদের পথটাই প্রশস্ত করেছে বলে মনে হয়। সমাবেশে যোগদান করতে না পারা মানুষের মুখে মুখে সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে ঘৃণার বারুদ ছড়িয়ে পড়েছে, এমন ঘৃণার বারুদেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিকভাবে ছাইভস্ম হয়েছে অনেক স্বৈরশাসক। মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব বসন্তের' ঘটনা তো বেশি দিনের পুরনো নয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংগঠন ও সভা-সমাবেশ, মিছিল করা নাগরিক সাধারণের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত বিষয়। আমাদের সংবিধানেও তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সরকার স্পষ্টতই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দুই মাস আগের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচিতেও সরকার একই নোংরা আচরণ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের আমলেও (১৯৯৬-২০০১) বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চ কাঁচপুরে আটকে দিয়েছিল তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগ। আখেরে, পরবর্তী নির্বাচনে তার ফলাফল ভালো হয়নি। এ আচরণ আওয়ামী লীগের মধ্যে অতীতেও দেখা গেছে।
স্বাধীনতার পর পর দেশে তেমন শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল ছিল না। চিরবিদ্রোহী মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তেমন কোনো শক্তি ছিল না। জাসদ গড়ে উঠেছিল তারুণ্যের শক্তির ওপর নির্ভর করে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি শাসক দলের জন্য ত্রাস হিসেবে আবিভর্ূত হলেও জাতীয় কোনো ভিত্তি ছিল না। সারা দেশে জাসদই একটি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠছিল। কিন্তু তাও বরদাশত করেনি আওয়ামী লীগ। অসম বিরোধী পক্ষের ওপর কি নির্মম আচরণ করা হয়েছিল তা এখন ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। পাতা উল্টালে তরুণ প্রজন্মও জেনে নিতে পারে বামপন্থি গেরিলা নেতা সিরাজ সিকদারসহ জাসদের অনেক নেতা-কর্মীর মর্মন্তুদ হত্যাকাহিনী। বিরোধী পক্ষকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী। ১৯৭৪ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে কায়েম করা হয়েছিল একদলীয় বাকশালী শাসন। কিন্তু সাফল্য আসেনি তাতে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিপথে চালিত করেছিল বলে রাজনৈতিক মহলে এখনো গুঞ্জন আছে, তাদের কিছু না হলেও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার। ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফ-এ 'শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে' শিরোনামে এক নিবন্ধে অমিত রায় লিখেছিলেন, 'বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্তা হলো শহরের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এদের সমর্থনই মুজিবকে নেতা বানিয়েছিল_ ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু শাসনতন্ত্র সংশোধনের ফলে মুজিব তাদের সমর্থন হারিয়ে ফেলেন এবং সেদিন থেকেই নিজেকে অতীতের পাতায় তুলে দিয়েছিলেন। সর্বব্যাপী গণঅসন্তোষ উপলব্ধি করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।... তার মেরুদণ্ডহীন সমর্থকরা তাকে বুঝিয়েছিল যে, অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশা, শিল্প-কারখানার অব্যবস্থা, অপরিমেয় মজুদদারি ও চোরাকারবার এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যাদি মুজিবী খ্যাতির মুখে কিছুই নয়।' কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে তা মেলেনি। কোনো ব্যবস্থাই বাকশালী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু কোনো রাজনৈতিক দলকে নয়, ভয় করেছিলেন জনগণকে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যারা পরামর্শক তারা তাকে সঠিক পরামর্শ দিচ্ছেন না। সঠিক পরামর্শ পেলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে বর্তমান অস্বাভাবিক সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি তিনি সৃষ্টি করতেন না। প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র, গণতন্ত্রের চাদর পরে স্বৈরাচারী আচরণ সম্পর্কে দেয়ালের লিখন কি প্রধানমন্ত্রী পড়তে পারছেন না।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের 'ঢাকা চলো' কর্মসূচির মহাসমাবেশও হয়েছিল বিশাল। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারেনি তারা। কারণ আন্দোলনের গতি তারা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের ডাকা সমাবেশে এত লোক হয়, কিন্তু কোনো পজিটিভ রেজাল্ট আসছে না কেন, এমন প্রশ্ন উঠছে। এর জবাব বোধহয় এটাই হতে পারে যে, এসব সমাবেশে যে লোকসমাগম হয় তার একটি বড় অংশ সরকারবিরোধী, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের লোক নয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে এর থেকে অনেক কম লোক নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল আওয়ামী লীগ একটা কর্মীনির্ভর দল বলে। বিএনপি কর্মীনির্ভর দল নয়, সমর্থকনির্ভর দল। সমর্থকদের একটি বড় অংশ আবার নেগেটিভ সমর্থক। আওয়ামী লীগ পছন্দ করে না, আবার নিজের আদর্শের শক্তিশালী কোনো দল নেই। তাই বিএনপির সমর্থক। আওয়ামী লীগেও তেমন সমর্থক (বিশেষ করে সাবেক মস্কোপন্থি কমিউনিস্টরা) আছে। সরকার বিএনপির এ দুর্বল দিকের সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। মঞ্চে-ময়দানে, চেয়ারে, সামনে যাদের দেখা যায় তাদের অধিকাংশের 'আমলনামা' ভালো নয়। একটা দুর্নীতিবাজ বা জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই দেশ ও জনগণের স্বার্থে একটি মহৎ কাজ। মহৎ কাজের জন্য সৎ লোকের প্রয়োজন। যাদের হারানোর কোনো ভয় নেই, তারাই রাজনৈতিক আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনপির অধিকাংশ নেতা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, এমনকি শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলেও সাহস দেখিয়েছিলেন এ কথা সত্য। তখন তাদের পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল সুতীব্র। এখন অর্থ-বিত্তের ভারে তারা নুইয়ে পড়েছেন। তাই সর্বদা হারানোর ভয়ে অস্থির। ঝুঁকি নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মাঠের লড়াইয়ের চেয়ে কারাগারের নিরাপদ ঠিকানায় তারা নিশ্চিন্ত। বলার আগেই তারা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়ার লোক। পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারবিরোধী যেসব মানুষ বিএনপির ডাকা সভা-সমাবেশে আসেন তারা মঞ্চে যাদের দেখেন তাদের আস্থায় নিতে পারেন না, রীতিমতো ভয় পান। দলকে শুদ্ধ করে এসব 'চিজদের' হটিয়ে দুর্গন্ধমুক্ত লোকদের সামনে নিয়ে না এলে, বিএনপি কিছু করতে পারবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন না। বিএনপির বড় সমাবেশ দলটির সবলতা নয়, সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতার স্মারক। সরকার জনগণের ভয়েই আতঙ্কিত। জনগণকে রুখার জন্যই খারাপ পন্থা অনুসরণ করছে। কিন্তু এ পথে গিয়ে পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসক 'নিশ্চিন্ত নিবাসে' প্রত্যাবর্তন করতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, দেশ-জাতির স্বার্থে নয়, স্রেফ ক্ষমতার কাঙালিপনা থেকেই দুই নেত্রী দেশকে একটি অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তাদের দুজনের ব্যাপারে জনগণের নেতিবাচক মনোভঙ্গির পরও কেউ কেউ দুই নেত্রীকে আলোচনা-সংলাপে বসানোর কথা বলছেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে সর্বজনমান্য কিছু ব্যক্তি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে পারেন। বিচারপতি সাহাবউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এ বি এম মূসা, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. জহির ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সমঝোতা না হলে সংঘাত অনিবার্য। ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়ার দুই মাস পর 'যুদ্ধের' ঘোষণা তারই ইঙ্গিত করে।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, সরকারের অসাংবিধানিক স্বৈরাচারী আচরণ। প্রধানমন্ত্রী এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ যোগ করেছেন। হরতাল কার্যক্রমকে আইনের আওতায় আনার তার সর্বশেষ হুঁশিয়ারিতে কিন্তু ফ্যাসিবাদী মানসিকতার গন্ধ আছে। পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত যত হরতাল হয়েছে (১৯৯১-৯৬ আমলে আওয়ামী লীগ একাই করেছিল ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ) তাতে রাজপথে দলীয় লোকরা পিকেটিং না করে উচ্চাঙ্গসংগীত গেয়েছে কবে? হরতালে গাড়ি পোড়ানো, মানুষ মারা সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এখন এসব কাজ শুধু হরতাল অবরোধকারীরাই করে না, হরতালকারীদের ফাঁসানোর জন্য সরকারি লোকজনও তা করতে পারে বলে ধারণা জন্মাচ্ছে। যেমন_ গত হরতালে সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে বিরোধী জোটের প্রায় অর্ধশত নেতাকে মামলায় জড়ানোর বিষয়কে জনগণ 'বিশ্বাসের চোখে' দেখছে না। এমকে আনোয়ার, খোন্দকার মোশাররফ, মির্জা ফখরুল, মির্জা আব্বাস, সাদেক হোসেন খোকা, গয়েশ্বর রায়, কর্নেল (অব.) অলি প্রমুখ সত্তর প্লাস-মাইনাস বয়সের লোকগুলো কি এ ধরনের কাজ করতে পারেন? হয়রানি করার জন্যই এসব মামলা করা হয়েছে বলে বিরোধী দলের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণ ও সরকারি আচরণে আতঙ্কিত অভিজ্ঞজনরা ভাবছেন, প্রধানমন্ত্রী কি তার পিতার পথ ধরেই হাঁটছেন? সেই পথে গিয়ে একই মুদ্রার অপর পিঠ বর্তমান বিরোধী দলকে হয়তো ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে- কিন্তু ক্ষুব্ধ, দ্রোহী জনগণকে? জনগণ তো কখনো কারও পরাভব মানে না, পরাজিত হয় না। তেমন অবস্থায় সারা দেশে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা সামাল দেবে কে?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
ই-মেইল : kazi.shiraz@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন