রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই



ইফতেখার আহমেদ টিপু :
 রাজধানীর বায়ুদূষণ অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করতে চলেছে। তথ্যমতে, গত চার মাসে ঢাকা মহানগরীতে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটেছে তা গত চার বছরের যে কোনো একটি বছরের চেয়ে বেশি। সোজা কথায়, গত চার বছরের যে কোনো সময়ের তুলনায় বায়ুদূষণ অন্তত তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুদূষণে শুধু মানুষই নয়, মহানগরীর জীববৈচিত্র্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রাখছে। অন্যান্য প্রাণী এমনকি গাছগাছালির ওপরও রাখছে বিরূপ প্রভাব। বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও পরিবেশ অধিদফতরের মান অনুযায়ী গড়ে আট ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ হাজার মাইক্রোগ্রাম কার্বন মনোঅক্সাইড, ১০০ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, এক দশমিক ৫৭ মাইক্রোগ্রাম ওজোন এবং গড়ে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৫ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস থাকলে তা হবে পরিবেশের জন্য সহনীয়। অথচ চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- শুধু এই চার মাসে রাজধানীর বাতাসে যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তা ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের একেকটি বছরের মোট বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকার বাতাসে এ চার মাসে গড়ে আট ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৩ হাজার ৫৭৪ মাইক্রোগ্রাম কার্বন মনোক্সাইড, ৭৮৫ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ৩৬৮ মাইক্রোগ্রাম ওজোন এবং গড়ে ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটারে ৯১২ মাইক্রোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও পানিদূষণ প্রতিদিনই ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতর রূপ নিচ্ছে। বেহাল প্রতিবেশের নানা লক্ষণ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে জনজীবনের নানা স্তরে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ২৫ শতাংশ প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্ত হতে পারে। শিল্পায়নের মধ্যে দিয়ে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই; কিন্তু শিল্পের বর্জ্য পরিবেশ, উৎপাদিত ফসল, মৎস্য ও মানুষের জীবনের জন্য ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গা নদীকে রাজধানী ঢাকার প্রাণ বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এ নদীর দু'পাশে গড়ে উঠেছে ট্যানারি, সাবান ফ্যাক্টরি, লবণ ফ্যাক্টরি, ডাইং প্রিন্টিং মিল, তেল শোধনাগার প্রভৃতি। এগুলো থেকে প্রতিদিন নির্গত হয় বর্জ্য। এই বর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে বিষাক্ত করে তুলেছে। অতিমাত্রায় দূষণপ্রক্রিয়ার ফলে বুড়িগঙ্গার পানির রং বিবর্ণ হয়ে গেছে। প্রচন্ড দুর্গন্ধ এই পানিতে।
নিম্নভূমি ও জলাভূমি ভরাট করে একের পর এক কংক্রিটের ভবন ও পিচঢালা পথ নির্মাণের ফলে শহরে তাপমাত্রাও বাড়ছে। জলাশয় কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতও কমছে। জলাভূমি ভরাট হয়ে শহর থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পানি নিষ্কাশন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বাড্ডা, খিলক্ষেত, রামপুরা, দক্ষিণ ও উত্তরখানের বেশিরভাগ এলাকা একসময় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল ছিল। গত এক যুগে এই জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। এক যুগে নগরায়ণ ও উন্নয়নের নামে এলাকাগুলো ধূসর এলাকায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি নদীকে আবার তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীকে সারা বছরই বহমান রাখার দরকার। উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে যেন কোন নদীরও মৃত্যু না হয় সে বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য।
ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ইটখোলায় জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের কয়লার ব্যবহার, কলকারখানায় প্রতিরোধক ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে রাজধানীতে বিষাক্ত গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন গাড়ির প্রাধান্য বায়ুদূষণের কারণ ঘটাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারাবিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ  ব্যাপকহারে বাড়ছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্তদের সংখ্যাও। বিশেষ করে চীন এবং ভারতে এই ধরনের রোগাক্রান্তদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
বায়ুদূষণের ফলশ্রুতিতে শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট। চর্মরোগ ও ত্বকের ক্যান্সারও বিস্তৃত হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। রক্তের হিমোগ্লোবিন হ্রাস পাওয়ায় বাড়ছে রোগবালাইয়ের ঘটনা। বিশেষত শিশুরা এক্ষেত্রে ক্ষতির শিকার হচ্ছে বেশি। বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীতে অ্যালার্জি ও অ্যাজমার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কম নয়। জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে বায়ুদূষণ বন্ধে সরকারের তৎপর ভূমিকা কাম্য। বায়ুদূষণের ঝুঁকি কমাতে যানজট অবসানে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। রাজধানীর সর্বত্র আরও বেশি গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃশোধিত করার ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। রাজধানী ঢাকা যেসব কারণে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বায়ুদূষণ তার মধ্যে অন্যতম। অস্তিত্বের স্বার্থে এ সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হতে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন