রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনের বরাদ্দ যথেষ্ট নয়



 আলী ইদিরস 
২ ০১২-২০১৩ সালের বাজেটের কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে ১,৯১,৭৩৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তাতে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় একটি বৃহত্ বাজেট পাওয়া গিয়েছে কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা মেটেনি। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের  চতুর্থ বাজেটটির গুরুত্ব অপরিসীম, একইসাথে বিরাজমান অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মেটানোর প্রচেষ্টা ক্ষমতাসীন দলের ভবিষ্যত্ ভাগ্য নির্ধারণ করবে। সাধারণ জনগণ অর্থাত্ কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, রিক্সাওয়ালা, ফেরিওয়ালা বাজেট বুঝে না, বরং বাজেটের নামে দ্রব্যমূল্যের একদফা বৃদ্ধির আতংকে আতংকিত থাকে।  ২০১২-১৩ সালের বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে অনেক প্রস্তাব করা হলেও আরও করা যেতো,   এখন  দক্ষতার সাথে এবং দুর্নীতিহীনভাবে  এর বাস্তবায়ন করা জরুরী।
দারিদ্র্য বিমোচনের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে  সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বর্ধিত করা হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তির অবসানে নতুন বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মাতৃত্বকালীন ভাতা ৪২.৫ কোটি,  বয়স্ক ভাতা ৮৯১ কোটি, মুক্তিযোদ্ধা ৩৬০ কোটি, বিধবা/স্বামী-পরিত্যক্তা ভাতা ৩৩১ কোটি , হিজরা ১৪ কোটি, এতিম শিশু ২৮.৫ কোটি, একটি বাড়ি একটি খামার  ৬৫০ কোটি, অতি দরিদ্রদের কর্ম সংস্থান ১২০০ কোটি  টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং সুবিধাভোগীদের সংখ্যা  হয়েছে। এসব খাতে মোট বরাদ্দ ২২,৭৫০ কোটি টাকা  যা মোট বাজেটের ১১.৮৬ শতাংশ।  দারিদ্র্য হ্রাসের লক্ষ্যে এসব বরাদ্দ প্রশংসনীয়, কিন্তু প্রকৃত সুবিধাভোগীদের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছার পূর্বেই দুর্নীতির কবলে একাংশ বেহাত হয়ে যায়। এ সব নগদ সহায়তা বিতরণের  দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেটে প্রস্তাব নেই । এ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীদের  পূর্ব তালিকা  তৈরি করে  স্থানীয় প্রশাসন ও কোন এন জি ও দ্বারা প্রত্যয়ন করে ব্যাংক হিসাব খোলার  পর বিতরণ করলে হয়তো দুর্নীতি  পরিহার করা যেতো । ভি জি এফ, বি জি ডি কার্ড, কাবিখা  , এ সমস্ত  পদক্ষেপগুলোও দারিদ্র্য দূর করবে কিন্তু  সেখানেও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির  পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে করমুক্ত  আয়ের সীমা বাড়ানো  উচিত ছিল। তাতে ধনী-দরিদ্র সবাই উপকৃত হতো, কিন্তু  দরিদ্রের সংখ্যা অধিক বলে তারাই বেশি  উপকৃত হতো। মোবাইল ফোনের বিলের উপর  করারোপ করাতে দরিদ্ররা বেশি  ক্ষতিগ্রস্ত  হবে । ঢালাওভাবে  করারোপ না করে  দরিদ্রদের  বাঁচানোর জন্য  বিলের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া যেতো। যেমন মাসিক ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত বিল করমুক্ত  রেখে বাকি  অংকের উপর করারোপ করা যেতো। তেমনি টিন নম্বর না দিলে অর্জিত মুনাফার ওপর  ব্যাংক  অতিরিক্ত ৫% কর  কেটে রাখার  প্রস্তাবটি  দরিদ্রদের  ও নিম্নবিত্তের  সঞ্চয়ে নিরুত্সাহিত করবে। ঢালাওভাবে এটা না করে  একটি নির্দিষ্ট সীমা যেমন বছওে  ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত  করমুক্ত রেখে বাকি অংকের ওপর  করারোপ করা যেতো। ন্যূনতম করের  সীমা ৫০% বাড়িয়ে দিয়ে  নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ঘাড়ে করের বোঝা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ  ধনীদের  প্রত্যক্ষ করের  হার একই রাখা হয়েছে। একমাত্র  প্রত্যক্ষ  করের বোঝাই সাধারণ মানুষের  ওপর  প্রভাব ফেলে না। তাই  প্রত্যক্ষ করের  হার  ওপরের দিকে  বাড়ানো প্রয়োজন। তাতে  রাজস্ব আহরণের  পরিমাণ বাড়বে  ও বাজেট ঘাটতি কমবে।
মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। মূল্যস্ফীতি হতদরিদ্রের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ। সাধারণ জনগণের নিকট মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক দূর করার মতো প্রস্তাবনা ও বাস্তব বরাদ্দ বাজেটে নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ঘাটতি বাজেট কাম্য নয়। ৫৫,০০০ কোটি টাকার ঘাটতি মিটাতে সরকারকে হয় বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে অথবা অভ্যন্তরীণ উত্স অর্থাত্ ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে ঋণ নিতে হবে। এ ঋণের উপর সুদ একটি বাড়তি খরচ। তাছাড়া ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে। তাতে উত্পাদন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- চাল, ডাল, তেল, চিনি  এসবের  দাম যাতে না বাড়ে সেজন্য  ভর্তুকি আরও বাড়ানোর এবং গুদামে প্রয়োজনমত মজুত রাখার এবং সময়মতো মজুত খাদ্য বাজারে বিক্রি করে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাবনা ও বরাদ্দ বাজেটে নেই ।
এ দেশে এখনও কৃষি প্রধান দেশ। বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি কর্মক্ষম এবং তাদের উপর নির্ভরশীল ৯ কোটি লোক সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত। এখনও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারিনি এবং চাল, ডাল, পিঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এখনও কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি, হাইব্রিড বীজ, ন্যায্য দামে সার, কীটনাশক এবং সেচ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ১৫ কোটি মানুষের খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে যেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দেয়। কৃষি জমির পরিমাণ প্রতি বছর ১% কমে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। এ জন্য দেশে হাইব্রিড ফসল, খরা ও বন্যাসহিষ্ণু ধান, বছরব্যাপী ফলন দেয় এমন সবজি, ফল ও মসলার আবাদ প্রচলন করতে হবে। বাজেটে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য স্পষ্ট বরাদ্দ নেই।
 শিক্ষাখাতে সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, শিক্ষা বিভাগের দুর্নীতি শিক্ষার মান ও অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়।  দুর্নীতি যাতে না হয় সে ব্যবস্থার জন্য বাজেটে কোন প্রস্তাব নেই। এমপিওভুক্তি, শিক্ষা-বৃত্তি বিতরণ, বিনামূল্যে বই বিতরণ, দরিদ্র শিক্ষার্থীদেরকে খাদ্য প্রদান, বিনা বেতনে শিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি পদক্ষেপে আরও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত ছিল। দারিদ্র্য দূর করতে হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলা অপরিহার্য। দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারে না, কাজেই রাষ্ট্রকেই শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। এসএসসি পর্যন্ত বিনা খরচে প্রত্যেকটি ছেলে-মেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দেয়া উচিত। বাজেটে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ফাউন্ডেশন গ্রামেগঞ্জে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি দিতে পারবে না।
৫৫,০০০ কোটি টাকার এডিপি বরাদ্দ থাকলেও তার কত ভাগ বাস্তবায়িত হবে এর উপর নির্ভর করে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন। বিশেষ করে গ্রামেগঞ্জের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কৃষি, শিক্ষা ও যাতায়াত অবকাঠামো গড়ে উঠবে, তাতে পল্লী গ্রামের কর্মকাণ্ড বাড়বে এবং দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। এডিপিতে পর্যটন খাতে অবকাঠমো নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রেখে সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে অনেক রাজস্ব আহরণ করা যেতো।
দারিদ্র্য এ দেশের অভিশাপ । বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচনের  পদক্ষেপসমূহ আরও স্পষ্ট ও জোড়ালো হওয়া উচিত।
লেখক: এফ,সি,এ ও
কথাসাহিত্যিক
aliidris446@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন