ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
আ বার রোহিঙ্গা সমস্যায় আক্রান্ত দেশ। দুর্ভাগা রোহিঙ্গারা জাতিগত দাঙ্গায় জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে। বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সবরকম মানবিক সমর্থন প্রকাশ করেও বলবো এই অবস্থায় জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নটি সবার উপরে স্থান দিতে হবে। ইতোমধ্যে সরকারি বক্তব্য, বিদেশি চাপ, বিশিষ্ট নাগরিকদের বিবৃতি এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের মন্তব্য একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে বিদেশি চাপের বিষয়টি বাদ দিলে বাকি তিনপক্ষ স্বদেশি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বিষয়টি আমাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়। এর সাথে রয়েছে সার্বভৗৈমত্ব ও রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রসঙ্গ। এরপর যুক্ত হবে মানবিকতার বিষয়টি। রোহিঙ্গা ইস্যুটি এমন নয় যে এর সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। সুতরাং প্রথাগতভাবে এ প্রসঙ্গে দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা এ খুব যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে তো বদভ্যাস রয়েছে, ভালো হোক মন্দ হোক, যুক্তি থাক বা না থাক পরস্পরকে সমালোচনা (নাকি নিন্দা!) করতেই হবে। গত ১৫ জুন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একটি সত্য প্রকাশ করেছেন। প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সভায় তিনি বলেছেন ‘রাজনীতিবিদরা পরস্পরকে বিশ্বাস করেন না’। এই অমোঘ সত্যটি দেশবাসী বিশ্বাস করলেও একজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের মুখে শুনে স্বস্তি পেলাম। মনে হলো সক্রেটিসের আত্মা এই ভেবে শান্তি পাবে যে বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ‘নিজেকে জানার’ কঠিন কাজটি করতে পেরেছেন। কিন্তু এই মহান দার্শনিকের পরবর্তী প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা কি এ দেশের রাজনীতি অঞ্চলের সমালোচক নন—নিন্দুক ঝগড়াটে মানুষেরা পূরণ করতে পারবেন?
রোহিঙ্গা প্রশ্নের মত একটি অরাজনৈতিক ইস্যুতেই তো দুই মেরু থেকে দোষারোপ শুরু হয়েছে। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় দেয়ার পেছনে যেমন মানবিক আবেদন রয়েছে একইভাবে এই সূত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতায় এবং বাস্তবতার নিরিখে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নটিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ফলে এই সঙ্কটাপূর্ণ সময়ে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের উচিত দড়ি টানাটানির বদভ্যাস থেকে বেরিয়ে সকল পক্ষকেই করণীয় নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছার পদক্ষেপ নেয়া। পত্রিকার রিপোর্টে দেখা গেল কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক মানবিকতার কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছেন। তাদের এই যথার্থ অনুরোধের পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে যদি পরামর্শ থাকতো তবে আমাদের আরো ভালো লাগতো। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সরকারকে মানবিক দৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আহবান জানিয়েছেন। তিনি মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সরকারের আশ্রয় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
সরকার কোন্ দুশ্চিন্তায় মানবিকতা প্রদর্শন করতে পারছে না? রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। পাশাপাশি দু দেশ থাকলে নানা সংকটে—সুবিধায় আইনী বা বেআইনীভাবে কিছু অভিবাসন পৃথিবীর সর্বত্রই হয়ে থাকে। তবে ১৯৯১-এ আরাকানে জাতিগত দাঙ্গায় জীবন বাঁচাতে অনেক রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে অভিবাসন করতে বাধ্য হয়। তত্কালীন সরকারের কাছে এটি নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। চরিত্রগতভাবে মানবিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আশ্রয়দানের পক্ষে সরকার সমর্থনও পেয়েছিল। সহযোগিতার জন্য পাশে দাঁড়িয়েছিল জাতিসংঘ।
এর পরের অভিজ্ঞতা মধুর নয়। কাগজপত্রে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা ২৮ হাজার। সংবাদপত্রের ভাষ্যে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের সংখ্যা এখন ৪ থেকে ৫ লাখ। এদের নিয়ে নানা সংকটে পড়ছে দেশ। কক্সবাজার অঞ্চলে নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। আর এই অসম্ভব দুর্নীতির দেশে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হয়ে রীতিমত এ দেশের নাগরিক হয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে পাড়ি দিচ্ছে। সেসব জায়গায় নানা অপরাধের সাথে এদের জড়িয়ে পড়ার খবর প্রায়ই কাগজে ছাপা হয়। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। প্রত্যক্ষ প্রকট সংকট এখন বেআইনীভাবে বসবাস করা লাখ লাখ রোহিঙ্গা আবাসন ও কর্মসংস্থান নিয়ে। কক্সবাজার জেলায় বিশেষ করে উখিয়া, টেকনাফ উপজেলার স্থানীয় অধিবাসীরা এই রোহিঙ্গাদের কারণে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘ সহায়তা করলেও কাগজপত্রের বাইরে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জাতীয় অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সীমান্তবর্তী একটি দেশে যখন কোনো সম্প্রদায়ের জাতিগত সংকট বা অর্থনৈতিক দুর্দশা থাকে তখন তারা নিরাপত্তা ও সুবিধার আশায় প্রতিবেশী দেশের দিকে নৌকায় পাল খাটাতেই পারে। এ কয় বছরে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পেছনে বর্তমান সময়ের মত দৃশ্যমান জাতিগত দাঙ্গার বিষয়টি ছিল না। এই চাপ বাংলাদেশের মত একটি দেশের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বিগত বিএনপি আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই অবৈধ অভিবাসন রোধ করার ব্যাপারে মায়ানমার সরকারের সাথে সফল কূটনৈতিক মীমাংশায় যেতে পারেনি। অথবা এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে আরেকটি বিষয়ও এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সম্ভবত এবারে রোহিঙ্গা আশ্রয় না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অনড় থাকার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে। তা হচ্ছে এদেশের চলমান রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। যেহেতু দেশপ্রেমের চেয়ে ক্ষমতাপ্রেম এ দেশের অধিকাংশ রাজনীতিকদের আরাধ্য তাই দেশের কলজেতে ছুরি চালিয়ে হলেও সোনার হরিণ তাদের চাই-ই। তার আলামত অনেকদিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে মৌলবাদী নানা দল রোহিঙ্গাদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে চাইছে। গত ১৬ জুনে প্রকাশিত এক জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানা যায় উখিয়া উপজেলায় মায়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে দুই জামায়াত নেতার পরিচালিত স্কুলে অভিবাসী রোহিঙ্গা শিশুদের ভর্তি করা হয়েছে। এসব শিশুদের জন্ম নিবন্ধিত হয়েছে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। এখন মায়ানমার সরকার অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশের মৌলবাদী দল জামায়াতি ইসলামী রোহিঙ্গাদের জঙ্গি ট্রেনিং দিয়ে মায়ানমারে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য পাঠাচ্ছে। একটি দেশের পক্ষ থেকে অন্য দেশের প্রতি এক মারাত্মক অভিযোগ।
এসব অভিযোগের সূত্রে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত থাকে। তাই কোনোভাবেই এসব প্রশ্ন বা অভিযোগকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমনি তার বক্তব্যে এ প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যথারীতি এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন। বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থাকতে পারে। তবে বন্ধুর নানা অন্তর্ঘাতমূলক তত্পরতার সহযোগী না হলে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হলেও বিষয়টি তলিয়ে না দেখে বিএনপি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়নি।
জাতিসংঘসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবিক কারণে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। নিজের নানা সংকটের পেছনে হাজারটা যুক্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে অনড় থাকা বাংলাদেশের মত দেশের পক্ষে সহজ হবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ নিজ স্বার্থের কথা ভেবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যতটা শক্ত ভূমিকাই নিক না কেন জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা বিপন্ন মানুষদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াকে এ দেশের মানুষ সমর্থন করবে না। বিপদাপন্ন মানুষকে রক্ষা করা প্রথম কর্তব্য। যেহেতু পরবর্তী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ও রাষ্ট্রের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে তাই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েই আশ্রয় দিতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও তৈরি করতে হবে জনমত। মায়ানমার সরকারের উপরও চাপ সৃষ্টি করতে হবে। আশ্রয় দেয়া মানুষদের কঠোর পর্যবেক্ষণে রেখে অবস্থা শান্ত হয়ে এলে যাতে কাল বিলম্ব না করেই সকলকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো যায় সে ব্যবস্থা পাকা করতে হবে।
তবে এসব আপাত জটিল কাজ সরকারের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। একে সম্ভব করতে হলে দেশপ্রেমিক সকল মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। দেশের স্বার্থের প্রশ্নটি সবার উপরে রেখে মানবিক আবেদনটিকেও খাটো করে দেখা যাবে না। এই একটি প্রশ্নে আমাদের ভিন্ন মেরুতে থাকা রাজনীতিকরা যদি নিজেদের ভেতর দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলতে পারেন তবে একমঞ্চে বসা সম্ভব। ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা যে মাঝে মাঝে ‘দলের চেয়ে দেশ বড়’ ধরনের কথা বলে জনগণের সামনে কৌতুকের করুণ রস সরবরাহ করেন এবার অন্তত তা বাস্তবের অলিন্দে নামিয়ে আনুন। দেশের স্বার্থ রক্ষা ও দেশের মানুষের সম্মান এবং মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব দল নির্বিশেষে সকলের সমান।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন