সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

রাজনীতির নীতি


 মাহমুদুল বাসার  

বাংলা গদ্যের অন্যতম স্থপতি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বসন্তের কোকিল’ এবং ‘বিড়াল’ নামে দুটো সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। সমাজের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী, ভদ্রলোকদের চরিত্র বিশ্লেষণে বঙ্কিম এ প্রবন্ধদ্বয়ে ক্ষুরধার শক্তির পরিচয় দিয়েছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র ঊনিশ শতকের প্রথম দিককার প্রতিভাবান বাঙালি। বাঙালিদের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট এবং তিনি ইংরেজ সরকারের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। যদিও তার জীবদ্দশায় ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবুও তখনো ভারতের বাঙালি সমাজে রাজনীতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েনি। বঙ্কিম ছিলেন পূর্ণমাত্রায় ইতিহাস সচেতন। ইউরোপের ইতিহাস এবং ভারতবর্ষের মোগল পিরিয়ডের ইতিহাস তার নখদর্পণে ছিলো। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ‘বসন্তের কোকিল’ ও ‘বিড়াল’ প্রবন্ধ দুটি লিখেছেন:যেখানে ফুটিয়ে তুলেছেন ভদ্রলোকদের নিরপেক্ষতার ভণ্ডামি। বসন্তের কোকিল হচ্ছে গাও বাঁচানো ভদ্রলোক, যিনি কোন ঝুট-ঝামেলার মধ্যে নেই, যিনি বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি। কিন্তু তিনি সমাজের দুধের সর চেটেপুটে খেতে খুব ওস্তাদ।
ভদ্রলোকদের দেখেছেন কখনো কোন মিটিং-মিছিলে যাদের বসন্তের কোকিল বলে চিহ্নিত করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র? প্রবীণ জনপ্রিয় কলাম লেখক আবদুল গাফফ্ার চৌধুরী তার ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ’ বইতে দেখিয়েছেন স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দলটি প্রথম দিকে চকচকে বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যে কল্কে পায়নি। বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক প্রতিভার জোরে দলটি ষাটের দশকে এসে কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের সমর্থন পেয়ে যায়, ৬ দফা ঘোষণার পর দলটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গভদ্রার তীরে ধাবিত হতে থাকে, এরপর ইংরেজি শিক্ষিত এলিটরা এই দলে ভিড়তে থাকেন। তবুও গাফ্ফার চৌধুরী ষাটের দশকের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে ছিলেন তখনকার এক দৈনিকে। কর্তৃপক্ষ তা ছাপেননি। বলেছিল যে, ‘ব্যক্তির ওপর এত উত্সাহিত হয়ে লাভ কী?’
আর যারা বিড়ালের মত ভাজা মাছটি উল্টিয়ে খেতে জানেন না, তাদের ভয়ঙ্কর চেহারা উন্মোচন করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে।
যারা বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করি না’ তারা কিন্তু সাংঘাতিক রাজনীতি করেন। ১৯৭১ সালে তাদের নিরপেক্ষ চেহারা আমরা দেখেছি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরও আমরা তাদের সরব চেহারা দেখেছি। তারা প্রকৃতই বিড়াল, ঝোপ বুঝে কোপ মারার ধ্যান করেন বিড়ালের মত।
জুন মাসের ১ তারিখে চলে গেছে সাংবাদিক জগতের মহাপুরুষ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী। স্বয়ং জাতির পিতা তার ওপর দুটো প্রবন্ধ লিখেছেন:একটির নাম ‘আমাদের মানিক ভাই’, অন্যটির নাম ‘আমার মানিক ভাই’। জাতির পিতাই ফুটিয়ে তুলেছেন যে, মানিক মিয়া নিরপেক্ষ ভদ্রলোকী সাংবাদিক ছিলেন না। বাঙালির স্বার্থ আদায়ের জন্য তার ফ্রন্টে তিনি পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। জাতির পিতাই বলেছেন, ‘১৯৪৩ সাল থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দুভাই জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছি।’ (এই দেশ এই মাটি, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমী ২০০৮, পৃ:৬৫)।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মানিক মিয়া ব্যতীত আর কোন সাংবাদিক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এমন আবেগমাখা-দরদভরা উক্তি করেননি।
আজকাল দেখি নিরপেক্ষ ভদ্রলোকেরা যাদের ধোপ-দুরস্ত পোশাকের সহজে ভাঁজ ভাঙ্গে না, তারা অনেক উচ্চকণ্ঠ উস্কানিমূলক উক্তি করেন নানান বিষয়ে। তারা বাছবিচার করে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কথা বলেন না। লেখকদের মধ্যে যদি ইংরেজের দালাল, পাকিস্তানি শাসকদের দালাল, সামরিক স্বৈরাচারের দালাল থাকতে পারে, তাহলে রাজনীতিবিদদের মধ্যেও ভালো-মন্দ থাকতে পারে। যারা মনে করেন দলীয় লোক শয়তান আর নির্দলীয় লোক ফেরেস্তা, তাদের সঙ্গে একমত হতে পারবো না। লম্বা দু’বছর নির্দলীয় এলিটদের কাণ্ডকারখানা আমরা দেখেছি। তখন কথা উঠেছিলো, ‘যার কাজ তারই সাজে।’ সাপ নিয়ে যিনি খেলেন তিনিই সাপুড়ে। সাপুড়ে হতে গিয়েছিলো শরত্চন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয়। পরিণতি হলো মৃত্যু। শরত্চন্দ্র কিন্তু রাজনীতি করতেন। তিনি নেতাজী ও দেশবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। দেশবন্ধুর অনুরোধে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। রাজনীতি সচেতন না হলে ‘পথের দাবী’-র মত ইংরেজ বিরোধী উপন্যাস আমরা পেতাম নাকি? উপন্যাসটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। শরত্চন্দ্র বাঙালি বাবু-ভদ্রলোকদের ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি।
সারা ভারত বর্ষে মহাত্মা গান্ধীই শ্রেষ্ঠ মহামানব; তার প্রধান কৃতিত্ব তিনি ভারতের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। মহাত্মাজীর পূর্বে শুধুমাত্র লোক মান্য বালগঙ্গাধর তিলকই প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিলকের মৃত্যুতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেমন আবেগময় প্রবন্ধ লিখেছেন দেখুন, “আজ মনে পড়ে সেই দিন আর সেই ক্ষণ-বিকাল আড়াইটা, যখন কলকাতার সারা বিক্ষুব্ধ জনসঙ্ঘ টাউন হলের খেলাফত আন্দোলন সভায় তাহাদের বুকভরা বেদনা লইয়া সম্রাটের সম্রাট বিশ্বপিতার দরবারে তাহাদের আর্তপ্রার্থনা নিবেদন করিতেছিল। আর পুত্রহীনা জননীর মত সারা আকাশ জুড়িয়া কাহার আকুল ধারা ব্যাকুল বেগে ঝরিতেছিল। সহসা নিদারুণ অশনিপাতের মত আকাশ বাতাস মন্থন করিয়া গভীর আর্তনাদ উঠিল,—“তিলক আর নাই।” হিন্দুস্থান কাঁপিয়া উঠিল। কাঁপিতে কাঁপিতে মূর্ছিত হইয়া পড়িল। আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড় স্নেহের সন্তান—“তিলক আর নাই।”
(নজরুলের নির্বাচিত প্রবন্ধ—লোক মান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলকাতার দৃশ্য নজরুল ইন্সটিটিউট, ১৯৯৭)।
ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই নজরুল জেলে গিয়েছিলেন। অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। আর এজন্যই বিশ্বকবি ‘বসন্ত’ নাটিকা উত্সর্গ করেছিলেন নজরুলের নামে।
একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ইংরেজের স্থূল-অমার্জিত পীড়ন। ‘বসন্তের কোকিল’ জাতীয় ভদ্রলোকেরা হজম করেনি। করেছে রাজনীতিবিদরা। তাই রাজনৈতিক চেতনাই আসল চেতনা। ১৯৭১ সালেও ভদ্রলোকেরা গা-ঢাকা দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলো। রাজনীতিবিদদেরই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী।
রাজনীতি সম্পর্কে সত্যোচ্চারণ করা, যৌক্তিক ভাষ্য প্রদান করা আর মনগড়া বিরূপ মন্তব্য করা এক কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কেবল স্বদেশে জন্ম গ্রহণ করলেই স্বদেশী হওয়া যায় না। স্বদেশকে বুকে লালন করতে হয়।’
 লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন