রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা প্রশ্নে আরও সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন


আ ক ম ল হো সে ন
যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশকে বিব্রত ও পীড়িত হতে হ”েছ, তা মিয়ানমারের জাতিগত সম্প্রীতির সংকটকে বারবার সামনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পর এ নিয়ে তিনবার এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হ”েছ। মিয়ানমারের দীর্ঘকালের সামরিক শাসনের ফলে সে দেশের নাগরিকদের কোন গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। সামরিক স্বৈরাচারী শাসনের কুফলের সঙ্গে সঙ্গে দেশটির সব সংখ্যালঘু জাতির মানুষকে অত্যাচারিত হতে হয়েছে তাদের নিজ নিজ স্বতন্ত্র পরিচয়ের জন্য। যে কারণে কিছু সংখ্যালঘু জাতি সশস্ত্রভাবে বর্মীদের শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। তবে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় তাদের সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই রোহিঙ্গাদের একটা অংশ মিয়ানমারের অন্য সংখ্যালঘু জাতির মতো বি”িছন্নতাবাদে আক্রান্ত হয়েছে। ভারত বিভক্তির সময় এরা পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিল বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। তাদের বির“দ্ধে আরও অভিযোগ আছে যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন উৎস থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। বাংলাদেশে ¯’াপিত শরণার্থী শিবিরে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার কথাও বলা হয়।
দেশটির শাসকদের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক নয়। এ জনগোষ্ঠীকে তারা বাঙালি বলে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। আরাকানে (বর্তমান রাখাইন স্টেট) তারা শত শত বছর ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও তাদের বিদেশী হিসেবে গণ্য করে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যেখানে প্রতিবেশী রাখাইনদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে রোহিঙ্গাদের বাঙালি মনে করে ভিন্নভাবে দেখা হয়। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুখে বারবার এসব মানুষকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এর আগে দু’বারÑ ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে বড় সংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বা¯‘ হয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিল। প্রথমবার ‘অপারেশন ড্রাগন’ নামে এক আধা-সামরিক অভিযানে ২ লাখের ওপর রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়। মিয়ানমারের সরকারি ভাষ্য ছিল যে, এ অভিযান মুসলমানদের বির“দ্ধে নয় বরং অবৈধ অভিবাসীদের বির“দ্ধে পরিচালিত। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে পারলেও দ্বিতীয়বারের শরণার্থীদের সবাইকে আজও প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি। এর বাইরেও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে অসংখ্য রোহিঙ্গার আগমন ঘটে থাকে। মনে হয় না এর কোন সঠিক হিসাব আছে, যেহেতু তারা রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়নি এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এসব অবৈধ রোহিঙ্গা বাংলাদেশকে তাদের ¯’ায়ী আশ্রয়¯’ল বানিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি করছে বলে প্রমাণ আছে।
বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্র ধরে আবারও রোহিঙ্গাদের আগমন শুর“ হয়েছে। তবে এবার আর তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সরকারের কোন আগ্রহ নেই। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ শরণার্থী সং¯’া ইউএনএইচসিআরসহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানালেও সরকার তাদের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব দেখিয়ে যা”েছ। সরকারের এ ধরনের মনোভাবের কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না এ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। আগের শরণার্থীদের সবাইকেই যেখানে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব হয়নি, সেখানে নতুন করে শরণার্থীদের বোঝা নিতে চাওয়ার কথা নয়। 
তবে শরণার্থীদের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে নিজ নিজ বাড়িঘর ছেড়ে আসতে হ”েছ বলে সমস্যার মানবিক দিকটি গুর“ত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সহিংসতার মুখে আহত হওয়াসহ বাড়িঘর সহায়-সম্বল হারিয়ে এরা শেষ ভরসা¯’ল হিসেবে নাফ নদী ও সমুদ্র অতিক্রম করে এ দেশে ছুটে আসছে। কিš‘ সীমান্তে কড়া পাহারা বসিয়ে এসব অনাহূত অতিথিকে বাংলাদেশ ঢুকতে দি”েছ না। মানবিকতার দিকটি উপেক্ষা করে তাদের আবার ঠেলে ফেরৎ পাঠিয়ে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আগের দু’বারের তুলনায় কঠোরতা দেখা”েছ। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে যে কারণ দেখানো হ”েছ, তা আইনি কারণ। বাংলাদেশ যেহেতু শরণার্থী সংক্রান্ত কোন কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী বা অনুসমর্থনকারী নয়, তাই এ শরণার্থীদের দায় তার ওপর বর্তায় না। এর সঙ্গে বাংলাদেশ নিজেই সমস্যাক্রান্ত দেশ বলে শরণার্থীদের বোঝা নিয়ে সমস্যা বাড়াতে চায় না, বলেছেন মন্ত্রী। 
শরণার্থী বিষয়টির দুটি দিক আছে। একটি মানবিক দিক, যার উৎপত্তি হয় যখন কোন দেশে জাতিগত দাঙ্গা বা সরকারি বাহিনীর ব্যাপকভাবে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হওয়া মানবগোষ্ঠী পাশের কোন দেশে আশ্রয় নিতে যায়। এরকম ঘটনা যুদ্ধকালীন পরি¯ি’তিতে তৈরি হয় বলে এর প্রতি সদয় দৃষ্টিতে দেখার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। সাধারণত আশ্রয়দাতা দেশের মানুষজনও সহানুভূতির সঙ্গে শরণার্থীদের দেখে থাকে। এ ধরনের আশ্রয় অবশ্যই সাময়িক হবে বলে বিবেচনা করা হয়। জীবন বাঁচাতে অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় বলে জাতিসংঘ উদ্বা¯‘ সংক্রান্ত হাইকমিশন তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আগের দু’বার আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় শিবির পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল এ সং¯’ার। কিš‘ অন্য দিকটি আইন সংক্রান্ত, যার গুর“ত্ব মানবিক বিষয়ের বিচার করার চেয়েও গুর“ত্ববহ। যেহেতু মানবিকতার ব্যাপারটি স্বে”ছামূলক তাই এটা অবশ্য পালনীয় নয়। কিš‘ শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে আইনি কাঠামোর অধীন কোন দেশের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় এবং বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের কোন কাঠামো নেই বলে সরকার কঠোর মনোভাব দেখা”েছ। অতীতের রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভুগতে হ”েছ বলে নতুন করে আর দায় নিতে চায় না সরকার।
কিš‘ মানবিক দিক থেকে খুব সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যায় বলে আমি মনে করি। কেননা আশ্রয় না দিয়ে তাদের আবারও মিয়ানমারের দিকে ঠেলে দিলে তা হবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। তারা যে পরি¯ি’তি থেকে পালাতে চেয়েছে সেই পরি¯ি’তি যতক্ষণ পর্যন্ত না বদলাবে, তাদের বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যে শিবিরে ¯’ান দেয়া যায় এবং পরি¯ি’তি ¯ি’তিশীল হওয়া মাত্রই নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়। সমস্যাটি নিরসনের জন্য সরকারের নিবিড় কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন, যা এখন পর্যন্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের উদ্যোগ দু’ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। প্রথমত, মিয়ানমার সরকারকে তাদের দেশে সৃষ্ট এ পরি¯ি’তি পরিবর্তনের জন্য অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা। এবারের ঘটনার সূত্রপাত যেহেতু প্রধানত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সরকারের ‘বিদেশী’ তাড়ানোর নীতির ফল নয়, তাই মিয়ানমার সরকার দৃঢ় হাতে দাঙ্গা দমন এবং রোহিঙ্গাদের আ¯’া অর্জনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে পরি¯ি’তির মোড় ফেরানো সম্ভব হবে। তাদের বলতে হবে যে, বাংলাদেশ সাময়িকভাবে তার নাগরিকদের আশ্রয় দিয়েছে এবং পরি¯ি’তির উন্নতি হওয়ামাত্রই তাদের ফেরত নিতে হবে। দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সীমান্তে শান্তি ভঙ্গের আশংকায় এ বিষয়ে জড়ানো যায় কিনা, তা ভাবা যেতে পারে। বাংলাদেশ বারবার মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে, যা তার সামাজিক ¯ি’তিশীলতা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করছেÑ এ যুক্তিতে এর ¯’ায়ী সমাধান চেয়ে জাতিসংঘের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ চাওয়া যায়। নিরাপত্তা পরিষদের এখতিয়ারের আওতায় না পড়লে এ বিষয়ে মহাসচিবের হস্তক্ষেপ চাওয়া যেতে পারে। এসব কাজ এক সঙ্গে করা যেতে পারে এবং অবিলম্বে করা উচিত।
বর্তমান মিয়ানমারে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এক প্রক্রিয়া শুর“ হয়েছে, যা প্রভাবশালী দেশগুলো সমর্থন করছে। দেশটির ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধও তুলে নেয়া হ”েছ। এমন এক মুহূর্তে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে। মিয়ানমার সরকারের প্রতি তার নতুন পৃষ্ঠপোষকরা এ বিষয়ে কোন আহ্বান জানালে তা ফেলে দেয়ার কথা নয়। এসব বিষয়ে না ভেবে শুধু কঠোরতা দেখালে এখন হয়তো সাময়িক সুবিধা পাওয়া যাবে। কিš‘ রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও বাংলাদেশকে ভুগতে হ”েছ এর জন্য। তাই সমস্যাটির ¯’ায়ী সমাধানের জন্য বাইরের চাপের বিষয়ে ভাবা উচিত।
আকমল হোসেন : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ধশসধষযঁংংধরহরৎ@ুধযড়ড়.পড়স 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন