রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

কে আমি? নক্ষত্র নাকি নরাধম?-২



অধ্যক্ষ তোফায়েল আহাম্মদ তানজীর
সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর হাইস্কুল খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম আর খেয়াল রাখছিলাম দু’একটা মিছিল-টিছিল আসে কিনা। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। কী সুন্দর লাগে, এক সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করতে করতে যায় ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ আরও কত সুন্দর সুন্দর স্লোগান। হঠাত্ মুরাদনগর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার ছেলে তৌহিদ ভাই এসে মাথায় হাত রাখলেন, পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করলেন আর সঙ্গের ছেলেটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, একে চেন? আতিকুর রহমান হেলাল! ছাত্রলীগ করে। ধীরে ধীরে সম্পর্ক আরও গভীর হলো। মনে অন্যরকম একটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জেগে উঠল হেলাল ভাইয়ের উপর। হেলাল ভাইকে দেখি বাচ্চাদের খুবই আদর করেন, আবার দেখি বড়দের সঙ্গে মিশে গিয়ে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে বিএনসিসির পোশাক পরে কমান্ড দেন। নদী ভাঙন থেকে মুরাদনগর হাইস্কুলকে বাঁচাতে আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ায় সরকারি প্রশাসন সে বছর তার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগটুকুও কেড়ে নিল। সেই সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আমাদের স্বপ্নের নায়ক হয়ে গেলেন তিনি। বুঝলাম হেলাল ভাইয়ের মতো ভালো ছেলেরা ছাত্রলীগ করেন। ছাত্রলীগ নিশ্চয়ই অনেক ভালো। একদিন বন্ধু আমির একটা কাগজ দেখাল, কাগজে লেখা ‘বাঙালি জাতির ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস’।
দিন কেটে যায়, পড়াশোনার প্রয়োজনে ঢাকায় চলে আসি। হেলাল ভাই সর্বোচ্চ ডিগ্রি শেষ করে রাজনীতির পাশাপাশি তার বাবার পেশাতেই ফিরে গেছেন অর্থাত্ মুরাদনগর সোনার বাংলা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। অনেকদিন পর সেদিন দেখা হতে সেই চিরচেনা হাসি। বললাম সোনার বাংলার সোনার ছেলে তোমায় সালাম। আহারে! আজকের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে নিমজ্জিত ছাত্রলীগের ছেলেরা কি হেলাল ভাইয়ের মতো হতে পারে না? যে ছাত্রলীগের ইতিহাস নাকি বাঙালি জাতির ইতিহাস, সে ছাত্রলীগ কীভাবে সচিবালয়ে গুলি করে হত্যা করে তাদেরই সহকর্মীকে? আর প্রতিপক্ষের বেলায়? ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির হলে তো আলী আজ্জম আরও তুঙ্গে! সব শিক্ষাঙ্গনসহ সবকিছু দখল করে এখন নিজেরাই মারামারি করে মরে!
এবারে আসি ছাত্রদলের কথায়। ১৯৯৪ সালে দেবিদ্বার সরকারি কলেজে পড়াকালীন দেখেছি ছাত্রদলের ঔদ্ধ্যত্ব; কীভাবে ভাত খাওয়া গলায় গান গেয়েও ছাত্রদল নেতারা প্রথম পুরস্কার জিতে যান। কিংবা ২০০১ সালে নির্বাচনে জয় লাভের পরের আস্ফাালন। ঢাকায় এসে পরিচয় ঘটেছে ছাত্রদল নেতা রেজাউর রহমান তপনের সঙ্গে। ওহ! কী সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ! ওয়ার্ড সম্পাদক থেকে আজ কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক। কী বিনয়! প্রতিপক্ষের সঙ্গে কত সুসম্পর্ক। এত বড় নেতা অথচ কাউকে উঁচু গলায় কথা বলতে পর্যন্ত দেখেনি কেউ! আচ্ছা ছাত্রদলের সবাই রেজাউর রহমান তপনের মতো হতে পারে না? তপনের মতো করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিঃসংকোচে মিশে গিয়ে একাত্ম হয়ে যাওয়াই তো শহীদ জিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শ।
অনেক আগে হুমায়ূন আহমেদের একটি নাটকে ডাক্তারকে কসাই বলায় নাকি কসাইরা মাইন্ড করেছেন। কী ভয়ানক অবস্থা! আমার স্পষ্ট মনে আছে, মেডিকেলে চান্স পাইনি বলে কত কেঁদেছি। আহা! ফসকে গেল আমার গ্রামের মানুষদের সেবা করার সুযোগ! যদি ১০০ জন ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয় তার জীবনের লক্ষ্য কী? ৯০ জনই বলবে ডাক্তার হয়ে দুঃখী মানুষের সেবা করার কথা। কিন্তু শতকরা একজন ডাক্তার কি সেবার পথে আছে? (আমি সবাইকে বলছি না) তাদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে পাস করে সরকারি হাসপাতালে ঢাকায় চাকরি করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন, আর কীভাবে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কানপড়া, চেম্বার এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সর্বোচ্চ ইনকাম করা যায়! আচ্ছা আমি বুঝি না ইনকাম করার জন্য ডাক্তার হওয়ার কী প্রয়োজন, ব্যবসা করলেই তো পারেন ওনারা! ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে হঠাত্ খবর পেলাম বাবা গ্রামে মৃত্যুসজ্জায়। দ্রুত বাড়ি গিয়ে দেখি বিছানার সঙ্গে মিশে গেছেন, কাউকে চিনতেও পারছেন না। রাস্তার বেহাল দশার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তখন বাধ্য হয়ে কুমিল্লার মুরাদনগর, দেবিদ্বার এই দুই থানার ডাক্তারদের অনুরোধ করতে লাগলাম আমাদের বাড়ি আসার জন্য; কিন্তু কেউই রমরমা চেম্বার ছেড়ে ৫/৭ মাইল দূরের গ্রামে যেতে রাজি হলো না। তাদের একই কথা, পারলে রোগী চেম্বারে নিয়ে আসেন না হলে তাদের কিছুই করার নেই। ছোট ভাইটা কান্না শুরু করে দিল, কিন্তু কান্নায় কী আর পাষানদের মন গলে? এদিকে বাড়ি থেকে ফোন আসছিল বাবার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। সেই সময় খবর পেলাম ডা. মোস্তফা কামরুজ্জামানের। তিনি নাকি রোগীর প্রয়োজনে সব জায়গায় যান। ওনার F.C.P.S, B.C.Sসহ বিভিন্ন ডিগ্রি দেখে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতেই ভয় হলো। কিন্তু তিনি আমাদের দেখে নিজেই সব জানতে চাইলেন এবং সবকিছু জেনে খুব দ্রুত কিছু ওষুধসহ হোন্ডা নিয়ে আমাদের আগেই চলে এলেন। রিকশা নিয়ে বাড়িতে এসে দুরু দুুরু বুকে ঘরে ঢুকে দেখি আমার বাবার স্যালাইন চলছে, ডাক্তার বাবার শিয়রে বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটা আশ্বস্ত করা হাসি দিলেন। তখন বুঝলাম মহান আল্লাহ কেন মানুষের স্থান ফেরেশতাদের উপরে দিয়েছেন। ক্লান্তিতে চোখ বুঝে এসেছিল, গভীর রাতে দেখি বাবার শিয়রের পাশে বসে সুস্থতার অপেক্ষা করছেন মাত্র আজকে পরিচয় হওয়া এই মানুষটি! তখন মনে হলো ওনারা আসলে মানুষ নন। মানুষের সাজ পোশাকে ঘুরে বেড়ান আর কি! আজ সাত বছর পর আমার জানতে ইচ্ছে করে সম্পদের কাঙ্গাল তথাকথিত ডাক্তারদের সম্পদ বেশি নাকি মানুষের সত্যিকারের সেবকদের! অবশ্য আমিই বেকুবের মতো ভাবছি। কারণ সেবকরা সেবাতেই তুষ্ট সম্মানিতে নয়!
গত কয়েক মাস ধরে পত্রিকার নেতিবাচক শিরোনামের শীর্ষে আছে কিছু পুলিশের নিউজ। পেশিশক্তি, লাঠি কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ থাকে পুলিশের। পুলিশকে প্রয়োজনে শক্তি প্রদর্শনের কিংবা লাঠি, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হলেও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের ট্রেনিং দেয়া হয়। কিন্তু সেই শক্তি কিংবা অস্ত্র যদি জনগণের নিরাপত্তায় ব্যবহার না করে সেই জনগণকেই সাইজ করার কাজে ব্যবহৃত হয় তখন সেই প্রবাদটিই মনে হয়—
‘ডাক্তার আনলাম মাকে চিকিত্সা করাতে
ডাক্তার চায় মাকে বিয়ে করতে!’
আসলে ১৫ কোটি মানুষের দেশে কয়েক লাখ পুলিশের মধ্যে সব পুলিশ কি থানায় ঝুলিয়ে মানুষ পেটায়, শ্লীলতাহানি করে কোর্টে আসা তরুণীর, সংসদ সদস্য কিংবা চিফ হুইপকে ঠেঙ্গায় নাকি সীমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে? আমি জানি উত্তর হবে, না! কারণ যদিও গণহারে বলা হয় পুরো বাহিনীটি ঘুষ কিংবা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, তাহলে বেশিরভাগ সত্ পুলিশ সদস্যকে অপমান করা হবে। আচ্ছা বিপ্লব, হারুন, মোয়াজ্জেম, সালাউদ্দিনরা কি সার্জেন্ট আহাদের আত্মত্যাগের কথা মনে করতে পারেন না? কিংবা সাভারের সহকারী পুলিশ সুপার আ. সালাম সাহেবকে অনুসরণ করতে পারেন না? যতটুকু জানি প্রায় দুই যুগ চাকরির বয়স পেরিয়ে গেলেও সালাম সাহেবের পোস্টিং হয়নি ঢাকার কোনো থানায়! রামগড়, সিলেট, মৌলভীবাজার, সীতাকুণ্ড, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সর্বশেষ সাভারের সহকারী পুলিশ সুপার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চাকরির কারণে কি তার সন্তানরা ভালো ফলাফল করছে না? আসলে জনগণের জন্য নিজেকে নিবেদন করলে জনগণের দোয়ায় স্বয়ং আল্লাহ তার সংসারের জিম্মাদার হয়ে যান।
এবারে আসি রুই-কাতলাদের কথায়! হেজা কাটিং (সজারু) চুলের অধিকারী বিচিত্র ইংরেজির আমদানিকারক একজন প্রতিমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড চারদলীয় জোট সরকারের সময় হজম করেছে এ দেশের মানুষ। আর বর্তমানে আরেক প্রতিমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ে মুখ বিকৃত করে বিরোধীদলকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন খিস্তিখেউড় মিডিয়ার কল্যাণে দেশব্যাপী প্রত্যক্ষ করে আর বিরক্ত হয় কিংবা ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে তার প্রতিপক্ষরা। নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য হাইকোর্ট কর্তৃক তিরস্কৃত হয়ে বর্তমানে তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন। আচ্ছা তিনি কি দেখেন না শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, খাদ্যমন্ত্রী আ. রাজ্জাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি—ওনারা কত মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলেন। অতীতেও দেখা গেছে বড় বড় কথা বলা মন্ত্রী, এমপি কিংবা নেতারা দল ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই সীমান্ত পার হয়ে যান কিংবা জেলখানায় কাটান। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার দম্ভে শামীম উসমান বেগম খালেদা জিয়াকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দল ক্ষমতা ছাড়ার পর নিজেই পগারপাড় হন। হয়তো প্রতিমন্ত্রী সাহেবও একদিন বলবেন, য পলায়তি স জিবতি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
tofayalahammed@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন