শনিবার, ১৬ জুন, ২০১২

সরকারের নার্ভাস দশা


এ কে এম শা হ না ও য়া জ
সরকার পরিচালনায় পথহারা আওয়ামী লীগ ক্রমে অচেনা হয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে খুঁজে পাওয়া এখন অনেক কঠিন। অথচ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যখন বামধারার রাজনীতি শক্তিশালী হতে পারেনি তখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী গণতান্ত্রিক চেতনা লালিত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগই ছিল মুক্তিকামী বাঙালির শেষ ভরসা। স্বাধীনতার পাঁচ বছর না পের“তেই যখন পাকিস্তানি প্রেতাÍারা সক্রিয় হয়ে উঠল, সামরিকতন্ত্রের ভেতর দিয়ে রাজনীতির নামাবরণে প্রো-পাকিস্তানি রাজনীতির নতুন মের“করণ হল এবং এই রাজনীতির প্রশ্রয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি গর্ত থেকে বেরিয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াল, তখন আতঙ্কিত মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ ছিল শেষ আশ্রয়¯’ল। ষড়যন্ত্রকারীরা ছিল সুদক্ষ ও দূরদর্শী। তাই আওয়ামী লীগের প্রগতিবাদী শক্তির প্রাণভোমরা বঙ্গবন্ধু আর বিদগ্ধ চার নেতাকে হত্যা করে দলটির ডানা ছেঁটে দিল। এর বাস্তব প্রতিফল এতগুলো বছর মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে আর এখন আরও মর্মান্তিকভাবে পা”েছ। নেতৃত্বের দুর্বলতা দীর্ঘ ঐতিহ্য লালিত একটি দল ও মুক্তিকামী মানুষকে কিভাবে হতাশ করে বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগ আর এই দলীয় সরকার পরিচালকদের পারফরম্যান্স তা প্রমাণ হ”েছ।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ¯ি’তি¯’াপকতার গুণ প্রবল। সর্বংসহা বলা যায়। বারবার বিপন্ন হয়েও হতাশ হয় না। আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। দাঁড়ায়ও। কিš‘ দুর্ভাগ্য, এমন একটি জীবন্ত জাতিকে দলতন্ত্রের সংকীর্ণতায় আড়ষ্ট এ সময়ের আওয়ামী লীগ আপন করে নিতে পারল না। উদারভাবে গ্রহণ করতে পারল না। গণশক্তিকে ধারণ করার যোগ্যতা না থাকলে সেই শক্তিকে অনুভবও করা যায় না। এ ব্যর্থতা একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে ক্রমে আÍবিশ্বাসের জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলে। আর আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো নিজেদের সংঘশক্তি সংহত করতে সক্ষম হয়। 
মাঠের রাজনীতিতে সরব ও বলবান অব¯’া থাকলেও কী এক দুর্ভাগ্যে সরকার পরিচালনায় এলে অনেকটাই নি®প্রভ হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। দলতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, নেতৃত্বের আÍীয়তন্ত্র ও অঞ্চলপ্রিয়তার মানসিকতা সম্ভবত উদার গণতান্ত্রিক বোধ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় দলটিকে। দেশের মানুষ তবুও হতাশ হতে চায় না। আওয়ামী নেতৃত্বকে পথের দিশা দিতে বারবার চেষ্টা করে। না হলে গত নির্বাচনে এত বিপুল সমর্থন পাবে কেন আওয়ামী লীগ? নির“পায় আশাবাদী মানুষ প্রত্যাশা করেছিল এই সমর্থন আওয়ামী নেতৃত্বকে নতুনভাবে আÍবিশ্বাসী করে তুলবে। দলীয়করণের কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের দল হিসেবে আÍপ্রকাশ করবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করে মানুষের সমর্থনের প্রতিদান দেবে। 
কিš‘ দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাগাড়ম্বর ছাড়া সরকার পরিচালনায় আর কোন দৃশ্যমান সফলতা দেখাতে পারল না। বিএনপির ভূমিধস পতনের পেছনে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। তাই সাধারণ মানুষ ভেবেছিল শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতির বির“দ্ধে জেহাদ ঘোষণা করবে। দলটির নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিও তেমনই ছিল। কিš‘ গত সাড়ে তিন বছরের মূল্যায়নে মনে হ”েছ, দুর্নীতির কাছে যেন আÍসমর্পণ করে ফেলেছে সরকার। দলীয় রাজনীতি ও প্রশাসনÑ সর্বত্রই মহামারীর মতো দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের অদূরদর্শিতা। যাপিত জীবনে মানুষ যখন সরকারের কাছ থেকে স্বা”ছন্দ্য পেতে চায় তখন নানা প্রতিবন্ধকতার খর্গ নেমে আসে। শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে না অথচ গ্যাসভিত্তিক শিল্প উদ্যোক্তাদের শিল্প গড়ার অনুমতি দিয়ে পথে বসা”েছ। হাজার হাজার আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে সহস্র কোটি টাকার বিনিয়োগ করিয়ে এখন বলছে, দুঃখিত গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। 
বিদ্যুৎহীনতা ও অব্যব¯’ায় নাকাল দেশবাসীকে আশার কথা শুনিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বারবার বিএনপির খাম্বা বসানোর সমালোচনা করেছে। বিএনপি আমলে এক ঝলক বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়নি বলে বক্তব্য রেখেছেন, রেখে যা”েছন আওয়ামী নেতারা। বিদ্যুৎ সংকট থেকে দেশবাসীকে উদ্ধারের জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে দলীয় লোকদের। অথচ হাজার নয়Ñ শত কোটি টাকা ব্যয় করে বন্ধ হয়ে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সচল করার ব্যব¯’া নেয়নি। কী এক অদৃশ্য কারণে কুইক রেন্টালের অপরিহার্যতাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। প্রচার করা হ”েছ, এতে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। কিš‘ এসব পরিসংখ্যানে কী লাভ সাধারণ মানুষের। তারা দেখছে আগের চেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের যাতনায় ভুগছে মানুষ। শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হ”েছ। সেচ প্রকল্প অচল থাকায় হতাশ কৃষক। বলা হয়, বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও নতুন অনেক সংযোগ দেয়া হয়েছে তাই ঘাটতি কমেনি। একটি গণতান্ত্রিক সরকার তাহলে এমন অদূরদর্শিতা দেখাবে কেন? বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়া খাম্বা বসানো যদি বিএনপি সরকারের অপরাধ হয় তবে বিদ্যুৎ দেয়া যাবে না জেনেও কেন নতুন সংযোগ দেয়া অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না? 
কোন সরকার যদি নানা ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে থাকে, তখন সরকার পরিচালকরা নার্ভাস হয়ে পড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালকদের দশা এখন অনেকটা তেমনই। কুইক রেন্টালের সমালোচনা করায় গোস্বা হন জ্বালানি উপদেষ্টা। অতীতে কৃতকর্মের জন্য নানা বিতর্কের জš§ দেয়া জ্বালানি উপদেষ্টা কুইক রেন্টালের সমলোচকদের দেশদ্রোহী বলতেও নাকি দ্বিধা করেননি। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন, কুইক রেন্টালের পেছনে নাকি দুর্নীতি ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পাকিস্তানে এমন কুইক রেন্টালের আয়োজন হয়েছিল। পরিণতিতে এর সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এখন জেলে। গণতন্ত্র তো জবাবদিহিতা শেখায়। তাহলে জনগণকে অন্ধকারে রেখে গৃহীত পদক্ষেপ জনগণের আদালতে উত্থাপিত হবেই। 
সরকার পরিচালনায় দৃশ্যমান সাফল্য দেখতে পারছে না সাধারণ মানুষ। মুখে যাই বলুন, সরকার পরিচালকরা যে তা বুঝতে পারছেন না এমন নয়। তাই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সরকার পরিচালক ও আওয়ামী নেতা-নেত্রীরা বচনভঙ্গিতে কেমন যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। সরকারবিরোধী কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারছেন না। সাংবাদিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী সবাইকে শত্র“জ্ঞান করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিরোধী দলের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কর্মসূচি মোকাবেলায় ভীতি এড়াতে পারছেন না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব যেখানে নাগরিকের সুখ-স্বা”ছন্দ্য নিশ্চিত করা সেখানে নিজেদের নিরাপদে রাখার অহেতুক দুশ্চিন্তায় মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দি”েছন অসহনীয় কষ্ট। বিগত কয়েকটি বিরোধীদলীয় সমাবেশ-মহাসমাবেশ ঠেকাতে হরতাল পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকার অবর্ণনীয় কষ্টে ফেলে দিল মানুষকে। এসব সরকারী নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তৈরি হওয়া নার্ভাস দশারই প্রতিফলন।
গত ১১ জুনের ১৮ দলীয় মহাসমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে দেশজুড়ে অবর্ণনীয় অবরোধ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষকে বিপন্ন করা সরকারের ছন্দপতনেরই প্রকাশ। ২৩ ঘণ্টা লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখে, গাড়ি চলাচলে অবরোধ তৈরি করে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার কী অর্জন করেছে তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে মানুষের কষ্ট ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সবাই পড়েছেন ও দেখেছেন। আমি নিজেও ভুক্তভোগী হয়ে মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। 
১১ তারিখে আমার জর“রি প্রয়োজন ছিল বসুন্ধরায় যাওয়ার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তরা হয়ে বসুন্ধরায় যেতে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগার কথা। তবুও যানজটের কারণে দু’ঘণ্টাও লেগে যায়। আমি এদিন আড়াই ঘণ্টা হাতে নিয়ে সকাল ৯টায় ব্যক্তিগত গাড়িতে ক্যাম্পাস থেকে বের হই। আশুলিয়ার বিলে প্রায় ৩০ মিনিটের জ্যামে পড়ি। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলে একে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেই। আবদুল্লাহপুর থেকে উত্তরার রাস্তায় পড়ার পর সরকারি ‘হরতালে’র ছোঁয়া পেলাম। পাবলিক পরিবহনের বাস-মিনিবাস কিছু নেই। শুধু প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ইত্যাদিতে রাস্তা ঠাসা। হাজার হাজার অফিস যাত্রী পথচারী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অসহায়ভাবে। অনন্যোপায় হয়ে হাঁটা ধরেছেন কেউ কেউ। দু-একটি খালি পিকআপ ভ্যান পেয়ে তাতে চড়ার প্রতিযোগিতায় নামছেন অনেকে। যানবাহন না পেয়ে ছেলে বৃদ্ধ মহিলা সবার চোখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। রাস্তা ¯ি’র হয়ে আছে কঠিন জ্যামে। উত্তরার রাস্তায় দু-তিন কিলোমিটার যেতে দু’ঘণ্টা চলে গেল। বুঝলাম বসুন্ধরায় পৌঁছা আমার আর হবে না। নিজের বড় রকমের ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিš‘ গাড়ি ঘোরানোর জো নেই। অবশেষে প্রায় আড়াই ঘণ্টায় এয়ারপোর্টের মোড়ে এসে গাড়ি ঘোরালাম। একটু হাঁফ ছাড়ার জন্য উত্তরায় এক øেহাস্পদ বন্ধুর বাড়িতে এলাম। দেখলাম বন্ধুটি চিন্তিত। ওর মেয়ে পড়ে বাড্ডায় ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ও সকালেই চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র ও শিক্ষক পৌঁছতে না পারায় ক্লাস হ”েছ না। বের হয়ে পথে আটকা পড়েছে। ফেরার কোন গাড়ি নেই। অবশেষে টেলিফোনে সিদ্ধান্ত দিতে হল রিকশা নিয়ে ধীরে ধীরে খিলগাঁওয়ে ওর ভাইয়ের বাসায় চলে যেতে। বন্ধুটির স্ত্রী ময়মনসিংহে এক কলেজের শিক্ষিকা। আজ ওর ঢাকায় ফেরা জর“রি। বারবার ফোন করছে, ঢাকার পথে কোন গাড়ি ছাড়ছে না।
আমি এই সামান্য অভিজ্ঞতায় বুঝলাম সাধারণ মানুষের কতটা দুর্দশা। না জানি কত মুমূর্ষু রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে রাস্তায়। জর“রি প্রয়োজনে অনেকে ঢাকা ছাড়তে পারছেন না বা ঢাকায় আসতে পারছেন না। কতজনের ব্যবসার ক্ষতি হ”েছ। আরও নানাভাবে সংকটে পড়ছে জনগণ। অথচ এই জনগণকে শান্তি ও গতি দেয়ার কথা সরকার পরিচালকদের। কিš‘ দুর্ভাগ্য এমন নিজ নিজ রাজনৈতিক সুবিধার জন্য মানুষকে জিম্মি করে ফেলছেন রাজনীতিকরা। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকার বাধা সৃষ্টি করে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখা”েছ। সরকার পরিচালনায় নানা ব্যর্থতায় উ™£ান্ত হয়ে নিজেদের নার্ভাস দশা এড়াতে পারছেন না নীতিনির্ধারকরা। হয়তো বিরোধী দলের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে আপাতত কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পা”েছন। কিš‘ এ ধারার পথচলায় গণমানুষের আ¯’ার জায়গা থেকে যে ক্রমে দূরে সরে যা”েছন, সে হিসাব রাখছেন না। এ দেশের মুক্তমনের দেশপ্রেমিক মানুষ কিš‘ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে এতটা নার্ভাস দশা আশা করেনি। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যারা দেখতে চান, তাদের কাছে এর চেয়ে হতাশার কিছু নেই। 
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, প্রতœতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ংযধযহধধিুলঁ@ুধযড়ড়.পড়স 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন