সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

খাদ্যে ভেজাল জাতির জন্যে একটি অভিশাপ


ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী  

বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে খাদ্যদ্রব্যে, ঔষধে এবং মানুষের ব্যবহূত বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীতে ভেজাল মিশিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী রমরমা ব্যবসা- বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বেশি বেশি মুনাফা অর্জনের লোভে তারা এ ধরনের হীন কাজে লিপ্ত আছে। খাদ্য ও বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীতে ভেজাল মিশানোর প্রক্রিয়া এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে, এটি এখন শুধু রাজধানী ঢাকা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মফস্বল শহরে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের সর্বত্র অধিক মুনাফালোভী অসাধুচক্র ভেজাল খাদ্যে মিশিয়ে বাজারজাতকরণের কূটকৌশল বেশ আয়ত্ত করেছে। বিষ জাতীয় ভেজাল মিশ্রিত মাছ-মাংস, ফল-ফলারি, বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি ও দ্রব্যসামগ্রী দেখে বোঝার কোন উপায় নাই যে, এতে মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত আছে। এ অসাধু ব্যবসায়ীচক্রের নিকট আজ সারা জাতি জিম্মি। দেশের অসহায় মানুষ খাবারের সাথে প্রতিনিয়ত বিষ খাচ্ছে; অথচ তারা হয়তো জানে না যে, এর ক্ষতিকর প্রভাবে তাদের জীবনহানিও হতে পারে।
ভেজাল খাবার খেয়ে কেউ সাথে সাথে হয়ত মৃত্যুবরণ করে না। তাই এর ক্ষতিকর প্রভাব তাত্ক্ষণিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। ভেজাল খাবারকে Slow Poisoning  বলা যেতে পারে। কারণ সাধারণত যে সকল ভেজাল মেশানো হয়, তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে পরিলক্ষিত হয়। ভেজাল মিশ্রিত খাবার খেতে খেতে ব্যক্তি এক সময় রোগাক্রান্ত হয়, শরীরের কোন কোন অঙ্গ বিকল হয়ে যায়, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অস্বাভাবিক এবং অকাল মৃত্যু। আমি কোন ভেজাল বিশেষজ্ঞ নই কিংবা চিকিত্সকও নই। তবে আমাদের চিকিত্সক বন্ধুদের সাথে আলাপ-আলোচনায় এ ধরনের তথ্যাবলী জানতে পেরেছি। তাছাড়া সাধারণ জ্ঞানের আলোকেও এ সংক্রান্ত বিষয় বিশ্লেষণ করা যায়। ভেজাল খাবারের প্রভাব সম্পর্কে কখনও কখনও পত্র-পত্রিকায়ও নানা খবর ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে করে জানা যায় যে, ভেজাল খাবারের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী এবং এর পরিণতি অত্যন্ত মারাত্মক ও ভয়াবহ।
এ কথা এখন কে না জানে যে, আম, আনারস, লিচুসহ মৌসুমি ফলে অবলীলাক্রমে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন, পিজারভেটিভ, কার্বাইডসহ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কেমিক্যাল। ফুটপাতের দোকানেই শুধু নয়, নামিদামি চেইন এবং সুপার শপের মৌসুমি ফল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যেও পাওয়া যায় ফরমালিন, কার্বাইডের মতো বিষাক্ত কেমিক্যালের উপস্থিতি। বাংলাদেশে জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলা হয় মধুমাস। এ মাসে আমাদের দেশে আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচুর মতো লোভনীয় ফল-ফলারির সমারোহ ঘটে। ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকলেই কম-বেশি এসব ফলের আস্বাদন গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু হায়রে কপাল — আজ এদেশে এসব ফল খাবার কোন উপায় নাই। বড় বড় দোকানে ব্যানারে লেখা আছে কেমিক্যালমুক্ত আম, অথচ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, পচনরোধে এগুলোতে মিশানো হয়েছে বিষাক্ত ফরমালিন। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত আপেল, আঙ্গুরেও ফরমালিন মিশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকি কম দামি ছোট কলা পাকাতেও ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল।
মাছের বাজারেও একই অবস্থা। রুই, কাতল থেকে শুরু করে হেন মাছ নাই— পচনরোধে যাতে মিশানো হয় না বিষাক্ত ফরমালিন। কথিত আছে, ঢাকা শহরে এক ভদ্রলোক এক অভিজাত বাজার থেকে একটি বড় কাতল মাছ কিনে গাড়ির পেছনে (বেক ডালায়) বালতির মধ্যে মাছটি রাখেন; কিন্তু বাসায় ফিরে একটি দুর্ঘটনার কথা শুনে তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। ফলে মাছটি আর বের করা হয় নাই। কয়েকদিন পর যখন পিছনের ডালা খোলা হয়, ভদ্রলোক দেখতে পান যে, মাছটি তরতাজা অবস্থায় বালতিতে রক্ষিত আছে এবং মাছটি সামান্য পরিমাণেও নষ্ট হয় নাই। এতে ভদ্রলোক বিস্মিত হন এবং মাছটি না খাবার সিদ্ধান্ত নেন। কাঁচা সবজিকে কাঁচা রাখার জন্য, সবুজ সবজির সবুজ রং অক্ষুণ্ন্ন রাখার জন্য মিশানো হয় বিশেষ ধরনের রং, যা খেলে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সাধারণ চোখে দেখে এগুলো বোঝার কোন উপায় নাই। মাস দুইয়েক আগে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে বরই (কুল) কিনে এনেছিলাম দেখতে খুব সুন্দর, চোখ জুড়িয়ে যায়। বাসায় আনার দুইদিন পর বাসার সবাই বুঝতে পারলাম যে, এগুলো রং মেশানো বরই। আমি আশ্চর্য হলাম এ ভেবে যে, অতি মুনাফাখোর লোভীরা কিছুই আর বাকি রাখলো না।
ভেজাল ঠেকানোর আমাদের দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বি এস টি আই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন)। এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাঝে-মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। দোষী ব্যবসায়ীদের শাস্তি বিধান করা হয়। শাস্তি হলো প্রধানত জরিমানা। এদের পক্ষে জরিমানার টাকা পরিশোধ করা মোটেই কষ্টকর নয়। যে পরিমাণ জরিমানা দেয় তার বহুগুণ জরিমানার টাকা আগে ও পরে ভেজাল বিক্রি করে উসুল করে নেয়। বি এস টি আই-এর উদ্যোগে মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত। সারাদেশে ভেজাল মিশ্রিত খাবার যেভাবে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে, সে তুলনায় বি এস টি আই-এর মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম একেবারেই অপ্রতুল। ভেজালের ব্যাপ্তি এতই ব্যপক ও বিশাল আকার ধারণ করেছে যে, বি এস টি আই-এর মতো একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত বিশাল ভেজাল বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।
আজ দুর্নীতি যেমন সমস্ত রাষ্ট্র ও সমাজকে গ্রাস করেছে, তেমনি বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে। বিষাক্ত ফরমালিনসহ নানা ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে— নানা ধরনের ব্যাধি তাদের আক্রমণ করছে; দেখা দিয়েছে অকাল এবং অস্বাভাবিক জীবনহানির সম্ভাবনা। একজন চিকিত্সক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, “৩০ মিলিলিটার অথবা প্রায় এক আউন্স পরিমাণ ফরমালিন গলাধঃকরণে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে ফরমালডিহাইড এক্সপোজার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল, যদিও অন্যজনের ক্ষেত্রে ঐ একই লেভেল সংবেদনশীল নাও হতে পারে। গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যায় যে, বাতাসে যখন ফরমালডিহাইডের লেভেল কেবলমাত্র ০.১ পিপিএম অতিক্রম করে, তখন কিছু কিছু মানুষের জন্য পরিবেশ অনুকূল বিরুদ্ধ হয়, যেমন-চোখে পানি আসা, চোখ, নাক ও গলা ভীষণভাবে জ্বালা-পোড়া করা, কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, চেস্ট পেইন, হাঁপানি রোগীর মতো করে শ্বাস ত্যাগ করা, বমি বমি ভাব, ত্বকের জ্বালা- পোড়া এবং এজমা। ফরমালিন এত বড় একটি প্রাণঘাতী বিষাক্ত কেমিক্যালস, যা খাদ্যের মধ্যে মিশিয়ে এক ধরনের শ্লো পয়জনিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ক্রমেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর নজির নাই। এমনকি আমাদের দেশেও অতীতে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর উদাহরণ একেবারেই বিরল। আমরা শুধু জানতাম যে, গরুর দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করা হয়। কিন্তু দুই দশক আগেও খাদ্যে ভেজাল তথা ফরমালিন ও অন্যান্য কেমিক্যাল মিশানোর ঘটনা তেমন একটা দেখা যায় নাই। কিন্তু গত দুই দশক যাবত্ এর প্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? উপায় হলো সরকারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে এক সামাজিক আন্দলন গড়ে তোলা। আমি প্রস্তাব করি, ভেজালবিরোধী আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা হোক মৃত্যুদণ্ড। ভেজাল মিশানো অতি মুনাফালোভীকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে এবং কঠোর হস্তে আইন প্রয়োগ করতে হবে । এ ধরনের কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে ভেজাল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ভেজালের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ভোক্তা সাধারণকে বুঝাতে হবে যেন ভেজাল মিশ্রিত খাবার পরিহার করে, এগুলোকে এড়িয়ে চলে, ভেজাল জিনিস ক্রয় বন্ধ করে। এতেও কিছুটা ফল হতে পারে। মোটকথা, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে যদি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে আর সেজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা। আসুন, আমরা সকলে মিলে ঢাকা শহর থেকে এ সামাজিক আন্দোলন শুরু করি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, ভেজালবিরোধী যে কোন আন্দোলনে, সংগ্রামে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবো। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বিষ মিশ্রিত খাবার থেকে রক্ষা করার এক সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তিয়েছে এবং সে দায়িত্ব আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন