প্রফেসর ড. মখদুম মাশরাফী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে কেবল প্রলাপ আর বিলাপ চলছে। সংলাপ চলছে না। আলাপ চলছে না। আলাপ ও সংলাপের বিষয়ে সরকার একেবারেই আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সংসদেই কিংবা সংসদের বাইরে যে কোন জায়গায় আলাপ বা সংলাপ হতে পারে। তবে এই সংলাপ হতে হবে শর্তহীন। এ কথায় চিড়ে ভিজছে না। কারণ, সংসদে তাদের এখন ব্রুট মেজোরিটি। সুতরাং ব্রুটালি আলোচনা বা সংলাপ হতে পারে এ আশংকা বিরোধী দলের। সেই আলোকে বিরোধী দলের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতাও। ব্রুট মেজোরিটির কল্যাণেই হোক বা অন্য কোন কার্যকারণে হোক সরকারের অবস্থানও এবার প্রথম থেকেই বেশ শক্ত। এবারে সরকারের সব কার্যক্রম একটি সুনির্দিস্ট ধারণা কাঠামো নিয়েই শুরু হয়েছে। সেটি দেশের জন্যে কতটা লাভজনক তা সময়ই বলে দেবে। তবে সম্ভবত: দলের জন্যে সাময়িকভাবে হলেও লাভজনক। আর রাজনৈতিক দল এ দেশে সত্যিকার রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত হয়নি বলে নেতৃত্ব স্তরের গুটিকতক মানুষের সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছা কোন ব্যাপক দলীয় অভ্যন্তরীণ আলোচনা ছাড়াই গৃহীত, নন্দিত ও অন্ধভাবে সমর্থিত। অন্ধ সমর্থন, সমর্থন বিষয়ক অন্ধতা ও আবেগ রাজনৈতিক উল্লম্ফনময় অতিগতিশীলতাকে অবারিত, উত্তুঙ্গ ও সাধারণ নাগরিকের জন্যে ভয়াবহ করে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেই গণতন্ত্র নেই। আর দলের বাইরে যারা তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ সেও বা সম্ভব হবে কেমন করে। সুতরাং গুটিকতক মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পুরো দেশ বিষয় ও জীবন বিষয়কে নিরূপিত করছে। অর্থাাত্, গণতান্ত্রিক, আলোচনা, পর্যালোচনা ্ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই যে রাজনীতি সে রাজনীতিতে যেহেতু লাগাম টেনে ধরে ট্রাকে ধরে রাখার কোন বিষয় থাকে না সেহেতু তা পথে উল্টে পড়া বাস-ট্রাকের মত যাত্রীহত্যার কার্যকারণ হতে পারে যে কোন সময়। এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের জালে আটকে যায় রাজনীতিক। এগোলে পেছাতে পারে না। পিছালে এগোতে পারে না। একটি অনির্দিষ্ট অতিগতিশীলতা সবার জন্যে মরণ কামড় অবধারিত করে। বাংলাদেশে এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাই।
রাজনীতি সে কারণে এখন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে। শক্তির উন্মত্ত খেলা চলছে চারিদিকে। সামাজিক শক্তি আর সরকারি শক্তি এখন প্রত্যক্ষভাবে মুখোমুখি। রাজনীতির অতিগতিশীল পরিস্থিতিতে সমাজও ভয়াবহভাবে রাজনীতিকৃত হয়ে ওঠে বিকৃত অর্থে। বিরোধী দলের সঙ্গে সামাজিক শক্তি একাকার হয়ে গেছে সেই কারণে। মানুষের অস্বস্তি ও অপ্রাপ্তির বহর এতো দীর্ঘ হয়ে উঠেছে যে, বিরোধী দলকে তাদের সংগঠিত করতে হয়নি। তারা অকৃপণ ধারায় বিরোধী দলের সঙ্গে মিশে গেছে। ইতিহাস ও সমাজের সম্পর্ক চিরকাল এমনই। সরকার কতটা গুডস ডেলিভারি দিয়েছে সে প্রশ্নে না গিয়েও নিত্যদিনের বাজারের ও আচারের ছবি বলে দেয় মানুষকে তারা কোন দিকে যাবে। এ সময় খুব দরকার সৃষ্টিশীলতা, ধৈর্য ও দূরদৃষ্টি। রাজনীতির ভেতরে দেশে এ রকম কিছুর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না যদিও সমাজ সামগ্র্যে সমর্থ, মেধাবী, কল্যাণশীল ও দক্ষ লোকের অনুপস্থিতি নেই । তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, এর সবটাই এ সরকার করেছে।্ এটি ঘটে চলেছে কোন কোন ক্ষেত্রে নিছক ঐতিহাসিক কারণে। তবে সরকারের দায় এতো বিস্তৃত যে, সরকারে থাকা অবস্থায় তা এড়ানোর কোন উপায় নেই। আর তাইতো মানুষের চোখ ও জিজ্ঞাসা উঁচিয়ে আছে সরকারের দিকে। আর সরকারও অজ্ঞতা অথবা চাতুর্য অথবা বিভ্রান্তির কারণে ক্ষমতা আয়তনের সীমার মধ্যেই নিজেকে আটকে রেখেছে। বাইরে বেরুচ্ছে না বা বেরুতে পারছে না। গণতন্ত্রে যা সবচেয়ে প্রার্থিত, আপডেটিং ও ফ্লেক্সিবিলিটি, কোন ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। অবরুদ্ধ রাজনীতি ও অন্ধ ক্ষমতার মত নির্মম আর কিছু হতে পারে না। তাই পথে পথে মরছে মানুষ। আন্দোলন করতে গিয়েও মরছে, না করতে গিয়েও মরছে। মৃত্যু অবধারিত হয়ে উঠেছে সর্বত্র। ঘরে-বাইরে কোথাও মৃত্যুর জন্যে এখন পাসপোর্ট দরকার হয় না। মৃত্যুর জন্যে এখন কোন চেকপোষ্ট নেই। আর দেশের সীমান্তের চেকপোস্টেও অবারিত মৃত্যুর যজ্ঞ চলছে। বিএসএফ’র হাতে। সরকার কারুর দায়িত্ব নিতে পারছে না। জীবনের পক্ষে কোথাও সরকার সাহসী হতে পারছে না, সৃজণশীল হতে পারছে না। সরকারকে ভেতর-বাহির থেকে কে যেন তাড়া করছে। আর বিরোধী দল, তার হাতে তো আনুষ্ঠানিক কোন ক্ষমতাই নেই। এ ক্ষেত্রে তাদেরও ভূমিকা মরণমুখি। তারাও জীবন বাজি রেখে মরণে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিবাদ করবার জন্যে, আন্দোলন করবার জন্যে। রাজপথের রাজনীতির ভাষায় তারা কথা বলছে । রাজপথের বাইরে তাদের কর্মের ও কর্মসূচির কোন জায়গা নেই। ওখানেও তাই মানুষের জন্যে মরণ ফাঁদ। বাংলাদেশ আজ দু’মুখো মরণ ফাঁদের মাঝখানে দাঁড়ানো। পা বাড়ালেই মরণ, পেছালেও মরণ।
প্রতিষ্ঠানগুলো কাজের চরিত্র হারাচ্ছে । অকাজের ওস্তাদ হয়ে উঠছে। কখনো কখনো ব্যর্থতাই হয়ে উঠছে গরিমার বিষয়। যেমন পুলিশ বাহিনী। তারা বড় বড় তদন্তে অসফল হয়েও একটুও লজ্জিত নয়। তাদের বড় বড় পদের বড় বড় মানুষেরা (?) ব্যর্থতার লজ্জা নিয়ে মর্যাদার প্রয়োজনে পদত্যাগ করছে না। নৈতিকভাবে ও প্রায়েগিকভাবে তারাও ফাঁদের ভেতর, যার এ পাশেও মৃত্যু ওপাশেও মৃত্যু। রবিঠাকুর সাহিত্যকে উচ্চ সাংস্কৃতিক স্তর থেকে বলতেন ‘বাজে কথা’। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে-বাহিরে দায়িত্ব নেই সবই ’সাহিত্য’ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ এখন সাহিত্য তথা অপসাহিত্যের বাজার।
অথচ রাজনীতির মূল সংজ্ঞটা একবারেই অন্য রকম। রাজনীতি হাতাহাতি নয়, এ হচ্ছে মাতামাতি। আরো শুদ্ধ ভাষায় বললে এ রকম শোনায় রাজনীতি হচ্ছে সংঘাতের বুদ্ধিবৃত্তিকরণ। সংঘাত এড়িয়ে বা ছাড়িয়ে আরো উপরের স্তরে গিয়ে সংঘাতের কার্যকারণ নির্মূল করার প্রক্রিয়াই রাজনীতি। সমাজকে আরণ্যকতা থেকে উদ্ধারের জন্যেই রাজনীতি। সমাজ জীবনে বিবাদ-কলহকে আলোচনা-পর্যালোচনা বিবেচনার অধীন করে সমাধান বের করবার জন্যেই রাজনীতি। রাজনীতিতে আলোচনার কোন বিকল্প নেই। আর সংসদীয় গণতন্ত্রে সংজ্ঞা তো আরো স্পষ্ট। সংসদ মানে কথার আসর। অর্থাত্ আলোচনার আসর। বিতর্কের তাত্পর্যপূর্ণ স্থান হচ্ছে সংসদ। মার্জিত ভাষা, উত্তেজনা বিবর্জিত রুচিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিময় ভাষায় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সমাধান বের করবার জায়গা হচ্ছে সংসদ। প্রজ্ঞা ও সুবিবেচনার ঘাটতির কারণে অথবা যোগ্যতা ও যথার্থ প্রশিক্ষণের কারণে সংসদ তার নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এটি অন্ধ ক্ষমতা বোধের কাছে পরাজিত হয়ে একটি অনিশ্চয়তায় দেশ, মানুষ ও জীবনকে নিয়ে চলেছে। এমন ধৈর্য ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না যা সংসদীয় গণতন্ত্রকে তার স্বরূপে ফিরিয়ে আনতে পারে বাংলাদেশে। অথচ শ্রেষ্ঠ বিকল্প এখন। তা না হলে রাষ্ট্রধারণা পল্টানোর তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা আনতে হবে। বলতে হবে বিশ্ববিবেক ও বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের মাধ্যমে আমাদের এ সমস্যা সমাধান করা দরকার । কারণ আমারা সংসদীয় গণতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্র কোনকিছুর জন্যে নিজেকে প্রমাণ করতে পারছি না। আমাদের রাষ্ট্রধারণাকে বদলাবার সময় বোধ করি এসেছে। বাংলাদেশের রাজনীতি তারই প্রমাণ ও ইঙ্গিত বহন করছে।
n লেখক : সাবেক সভাপতি, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক, গণবিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন