মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

নিয়ন্ত্রণহীন পুলিশ : নির্বিকার সরকার!



ড. মো. হারুনর রশীদ খান
১৯৯৬ সালে জাপানের সাগা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির পরপরই আমার সুপারভাইজার আমাকে জাপানিজ কালচারসহ আমার দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে উপদেশ দিতে লাগলেন। একদিন তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘জাপানে যদি কখনও কোনো বিপদে পড়, তখন তুমি কার কাছে যাবে?’ উত্তরে আমি সরাসরি বললাম, ‘কেন তোমার কাছে।’ সুপারভাইজার বললেন, ‘না, তুমি প্রথমে যাবে পুলিশের কাছে। পুলিশ যে কোনো ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করবে।’ একথা শুনে আমার চোখের সামনে বাংলাদেশী পুলিশের অবয়ব ভেসে উঠল। আমি ভাবলাম, আমার দেশে তো মানুষ যথাসাধ্য পুলিশকে এড়িয়ে চলে। পৃথিবীতে বেশিরভাগ উন্নত দেশেই পুলিশকে জনগণের বন্ধু ভাবা হয়। প্রাচীন গ্রীসের ্তুচড়ষরংংড়ড়ংং্থ নামে যে শব্দ থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি এসেছে, তার অর্থ হলো, ্তুও ংধাব, ও শববঢ়.্থ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই মন্ত্র থেকে আমাদের বাংলাদেশের পুলিশ এখন অনেক দূরে। তারা একদম এর উল্টো কাজটিই করছে। সম্প্রতি পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিদিন অতি গুরুত্বসহ যে সংবাদগুলো ছাপা হয়, তার মধ্যে দেশের কোথাও না কোথাও পুলিশি বর্বরতা অন্যতম।
অসংখ্য বর্বরতার মাঝে সম্প্রতি একদম হৃদয়স্পর্শী ও মর্মন্তুদ যে কয়টি ঘটনা উল্লেখযোগ্য তা হলো—১. গত ২৯ মে পুলিশ আদালতে বিচার প্রার্থী এক তরুণী ও তার মা-বাবাকে প্রকাশ্যে নির্যাতন ও হয়রানি করে। মানুষ যেখানে বিচারের জন্য যায়, সেই আদালতেই ওই তরুণীকে আলাদা কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় পুলিশ। তার বাবার বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর নাটক করে। উপস্থিত সাংবাদিক ও আইনজীবীরা এর প্রতিবাদ করলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও আইনজীবীকে আহত করে। দিনভর হেনস্তা শেষে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের হস্তক্ষেপে রাত ১০টায় তিন জনকেই ছেড়ে দেয় পুলিশ। ২. একই দিনে বরিশালের হিজলায় পুলিশের একজন এএসআই পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের নামে একজন গৃহবধূর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলে স্থানীয় লোকজন পুলিশের সহায়তায় গৃহবধূকে উদ্ধার করে। ৩. অন্যদিকে এই দিনই পাবনায় জেল থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আনা একজন বন্দীকে পুলিশ এলোপাতাড়িভাবে পিটিয়ে অচেতন করে হাসপাতালে পাঠায়। ৪. গত ৩০ মে গাজীপুরে গ্রেফতারের পর হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিশ বালু ব্যবসায়ী মামুনকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই মামুনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ৫. গত এপ্রিল মাসে খুলনা সদর থানায় একজন ছাত্রকে ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটায় পুলিশের ওসি কামরুজ্জামান। পত্রিকায় প্রকাশিত ঝুলিয়ে পেটানোর এই ছবি দেখলে যে কোনো সুস্থ মানুষ শিউরে উঠবে। সেটা যেন এক মধ্যযুগীয় বর্বরতা, কিংবা পাক হানাদারদের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা। ৬. গত মাসে আন্দোলনরত এক প্রাথমিক শিক্ষককে পিটিয়ে গায়ে গরম পানি ঢেলে মারাত্মক জখম করে পুলিশ। মুক্তিযোদ্ধা এই হতভাগ্য শিক্ষক পরে মারা যান। ৭. গত বছর পুলিশের চোখের সামনে ঢাকার অদূরে আমিনবাজারে ছয় কলেজছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে গ্রামবাসী। ৮. একই বছর খিলগাঁও থানার ওসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরকে থানার ভেতরে চাপাতি দিয়ে কোপায় এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজায়। প্রিয় পাঠক, এক সমুদ্র পানির সমান অপরাধের মধ্যে এগুলো মাত্র কয়েকটি পানির কণাসম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পুলিশ মধ্যযুগের সব বর্বরতার সীমাও যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কোনো দেশের পুলিশ হলো ওই দেশের আইন-শৃঙ্খলার মূল ধারক, দেশ তথা জনগণের জানমালের রক্ষক। পুলিশ সরকার তথা দেশের জনগণের চাকর। চাকর যদি অত্যাচারী হয়ে মনিবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেটা দেশের জনগণের জন্য, জাতির জন্য কখনও সুখকর নয়। দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করার বিধান আছে। একটি রাষ্ট্রে যত বেশি পুলিশের লাঠিচর্চা হয়, সে রাষ্ট্রে জ্ঞানের চর্চা, বুদ্ধি ও বিবেকের চর্চা তত কমে যায়। লাঠি প্রধান হলে সেখানে কলম, বিবেক ও বুদ্ধি গৌণ হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে যে কোনো ধরনের সংঘর্ষ বা জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়—সেখানকার পুলিশ দু’হাত দিয়ে লাঠির দুই মাথা চেপে ধরে জনগণকে দূরে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং লাঠির এক মাথা ধরে গায়ের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এটা একটি স্বাধীন দেশে, কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। আমাদের দুর্ভ্যাগ্য, আমরা ৪১ বছর পরও স্বাধীনতার কানাকড়িও ভোগ করতে পারছি না। জনগণের দেয়া কর থেকে যাদের বেতন হয়, জনগণের সঙ্গে তাদের এমন অমানবিক, অনৈতিক ও হিংস্র আচরণের দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তায়। ওপরে বর্ণিত পুলিশের সবক’টি অপকর্মের পরপরই সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কম-বেশি বক্তব্য প্রদান করে জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে তরুণী নির্যাতন, সাংবাদিক ও আইনজীবী পেটানোর ঘটনায়ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ‘অমিয়’ বাণী দিয়েছেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করুন।’ আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে—এই সার্টিফিকেট আপনাদের দিতেই হবে। তবে সবাই ভালো হবে, এমন কথা নয়।’ মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। আদালতপাড়ায় যে তরুণীটি লাঞ্ছিত হলো সে এ দেশেরই সন্তান, আমাদের কারও না কারও মেয়ে, বোন কিংবা নিকটাত্মীয়। দায়িত্বশীল ব্যাক্তিরা যখন এরকম বেফাঁস কথা বলেন, তখন আমরা মর্মাহত হই, আমদের বিবেককে নাড়া দেয়। ড. কামাল হোসেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে জাতির কাছে তার এই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেছেন। গণমাধ্যম, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে পুলিশ থেকে দূরে থাকলে তারা সংবাদ সংগ্রহ করবে কীভাবে? তার বক্তব্যে মনে হয়, সরকার পুলিশি নির্যাতনের ছবিগুলো জনগণকে দেখাতে চায় না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা লাঠি আর রাইফেল দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ সাধারণ মানুষকে যেভাবে পেটানো হয়, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সরকার কি তাহলে চায় না—বিশ্ববাসী দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই জঘন্য দৃশ্য দেখুক? এর আগে আমরা দেখেছি, সাগর-রুনি হত্যার তদন্তসহ অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা স্বীকারের পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং তিনি এতে সন্তুষ্ট।
মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্যে পুলিশের উন্মত্ত, অশালীন ও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ বন্ধ না হয়ে বরং উত্সাহিত হয় এবং পুলিশ নবোদ্যমে নতুন নতুন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। মন্ত্রীদের এরকম কথা বলার দুটি ক্ষতিকর দিকে আছে। প্রথমত, এতে পুলিশ বাহিনীর প্রতি সরকারের অসহায়ত্ব প্রকাশ পায় এবং প্রতীয়মান হয়, সরকারের ংঁঢ়বত্ ংঃধঃব বহঃরঃু-গুলোর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যেটা জাতির জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত। আর দ্বিতীয়ত, এটি মন্ত্রী তথা সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্নম্ন করে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। পুলিশ যদি সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ মনে করে, সেটা অবশ্যই আশঙ্কার কথা। পুলিশ যেখানে ‘জনগণের বন্ধু’, সেখানে খোদ মন্ত্রীই বলছেন, পুলিশকে এড়িয়ে চলতে। দেশ কি তাহলে পুলিশ চালাচ্ছে? পুলিশ কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও শক্তিশালী? কিছুদিন আগে বিরোধী দলের নেতারা যাতে আদালতে বিচারপ্রার্থী না হতে পারেন, সেজন্য পুলিশ আদালত ঘিরে রেখেছিল। আর এখন সাধারণ মানুষ যাতে আদালতে যেতে না পারে, সেজন্য পুলিশ আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিক ও আইনজীবীদের পেটাচ্ছে, নারীদের শ্লীলতাহানি করছে। এর চেয়ে অসভ্যতা, নির্মমতা আর কী হতে পারে? কী দারুণ উন্নতি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর! পুলিশের সবাই ভালো হবে, সে আশা কেউ করে না; কিন্তু যারা খারাপ ও অনৈতিক কাজ করে তাদের যথাযথ শাস্তি সবাই আশা করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী অত্যন্ত স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তাদের সুপথে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মন্ত্রীরা শুধু বক্তব্য দিলেই চলবে না, তাদের বক্তব্য জনগণকে বিশ্বাস করানোর দায়িত্বও তাদেরই। বর্তমান অবস্থায় পুলিশ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, এটা এদেশে কি কেউ বিশ্বাস করবে? এ ধরনের বক্তব্য যে তরুণীটি আদালত কক্ষে তার ইজ্জত হারিয়েছে, তার সঙ্গে, তার অভাগী মায়ের সঙ্গে এবং হতভাগা বাবার সঙ্গে নিষ্ঠুর মস্করা ছাড়া আর কিছু নয়।
সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তদের তাত্ক্ষণিক চাকরিচ্যুত করা হয় এবং সেটা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। তারপর তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এমন কাজ করতে সাহস না পায়। পুলিশের বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, যেখানে বিরোধী দলের চিফ হুইপকে মারলেও কিছু হয় না, সেখানে আদালত চত্বরে অসহায় তরুণীর শ্লীলতার মূল্য কোথায়? বিরোধী দলের চিফ হুইপকে ফিল্মি কায়দায় আক্রমণ ও মারধর করার পুরস্কারস্বরূপ সেই পুলিশ কর্মকর্তা হারুনকে ৪২ জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে প্রথমে মানিকগঞ্জের এসপি এবং তার এক সপ্তাহের মাথায় লালবাগের উপকমিশনার করা হয়। আর সেটা দেখে পদোন্নতি ও প্রশাসনের সুদৃষ্টির আশায় পুলিশ বিরোধী দলকে যখন তখন পিটিয়ে খোঁড়া করে, অবিশ্বাস্য মিথ্যা মামলা করে ১১ দিনে তার চার্জশিট দিয়ে বিরোধী দলের মহাসচিবসহ বড়বড় নেতাকে কারাগারে পাঠায়, রাস্তায় প্রাথমিক শিক্ষককে পিটিয়ে গরম পানি ঢেলে পরপারে পাঠায়, সাংবাদিক পেটায়, আর দিনে-দুপুরে আদালত চত্বরে তরুণীর শ্লীলতাহানি করে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের চাকরের এ কী অপকর্ম? সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক পুলিশি নির্যাতনে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি একেবারেই ক্ষুণ্ন হয়ে পড়েছে। লোকদেখানো সাসপেন্ড, ক্লোস্ড, বদলি ছাড়া কিছুই করা হচ্ছে না। আর মন্ত্রীদের কথা একদম ছোট বাচ্চার মায়ের মতো, ‘যত দোষই করুক মায়ের চোখে বাচ্চা নির্দোষ!’ অবস্থা এখন এমন যে, কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো প্রতিবাদকারীকেও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। যে নির্দোষ মানুষের শরীরে পুলিশের আঘাতের চিহ্ন আছে, সে কি সারা জীবনে পুলিশ নামের এই আতঙ্ককে ভুলতে পারবে? সে কি কোনোদিন ভাববে, পুলিশ জনগণের বন্ধু? পুলিশ সব সময় এবং সব জায়গায় যে সীমাহীন বাড়াবাড়ি করছে, তার দায়-দায়িত্ব অবশ্যই মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তথা সরকারের। রাজনীতিবিদদের পেটানো বাদ দিয়ে মন্ত্রীর উচিত পুলিশ বাহিনীকে সামলানো। স্বাধীন দেশে মানুষ নিশ্চয়ই পুলিশ-শাসিত প্রশাসন দেখতে চায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস হিটলারের নািস বাহিনী কিংবা রাশিয়ার জার সরকারের পুলিশ বাহিনীরও কিন্তু নির্মম পতন হয়েছে।
অন্যদিকে পুলিশের তদন্ত যখন পুলিশকে দিয়েই করানো হয়, সে তদন্তে দেশের মানুষ আসল সত্যি জানতে পারবে, তা আশা করার কি কোনো কারণ আছে? যে দেশে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়, যেখানে লালবাগ জোনের কমিশনার ওই তরুণীর অভিযোগকে ‘সাজানো নাটক’ দাবি করে তারই অধীনস্থ অতিরিক্ত উপ-কমিশনারকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন, সেখানে এই তদন্ত রিপোর্টে কি ‘সাজানো নাটক’-এর বাইরে কিছু থাকবে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যখনই কোনো গুম, খুন, কিংবা চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তখনই তিনি জানান, ‘তদন্ত চলছে।’ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কেয়ামত আসবে, কিন্তু তদন্ত শেষ হবে না। আর কখনও যদি তদন্ত শেষ হয়ও, পুলিশ নিঃসন্দেহে নির্দোষ প্রমাণিত হবে, আর ভুক্তভোগী অভিযোগকারীই অপরাধী প্রমাণিত হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, ‘গত সাড়ে তিন বছরে যখনই কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তখনই তার তদন্ত করা হয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ সাধারণ জনগণ কিন্তু জানে না, কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে! পুলিশ কোনো অপরাধ করলে তাকে প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তদন্তের নামে সেটি হিমাগারে চলে যায় বা ধামাচাপা দেয়া হয়। একজন সাধারণ নাগরিক অপরাধ করলে যদি তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া যায়, তাহলে পুলিশ তা করলে পুলিশের বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেয়া যাবে না কেন? প্রমাণিত ঘটনায় তদন্ত দরকার পড়ে না। পুলিশের নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে চাইলে এবং এই বাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত করে পুলিশকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। পুলিশ হারুনকে যেভাবে প্রমোশন দেয়া হয়েছে, তাতে তরুণী নির্যাতন, সাংবাদিক ও আইনজীবী পেটানো পুলিশেরও প্রমোশন হবে—সাধারণ জ্ঞান আর ঐকিক নিয়ম তো তা-ই বলে। এ যেন একদম হীরক রাজার দেশ!
আদালতপাড়ায় যে তরুণী আর তার মা-বাবা বিনা দোষে নির্যাতনের শিকার হলো তাতে একটি পরিবার ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। পরিবার হলো একটি রাষ্ট্রের একক (ঁহরঃ)। অসংখ্য পরিবারের সমষ্টি আমাদের এই দেশ। পরিবার বিপন্ন হলে, কিংবা ধ্বংস হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে না। পুলিশের হিংস্র মুখ, বর্বর লাঠি আর বিকৃত মানসিকতার কাছে এরকম অনেক পরিবার বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অহরহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশকে ধোয়া তুলসী পাতা প্রমাণের চেষ্টা না করে এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া উচিত যাতে জনমনে আশার সঞ্চার হয়, জনগণ মন্ত্রী তথা প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারে। দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় সাড়ে তিন বছর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম ‘মিট দ্য প্রেসে’ এলেন গত ১ জুন। তিনি সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বেফাঁস বক্তব্য প্রদানের চেয়ে দুঃখ প্রকাশ অনেক ভালো, কারণ তাতে নির্যাতিত ব্যক্তি, পরিবার এবং জনগণ কিছুটা হলেও সহমর্মিতা খুঁজে পায়। কিন্তু তিনি আবারও যথানিয়মেই বলেন, ‘বিশেষ কোনো মহলের ষড়যন্ত্র হতে পারে। প্রতিমন্ত্রী যে কথা বলেননি সে কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রচার করা হচ্ছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একথা বলেন তখন কিন্তু ওই ‘বিশেষ মহলকে’ খুঁজে বের করার দায়িত্বও তার তথা সরকারের। আর তা না পারলে সেটাতে কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা সরকারের ব্যর্থতারই ইঙ্গিত মেলে। কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশ বাহিনী।’ আর ২০১১ সালের ২৭ মে ঢাকার একটি পত্রিকার বরাত দিয়ে বিবিসি থেকে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের পুলিশের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজন দুর্নীতিগ্রস্ত।’
বাংলাদেশ পুলিশের মূলমন্ত্র শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, প্রগতি। পুলিশ বাহিনীকে স্মরণ রাখতে হবে, তারা তাদের এই মূলমন্ত্র থেকে অনেক বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং সেইসঙ্গে সরকারকেও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন বাতিল করে নতুন ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। ভারতে ২০১০ সালে পুলিশের জন্য বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৪.৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা মাত্র ০.৫ শতাংশ। ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে ব্যারাকে ফিরে যখন একজন পুলিশ সদস্য ঘুমাতে পারে না এবং পরের দিন সকালে আবার যখন ডিউটিতে যেতে হয়, তখন শারীরিকভাবে তারা সুস্থ থাকে না। পুলিশের এসব সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দায়িত্বও সরকারের। সম্প্রতি চট্টগ্রামে পুলিশ সদস্যদের কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে, যাতে সাংবাদিকসহ সব নাগরিকের সঙ্গে তারা ভালো আচরণ করে। তাদের ধৈর্য, সংযম, ত্যাগ ও সেবার প্রতি মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সরকারকে অবশ্যই নিজেদের ব্যর্থতা বিরোধী দলের ওপর চাপানোরে মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই সে ঘটনা ‘বিরোধী দলের সাজানো নাটক বা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর পাঁয়তারা’—এ কথা বলে সরকারের পার পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র হলে সেটা খুঁজে বের করা বা বন্ধ করার দায়িত্বও কিন্তু সরকারেরই। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর সুযোগ নেই।
পুলিশের মাধ্যমে সরকার যে সুনাম (?) অর্জন করেছে, তা আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যায়-অবিচার সহ্য করতে করতে একসময় জনসাধারণের মধ্য থেকেই প্রতিবাদ আসবে। আমেরিকার সংবিধান রচয়িতা ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট জেফারসনের সেই বিখ্যাত উক্তি আমাদের সরকারের স্মরণ রাখা উচিত : ্তুডযবহ রহলঁংঃরপব নবপড়সবং ষধ,ি ত্বংরংঃধহপব নবপড়সবং ফঁঃু.্থ পুলিশ বা কোনো বিশেষ বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীতে কোনো দেশ, কোনো রাষ্ট্র বা সরকার টিকে থাকতে পারেনি। অতএব প্রশাসন তথা সরকারের পুলিশের অন্যায়কে অন্যায় বলা উচিত এবং প্রচলিত নিয়মে আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত। আর সার্জেন্ট আহাদের মতো যারা ভালো কাজ করবে, তাদের জাতীয়ভাবে সম্মান দিতে হবে, পুরষ্কৃত করতে হবে। প্রশাসন তথা সরকারকে মনে রাখতে হবে, ‘পুলিশ নয়, জনগণই সব ক্ষমতার উত্স।’ সরকারকে ক্ষমতায় রাখা না রাখা জনগণের মতামতের ওপরই বর্তাবে, পুলিশের ওপর নয়। সুতরাং পুলিশের পক্ষে সাফাই না গেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়ানোই প্রশাসন তথা সরকারের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত।
লেখক : ডিন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুল,
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা
promi95@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন