সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

পুলিশকে অত্যাচারী বানাচ্ছে কারা?



সৈয়দ নজরুল হুদা (তৌহিদ) :
 স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন গত ৩০ মে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘‘পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।’’ নিজেই আগে পুলিশী নির্যাতনের স্বীকার এবং ইঙ্গিত করে বলেন, ‘‘আমার ডান পা ভাঙ্গা, আগে এমন ঘটনাও ঘটেছে।’’ পুলিশের কোথাও ব্যত্যয় ঘটলে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, আমি রাজপথের কর্মী, পাকিস্তান আমল থেকে রাজপথে রাজনীতি করি। গত সাড়ে তিন বছরে পুলিশ যখন ব্যত্যয় ঘটিয়েছে- তখনই এ্যাকশন নিয়েছি, ভবিষ্যতেও নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ বাহিনীতে এক লাখ একচল্লিশ হাজার পুলিশ রয়েছে এর মধ্যে যে সবাই ভালো, তা বলব না। তবে পুলিশকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ার জন্য কাজ করছি।’’ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সময় মন্তব্যটি করলেন যখন সারাদেশে পুলিশকে নিয়ে এক রকম আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশকে বলা হতো জনগণের বন্ধু। পোলাইটনেস, ওবিডিয়েন্সি, লয়ালিটি ইত্যকার ইংরেজি শব্দের আদি অক্ষর বিশিষ্ট পুলিশ (Police) শব্দটি বিশেষ করে বাংলাদেশের জনপদে এখন এক আতঙ্কের নাম। ইদানিং ক্রমবর্ধমান পুলিশী জুলুম ও অপকর্মের ধারাবাহিক ক্রিয়াকান্ডে জনজীবনে আতঙ্ক ও ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা যে, অপশাসনে সৃষ্ট অনাচার ও ঔদ্ধত্য আজ পুলিশ বাহিনীকে বিপথে চালিত করছে। এ অনাচার একদিনে তৈরি হয়নি। ক্ষমতাসীনেরা প্রতিপক্ষ দলনে যোগ্য সৎ কর্মকর্তাদেরকে সরিয়ে দলীয় লোক নিয়োগ দেয়ায় এ ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। মাস ছয়েক পূর্বে বিএনপি'র দলীয় এমপি ও চিফ হুইপ সংসদ সদস্যদের নিয়ে একটি মিছিল নিয়ে এগুনোর সময় একজন উপ-পুলিশ কমিশনার মো. হারুনুর রশিদ চিফ হুইপ মো. জয়নুল আবদিন ফারুককে যে অমানবিকভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছিলেন- তাতে মিডিয়ার বদান্যতায় সারাবিশ্ব নিনদামূখর হয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তার বিচার না করে বরঞ্চ পুরস্কৃত করে ‘এসপি' পদে পদোন্নতি দিয়েছিল। এভাবে ক্ষমতাসীনেরা দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন' না করাতে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তোলা হয়েছে। যার জন্য এককভাবে ক্ষমতাসীনেরা দায়ী বলে মনে হয়, একটি দৈনিক গত ৩১ মে'র প্রথম পৃষ্ঠায় ‘‘চারদিকে পুলিশ আতঙ্ক’’ শিরোনামে লিখেছে, ‘‘পুলিশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে, আর সরকারের নীতি-নির্ধারকদের বক্তব্য এ আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে কোর্ট চত্বরে তরুণীর শ্লীলতাহানী, রাস্তায় সাংবাদিকদের পিটিয়ে হাত-পা গুড়িয়ে ফেলা, প্রকাশ্যে ছিনতাই, চাঁদাবাজি। নিরপরাধ মানুষকে দুর্বৃত্ত সাজিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলাসহ নানা অপরাধকর্মে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্য। অন্যদিকে, অপরাধীদের বিচার না হওয়ায় অসৎ পুলিশ সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আবার কোনো কোনো ঘটনায় অপরাধী পুলিশ সদস্যরা শাস্তির বদলে পুরস্কৃত হচ্ছেন।’’ সাংবাদিক নিপীড়ন, ফটো সাংবাদিকদের পশুর মতো পিটানো ও ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলাটা, প্রতিবাদী জনতা ও এডভোকেটদের পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে দেয়া পুলিশী কর্মকান্ড হিসেবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিবিধান না করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার নসিহত করেছেন। যে পুলিশকে জনগণের বন্ধু বলা হতো- সে পুলিশ থেকে সভ্য জনতাকে দূরে থাকতে বলা কতটুকু শোভন হলো, মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর মেধায় সেটা কেন ধরা পড়ল না- বুঝা গেল না। পুলিশতো অস্পৃশ্য কোন নিষিদ্ধ এলাকার পশু না। তারা নিপীড়িত জনগণের ত্রাণকর্তা। কুটিল রাজনীতির বাহকেরা যখন তাদেরকে কূপথে ব্যবহার করে, তখন ব্যবহারকারীরা নিজেদের নিাপ দেখাতে পুলিশ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। গত ৩০ মে ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিম আদালত চত্বরে বিচার প্রার্থী এক তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টায় পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক ও আইনজীবী নির্যাতনের ব্যাপারে মাননীয় হাইকোর্ট ৮ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আগামী ৬ জুন হাজির হতে নির্দেশ দিয়েছে। দুঃখ হয়, উদ্বেগজনক এসব অপকর্মের ব্যাপারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহল যখন অপরাধীদের বাঁচাতে সচেষ্ট থাকে, তখনই দেশের শেষ ভরসাস্থল মাননীয় সুপ্রীমকের্টের হাইকোর্ট বিভাগকে এগিয়ে আসতে হয়। জানা গেছে, নির্যাতিতা তরুণীর মামলা  মা ও বাবাকে কোতয়ালী থানায় ৬ ঘণ্টা বসিয়ে রাত ২টায় মামলা নেয় থানা পুলিশ। দৈনিক প্রথম আলো গত ৩১ মে প্রথম পৃষ্ঠায় লীড নিউজে লিখেছে, ‘ব্যবসায়ীকে খুনিদের হাতে তুলে দিল পুলিশ।' আবক্ষ সংবাদে বলা হয়েছে, গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানা পুলিশ বালু ব্যবসায়ী মামুন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে সন্ত্রাসীদের হাতে ছেড়ে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতে হাত কড়া পরা অবস্থায় মামুনকে কুপিয়ে হত্যা করে বীরদর্পে সরে যায় সন্ত্রাসীরা। বিষয়টি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হোসেন পুলিশী সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন। দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন, দেশে ক্রমবর্ধমান পুলিশী অপরাধকে এখনই টুঁটি চেপে ধরতে হবে, কেননা পুলিশী সুশাসন ছাড়া সমাজ স্থবির হয়ে পড়ছে, সমাজে বিশৃক্মখলা সৃষ্টি হবে। আমরা জানি সব পুলিশ খারাপ নয়, অধিকাংশই ভালো। তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। গুটিকয়েক খারাপের জন্য বিশাল এক বাহিনীকে কলংকৃত করা যাবে না। পলিটেকনিক ছাত্রদের বিক্ষোভের সময় ‘প্রথম আলোর' ৩ সাংবাদিককে যেভাবে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, সেটা একটা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। ২০০৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সিলেট কোতয়ালী থানায় তুহিন নামক এক আসামীকে ওসি সাহেবের সামনে জনৈক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। তুহিনের মুখমন্ডল কালো কাপড়ে ঢেকে হাত-পা বেঁধে সে সন্ত্রাসী ক্রমাগত খুরের পোচ আর রড দিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভাঙ্গার নারকীয় উৎসব পালন করেছিল থানা অভ্যন্তরেই। পরে জানাজানি হলে মুমূর্ষ অবস্থায় তুহিনকে সিলেট মেডিকেল ও পরবর্তীতে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হলে ওসি সৈয়দুজ্জামান ও এসআই আল মামুনের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়- এর পরবর্তীতে আর কোন খবর জানা যায়নি। দুর্ভাগা এ জাতি, নিত্যই শত সহস্র দুঃসংবাদের ভারে পূর্বতন অঘটনের খবর ভুলে যায়। তবুও কিছু কিছু দুঃসংবাদ কোনভাবেই ভুলা যায় না। ইতোপূর্বের পুলিশ কর্তৃক দিনাজপুরের ‘ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা' মামলার খবর জাতি ঘৃণাভরে স্মরণ করে।
ক্ষমতার রাজনীতি আজ পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করেছে-এ জন্য পুলিশ দায়ী নয়। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনরা তাদেরকে বিভিন্ন অপকর্ম করিয়েছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দেশের নৈতিকতাকে। যে পুলিশী টহল ছাড়া সমাজ একমুহূর্ত চলতে পারে না- তাদেরকে ক্ষমতার কলুষিত রাজনীতি কত নিচে নামাতে পারে, তার প্রমাণ আজকের পুলিশ বাহিনী। দরকার নিম্ন থেকে শীর্ষ পর্যায়ের সকলকে ঐকবদ্ধভাবে শপথ নেয়ার : ‘আমরা আর অন্যের লাঠিয়াল হবো না। বিবেক দ্বারা চালিত হব।' পুলিশের ভাবমূর্তি ও দেশের অস্তিত্ব রক্ষায় বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার-নচেৎ সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন