বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

শফিক রেহমানের কলাম--ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড



               ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড

ডিসেম্বর ২৮, ২০১১
shafik-rehman211111111112111প্রশ্ন : আমেরিকার বিয়াল্লিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন, যিনি তার ইচ্ছানুযায়ী বিল ক্লিনটন নামে বেশি পরিচিত, তার সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মা’ল আব্দুল মুহিত, যিনি সংক্ষেপে মুহিত নামে পরিচিতÑ এই দুইজনের মধ্যে মিল কী?
উত্তর : দুজনই স্টুপিড শব্দটি ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত।

তবে দুজনের মধ্যে গরমিলটা হচ্ছে ক্লিনটন ক্ষমতায় যাবার আগে শব্দটি বহুল ব্যবহার করেছিলেন। আর মুহিত ক্ষমতাসীন হবার পরে শব্দটি বহুল ব্যবহার করেছেন। শব্দটি ক্লিনটনের মুখ নিঃসৃত ছিল না। একচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট জর্জ হার্বার্ট বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩)-এর পুনঃনির্বাচনের বিরুদ্ধে যখন ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন, তখন লিটল রক শহরে (আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আরকানস-র রাজধানী) তার ক্যামপেইন হেড কোয়ার্টার্সের সামনে ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড (It’s the economy, stupid) স্লোগান সংবলিত একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়। ক্লিনটনের পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজিস্ট জেমস কারভিল ১৯৯২-এ নির্বাচনী অভিযানের সূচনায় এই সাইনবোর্ড টাঙ্গান।তিনি চেয়েছিলেন ভোটারদের বোঝাতে তাদের দলের মূল লক্ষ্যটা কী। বিল ক্লিনটন তখন ছিলেন আরকানস-র তরুণ গভর্নর। তিনি বলেছিলেন, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। তাই আমেরিকান ভোটারদের উচিত হবে বুশকে বাদ দিয়ে ডেমক্রেট ক্লিনটনকে নির্বাচিত করা। এই স্লোগান দিয়ে ক্লিনটন আমেরিকান নাগরিকদের বলেছিলেন, যেহেতু তারা ভাবছেন অর্থনীতির তুলনায় অন্যান্য ইসুগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট সেহেতু তারা স্টুপিড। বস্তুত এই স্লোগান দিয়ে ক্লিনটন প্রতিটি আমেরিকান নাগরিককে স্টুপিড বলে অপমানিত করেছিলেন। অন্যদিকে ক্লিনটন বোঝাতে পেরেছিলেন, ওই সময়ে দেশের একমাত্র রাজনৈতিক ইসু ছিল অর্থনীতি। আমেরিকায় তখন মন্দাবস্থা চলছিল। বহু লোক বেকার ছিল।
ক্লিনটন নির্বাচিত হন। তিনি আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থানকে উন্নত করেন। বেকারের সংখ্যা কমে যায়। তিনি খুব জনপ্রিয় হন এবং পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বলা হয় সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা যদি না থাকতো এবং ক্লিনটন যদি তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী হবার সুযোগ পেতেন তাহলে তিনি অবশ্যই পুনঃনির্বাচিত হতেন। ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সি (১৯৯৩-২০০১) এখনও আমেরিকার সাম্প্রতিক স্বর্ণযুগ রূপে বিবেচিত। তার পরে তেতাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান জর্জ ডাবলিউ বুশ (হার্বার্ট বুশের বড় ছেলে)। তার প্রেসিডেন্সিতে (২০০১-২০০৯) আমেরিকা আবার মন্দাবস্থায় ফিরে যায়। বর্তমান ডেমক্রেট প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা ২০০৯ সাল থেকে আমেরিকার অর্থনীতিকে আবার উন্নত ও দৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও ২০১১-র মাঝামাঝিতে আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪ মিলিয়ন। এই বেকারত্ব দূর করার জন্য দি ডেইলি বিস্ট-এ (১৯.০৮.১১) বিল ক্লিনটন ১৪ দফা প্ল্যান প্রকাশ করেন। আমেরিকায় এখনো ক্লিনটনকে মনে করা হয় তিনি ছিলেন একজন ইকনমিক উইজার্ড (economic wizard) বা অর্থনৈতিক জাদুকর।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে মুহিতের স্টুপিড শব্দটি ছিল মুখনিঃসৃত যা চলতি বছরের শেষে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বর্ষ পর্যালোচনামূলক অনুষ্ঠানে আবারো প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি ‘রাবিশ’ শব্দটিও প্রায়ই প্রয়োগ করেন।
ইলেকশন ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ যে পাঁচটি অগ্রাধিকারের কথা বলেছিল তার মধ্যে প্রথমই ছিল দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা।
ইশতেহারে বলা ছিল, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি, সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
ক্ষমতায় না থেকেও ক্লিনটন তার দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৪ দফা প্ল্যান দিয়েছেন। আর মুহিত ক্ষমতায় থেকে গত ১৬ ডিসেম্বর ২০১১-তে বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি সাপ্লিমেন্টে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন। তার ধ্যান ধারণায় বাংলাদেশের বিপন্ন ভোক্তা বা কনজিউমাররা আশ্বস্ত হতে পারেনি।
বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমলেও
২০১১-তে মূল্য বৃদ্ধির একটি ছবি দৈনিক সমকাল (২৭.১২.২০১১) (প্রকাশক এ কে আজাদ যিনি এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি) তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যায় জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে দাম বেড়েছে :
আইটেম খুচরা দাম বৃদ্ধির পরিমাণ
চাল (সরু)৫০-৫৫ কেজি প্রতি ৫
তেল ৯৬-১১১ কেজি প্রতি ১৬
চিনি ৫৭-৬৮ কেজি প্রতি ১১
বিদ্যুৎ ইউনিট প্রতি গড় ২১%
সিএনজি ১৬-৩০ ঘনফুট প্রতি ১৪
অকটেন ৭৭-৮৯ লিটার প্রতি ১২
পেট্রল ৭৪-৮৬ লিটার প্রতি ১২
ডিজেল ৪৪-৫৬ লিটার প্রতি ১২
দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টের মতে (২৬.১২.২০১১) সয়াবিন তেলের দাম হয়েছে ১২৩ থেকে ১২৬ টাকা।
গত এক বছরে পাঁচ দফায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ। এর প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন খাতে খরচ বাড়ার ফলে শিগগিরই বিভিন্ন ভোগ্য পণ্যের দামসহ বাড়ি ও বাহন ভাড়া আরো বাড়বে সেটা নিশ্চিত।
এখানে মনে করা যেতে পারে যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমে যাবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮-এ দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়। কিন্তু বর্তমান সরকার অব্যাহতভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ধারায় ফিরে যায়। সেপ্টেম্বর ২০১১-তে বিশ্ব বাজারে যখন তেলের দাম আরো এক দফা কমে যায় তার পরেই বাংলাদেশে তেলের দাম আরো এক দফা বাড়ানো হয়।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, ‘জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ালে ইতিমধ্যেই টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া, সরকারের রাজস্ব আয়ের অপর্যাপ্ততা ও সরকারের ঋণগ্রস্ততার ফলে সংকটাপন্ন অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হবে।… মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান প্রায় ১০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চলতি অর্থবছরে অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে।’
এত বিশাল ভর্তুকি দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে তথ্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘এ অবস্থায় জ্বালানি তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে হলে এ খাতে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হবে, যা সরকারের বর্তমান আয় থেকে সঙ্কুলান করা অসম্ভব। এ পরিমাণ ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হলে অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ব্যয়সহ উন্নয়ন ব্যয় কমাতে হবে, যা কাম্য নয়। অন্য দিকে ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণগ্রহণ অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।’
অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা
এই ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য এবং অগ্রহণযোগ্য। এই ব্যাখ্যার বিপরীতে ভোটাররা পাল্টা অনেক প্রশ্ন তুলতে পারে। যেমন, কেন টাকার মূল্যমান কমে গেল? কেন সরকারের রাজস্ব আয় অপর্যাপ্ত হলো? কেন সরকার ঋণগ্রস্ত হলো? কেন অর্থনীতি সংকটাপন্ন হলো?
এরপর ভোটাররা প্রশ্ন তুলতে পারে কেন ইলেকশন ম্যানিফেস্টো প্রকাশের সময়ে আওয়ামী লীগ এসব বোঝেনি বা বলেনি?
ফাইনালি ভোটাররা প্রশ্ন তুলতে পারে এই অবুঝ সরকার কেন এখনো ক্ষমতায় আছে? এই সরকার নিজেদের অক্ষমতা, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা স্বীকার করে নিয়ে কেন পদত্যাগ করছে না?
মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর মতে নভেম্বর ২০১১-তে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশ ছুঁয়েছে যা গত দেড় দশকের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ১৯ ডিসেম্বর ২০১১-তে মুহিত স্বীকার করতে বাধ্য হন ‘শুধু বিশ্বে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে বলেই বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হয়নি। দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু কারণেই মূল্যস্ফীতি হয়েছে।’
কিন্তু ‘বিশ্বে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে’, এই তথ্যটি কি সঠিক? ১৩ ডিসেম্বর ২০১১-তে বিবিসি থেকে জানানো হয় বৃটেনে নভেম্বরে কনজিউমার প্রাইসেস ইনডেক্স (সিপিআই) আগের মাসের ৫% থেকে কমে ৪.৮% হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর ২০১১-তে ইনফ্লেশন ডেটা ডট কম-এ জানানো হয়, আমেরিকাতে ২০১১-র মে থেকে অক্টোবরে এই ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৩.৬৫ এবং সেটা নভেম্বরে কমে হয়েছে ৩.৩৯%।
বস্তুত পশ্চিমি বিশ্বের চলমান মন্দাবস্থায় বিভিন্ন দেশের অর্থমন্ত্রীরা নিয়তই চেষ্টা করছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে এবং তাদের অনেকেই সফল হয়েছেন। ইউকে এবং ইউএসএ-র সর্বশেষ পরিসংখ্যান দুটি এর প্রমাণ।
কিন্তু বিদেশে যাই হোক না কেন দেশের মানুষ সেটা শুনতে আগ্রহী নয়। তারা শাদামাটা ভাবে বোঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বাড়ি ও বাহন ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে এবং আরো বাড়বে। এরা ভাষার মারপ্যাঁচ বোঝে না। এরা পরিসংখ্যানের জটিলতা বোঝে না। অনিয়ন্ত্রিতভাবে দাম বেড়ে যাবার ফলে এদের সংসার বিপর্যস্ত, স্বপ্ন বিধ্বস্ত, জীবন বিপন্ন। সাধারণ মানুষের কাছে দিনদিন বাস্তবতা হলো বাজারের দাম দুঃস্বপ্ন, বাড়ি ও বাহন ভাড়া দুঃসহ। তারা মর্মে মর্মে বুঝছে বর্তমান সময় একটি সুদীর্ঘ দুঃসময়। তারা বোঝে ১২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মানে তাদের সঞ্চয় এবং আয় প্রকৃত অর্থে ১২ শতাংশ কমে গিয়েছে।
দেশের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার আরো কয়েকটি অনাকাঙ্খিত চিহ্ন হলো :
এক. ডলারের দাম বেড়েছে। ২০১০-এ এই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ৭০ টাকা ছিল। এক বছর পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এটি হয়েছে প্রায় ৮০ টাকা। অর্থাৎ, ডলারের বিপরীতে এক বছরে টাকার দাম কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। খোলা বাজারে ডলার এখন ৮৩ টাকা হবার রিপোর্ট এসেছে।
দুই. রাজধানীর কিছু এটিএমে বা ক্যাশ বুথে ক্যাশ টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
তিন. কিছু ব্যাংক গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ক্যাশ টাকা দিতে পারছে না। ‘ব্যাংকে টাকার হাহাকার’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
চার. সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন চারটি ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা বিপুল পরিমাণে আমানত সরিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে, এ বছরের জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে বিপুল পরিমাণ আমানত হারায় এই ব্যাংকগুলো। এ সময়ের মধ্যে সোনালী ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা ৫৭৩ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। জনতা ব্যাংক থেকে তুলেছেন ৯৯০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৭০৬ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা তুলে নিয়েছেন ছয় কোটি ৩১ লাখ টাকা। অর্থাৎ, আমানতকারীরা সরকারি ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকে আমানতকারীদের কম হারে সুদ দেয়া হয় বলে এমনটা ঘটেছে।
পাঁচ. ইনডিয়াতে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ছাপতে দেওয়া প্রাথমিক স্তরের ৮০ লাখ (অপর একটি সূত্র মতে ২৫ লাখ) কপি বই নির্দিষ্ট সময়ে সরবরাহ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে পৃন্টিং বিল পরিশোধ করতে না পারায় এবং বন্দরের শুল্ক পরিশোধ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় আশংকা করা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে দেশের বহু উপজেলায় শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবই পৌঁছাবে না।

সংকটে জর্জরিত ব্যাংকিং সিসটেম

ডলার সংকট ও তারল্য সংকটে জর্জরিত দেশের গোটা ব্যাংকিং সিসটেম ২০১১-তে বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছে।
এক. দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশে ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শংকা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়ছে। সামনে এ চাপ আরো বাড়বে। যে হারে আমদানি দায় বাড়ছে সে হারে ডলারের সরবরাহ বাড়ছে না। তিনি জানান, চলতি মাসে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানির জন্য পরিশোধ করতে হবে ৫০ কোটি ডলার। এর বাইরে পামঅলিন ও গম আমদানি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। পাশাপাশি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রাংশ, পেট্রোবাংলা থেকে বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কম্পানি শেভরনের পাওনা ও বিসিআইসির সার আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। অপর দিকে কয়েকটি ব্যাংকের বকেয়া আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। সব মিলে চলতি মাসে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে অন্য মাসের তুলনায় বেশি, কিন্তু সে হারে ডলারের সরবরাহ বাড়বে না। আর সরবরাহ না বাড়লে রিজার্ভ থেকে পরিশোধ করতে হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে।
সাধারণত একটি দেশের ইমার্জেন্সি খরচ মেটাতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হয়। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে সোয়া তিন বিলিয়ন ডলার করে আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। সে হিসাবে তিন মাসে প্রায় এক হাজার কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ রাখতে হয়। দাতা সংস্থা আইএমএফ সব সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক হাজার কোটি বা ১০ বিলিয়ন ডলার রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু ১ ডিসেম্বর ২০১১-তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৩০ কোটি ডলারে নেমে যায়। এখন আশঙ্কা হচ্ছে, সামনে রিজার্ভ ৮০০ কোটি ডলারে নেমে আসবে।
দুই. রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক চারটির পরিচালনায় অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তীব্র মত বিরোধিতা চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেছেন, ‘… পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো বেশি নজরদারি প্রয়োজন… এই ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো আক্ষরিক অর্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় নিতে হবে।’
প্রতিধ্বনি তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের সম্পদ ও দায় এবং পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা সবক্ষেত্রেই দুর্বলতাগুলোও আরো স্পষ্ট হয়েছে। অনভিজ্ঞদের হস্তক্ষেপে এবং চাপের মধ্যে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।… ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও শক্ত হতে হবে। শুধু চিঠি দিয়ে দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
এদের এসব বক্তব্য অরণ্যে রোদনের মতোই হবে। কারণ সরকার এই ব্যাংকগুলোকে তার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চায়।
তিন. চারটি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি সরকারি কৃষি ব্যাংক রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহার করেও রাজনীতি সামাল দিতে পারছে না। তাই ২০১১-তে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো দশটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ চারটি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। বাকি ছয়টির সম্পর্কে আরো আলোচনার দরকার আছে বলা হয়েছে পরিচালনা পর্ষদে। নিচে চার্টে দেখুন কোন আমলে কয়টি ব্যাংকের অনুমোদন হয়েছে।
কোন আমলে কয়টি ব্যাংকের অনুমোদন
সাল শাসন ক্ষমতায় যারা অনুমোদিত নতুন ব্যাংকের সংখ্যা
১৯৮২-১৯৯০ এরশাদের আমল ৯টি
১৯৯১-১৯৯৬ বিএনপি ৮টি
১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ ১৩টি
২০০১-২০০৬ বিএনপি (চারদলীয় জোট) লাইসেন্স দেয়া হয়নি
২০০৬-২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাইসেন্স দেয়া হয়নি
মোট বেসরকারি ব্যাংক সংখ্যা ৩০টি
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিদেশী ব্যাংক ১৮টি
মোট ব্যাংক সংখ্যা ৪৮টি

রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো ব্যাংক

বর্তমানে দেশের ১৭টি ব্যাংক ঝুকির মধ্যে থাকা সত্ত্বেও মহাজোট সরকার নতুন আরো দশটি ব্যাংকের অনুমোদন কেন দিতে চাইছে? অন্তত এ ক্ষেত্রে এই সরকার সত্য কথা বলেছে। বলা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে হবে। জানা গেছে বর্তমান সরকারের আমলে বিশটি আবেদন জমা পড়েছে।
এই রাজনৈতিক চাপ কারা সৃষ্টি করেছেন তার উত্তর পাওয়া যাবে মোট ৮২টি জমাকৃত আবেদনপত্রে আগ্রহী উদ্যোক্তাবৃন্দের নাম থেকে। দৈনিক আমার দেশ (২১-০৯-২০১১) এর একটি রিপোর্টের কিছু অংশ।
জানা গেছে, নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি তালিকা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আমলে নতুন ব্যাংকের জন্য আবেদন করা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ সালাহ উদ্দিন। তাদের ব্যাংকের নাম দেয়া হয়েছে মধুমতি ব্যাংক। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর একাই চেয়েছেন দুটি ব্যাংক। এর একটির নাম দেয়া হয়েছে ফারমার্স ব্যাংক ও অন্যটির নাম এসএমই ব্যাংক। দি ফারমার্স ব্যাংক গুলশানে অফিস খুলে এরই মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল রূপায়ণ ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছেন।
শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীদের নামেও কয়েকটি ব্যাংকের আবেদন করা হয়েছে। সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নামে সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাংক নামে একটি ব্যাংকের আবেদন এসেছে। ড. এসএম শওকত আলী ‘ক্যাপিটাল ব্যাংক’ এনজিও ব্যক্তিত্ব অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম টিএমএসএস ক্ষুদ্র পুঁজি ব্যাংক, ড. মো: শামসুল হক ভু্য়াঁ অ্যাপোলো ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন। প্রবাসী কমার্শিয়াল ব্যাংক নামে নতুন ব্যাংক চেয়েছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা ফরাসত আলী। তার সাথে আছেন ব্যবসায়ী নেতা কুতুবউদ্দিন। দি ব্যাংক অব এনআরবির আবেদন করেছেন মোল্লা ফজলুর রহমান, নিজাম চৌধুরী ও আরিফুর রহমান। আরবান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আবেদনে নাম আছে সাজ্জাদুল ইসলাম, মো: হেলাল মিয়া ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহসীন উদ্দিনের। ডাইনামিক ইসলামী ব্যাংকের আবেদনকারীরা হলেন বারেকুর রহমান, মো: হেলাল মিয়া ও তাজুল ইসলাম। রয়েল ব্যাংকের প্রস্তাবক হচ্ছেন নুরুল কাইয়ূম খান, জাহাঙ্গীর আলম খান ও আজিজুল খান চৌধুরী। কে টি আহমেদ আবেদন করেছেন বন্ড অ্যান্ড মর্টগেজ ব্যাংক (বিএমবি) প্রতিষ্ঠার। এক্সপ্রেস নামে ব্যাংক পেতে আবেদন করেছেন নাসিম আহমেদ, শাহরিয়ার আলম ও এবাদুল করিম।
আইএমএফ-এর বিরোধিতা
আইএমএফ-এর তরফ থেকে ও বাংলাদেশ এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংকের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
নতুন ব্যাংক বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক স্থাপনের বিষয়টি সরকারের একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জা আজিজুল হক বলেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশে নতুন ব্যাংকের কোনো দরকার নেই। বর্তমান সরকার রাজনীতিবিদদের আবদার মেটাতে নতুন ব্যাংকের অনুমতি দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে। অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমরা যখন দেখলাম সরকার নতুন ব্যাংক করবেই তখন একটি সমীক্ষাকে সামনে রেখে নতুন কিছু শর্ত দিয়ে একটি খসড়া বা গাইডলাইন তৈরি করেছি। এতে কঠিন অনেক শর্তই আছে। প্রকৃত উদ্যোক্তা ছাড়া অন্যরা হয়তো নতুন ব্যাংক পাবেন না। তবে নতুন ব্যাংক সংখ্যায় খুবই সীমিত হবে।’
বছরের শেষ সপ্তাহে ২৬ ডিসেম্বরে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বোঝা যায় অর্থমন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের সম্পর্কে হাস্যরসাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ‘অর্থমন্ত্রীর হ্যা গভর্নরের না’ শিরোনামে রিপোর্টের কিছু অংশ : ‘গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭। এবারের টার্গেট করা হয়েছিল ৭। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই সন্দেহ করছিলেন, এটা অর্জিত হবে না। অর্থনীতি ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত বললেন, হ্যাঁ, আমি শঙ্কিত। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। বললেন, না। আমি একমত নই। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ‘হ্যাঁ’ কেন ‘হ্যাঁ’ সেটা বোঝা গেলেও গভর্নরের ‘না’ কেন ‘না’ সেটা বোঝা যায়নি। একজন বিশ্লেষকের মতে, বার্তা সংস্থার খবর পড়ে মনে হয়েছে, গভর্নর জ্যোতিষের মতোই একটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তার অবস্থানের তথ্য ও উপাত্ত জানতে অনেকেরই আগ্রহ থাকবে। তবে আশার কথা শুনতে মন্দ না। মাত্র চার দিনের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিলেন। তবে এমএ মুহিত কেন ভয় পাচ্ছেন তা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তার কথায়, চার কারণে তিনি ভীত। এই চার কারণ হলো পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, চরম মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ভর্তুকি। অন্য দিকে আতিউর রহমান বলেছেন, তিনি খোজখবর নিয়ে জেনেছেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা ভাল। সে কারণে তিনি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তবে ঢাকার ওয়াকিফহালমহল বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের এই আকস্মিক আশাবাদ ব্যক্ত করার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তারা বুঝতে চাইছেন, অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে উচ্চপর্যায়ের দুই নীতিনির্ধারকের এ রকম পরস্পরবিরোধী অবস্থান শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক কিনা।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বাংলাদেশ অর্থনীতির একটা লেজেগোবরে অবস্থা সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই সাবধান করছিলেন। ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকার চালানোর পরিস্থিতি একটা বিরাট অশনি সঙ্কেত।
ব্যাংকগুলোতে যে তারল্য সঙ্কট চলছে সেটা এখন আর কারও স্বীকার করা বা না করার ওপর নির্ভর করে না। সাধারণ মানুষও তাদের দৈনন্দিন জীবনে টাকার সঙ্কট অনুভব করছেন। বড় অঙ্কের টাকার চেক আগের মতো বিনা নোটিশে ভাঙানো যাচ্ছে না। অনেকেই রসিকতা করে বলছেন, টাকার উপরে মুদ্রিত ‘চাহিবা মাত্র উহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’-এ কথার মানে ও তাৎপর্য বদলে যাচ্ছে। চাওয়া মাত্র টাকা পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।’
এসব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে মনে হয় মুহিত দ্বৈত ভূমিকা পালন করছেন। এক দিকে তিনি সরকারের অর্থমন্ত্রী রূপে বেসরকারি ব্যাংক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে নিজেকে নিছক সরকারি মুখপাত্র রূপে চিত্রায়িত করতে চাইছেন। অন্য দিকে অর্থনীতিবিদ রূপে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে সৎ মতামত প্রকাশ করতে চাইছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা এবং অর্থনৈতিকভাবে সৎ থাকার দুর্বল প্রচেষ্টার এই কন্ট্রাডিকশন বা বৈপরীত্যে মুহিতের বিবেক কি তাকে দংশন করছে? এর আগেও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে পদচ্যুতি ইসুতে মুহিত আরেকটি কন্ট্রাডিকশনে ভুগেছিলেন।
শেয়ার মার্কেটে অব্যাহত দরপতন
ব্যাংকিং সেক্টরের পরেই উল্লেখ করতে হয় শেয়ার মার্কেটে সারা বছর জুড়ে চলমান সঙ্কট ও বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। ৫ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে শেয়ারে দাম ধারাবাহিকভাবে পড়া শুরু হয়।
শেয়ারবাজারে ধস ঠেকাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনো সুফল হয়নি। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ইনসেনটিভ প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েও মার্কেটের ধস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে বহু বিনিয়োগকারী পথে বসেছেন। তারা অবস্থান এবং অনশন ধর্মঘট করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে। কেউ কেউ করেছেন আত্মহত্যা। কারো পারিবারিক অথবা দাম্পত্য জীবন গিয়েছে ভেঙ্গে। কারো হয়েছে হার্ট অ্যাটাক। অনেকে বেছে নিয়েছেন সহিংস পথ। তাদের তাড়া করেছে নিষ্ঠুর পুলিশ। শেয়ার মার্কেটের এই ছবি বছর জুড়ে ছিল টিভির বিভিন্ন নিউজ ও রিপোর্টে।
শেয়ার মার্কেটের অব্যাহত দরপতন ঠেকাতে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় শেয়ার বাজার তদন্ত কমিটি। এই তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু সেই রিপোর্ট পাবলিকের কাছে প্রকাশিত করা হয়নি। ফলে শেয়ার মার্কেটে ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে জড়িতরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মশিউরের হৃদয়হীনতা
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওরা দেশের শত্রু, সমাজের শত্রু। ওদের জন্য মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। তাদের কষ্টে আমার মন কাঁদে না। শেয়ার বাজার ধসে সরকারের মাথাব্যথার কিছু নেই; কারণ শেয়ার বাজারের পুঁজি প্রকৃত বিনিয়োগে যায় না। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীরা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকে দ্রুত কোটিপতি হওয়ার ব্যবসা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেয়ার মার্কেটে যারা টাকা খাটায় তারা অল্প সময়ে অল্প লগ্নি করে বেশি লাভ করতে চায়। তাই তাদের কষ্টে আমার হৃদয় কাঁদে না।’
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক সংখ্যা কতো? একটি সূত্র জানায়, প্রায় ৩৩ লক্ষ। প্রতিটি বিনিয়োগকারীর পেছনে যদি ধরে নেয়া হয় অন্ততপক্ষে পাঁচজন পারিবারিক সদস্য আছেন (পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, জামাই, শ্বশুর, শাশুড়ি প্রমুখ) তাহলে মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা দাড়াবে ৩৩,০০,০০০x৫ = ১৬,৫০০,০০০ বা প্রায় এক কোটি পয়ষট্টি লক্ষ মানুষ!
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের দুর্দিনে তাদের গালিগালাজ না করে ড. মশিউর রহমান কিছু সমবেদনার বাণী শোনাতে পারতেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ক্ষতিগ্রস্ত কেউ না হয় সেসব পদক্ষেপ নিতে পারতেন।
পশ্চিমে শেয়ার মার্কেটের অনিশ্চয়তা বিষয়ে কিছু বাধ্যতামূলক সতর্কবাণী থাকে বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, পোস্টারে, যেমন share prices may go up or down and you may lose your whole investment. (শেয়ারের দাম বাড়তে পারে অথবা কমতে পারে এবং আপনি আপনার পুরো বিনিয়োগই হারাতে পারেন)। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিলবোর্ড-পোস্টারের পাশাপাশি আপামর বঙ্গসন্তানদের উদ্দেশ্যে এই ধরনের সতর্কবাণী নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। যেমনটা সিগারেটের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং তার যথেষ্ট সুফলও পাওয়া গিয়েছে।
ড. মশিউর রহমানের এই ধরনের নষ্ট মন্তব্যে অথবা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অপ্রকাশিত রাখলেই প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ উপদেষ্টার দায়দায়িত্ব মিটে যাবে না। এয়ারলাইন পাইলটের যেমন অলটিমিটার (ভূমি থেকে আকাশে উড়ন্ত প্লেনের উচ্চতা মাপার যন্ত্র), ডাক্তারের যেমন স্টেথিসকোপ, নার্সের যেমন থার্মোমিটারের প্রয়োজন, ঠিক তেমনি দেশের অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের দৈনন্দিন জানা দরকার স্টক এক্সচেঞ্জ ও তার ইনডেক্স এবং ডলার-পাউন্ড-ইউরো প্রভৃতির এক্সচেঞ্জ রেট। আর সে জন্যই বিবিসি ওয়ার্ল্ড, সিএনএন, স্কাই নিউজ, আল-জাজিরা প্রভৃতি টিভি চ্যানেলে বারংবার দেখানো হয় বিশ্বের বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জ ইনডেক্স এবং বৈদেশিক মুদ্রার এক্সচেঞ্জ রেট। স্টক এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অলটিমিটার বিহীন প্লেনের তুলনা করা যেতে পারে। আর তাই বাংলাদেশে স্টক মার্কেট ক্র্যাশ করেছে ২০১১-তে। ও হ্যাঁ, এর আগের হাসিনা সরকারও একই ক্ষেত্রে ক্র্যাশ করেছিল।
কোনো সুখবর নেই
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে সুসংবাদ ছিল না।
এক. গার্মেন্টস : আমেরিকান বাজারে পোশাক রফতানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে চায়না। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ রয়েছে দ্বাদশ স্থানে। অথচ পোশাক রফতানিকারকদের মতে চায়নার অবস্থান কিছুটা নেমে যাওয়ার সম্ভাবনায় বাংলাদেশের অবস্থান উন্নততর হওয়া উচিত ছিল। চাঁদাবাজি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট প্রভৃতির কারণে বহির্বিশ্বে তৈরি ও নিট পোশাক মার্কেট বাংলাদেশ হারাতে বসেছে। তার পরেও ২০১১-তে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রফতানি ২৫০০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।

দুই. আবাসন শিল্প
: জাতীয় অর্থনীতিতে আবাসন খাতের অবদান ২১ শতাংশ। এর মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১,০০০ কোটি টাকা। এই খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায় দশ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। সহযোগী শিল্পেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। রিহ্যাবের মতে ২০১১তে আবাসন শিল্প বন্ধ হবার পথে গিয়েছে। এর কারণ তারা বলেছেন, নবনির্মিত বাসস্থানে সেবা সংযোগ (ইলেকটৃসিটি ও গ্যাস) প্রদানে নিষেধাজ্ঞা, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি আট গুণ বাড়ানো এবং বাস্তব সম্মত ভাবে ড্যাপ বাস্তবায়ন ও জলাধার আইন চূড়ান্ত না হওয়া।
রিহ্যাবের মতে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের রেজিস্ট্রেশন ফি ২৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২,০০০ টাকা করা হয়েছে। এই আট গুণ বেশি ফি দিতে ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। উৎস আয়কর বৃদ্ধি করায় বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন খরচ দাড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। ইনডিয়াতে এই ফি ছয় শতাংশ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর ও শ্রীলংকাতে এই ফি এক থেকে সর্বোচ্চ চার শতাংশ।
রিহ্যাব জানিয়েছে এসব কারণে অন্তপক্ষে ১৬,০০০ ফ্ল্যাট তারা ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে পারছে না। ফলে একদিকে ক্রেতারা এখনো তাদের বাসস্থানের ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে হস্তান্তরিত না হওয়া সত্ত্বেও নতুন ফ্ল্যাটের জন্য কিস্তি পরিশোধে বাধ্য হচ্ছে।
তিন. ম্যানপাওয়ার রফতানি : জনশক্তি রফতানিকারকরা মনে করেন আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়েছে শ্র্রমবাজার চালু রাখতে। দৈনিক প্রথম আলো-র (২৪.১২.২০১১) রিপোর্টে সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়ে তারা বলেছে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সে দেশে প্রতি বছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ কর্মী গেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের তিন বছরে গেছেন মাত্র ৩০ হাজারের মতো। এ সময় ফিরে আসে এরও বেশি, ৫০ হাজার লোক।
জনশক্তি রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সৌদি আরবে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে তিন দশকের মধ্যে কখনো এমন বিপর্যয় হয়নি। সরকারি সূত্র ও ব্যবসায়ী মহল উভয়েরই মতে, এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় শ্রমবাজার মালয়শিয়ায়ও একই অবস্থা। তিন বছর ধরে দেশটিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ আছে। গুরুত্বপূর্ণ বাজার কুয়েতের চিত্রও তাই।
জনশক্তি রফতনিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়শন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, সৌদি আরব, মালয়শিয়া, কুয়েত, কাতারÑ এগুলো হলো বাংলাদেশের আসল শ্রমবাজার। কিন্তু এগুলো চালু করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে; বরং এসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হয়ে উঠেছে।
নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য বর্তমান সরকার পাচটি কমিটি করে তাদের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। কিন্তু তিন বছরে সেই অর্থে নতুন কোনো বড় শ্রমবাজার খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।
তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে রফতানি বিষয়ে একটি ‘সুসংবাদ’ প্রকাশ করেছে দৈনিক নয়া দিগন্ত । রাজধানীর বেশ কয়েকটি নামীদামি হসপিটালে কিডনি কেনাবেচার পাশাপাশি ‘কলম্বিয়া এশিয়ান আন্তর্জাতিক সেবাকেন্দ্র, বাংলাদেশ’ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিডনি-লিভার পাচার করা হচ্ছে। অনেক সময় রোগীদের চিকিৎসার নামেও বিদেশে পাঠিয়ে তাদের কিডনি লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে রাখা হচ্ছে। মালয়শিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পার্শ্ববর্তী ইনডিয়া সহ বেশ কিছু দেশে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয়।
২০১১ জুড়ে এসব সংকটের মধ্যে যুক্ত হয় জাল নোট সংকট। এই বছরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ ১০০০ ও ৫০০ টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১০০০ টাকার জাল নোটও বাজারে আসে। ব্যবহারকারীরা ১০০০ টাকার জাল নোটে বিপন্ন হয় বেশি। কারণ একটি নোট জাল পাওয়া মানেই ৫০০ টাকার দ্বিগুণ ক্ষতি। সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে চক মার্কেটের ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন রিটেইলারের ক্যাশিয়ারের কাজ বেড়ে যায়। প্রতিটি নোট তারা বারংবার পরীক্ষা করে নিতে বাধ্য হয়। ফলে ট্রানজাকশন বা ব্যবসায়িক লেনদেন বিলম্বিত হয়। এই বিলম্বিত সময়ের মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতা পাবলিক যেসব বিশেষণ শেখ হাসিনা, মুহিত ও আতিউর রহমানের প্রতি ছুড়ে দেন সেসব তারা স্বকর্ণে শুনলে লজ্জিত হবেন।
পদ্মা সেতু ও দুর্নীতি
সর্বোপরি ২০১১-তে স্টক এক্সচেঞ্জ ক্র্যাশের মতো আরেকটি ক্র্যাশের সম্ভাবনা আওয়ামী সরকারের মাথায় টাইম বোমা হয়ে ঝুলে ছিল। এটি হচ্ছে মালটি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসা, বিদেশে যাকে বলা হয় পিরামিড মার্কেটিং ব্যবসা। প্রতারণামূরক যে কোনো ব্যবসা বন্ধ করার পাশাপাশি এমএলএম ব্যবসাকে আইনের আওতায় সরকার আনবে বলে জানা গেছে বছরের শেষ মাসে। কিন্তু একটি সূত্র জানিয়েছে দেশের একটি প্রধান এমএলএম কম্পানি পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। বিনিময়ে তারা আইনের আওতার বাইরে থাকার গ্যারান্টি চেয়েছে।
২০১১-তে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ বোধ হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অর্থ সাহায্য প্রতিশ্রুতির প্রত্যাহারে। এর ফলে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ কমেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ফোকাস পলিটিকাল এজেন্ডা
অনেকের মতে আওয়ামী সরকারের এই বিশাল ব্যর্থতার কারণ ক্ষমতা গ্রহণের পর তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো অনুসরণ না করে তারা ইকনমিক এজেন্ডার বদলে পলিটিকাল এজেন্ডা পূরণে ফোকাসড হয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতিই হয়েছে মুখ্য দেশের অর্থনীতি হয়েছে গৌণ। যেমন, শেখ মুজিবকে হত্যার অভিযোগে পাঁচ সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, খালেদা জিয়াকে চল্লিশ বছরের আবাসস্থল থেকে বহিষ্কার, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তারই সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী সরকার সফল হয়েছে।
কিন্তু ইকনমিক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
২৭ ডিসেম্বর ২০১১-তে আল জাজিরাতে প্রচারিত দি স্টৃম (The Stream) অনুষ্ঠানে লন্ডন প্রবাসী সাবেক পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বলেছেন তিনি পাকিস্তানে ফিরে নির্বাচনে অংশ নিতে চান এবং সেই নির্বাচনে জয়ী হলে প্রথমেই পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হবেন।
বাংলাদেশের মানুষ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে সে রকমটাই আশা করেছিল আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো পড়ে।
কিন্তু…
হতাশার কিছু নেই
এতক্ষণ যে বাস্তব ছবিটা তুলে ধরলাম সেটা কি খুব বেশি হতাশাব্যঞ্জক?
যদি এসব পড়ে ও জেনে এবং বাজার ও ব্যাংকে নিজে গিয়ে হতাশ হন তাহলে আপনি হয়তো বিএনপিপন্থী, জামায়াতপন্থী, রাজাকার, কিংবা যুদ্ধাপরাধী (আপনি টিনএজার হলেও!) রূপে বিবেচিত হবেন।
কারণ?
কারণ ২০ নভেম্বর ২০১১-তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘হতাশার কিছু নেই। বলা হচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে হাহাকার চলছে, টাকা নেই। কিসের টাকা নেই? চালাতে পারলে ঠিকই চালানো যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় দেশে কোনো রিজার্ভ মানি ছিল না। তখন কি দেশ চলেনি? রিজার্ভ মানি রাখা হয়, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে তিন মাসের জন্য খাদ্য আমদানি করা যায়। তাই যেহেতু আমাদের খাদ্য আছে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। মন্দার জন্য বিশ্ব এগিয়ে যেতে না পারলেও আমরা এগোচ্ছি।… যে ওয়াদা আমরা জনগণকে দিয়েছিলাম, তার অনেকাংশ পূরণ করেছি। ইনশাল্লাহ বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে।… হতাশা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু হতাশার কিছু নেই।’
সরকারের ব্যাংক ঋণ নেয়া এবং ব্যাংকে লিকুইড মানির অভাব সম্পর্কে প্রচারণার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘টাকা ধার করে সরকার ঘি খাচ্ছে না। জনগণের উন্নয়নে কাজ করছে।’
সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
আপনি ভাবুন, আপনি নিরাপদে আছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এসব পলিটিকাল প্রপাগান্ডার মধ্যে একটি ইকনমিক ট্রুথ থেকেই যাবে।
সেটা হলো বিল ক্লিনটনের সেই স্লোগান, ইটস দি ইকনমি, স্টুপিড।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী সরকারের মধ্যে কে বা কারা স্টুপিড?
২৮.১২.২০১১
(বানান রীতি লেখকের নিজস্ব)
শফিক রেহমান:প্রবীণ সাংবাদিক ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন