২০১২-০১-১৯
জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তার সাথে প্রথম সাক্ষাতে (সে দিন তিনি সাক্ষাৎকারের পরিবর্তে বলেছিলেন, আমার সাথে তার অনেক কথা আছে) তাকে আমার কাছে একজন সৈনিক বলেই মনে হয়েছিল, আর ভাগ্যাহত দেশটার জন্য অনেক কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন তিনি। প্রথম সমস্যাটার কথা তিনি বললেন তার প্রিয় সেনাবাহিনী সম্পর্কে। তিনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন, সেনাবাহিনীর নিজের কোনো সমস্যা নেই, তবে বাইরের কিছু লোক সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।সমস্যা যে এত সহজ ছিল না সেটা আমি ভালো করেই জানতাম। স্বাধীনতার সময় থেকেই মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় সেনাবাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর বিরোধ ছিল। জাতীয় বাহিনীকে বঞ্চিত রেখে রক্ষীবাহিনীকে আদরের দুলালের মতো তোষণ করা হচ্ছিল। জাতীয় বাহিনীর সৈনিকেরা যখন রাবারের স্যান্ডেল পায়ে কুচকাওয়াজ করছিল, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুরূপ ইউনিফর্ম পরিহিত রক্ষীবাহিনী নতুন ভারতীয় জিপে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াত। দুই বাহিনীর মধ্যে রেষারেষি তখন লক্ষ না করে উপায় ছিল না।
এর ওপর ভারত আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতাকে ভারতীয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তারা দ্রুত ঢাকা ফিরে আসেন। মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত এই ব্যক্তিরা রক্ষীবাহিনীকে দিকনির্দেশনা দিতেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পালাক্রমে তাদের কারো না কারো উপসি'তি থেকে আমার ধারণা হয়েছিল তারা শেখ মুজিবের ওপরও নজর রাখছিলেন।
মার্ক টালি প্রমুখ বিবিসির ডাকসাইটে সংবাদদাতারা তখন প্রায়ই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে যেতেন। তারা খবরগুলো প্রচার করতেন এবং ‘খবরের পেছনের খবরগুলো’ সম্পাদকীয় বৈঠকে আমাদের শোনাতেন। আমি নিজেও প্রায়ই বাংলাদেশে গিয়েছি তখন। মুজিব মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও অফিসারদের ডবল প্রোমোশন দিয়েছিলেন। পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে বাঙালি অফিসাররা দেশে ফিরে এসে দেখেন তাদের জুনিয়রদের কেউ কেউ এখন তাদের সিনিয়র হয়ে গেছেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনে আরো একটা মাত্রা যুক্ত হলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা কয়েকজন সেনা অফিসারের বিদ্রোহের পরিণতি হলেও তার পেছনে জাতির সমর্থন না থাকলেও আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। অশাসন-কুশাসন, রক্ষীবাহিনীর গুপ্তহত্যা, সর্বময় দুর্নীতি, অর্থনীতির চরম বিপর্যয়, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার লোকের প্রাণহানি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতার প্রভৃতি কারণে জাতীয় জীবন দুঃসহ, দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল এবং মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় জীবনের প্রতিভু, তারা বিশেষ কোনো মার্শাল রেস বা বিশেষ কোনো শ্রেণী থেকে আসেনি।
টানাপড়েনের বৈদেশিক মাত্রা
মুজিব হত্যার পর থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর টানাপড়েনে একটা বৈদেশিক মাত্রাও যুক্ত হয়। খোন্দকার মোশতাক আহমদ জাতীয়তাবাদী ছিলেন যদিও তার মন্ত্রিসভায় মুজিব সরকারের আটজন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একাত্তরে আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে মীমাংসার প্রস্তাব দিয়ে তিনি দিল্লির বিরাগভাজন হয়েছিলেন, সে জন্য ভারত ও মস্কোর চাপে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই সাউথ ব্লক (ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) তার অপসারণ কামনা করতে থাকে। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ জেনারেল খালেদ মোশাররফ যখন অভ্যুত্থান করে খোন্দকার মোশতাককে অপসারণ এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন দিল্লিতে তখন আনন্দোৎসব শুরু হয়েছিল, সাউথ ব্লকে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছিল।
কিন' সাধারণ সিপাইরা তাদের নামে অফিসারদের অভ্যুত্থানপ্রীতি সমর্থন করেনি। কর্নেল তাহের ও অন্য জাসদ নেতাদের প্রভাবে তারা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। আমার বড়ভাই মরহুম এয়ার কমোডোর এ বি এম মাহবুবুর রহমান ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একজন অফিসারের শূন্য বাড়িতে নিয়ে যান। সে বাড়ির দেয়ালে অন্তত হাজারখানেক বুলেটের গর্ত আমি দেখেছি। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সিপাইদের হাতে ধরা পড়েন, সিপাইরা তাকে হত্যা করে।
সাধারণ সিপাইরা ৭ নভেম্বর গৃহবন্দিত্ব থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে কাঁধে চড়িয়ে সেনা সদর দফতরে নিয়ে যায় এবং সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করে। কিন' সে দিনের একটা প্রবণতায় জিয়া উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। সিপাইরা দল বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে সমাজতন্ত্রী প্রচারপত্র বিলি করছিল, ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিচ্ছিল। তারা গণচীনের তৎকালীন স্বেচ্ছাসেবী গণবাহিনীর অনুকরণে বাংলাদেশে চেন অব কম্যান্ড-বিহীন একটা অনিয়মিত সেনাবাহিনী দাবি করছিল। এটাও পরিষ্কার হয়ে যায়, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কর্নেল তাহের।
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের নির্ধারিত দিন সকালে আমি বিমানে রাজশাহী থেকে এসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামি। পরিচিত এক ব্যক্তি বললেন, সিএমএলএ-এর ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন শুনেছি, কিন' ইন্টারভিউ তো আজ হবে না। তিনি আরো বললেন, আগের দিন পতেঙ্গা ক্যান্টনমেন্টে এক সিপাই জনৈক মেজরকে স্যালুট করতে অস্বীকার করলে মেজর তার আঙুলে গুলি করেন। সেখানে উত্তেজনা চলছে এবং সে উত্তেজনা সামলাতে জিয়া কিছুক্ষণ পরেই চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। ভদ্রলোক অতিরিক্ত কিছু তথ্যও দিলেন আমাকে। এ রকম অবস'া দেশের সর্বত্রই চলছে এবং পরিসি'তি শান্ত করতে জিয়া এ ক্যান্টনমেন্ট থেকে সে ক্যান্টনমেন্টে ছোটাছুটি করছেন, গুটি চালাচালির মতো করে নন-কমিশন্ড অফিসারদের বদলি করছেন। শেরাটন হোটেলে পৌঁছার অল্পক্ষণের মধ্যেই সিএমএলের পিএসএ কর্নেল অলি আহমদ টেলিফোন করলেন। বললেন, আমার সাথে নাকি জেনারেলের অনেক কথা আছে, আজ তার হাতে সময় কম, আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা এক দিন পিছিয়ে দিলে কি আমি কিছু মনে করব?
পরের দিনের সাক্ষাতে জেনারেল জিয়া অনেক কথা বলেছিলেন আমাকে। আমার টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরা তিনি নিজ হাত দিয়ে কর্নেল অলির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, আমার সাথে কথা বলে নিজের ও দেশের সমস্যাগুলো তিনি গুছিয়ে চিন্তা করার চেষ্টা করছিলেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতে চেন অব কম্যান্ড ফিরিয়ে আনা তার প্রথম প্রায়োরিটি। সমস্যাগুলো পরে আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। যতই ভেবেছি সমস্যাগুলো ততই দুরূহ মনে হয়েছে। তার মর্মান্তিক হত্যার পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্ক টালি বলেছিলেন, জিয়া তার সেনাবাহিনীকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন, আর হয়তো সে জন্যই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
জিয়া যেভাবে সমস্যাগুলো শনাক্ত করেছেন
কুশলী সেনাপতি যেভাবে রণক্ষেত্র ও যুদ্ধ-পরিসি'তির বিশ্লেষণ করেন জিয়াউর রহমান ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের সমস্যাবলি বিশ্লেষণ করছিলেন আমার কাছে। এর পরেও কয়েকবার তার সাথে আমার কথা হয়েছে, একাধিকবার তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। কিন' ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারির সে দিনের দীর্ঘ একান্ত আলাপ জিয়াউর রহমানের মূল্যায়নের জন্য আমার বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি বলছিলেন বাংলাদেশের মানুষ মনে-প্রাণে গণতন্ত্রকে ভালোবাসে। তার প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। সুতরাং তাদের গণতন্ত্র দিতেই হবে। কিন' বাকশাল, মুজিব হত্যা, একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান প্রভৃতির পর হঠাৎ করে অবাধ গণতন্ত্র দেয়া নিরাপদ হবে না। নিরাপদে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পন'া নিয়ে তিনি শিগগিরই বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের সাথে আলোচনা শুরু করবেন।
এটা হয়তো নতুন প্রজন্মের জানা না-ও থাকতে পারে। শেখ মুজিব সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক ইত্তেফাক আর বাংলাদেশ অবজারভার- এই চারটি ছাড়া অন্য সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। কিছু দিনের ভেতরই জেনারেল জিয়া সব পত্রপত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, পত্রপত্রিকা প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাকশাল চালুর সময় আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। সব রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি, তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পথ উন্মুক্ত করে দেন এবং নিজেও তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। গোড়া থেকেই তিনি কূটনৈতিক পন'ায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লি থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। সেসব উদ্যোগ ব্যর্থ হলে তিনি আওয়ামী লীগের দুইজন শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে শেখ ভগিনীদ্বয়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করেন। তারা অবশেষে রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যার মাত্র ১৩ দিন আগে ১৯৮০ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
জিয়াউর রহমান বলছিলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ কিন' জনসংখ্যা বিরাট। তার ওপর দেশটা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং প্রাকৃতিক সম্পদও খুবই সীমিত। মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে, বিদেশী রেডিও-টেলিভিশন তাদের প্রত্যাশা বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা নিকট-ভবিষ্যতে কিছু পরিমাণেও পূরণ করা না গেলে গণরোষ সামালের বাইরে চলে যেতে পারে। বিশেষ করে তিনি শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে সমস্যার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, এদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করা না গেলে তারা দেশজোড়া বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। বিগত তিন বছরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদি সংস'া যেভাবে হত্যা, ছিনতাই, সম্পত্তি গ্রাস, ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডার সন্ত্রাস প্রভৃতি চালাচ্ছে জেনারেল জিয়াউর রহমান খুব সম্ভবত এসব নৈরাজ্য দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছিলেন।
জিয়াউর রহমান তারপরে রাষ্ট্রপতি হন। তিনি যখন দেশজোড়া খাল খনন ও নদী সংস্কারের কাজ শুরু করেন তখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, শিক্ষিত বেকারদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করার এই পন'াটি গোড়াতেই তিনি বেছে নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এই কর্মসূচি দেশের শিক্ষিত ও পেশাজীবী মহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল এবং বিশ্বব্যাপী তাতে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। আর মাত্র একটা ব্যাপারেই সে রকম আন্তর্জাতিক উৎসাহ সৃষ্টি হয়, সেটা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে কখনও বন্যা, কখনও খরা- এই হচ্ছে প্রকৃতির তাণ্ডব। সামপ্রতিক কালে ভারত নিদারুণ পানি আগ্রাসন শুরু করেছে এ দেশের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে তারা সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ বেঁধে পানি আটকাচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ খাল তৈরি করে তারা মধ্য ভারতের ঊষর অঞ্চলে সেচের জন্য সেসব নদীর পানি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
পানি আগ্রাসন ও জিয়ার খাল খনন প্রকল্প
অভিন্ন ৫২টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে ভারত বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ দুই সপ্তাহের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সুযোগ ভারতকে দিয়েছিলেন। ভারত সেটাকে চিরস'ায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সাথে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেছিলেন। কিন' চুক্তি অনুযায়ী এক বছরও বাংলাদেশ পানি পায়নি। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ‘নতজানু বন্ধুত্বের’ সম্পর্ক। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে কল্পনার রসগোল্লা খাওয়াচ্ছিলেন এই বলে যে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় এসে মনমোহন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করবেন। মনমোহন এলেন ও গেলেন কিন' তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি হলো না।
ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক মানাভিমানের খেলা খেলল, মাঝখান দিয়ে বঞ্চিত হলো বাংলাদেশ। পশ্চিবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নাকি শেখ হাসিনার ‘জানী দোস্ত। হালে আবার মমতা বন্ধুত্বের জালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনিকেও জড়িয়ে ফেলেছেন। কিন' তিনি বলছেন খরার মওসুমে তিস্তার পানি তিনি বাংলাদেশকে দেবেন না, দেবেন বর্ষাকালে, যখন বন্যা সামলাতে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণান্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সর্বনাশ করবে, সুরমা-কুশিয়ারা আর মেঘনা শুকিয়ে যাবে। কিন' শেখ হাসিনা আর দীপুমনি বলছেন ভারতীয়রা কথা দিয়েছে বাংলাদেশের ক্ষতি তারা করবে না।
বাংলাদেশের মানুষকে নতুন করে বেঁচে থাকার চিন্তা শুরু করতে হবে, শহীদ জিয়ার নদী সংস্কার, খাল খনন ও জলাধার নির্মাণের কর্মসূচিতে ফিরে যেতে হবে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে জিয়া যদি নিহত না হতেন, তার এই আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত কর্মসূচি যদি পরিত্যক্ত না হতো তাহলে বাংলাদেশের মানুষ খাবার পানি, সেচের পানি ও মাছ চাষের পানির ব্যাপারে মোটামুটি স্বনির্ভর হতে পারত। বর্তমানের সঙ্কটপূর্ণ সময়ে বেঁচে থাকতে হলে আবারো তাদের জরুরি ভিত্তিতে সে কর্মসূচির কাজ শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের একটা কর্মসূচির কথা তিনি ভাবছেন- এ কথা জেনারেল জিয়াউর রহমান আলোচ্য বৈঠকেই আমাকে বলেছিলেন। পরবর্তী কালের ১৯ দফা কর্মসূচিতে সেটা বিকাশ লাভ করেছে। এ কর্মসূচিকে যথার্থই জাতীয় মুক্তির ম্যাগনাকার্টা বলা হয়েছে। ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের জমিদার ও জনপ্রতিনিধিরা এক অধিকারের সনদে রাজা জনের স্বাক্ষর আদায় করেছিলেন। ম্যাগনাকার্টা নামে বর্ণিত এ দলিল এখনো ব্রিটিশ গণতন্ত্রের রূপরেখা বলে স্বীকৃত। শহীদ জিয়ার প্রণীত ১৯ দফার প্রথমটিতেই ‘সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার’ কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্য আর পানীয়ের পরেই মানুষের প্রধান ভাবনা শেখ হাসিনার সরকারের ভারতের প্রতি অত্যধিক ঔদার্য থেকে দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার পবিত্রতা রক্ষা করা।
উনিশ দফায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রের মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর ও সুশৃঙ্খল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ওপর। নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল। ভুলে গেলে চলবে না, প্রারম্ভিকভাবে ১০ শতাংশ সরকারি চাকরি নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখার এবং বালিকাদের স্কুলে পাঠানোর বিনিময়ে খাদ্যসহায়তা দেয়ার ব্যবস'া রাষ্ট্রপতি জিয়াই প্রথম চালু করেন। জিয়ার ঘোষিত মূলনীতি থেকে আজকের বাংলাদেশ কতখানি সরে এসেছে তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। বাংলাদেশে ফসল ভালো হয়েছে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা জানান ‘মা-দুর্গাকে’, আরো একটা ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ স'াপনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তোড়জোড় চলছে বলে শুনেছি। অন্য দিকে টুপি-দাড়িওয়ালাদের ওপর নাকি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা খবরদারি নজর রাখছে।
সার্ক গঠনের অনুপ্রেরণা
সমতার ভিত্তিতে সব রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা তার ১৯ দফার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নীতি অনুসারেই জিয়া দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সমিতি (সার্ক) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ভারতের পিছুটানের কারণে সার্ক পূর্ণতা পায়নি। ভারতের লক্ষ্য ছিল ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিভক্ত ও দুর্বল রেখে তাদের ভারতনির্ভর করে রাখা। স্বভাবতই রাষ্ট্রপতি জিয়ার সার্ক গঠনের উদ্যোগকে তারা সন্দেহের চোখে দেখেছে।
তার বিপরীতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের শোচনীয় পরিসি'তি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ভারতের সাথে ‘নতজানু বন্ধুত্ব’ স'াপন করতে গিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্কের গুরুতর অবনতি করা হয়েছে। ভারতকে সন'ষ্ট করার প্রয়োজনে আগ্রাসী ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণ করা হচ্ছে (যদিও ভারতের প্রধান বিরোধী দলই হচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি, যে শিবসেনা গোষ্ঠী মহাত্মা গান্ধীর পরমতসহিষ্ণুতা সহ্য করতে না পেরে তাকে হত্যা করেছিল সে শিবসেনারা এখন বিজেপির অঙ্গদল), সংবিধান থেকে ইসলামকে বাদ দেয়া হয়েছে, নানা উছিলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি হয়েছে। এই দেশগুলো এখন সাহায্য-বাণিজ্য ও শ্রমিক নিয়োগের বেলায় ক্রমেই বাংলাদেশের প্রতি বেশি বৈষম্য দেখাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গত হয়েছেন প্রায় ৩২ বছর আগে। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সে দেশটিকে আমরা বাস্তবায়িত করতে পারিনি। দেশকে আজ যে পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে তাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন মনে হচ্ছে। সেটা যদি আমাদের কাম্য না হয় তাহলে শহীদ জিয়াউর রহমানের লক্ষ্য ও আদর্শের নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে আমাদের। জিয়ার প্রয়োজন আজ জরুরিভাবে অনুভূত হচ্ছে।
লন্ডন, ১৬.০১.১২
serajurrahman@btinternet.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন