আওয়ামী লীগের দোমড়ানো-মোচড়ানো সংবিধান
শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন জোটের মূল দলটির লৌহমানবী সভানেত্রীকে দেখা গেল, তিনি তাঁর দলের প্রধানমন্ত্রীর পাশে নেই। তাই ওই বিল (এফডিআই) পাস হলো না। এই দৃশ্য সাম্প্রতিক, তবে বাংলাদেশে নয়, প্রতিবেশী ভারতে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত উল্টে গেল কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কারণে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা বিরল হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ রকম ঘটতে পারে না; কল্পনাও করা চলে না।
গত তিন বছরে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটি কেমন চলেছে? রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির চেয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে দলের ভূমিকা জোরালো। কিন্তু দলীয় গণতন্ত্রকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি।
প্রথম আলোর জনমত জরিপ বলেছে, সার্বিক মূল্যায়নে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকে ভালো মনে করেছেন ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। কিন্তু দলের প্রতি সমর্থন নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশে। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে ভালো মনে করছেন ৭৩ শতাংশ উত্তরদাতা। বিএনপি জোটের প্রতি সমর্থন উন্নীত হয়েছে ৪৩ শতাংশে।
দলের চেয়ে ব্যক্তির উজ্জ্বলতম অবস্থায় থাকা সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির জন্য সুখকর, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য বিধ্বংসী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলোর ওপর জরিপ চালালে দেখা যাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠই পকেট কমিটি। এগুলো দলের গঠনতন্ত্র চেনে না। কিন্তু যাঁর চেনা থাকলে চলে, তিনি চেনেন। এসব কমিটি দলের সভানেত্রী ও তাঁর সমর্থনপুষ্টদের সন্তোষ অনুযায়ী মেয়াদে টিকে থাকে। মেয়াদোত্তীর্ণ পকেট কমিটিগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ স্থানীয় শাসন, মানবাধিকার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য কোনো না-কোনো মাত্রায় হুমকি।
মহল্লা, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও জেলা কমিটি গঠনের যে বিধান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে, তা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। এই গঠনতন্ত্র উন্নত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু যা আছে, তার মারাত্মক লঙ্ঘন ঘটছে। দলটির গঠনতন্ত্র ও তার বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকে না যে এটি সর্বতোভাবে একটি প্রাইভেট পার্টি হিসেবে চলছে। এখন কলুষিত করার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হতে চলেছে।
এ দলটির একটি যুক্তি অবশ্য এখনো অকাট্য। সেটি হলো, সেনাছাউনিতে জন্ম নেওয়া বিএনপি (স্পেশাল প্রাইভেট) লিমিটেডের চেয়ে তারা উত্তম অবস্থায় আছে। যদি দলীয় সংবিধানের আলোকে তার বৈধতা কোনো আদালতে পরীক্ষিত হয়, তাহলে বহু জায়গার সাংগঠনিক কার্যক্রম বেআইনি হিসেবে গণ্য হবে। দলীয় সংবিধান অগ্রাহ্য করা, এমনকি পদ্ধতিগতভাবে অকার্যকর করে রাখার জন্য কোনো দণ্ড নেই। বাংলাদেশের ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন এসব তদারকির ক্ষেত্রে এখনো নাবালক, তাকে দায়িত্ব দিয়ে সাবালক করার তেমন কোনো দাবিও সমাজে নেই।
২০১১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির বড় সার্কাস হচ্ছে, জাতীয় সংবিধান স্থগিত বা বাতিলের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে দলীয় সংবিধানকে পদপিষ্ট রাখার নীতি বা মনোভঙ্গিতে এতটুকু পরিবর্তন না আনা। জাতীয় সংবিধানের অর্ধশত অনুচ্ছেদের নিন্দা করলে আপনি রাষ্ট্রদ্রোহী হবেন। সে জন্য মৃত্যুদণ্ড আপনার প্রাপ্য। কিন্তু এখানে কতগুলো দলীয় আদর্শগত দিক রয়েছে, যার সমর্থন দলের সংবিধানে নেই। দলের সংবিধান কার্যকর না থাকলে জাতীয় সংবিধান কার্যকর করার দাবি হাস্যকর। দল ও তার রাজনীতি জাতীয় সংবিধান সৃষ্টি করে। জাতীয় সংবিধান দল সৃষ্টি করে না। দল নিকৃষ্ট স্বৈরতান্ত্রিক হলে রাষ্ট্রের সংবিধান উৎকৃষ্ট হতে পারেনা।
সাত বছরের ব্যবধানে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল-পরবর্তী দলীয় সংবিধান আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা, সংসদীয় দলের সভা ও দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর মধ্যে কোথাও ভিন্নমত নেই। পুরোটাই সর্বসম্মত। সে কারণে ক্ষমতাসীন সরকার ও দলকে আলাদা করে চেনা যায় না। চেনা যায় একজন ব্যক্তিকে। এতে যদি আমাদের কোনো ক্ষতি না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়াই ভালো।
এ দেশে এক ব্যক্তিকে ঘিরেই সবকিছু। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলের চেয়ে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের আরও অবনতি ঘটেছে। সভাপতিমণ্ডলীসহ শক্তিধর কমিটিগুলোর মান নিচে নেমেছে। মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ একসঙ্গে আঁকড়ে ধরা বৈধতা পেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনার হাল ধরার আগে গঠনতন্ত্রে তা নিষিদ্ধ ছিল।
এক-এগারোর পরে আওয়ামী লীগের তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয় লাভের ঘটনা দলনেত্রীর ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করেছে। দলে ব্যক্তির প্রভাব আরও বেড়েছে। অনেকটা ‘সামরিক কায়দায়’ ৬৪ জেলায় সম্প্রতি প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে।
সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর জগাখিচুড়ি দলের সংবিধানে ক্ষমতাসীনরা এবারে কীভাবে ধারণ করে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা বাতিলে দলের ভেতরে কোনো দাবি ছিল না। দেশের কোথাও কোনো অঙ্গসংগঠনও এ বিষয়ে রা করেনি। সংসদীয় বিশেষ কমিটিও তা বহাল রাখে। কিন্তু দলের সভানেত্রীর একক সিদ্ধান্তে বাতিল হয়। ১৫তম সংশোধনী বিল পাসের আগমুহূর্তে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিষয়টি ভূতাপেক্ষ অনুমোদন পায়। ওয়ার্কিং কমিটির ওই সভায় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। সভানেত্রী তা নাকচ করেন এই বলে, ওই ব্যবস্থা কেবল ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য প্রযোজ্য। তা যথার্থ যুক্তি নয়।
দুই ব্যক্তিকে একসঙ্গে দল ও সরকারপ্রধান হিসেবে টিকিয়ে রাখার রাজনীতির সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনীতির একটি যোগসূত্র আছে। এই সূত্র ছিন্ন করার ওপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আজ যদি দলের প্রধান হিসেবে একাদিক্রমে দুই বা তিন টার্মের একটি বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, তাহলে সামাজিক রাজনীতিতে একটা মেরুকরণ আসতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের শৃঙ্খলা অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছে। কিছুদিন আগে শ্যামপুরে দলীয় কর্মীদের হাতে দলীয় সাংসদ লাঞ্ছিত হলেন। ফরিদপুরে সাজেদা চৌধুরী ও শ্রমমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের চাপানউতোর প্রকাশ্য। ১৯৯৬ পর্বের মতোই পার্টি অফিস ফাঁকা। অথচ মন্ত্রীদের বাসায় নেতা-কর্মীদের ভিড় প্রচণ্ড। একজন কেন্দ্রীয় নেতা রসিকতা করে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শেখ হাসিনার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারে, কিন্তু দলের স্বার্থে এক পা হাঁটতে রাজি নয়।’ বিভাগীয় পর্যায়ে দলের মহাসমাবেশ করা যাচ্ছে না। বহু জায়গায় দলীয় কোন্দলের কারণে গঠনতন্ত্র-নিষিদ্ধ একটা পূর্ণাঙ্গ পকেট বা অ্যাডহক কমিটি করতে চাইলেও তা করা যাচ্ছে না।
গঠনতন্ত্রমতে, ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক নিয়মিত বসে। কিন্তু মন্ত্রিসভা বা সংসদের চিন্তার বাইরে সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয় না। তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু প্রমুখ ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকাকালে সমালোচনার একটা সুর ছিল। বিগত কাউন্সিলে তাঁদের উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়ার পর এই কমিটির পরিবেশ বদলে গেছে। মতিয়া চৌধুরী নীরব থাকেন। মোহাম্মদ নাসিম কিছুটা সরব থাকলেও তা কাজে আসে না। মন্ত্রিসভার মতোই ৭৩ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার ক্ষেত্রে আনুগত্যই ছিল মাপকাঠি। সেখানে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনায়াসে ‘হাঁ’ জয়যুক্ত হয়।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রচারণা সম্পাদক নূহ-উল আলম লেলিন অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কাউন্সিলের পরে দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহে বড় ধরনের অগ্রগতি এসেছে। এই প্রথম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ কিংবা তার নবায়ন না করা হলে কেউ কাউন্সিলর হতে পারবে না।’ এরই মধ্যে এক কোটির বেশি মুদ্রিত সদস্যপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। আরও ১০ লাখ ফরম ছাপতে দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, পরিবর্তিত কোনো অবস্থায় দলীয় কর্মী হিসেবে প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে ডিজিটাল ডেটা ব্যাংক করার পরিকল্পনা বাদ পড়ে।
দল পরিচালনায় তহবিলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি গণতন্ত্রের একটা পূর্বশর্ত। টিআইবি ২০০৯ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবসংক্রান্ত একটি সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেছিল। এতে দেখানো হয়, ভারত, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত আইন উত্তম। কিন্তু প্রয়োগে পিছিয়ে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনে সম্প্রতি দলের আয়-ব্যয়ের যে হিসাব দিয়েছে, তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইসিও সব দলের তথ্য গোপন রাখছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন বছরে দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তগুলো তাদের দলের কল্যাণ-চিন্তায় নেওয়া হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’
গত তিন বছরে দেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী শাস্তিযোগ্য অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়ার খবর প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে তদন্ত বা শাস্তিদানের ঘটনা বিরল। দল থেকে পারতপক্ষে কাউকে বহিষ্কার না করার ‘ঐতিহ্য’ তারা ধরে রাখছে। অথচ ‘অধিকার’ বলেছে, গত তিন বছরে ‘রাজনৈতিক সহিংসতায়’ ৬০৬ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। এর উল্লেখযোগ্য অংশই শাসকদলীয়। এ সহিংসতায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও হল দখলবাজিও অন্তর্ভুক্ত।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বাজিকররা’ সব দলেই আছে। তারা আসে গঠনতন্ত্রবিরোধী বিরাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়ায়। তাই সর্বনাশা এই বিরাজনীতিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে নিজে দলের সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। দলের সভাপতি পদ নেওয়ার জন্য শিল্পমন্ত্রী কামরুজ্জামানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। সামনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। এ কাউন্সিলে কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করা হবে?
তোফায়েল আহমেদ শনিবার সার্ক তরুণদের সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, সৎ ও মেধাবীরা কেন রাজনীতিবিমুখ? তোফায়েল বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য জানতাম, স্বাধীনতা আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগ কোথায়, তা চিনতাম না। কিন্তু এখনকার অনেক তরুণ ছাত্র টেন্ডারবাজি করে বলে ওই বিভাগ চেনা। তাদের সামনে লক্ষ্য নেই।’ কিন্তু মোক্ষম প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে গেছেন। প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তরুণেরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না?
বিএনপির তিন বছর নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হবে আগামী বুধবার
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন