॥ মহীউদ্দীন আহমদ ॥
২০১১ সাল আরব বসন্তের সূচনাকাল। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উৎসারিত হয়েছে আরব বসন্তের গণজোয়ার। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে জনতার লড়াই-সংগ্রাম ও শক্তির সামনে পতন ঘটেছে স্বৈরশাসকদের। লড়াই চলছে সিরিয়ায়। নব্যস্বৈরাচার বাশার আল আসাদ সেখানে জনগণের শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ, পতন এখন সময়ের ব্যাপার। জনগণের ভোটে সরকার গঠন করার মাধ্যমে মরক্কোর বাদশাহ হাঁপ ছেড়ে বেঁচে গেছেন। জর্ডানে বিরোধী দল শক্তিশালী নয়, তবে পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চল ওমান এখন শান্ত হলেও পরিসি'তি বেঁকে বসতে পারে। কুয়েতে বিক্ষোভ হয়েছে। পার্লামেন্ট উত্তপ্ত হলেও সরকারের বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণে জনগণও শান্ত রয়েছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হামাস-ফাতাহ সমঝোতা আরব বসন্তের অন্যতম বড় অর্জন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ঐকমত্যের সরকার গঠনের অঙ্গীকার ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি ও সি'তিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে অর্থবহ অর্জন বললে অত্যুক্তি হবে না। ফিলিস্তিনিদের বিবদমান উভয় গ্রুপের কৌশল পরিবর্তন এবং কর্মপন'া নতুনভাবে পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকারে এর সুবাতাস বইতে শুরু করেছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে। আরব বসন্তের পরিবর্তিত পরিসি'তিতে হামাসের নীতি ও কৌশল যুগোপযোগী করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে এবং ফাতাহ একলা চলার নীতি পরিত্যাগ করতে সক্ষম হলে ফিলিস্তিনিদের বৃহত্তর ঐক্যপ্রচেষ্টায় সফলতা আসবে। আরব ভূখণ্ডে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ফিলিস্তিনিদের অবস'ান জোরদারে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। আরব বসন্তের প্রভাব পড়েছে ইসরাইলেও। বিগত মাসগুলোতে তেল আবিবসহ অন্য শহরগুলোতে বড় বড় প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে, জনগণ রাস্তায় নেমে পড়েছে, সাথে সাথে ইসরাইলি গণমাধ্যমেও প্রতিবাদী আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। ইসরাইলি বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ ফিলিস্তিনিদের সাথে বোঝাপড়ার জন্য নেতানিয়াহুকে পরামর্শ দিতেও দেখা গেছে।
আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছে রুশ ফেডারেশন ও এশিয়ার কোনো কোনো দেশেও। কোথাও কোথাও এর প্রভাব পড়তে দেখা গেছে সরকারের ক্রিয়াকল্পেও। মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া এর অন্যতম। গণতন্ত্রের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল সোভিয়েত রাশিয়া। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড রাশিয়া বিজয়ী হলেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র ও নির্বাচনে পরাস্ত দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এ নির্বাচনকে অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার নির্বাচন অবাধ বা নিরপেক্ষ কোনোটাই হয়নি। সোভিয়েট ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ ভোট জালিয়াতি হওয়ায় পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। পুতিন ও মেদভেদেভের সময় শেষ হয়ে আসছেও বলে তিনি মন্তব্য করেন। গর্বাচেভ বলেন, এটা ভীষণ লজ্জা ও বিব্রতকর। আমি এ জন্য লজ্জিত। রাশিয়ায় ঘুরেফিরে চলছে ভ্লাদিমির পুতিন ও দিমিত্রি মেদভেদেভের ক্ষমতায় টিকে থাকার নাটক। রাশিয়ার চলমান বিক্ষোভকে রুশ বসন্ত বলেও অভিমত বিশ্লেষকদের। ডুমার নির্বাচনের পর যে বিক্ষোভ চলছে সে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস তাতে সন্দেহ নেই। রাশিয়ার নিষ্প্রাণ রাজনীতি এখন দ্রুত গতি সঞ্চার করছে, চলমান বিক্ষোভে তাই প্রমাণিত। ডুমার নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের প্রতি জোরালো একটি বার্তা দিয়েছেন এবং বাস্তবে এর প্রভাব পড়বে আগামী মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়। কেননা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্রেমলিনের ক্ষমতায় আসতে চাইছেন পুতিন। আগামীতে পুতিন যদি পাতানো নির্বাচনের খেলা খেলতে চান, তাহলে আরব বসন্তের মতো গণ-অসন্তোষ ও ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়বেন তিনি। মিয়ানমারে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে। অং সান সুচি এখন মুক্ত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিসি'তি আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুচি পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। বিদেশী অতিথি ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে চলা শুরু করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রে ফিরে আসবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সুচির দলকে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হলে মিয়ানমার দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মালয়েশিয়ায় স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসন চলছে। গণতন্ত্র সেখানে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগ সরকারের অধীন। কিন' ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর জন্ম নেয়া অসন্তোষ এ বছর জুলাই মাসে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। রাজধানী কুয়ালালামপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা কার্যত রাজধানীকে অচল করে রেখেছিল, যা নাকি মালয়েশিয়ার মতো দেশে অকল্পনীয়। সরকারের দমনপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে নানা মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে; কিন' তার জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। আরব বসন্তের পথ ধরে জনগণ যেমন উদ্বেলিত, তেমনই সরকার অপাতত নির্বাচন পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কিছু সংস্কার মেনে নিয়ে বিক্ষোভ প্রশমনের উদ্যোগ নিয়েছে। সব মিলিয়ে পরিসি'তি আগামী নির্বাচন নাগাদ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে যাবে নাকি বিপক্ষে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।
মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটেছে তা কোনো ভূমিকম্পের চেয়ে কম নয়। তিউনিসিয়ার গণবিস্ফোরণ এত দ্রুত পুরো আরব বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে তা ২০১০ সালের শেষার্ধেও কেউ ভাবতে পারেনি। বু আজিজির আত্মত্যাগের জন্যই অপেক্ষা করছিল আরব দুনিয়া। যেন স্বৈরাচারদের বিদায় ঘণ্টা বাজানোর জন্যই জন্মেছিলেন এই তরুণ। দীর্ঘ দিনের চাপা অসন্তোষ, দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনের যাঁতাকলে অতিষ্ঠ আরব বিশ্বের জনগণ খুঁজে পেল এক বু আজিজিকে তাদের দিশারী ও কাণ্ডারি হিসেবে। বাস্তবতা হলো, আরব জনগণ বরাবরই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে; সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল না কোনো কিছুই। আর তাই আন্দোলন বেগবান হতে সময় লাগেনি। স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে অকাতরে রক্তে সিক্ত করেছে রাজপথ। আরব গণআন্দোলন বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে অর্থবহ আন্দোলন। এর পুরোটাই চলেছে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। কোনো ষড়যন্ত্র বা বহির্বিশ্বের অংশগ্রহণ ছাড়াই এটা সম্ভব হয়েছে।
আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পেয়েছে দেশটি। তিউনিসিয়ার ২১৭ সদস্যের নির্বাচিত পার্লামেন্ট নতুন সংবিধানের প্রস্তাবিত ২৬টি অনুচ্ছেদই অনুমোদন দিয়েছে। নতুন সংবিধান পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক পরিষদের প্রধান মুস্তফা বেন জাফর বলেন, ‘এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত, স্মরণীয় এক রাত, এখন থেকে নতুন তিউনিসিয়ার যাত্রা শুরু হলো।’ ইয়েমেনে শপথ নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। রাজধানী সানার রিপাবলিকান প্যালেসে নতুন সরকারের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে শপথ নেন। ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্যের সরকারে অর্ধেক সদস্য বিরোধী জোটের, বাকি অর্ধেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহের অনুগত। ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ-রাব্বু মানসুর হাদি শপথ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এবং সরকার পরিচালনা করবেন। নতুন সরকার তিন মাস ক্ষমতায় থাকার কথা রয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ। ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ ক্ষমতা ছাড়লেও তিনি এখনো প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান। তার বিরুদ্ধে কোনো বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে না। রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সালেহর অনুগত লোকজনের হাতেই থাকবে এবং তারাই নির্বাচন করবেন এমন বাস্তবতায় ইয়েমেনের জনগণের রায়ের প্রতিফলন ব্যালেট বক্সে ঘটবে কি না সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
এ দিকে মরক্কোর ইসলামী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রধান আবদুল্লাহ বেন কিরান দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেছেন। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রধানকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান। পার্লামেন্টের ৩৯৫টি আসনের মধ্যে জাস্টিস পার্টি ১০৭টি আসন লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্য ছোট দলগুলোর জোট গঠনের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেন। আরব অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তার প্রভাব থেকে মরক্কোকে দূরে রাখতে মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ দ্রুত সংস্কার হাতে নেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর মরক্কোর বাদশাহের পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশে সুশাসন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য কমিয়ে আনার ঘোষণা দেন। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির ঘোষণা নতুন সরকারের বড় সাফল্য। তবে মরক্কোর নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার মতো কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এখনো বাদশাহর হাতেই রয়ে গেছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পার্লামেন্টকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে মরক্কোর এখনো অনেক কিছু করার বাকি। মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হলেও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সামরিক শাসকদের অভিপ্রায় নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ বাড়ছে। নতুন সংবিধানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার বিষয়ে সামরিক কাউন্সিলের সদস্য জেনারেল মামদো শাহীদের খোলামেলা বক্তব্যে এই সন্দেহ সৃষ্টির কারণ। পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে ঘোষণা দেয়ার পর আপাতত সমালোচনা শেষ হয়েছে। কিন' সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা রয়েই গেছে। জেনারেল মামদো শাহীদের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত বক্তব্য নয়, বরং মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় বললে বাস্তবে অত্যুক্তি হবে না। পার্লামেন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস ফ্রিডম পার্টির আত্মপ্রকাশের পর মিসরীয় সেনাবাহিনীর ঘোষণায় তাদের আন্তরিকতা ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হলো। জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টি মিসরে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। আজ ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি মেনে চলা ও আগেকার সম্পর্ক রক্ষা করার বিষয়ে জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। মিসরের সেনাবাহিনী মোবারকের প্রতি অনুগত না থাকলেও ইসরাইলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষপাতী। সেই বিবেচনায় তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না। অন্য দিকে গণরায়কে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ সরকারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মিসরে সরকার পরিবর্তন ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও ইসলামপন'ী সালাফি পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল তাদের স্বার্থপরিপন'ী বলে বিবেচনা করছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণকারী মিসরের সেনাবাহিনী পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের যে স্বপ্ন দেখছে, তার ফলে মিসরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়বে। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাস্টিস পার্টির উপপ্রধান এশাম এল ইরিয়ন ঘোষণা দিয়েছেন, ব্রাদারহুড মিসরে কঠোর ইসলামী বিধিনিষেধ জরবদস্তি চাপিয়ে দিতে আগ্রহী নয়। কারণ মিসরে মুসলিমদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও অন্য সমপ্রদায়ের লোকের বাস। তিনি বলেন, শরিয়া আইনের মৌলিক বিষয়গুলো উদারভাবে প্রয়োগ করতে চাই, যাতে মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে সালাফিপন'ী আল নূর পার্টির দ্বিতীয় স'ান দখল করার ফলে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি তাদের অবস'ান পরিষ্কার করল।
আরব গণজাগরণের ফলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিসি'তিতে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। বিশ্বের যে প্রান্তেই মানবাধিকার পদদলিত বা ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে, সেখানেই আরব বসন্তের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরব বিশ্বে পরিবর্তনের যে সুর লক্ষ করা গেছে, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেই শেষ হবে। মিসর ও লিবিয়ায় এখনো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মিসরে পার্লামেন্ট ডাকা এবং শাসনতন্ত্র রচনার প্রক্রিয়ার সাথে ষড়যন্ত্র চলছে- তবে জনরায়কে হাইজ্যাক করার যেকোনো প্রচেষ্টা মিসরীয় জনগণ প্রতিহত করবে সন্দেই নেই। লিবিয়ার দুর্বল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তাই আন্দোলনকারী জনতাকে সতর্ক থাকতে হবে। সিরিয়ায় স্বৈরাচার সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় অর্জন। আরব দেশগুলোতে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকলে আঞ্চলিক রাজনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের নীতিনির্ধারণে ইসলামপন'ীদের জোরালো ভূমিকা থাকবে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত রাজনীতিতে ইসলামী শক্তির পুনরুত্থানের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে- এটা বর্তমান বাস্তবতায় প্রমাণিত। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইসরাইলের একরোখা মনোভাবের পরিবর্তনের দাবি খোদ ইসরাইলি নেতৃত্বের কাছ থেকেই এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে বাস্তবতার আলোকে। কেননা পুরো আরব ভূমিতে ইসরাইলবিরোধী মনোভাব এখন অনেক বেশি চাঙ্গা। প্রকৃতপক্ষে ইসরাইল একঘরে হয়ে পড়েছে। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বাস্তবতায় ও ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বকে ইসরাইল তোষননীতি পরিহার করে বাস্তবসম্মত পন'া অবলম্বন করতে হবে। আরব বসন্তের আলোকে পশ্চিমাদের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক
mohi_ahmad15@yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন