মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি



মোঃ আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায় : 
রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হলে সেটাই বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রেমিটেন্স আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ দিয়ে মেটানো হচ্ছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী এ কৌশলটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ । দেশের অর্থনীতি জোরদার করতে চাইলে পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি কমানো একটি অন্যতম উপায়। পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে চলবে, এমন অবস্থায় শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা চিন্তা করা যায় না। সময়ের সাথে আমাদের পণ্যবাণিজ্য ঘাটতি শুধু বাড়ছেই।
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে। প্রতি বছরই আমদানির হার বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৪৫ কোটি ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৩৮২ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে চীন থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে চীনে রফতানির পরিমাণ একবারেই নগণ্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে চীনে রফতানির পরিমাণ ছিল ৯.৭ কোটি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭.৯ কোটি ডলার এবং গত অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৩২ কোটি ডলারের পণ্য। গত বছর চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৪৬৮ কোটি ডলারের বেশি। প্রতি বছরই চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
সার্কের ৬টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। অবৈধ পথেও রয়েছে বিশাল একটি বাণিজ্য। সব মিলে তা ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ভারত থেকে আমদানি আশঙ্কাজনকহারে বাড়লেও রফতানি বাড়ছে না। গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বৈধ পথে আমদানির চেয়ে অবৈধ পথে চোরাচালান হয়ে আসে দিগুণ পণ্য।
বর্তমানে ভারতসহ সার্কের দেশগুলো থেকে যেসব পণ্য বেশি আনা হচ্ছে সেগুলোর মধ্য রয়েছে- ভিটামিন জাতীয় ওষুধ, খেলনা, কসমেটিকস, হাতপাখা, লাটিম, হাতঘড়ি, ক্রিকেট ব্যাট, বল, কলম, ছাতা, মোবাইল কাভার, স্ট্যান্ড, চাবির রিং, বডি স্প্রে, লোশন, লিপস্টিক, আইলাইনার, পানির জার, মশার কয়েল, এসি, টেবিল ফ্যান, সিলিং ফ্যান, রুম হিটার, টিউবলাইট, সোডিয়াম বাতি, তালা, সিরামিক পণ্য, পুতুল, লিচু, জেল, সাবান, পাউডার, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি। আমদানিকৃত এসব পণ্যের সবগুলোই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়।
কিন্তু ভারতের কাছ থেকে যে পণ্যভিত্তিক প্রযুক্তি শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক কিছু আমরা শিখতে পারি তা ভুলে গেছি। ডিপ্লোমা শিক্ষা সম্প্রসারণের ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভারত এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবে। ২০২০ সাল নাগাদ এ দেশ হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। আমরা যদিও তাদের কাছাকাছি অবস্থান করতে না পারি তাহলে তো আমাদের ভাগ্যে উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্যের বাজার ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশের রফতানি আর্থিক হিসাবে সামান্য বাড়লেও আমদানি বাড়ছে ব্যাপকহারে। সরকারি হিসাবে গত অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্য রফতানির তুলনায় এ অঞ্চল থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় আটগুণ বেশি। এভাবে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। প্রযুক্তি অদক্ষতার সুনি©র্দষ্ট কারণে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) সুবিধা ভোগ করতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ সার্কের রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সার্কের ৭টি দেশের মোট জনসংখ্যা ১৫০ কোটি প্রায়। এ অঞ্চলে বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। অপরিসীম সম্ভাবনাকে বাস্তবের সাথে সম্পৃক্ত করতে প্রয়োজন দক্ষ ডিপ্লোমা কর্মীবাহিনী।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। গণতন্ত্রের ছোঁয়া যদি ঐ দেশের তরুণদের স্পর্শ করে এবং নিত্য নতুন মডেলের রকমারি পণ্য উৎপাদন করে এই দেশের ক্রেতারা প্রতিবেশী মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকে পড়বে। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি হতেই থাকবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়লেও তা রোধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, বরং পণ্য আমদানিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই বাণিজ্য বাড়ানো যায় না। এ জন্য নানা প্রযুক্তি শিক্ষার কৌশল অবলম্বন করতে হয়। বিশেষ করে প্রতিটি পণ্যকে গুণগত মানসম্পন্ন ও তুলনামূলক কম দামে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেবার মতো দক্ষ কারিগরি ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়।
জাতীয় উন্নয়ন ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য উৎপাদনের কোনই বিকল্প নেই। গত বছরগুলোতে কৃষি শিল্পসহ দেশের উৎপাদনখাতগুলোর সর্বোচ্চ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ আয়োজন ছিলো, তা কোন ক্ষেত্রেই আশাব্যঞ্জক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারেনি। আর্থিক সংকট প্রযুক্তি দক্ষ জনবলের পরিকল্পনাহীনতা কার্যত এ অবস্থার জন্য দায়ী।
তরুণ শিল্প উদ্যোক্তারা পৈত্রিক কৃষি জমি, ঘরবাড়ি, স্ত্রীর গহনা বিক্রি, বাপ-মায়ের পেনশনের টাকায় প্রাথমিক মূলধন সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শিল্পে উৎপাদন প্রবেশের পূর্বে ম্যানেজমেন্ট শ্রমিক নিয়োগ দিতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। একটি পদের বিপরীতে ৬/৭ শত আবেদন। এরপরও চাহিদা মোতাবেক যোগ্য লোক নেই। এক সময় আত্নীয়তা, তদবির, রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে আটকিয়ে যায়। একটি পদের বিপরীতে ১৫-২০ জন নিয়োগ প্রয়োজন হয়। অদক্ষতা, অযত্ন, অবহেলা, অপব্যবহারে উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রার পরিকল্পনা বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে ছোট, বড়, মাঝারী ৭ লাখ ১৩ হাজার ৪১৪টি শিল্পের মধ্যে ৪ লাখ ৬ হাজার ৩১২ টি শিল্প মৃত অথবা শয্যাশায়ী। শিল্পে ঋণের ৬৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫৩ হাজার কোটি টাকাই খেলাপীতে ভারাক্রান্ত। খেলাপীর ভয়ে ব্যাংকগুলো শিল্পে ঋণের চেয়ে আমদানি ঋণ প্রদানে বেশি উৎসাহী। অদক্ষ জনবল, ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কুট কৌশলে আমদানিকারকের উত্থান ঘটে। শিল্প উদ্যোক্তার উত্থান ঘটে অপমৃত্যু হয়।
বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেছে। একবিংশ শতাব্দী হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। প্রতিটি দেশই স্বল্প ব্যয়ে কম সময়ে উন্নত মানের পণ্য উৎপাদন নীতি গ্রহণ করেছে, ম্যানুয়েল পদ্ধতির পরিবর্তে হাই সুপার, আলট্রা সুপার টেকনোলজি সংযুক্ত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর শ্রমিক নিয়োগে সকল শিল্পেই পণ্যভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ দিয়ে শ্রমিক সংখ্যা হ্রাস করে উৎপাদনের ব্যয় সীমিত রাখছে।
গত শতাব্দী থেকেই শিল্প উন্নত দেশগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। চীনে ৮২ জন এসএসসি পাস শিক্ষার্থীকে ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ্যায় প্রশিক্ষণ দিলে ১৮ জনকে সাধারণ শিক্ষার সুযোগ দেয়া হয়। ভারতে ৬৪ জনকে ডিপ্লোমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করলে ৩৬ জনকে কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে ৩ জন ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণ করলে ৯৭ জন সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করছে। কাকতলীয়ভাবে চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি (৮৩ - ৩) = ৭৯ এবং ভারতের সাথে (৬৪ - ৩) = ৬১ গুণ।
বাণিজ্য ঘাটতি অপবাদ দূর করতে হলে প্রযুক্তি করণের মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সকল শিল্পে পণ্যভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এই দেশের তরুণ দেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তরুণদের হাত, চোখ, কান, হৃদয়, মস্তিষ্ক ডিজিটাল করতে হবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড দ্রুততম সময়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামে পণ্যভিত্তিক ডিপ্লোমা শিক্ষা ইনস্টিটিউট নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদদের শ্রম ও মেধার বিনিময়েই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় পরিণত হবে দেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন