সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

টেন্ডারবাজি ঠেকাবে ই-টেন্ডারিং




মা সু দ মু সা
সুযোগের অভাবে সৎ থাকার প্রবণতা বোধ করি আমাদের সমাজেই বেশি দেখা যায়। এমন অনেক গোবেচারা সৎ লোক পাওয়া যাবে যারা গোটা জীবন সৎ থেকেছেন কেবল একটি কারণে। কারণটি হল যথাযথ সুযোগের অভাব। এ ধরনের ঠুনকো সৎরা একটু লাইনঘাট পেয়ে গেলে নিজেকে আর সততার লাইনে ধরে রাখতে পারেন না। জীবনযাত্রায় বাড়তি জৌলুস ও তথ্যপ্রবাহের আচমকা সহজলভ্যতা সবার মনের চাহিদাকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে। এ চাহিদাই সবাইকে বাড়তি রোজগারের দিকে ঠেলে দি”েছ। সেটি অসৎ পথে হলেও কেউ তাতে আর বিবেকের তাড়না অনুভব করছে না। এমনকি সৎ উপার্জনে জীবন ধারণের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্তকারীরাও এখন খাঁটি সৎ পথ থেকে এক-আধটু সরে যেতেও কুণ্ঠিত বোধ করছেন না। এ অব¯’ায় সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা বেশ কঠিনই বটে। তবে দুর্নীতি নির্মূল করার একটি সহজ পথ হল দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করা। ধান মাড়াইকালে গর“র মুখে টোপর পরিয়ে যেমন খড় খাওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়, সে রকম দুর্নীতি রোধ করার জন্য চাই দুর্নীতি করার সমূহ সুযোগ বন্ধ করা। অর্থাৎ কোন সড়কে বড় গাড়ি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কেবল নোটিশ টানিয়ে দিলেই চলবে না, সড়কের প্রবেশমুখে বড় গাড়ি আটকানোর প্রতিবন্ধকও বসাতে হবে।
সরকারি প্রকল্প মানেই দুর্নীতির স্বর্গভূমি, এ কোন নতুন কথা নয়। ভুয়া বিল-ভাউচার করিয়ে যে যেভাবে পারে লুটপাট করে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যায়। কে কত দ্র“ত বাড়ি-গাড়ির মালিক হবেন, এ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে অঘোষিত প্রতিযোগিতাও চলে। সরকারি-আধাসরকারি অনেক সেক্টরে সংঘটিত দুর্নীতিকে এখন কেবল ‘দুর্নীতি’ নামক শব্দ দিয়ে যথাযথভাবে প্রকাশ করা যা”েছ না। এর সঙ্গে আখড়া শব্দ জুড়ে না দিলে সে সেক্টরের দুর্নীতিকে খাটো করা হয়। আর এসবের পেছনে রসদ জোগানদানকারীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রসদগারের নাম হ”েছ ‘টেন্ডার’। টেন্ডার নামক শব্দটিকে লুটপাটের খাসকামরায় প্রবেশের সিংহদরজা বলা যেতে পারে। এই টেন্ডার ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজে যতটা খুন-খারাবি হয়, অন্য কিছুতে ততটা হয় বলে মনে হয় না। বিষয়টির ভয়াবহতার কথা মাথায় রেখে বর্তমান সরকার ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি প্রচলন করেছে, যাকে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রবেশপথে শক্ত প্রতিবন্ধকতা বলা যেতে পারে। ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি অনেক আগে চালু হলেও এর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। একজন আইটি পেশাজীবী হিসেবে এ বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরে নিজেকে ভারমুক্ত করার চেষ্টা করছি।
‘পিপিআর অনুসরণ কর“ন, সরকারি ক্রয়ে স্ব”ছতা, জবাবদিহিতা, অবাধ প্রতিযোগিতা, সমআচরণ ও দক্ষতা নিশ্চিত কর“ন। সরকারি ক্রয়ে পিপিআর, জনগণের অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার’। এটাই মূলত ই-টেন্ডারিংয়ের মূল স্লোগান, যা সরকারিভাবে প্রচারেরও ব্যব¯’া রাখা হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর অনেক গুর“ত্বপূর্ণ ¯’ানে বিশাল বিলবোর্ডে লেখা উপরোক্ত স্লোগানটি অনেকের চোখে পড়তে পারে। সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমে স্ব”ছতা আনার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতার যে কমতি নেই বিলবোর্ডে প্রদর্শিত প্রচার থেকে তা বোঝা যায়। কিš‘ বাস্তবতায় গিয়েই ঘটে যত রকম বিপত্তি। হালের পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক অনেক কিছুকেই ম্লান করে দেয়। 
সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনেক অফিসই পিপিআর অনুসরণ করছে। তবে ই-জিপি (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) সিস্টেম মাত্র কয়েকটি অফিসে চালু হলেও অনেক সরকারি অফিসই এ পদ্ধতির বাইরে। প্রথম পর্যায়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, সিপিটিইউ ও আরইবির ১৬টি প্রকিউরিং এনটিটিতে এর ব্যবহার শুর“ হয়েছে। যদিও অন্যান্য অফিসে ই-জিপি চালুর বিষয়ে বহুল প্রচলিত স্লোগান ‘ইলেকট্রনিক টেন্ডার, ঝুট ঝামেলা নাই আর’ প্রভাব ফেলতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, দরপত্রদাতা, পরামর্শক, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় আইটি অবকাঠামো, আইটি প্রফেশনালস ও প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা। উপরš‘ আইটির নব নব উদ্ভাবন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা না থাকাও এর অন্যতম কারণ।
ই-জিপি চালু হলে দরপত্রদাতা/পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাগজপত্র জমা দিতে হবে না। এজন্য দরপত্রদাতা/পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে সিপিটিইউর ই-জিপি পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্ট, ট্রেড লাইসেন্স, টিন সনদ, ভ্যাট সনদ, কোম্পানি অ্যাডমিনের জন্য কোম্পানির মালিক থেকে অনুমতিপত্র, অথরাইজড অ্যাডমিনের জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট, ই-জিপি রেজিস্ট্রেশন ফি জমার রসিদ, অথরাইজড অ্যাডমিনের পাসপোর্ট সাইজ ছবি ইত্যাদি কাগজপত্র আপলোড করতে হবে। দরপত্রদাতা আন্তর্জাতিক, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক, সবার বেলায়ই যেসব কাগজপত্র আপলোড করতে হবে তার নিয়মাবলি সিপিটিইউর ওয়েবসাইটে বিস্তারিত দেয়া আছে। ই-জিপি চালু হওয়া যে কোন প্রতিষ্ঠানই উপরোক্ত সুবিধাগুলো পাবে। এর ফলে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সহজ হবে, যা দরপত্র/প্রস্তাব মূল্যায়নকে কেবল দ্র“ততরই করবে না; সেই সঙ্গে স্ব”ছতাও নিশ্চিত করবে। ফলে টেন্ডার জমা দেয়া নিয়ে মাথা ফাটাফাটিসহ খুন-খারাবি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে বিশ্বাস।
সিপিটিইউর ই-জিপি পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি সংক্রান্ত কাজগুলো করা খুব একটা কঠিন নয়। এজন্য ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের পরিধির ওপর নির্ভর করে কম্পিউটার যন্ত্রপাতি ও কয়েকজন কি-পার্সোনেলের আইটি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। তারপর ধীরে ধীরে প্রয়োজন অনুযায়ী আইটি এনভায়রনমেন্ট তৈরিসহ আইটি সুবিধাগুলো বাড়াতে হবে। এর ফলে সরকারি-আধাসরকারিসহ সব ক্ষেত্রেই ই-টেন্ডারিং চালু দ্র“ততর হবে।
মাসুদ মুসা : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
সঁংধধশযধহফ২০০০@ুধযড়ড়.পড়স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন