সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি না ভোগবাদ!




ড. আ হ সা ন হা বি ব
সারাবিশ্বে ১৯৭২ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে: এৎববহ ঊপড়হড়সু : উড়বং রঃ রহপষঁফব ুড়ঁ? এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলায় ভাবার্থ করছিÑ ‘পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি : আপনিও কি তাদের একজন?’ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিবেশের ঝুঁকি না বাড়িয়ে মানবকল্যাণ ও সামাজিক পরিবেশবান্ধব সাম্য রক্ষাই এবারের দিবসের মূল লক্ষ্য। গ্রিন ইকোনমির মাধ্যমে সম্পদের অপচয় রোধ ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এনে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে বিবেচনায় রাখা এর উদ্দেশ্য। তবে বর্তমান সময়ে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং ব্যাপক নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
কেননা ভৌগোলিক অব¯’ানগত কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে অব¯ি’ত। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন যৌগের ব্যবহার, বৃক্ষনিধন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব আজ সুস্পষ্ট। কৃষিপ্রধান ও নদীমাতৃক বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। বলা যায়, ইকোলজিস্ট গ্যারেড হার্ডিন ষাটের দশকে ‘ট্রাজিডি অব কমন্স’-এ যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তার প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পেয়েছি। ইতিমধ্যে ‘সিডোর’ ও ‘আইলার’ মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আমাদের জানান দিয়েছে প্রকৃতির বির“দ্ধাচরণ না করতে। এখন উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত বৃক্ষনিধন, নগরায়ন, শিল্প ও কলকারখানা ¯’াপন এবং পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি কারণে পরিবেশ অর্থনীতি আজ হুমকির সম্মুখীন।
পরিবেশ দূষণ সম্বন্ধে আলোচনা এখন আর নতুন কিছু নয়। নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণেই আমাদের এই পৃথিবী অন্যান্য গ্রহ থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশই জোগান দেয় জীবন ধারণের পানি, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড। এগুলো নিজস্ব ভারসাম্য রক্ষা করে পৃথিবীতে আমাদের সু¯’ভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করে দি”েছ। শিল্প বিপ্লবের পর বিভিন্ন বিষাক্ত বর্জ্যরে কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে দেখা দেয় ব্যাপক বিপর্যয়। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের বাহ্যিক অস্তিত্বে দেখা দি”েছ বিভিন্ন অ¯ি’তিশীলতা, ক্ষতি, অস্বস্তি ও বিশৃঙ্খলা। 
শব্দ, তাপমাত্রা, আলো, পানি ও রাসায়নিক উপাদানগুলো দিন দিন দূষিত হয়ে পড়ছে। পরিবেশ দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হ”েছ বাতাস, পানি ও মাটি। পরিবেশ দূষণের কারণেই ওজোন স্তরে ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও আবহাওয়ার পরিবর্তন। মিল-ফ্যাক্টরি ও শিল্প-কারখানাগুলো থেকে যে রাসায়নিক বর্জ্য বের হয়ে আসছে সেগুলো দূষিত করছে বাতাসকে। তাছাড়া পানি যখন বর্জ্য হিসেবে বের হয়ে আসে কিংবা তরল রাসায়নিক বর্জ্য মাটিতে পতিত হয় এবং পরে পানিতে পৌঁছে, তখন তা পানি দূষণের জš§ দেয়। রাসায়নিক দ্রব্য মাটিতে ফেলে দেয়ায় মাটিও দূষিত হয়ে পড়ে। 
পরিবেশ দূষণের যেসব কারণ রয়েছে তা একে একে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। মানবজাতি নগরায়নের স্বার্থে বনবাদাড় উজাড় করে দি”েছ। জনসংখ্যা যত বাড়ছে পানির চাহিদাও তত বৃদ্ধি পা”েছ। ঢাকা শহরের ভূ-গর্ভ¯’ পানি অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে এর স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। প্রতিদিনই টনকে টন গৃহ¯’ালির বর্জ্য স্তূপ আকারে জমা পড়ছে। যদি এসব বর্জ্য সঠিকভাবে সমাহিত করা কিংবা ফেলার ব্যব¯’া করা না হয় তাহলে পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হবে। তাছাড়া কলকারখানা ও গাড়ি-বাড়ি পরিচালনার কারণে যে ধোঁয়াগুলো বের হয়ে আসছে সেগুলো শুধু বাতাসকেই দূষিত করে না বরং পানিকেও দূষিত করে ফেলছে। এসব দূষণ প্রতিরোধে আমাদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যব¯’া নিতে হবে যথাশিগগিরই। 
আমাদের মতো অনেক পরিবেশবাদী সংগ্রামী ব্যক্তি আছেন, যারা জোরালোভাবে পরিবেশ দূষণের বির“দ্ধে আন্দোলন করে যা”েছন। পৃথিবীতে এখন কোন কিছুই সংরক্ষিত নেই এবং কোন জীবনই নিরাপদ নয়। মৌসুমগুলোর হেঁয়ালি পরিবর্তন আমরা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারছি, এর জন্য এখন আর কোন সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক ও পর্যালোচনা প্রয়োজন পড়ে না। তবে দুঃখজনক বিষয় হ”েছ, সারা বিশ্বই এখন পরিবেশ অর্থনীতির হুমকি সম্বন্ধে সচেতন, তবে অধিকাংশ দেশ এখন পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য তেমন কিছুই করছে না। কৃষকরা আগাছা ও পোকামাকড় উ”েছদের জন্য যে রাসায়নিক দ্রব্যগুলো ব্যবহার করে সেগুলো দূষিত করে যা”েছ মাটিকে, যার কারণে মাটিও দিন দিন তার উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে আমাদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরাট হুমকির সৃষ্টি করছে। পরিবেশ দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যায় শিল্প কর্মকাণ্ডগুলোকে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের কীটনাশকের ব্যবহার মাটিকে দূষিত করে যা”েছ দিন দিন। 
শুধু শিল্প-কারখানা ও সমুদ্রবক্ষে তেল নিঃসরণ থেকে যে পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি হ”েছ তা মনে করা ঠিক নয়। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য গাড়ি থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হ”েছ, যত্রতত্র পলিথিন যেভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে এবং কৃষকরা যেভাবে অধিক হারে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার করছে, সেগুলো পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। যদি আমরা এখন থেকেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সচেষ্ট না হই, তাহলে ধীরে ধীরে সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সেজন্য প্রত্যেকের উচিত এমনভাবে কর্মকাণ্ড পরিকল্পিতভাবে সাজানো, যাতে আমরা এক সময় ভূপৃষ্ঠ থেকে পরিবেশ দূষণের সব নিয়ামক দূর করতে পারি। পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে তাই আমাদের কার্বন যৌগের উৎপাদন ও ব্যবহার হ্রাসের পাশাপাশি অধিক হারে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যব¯’া করতে হবে। সারাদেশে নার্সারিতে পরিবেশবান্ধব চারা, কলম ইত্যাদি উৎপন্ন করে জনগণের মধ্যে তা বিতরণের ব্যব¯’া করতে হবে। প্রকৃতিকে নিয়ে বাণিজ্যমুখী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। পরিবেশবান্ধব কর্মক্ষেত্র ও অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোকে সাধুবাদ জানাতে হবে। বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব ভোগবাদ তৈরি করতে হবে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই পরিবেশবান্ধব হন এবং পরিবেশের ন্যূনতম ক্ষতি না করে পণ্য ব্যবহার করতে পারেন এবং প্রয়োজনে রিসাইক্লিংও করতে পারেন। আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে হাইব্রিড গাড়ি ব্যবহারে যাতে অতিস্বল্প কার্বন যৌগ উৎপন্ন হয়। সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহার করতে হবে। ¯’ানীয়ভাবে সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল সংগ্রহ ও বিপণন করতে হবে। মোট কথা ‘আমরা বাঁচি সবুজে’ এই স্লোগানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগকেও স্বাগত জানাতে এবং সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। 
ড. আহসান হাবিব : সহকারী অধ্যাপক, ফলিত সমাজবিদ্যা বিভাগ, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
ফধযধঁন@মসধরষ.পড়স, ফধয@ধংধঁন.বফঁ.নফ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন