ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় গ্রামীণ ব্যাংকের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে এর প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের শঙ্কার কথা জেনে অনেকের মত আমিও বিচলিত হয়েছি। প্রফেসর ইউনূসের বিবৃতি পাঠ করে জানতে পারলাম মে (২০১২) মাসের মাঝামাঝি সময়ে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ক নানা বিষয়ে তদন্ত করে সুপারিশ প্রদানের জন্য চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। তিন মাসের মধ্যে তদন্ত কমিশনকে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। ড. ইউনূসের মতো আমাদেরও মনে প্রশ্ন জেগেছে এ তদন্ত কমিশন কেন করা হয়েছে? কার স্বার্থে করা হয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংকে এমন কী ঘটেছে বা এমন কী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, সরকারের অর্থমন্ত্রণালয় এমন একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার প্রয়াস পেল?
সাধারণত বড় ধরনের কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অপকর্ম, বিধি লঙ্ঘন, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র কিংবা সহিংস ঘটনার প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়; ঘটনা তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কর্মজীবনে আমি নিজেও ছাত্রহত্যা, প্রশ্ন ফাঁসসহ বহুবিধ ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিতে কাজ করেছি। ওইসব তদন্ত কমিটি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধানকে সমুন্নত রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত দোষীদের শাস্তি বিধান করা।
গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংক অডিট ও পরিদর্শন করে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে কিংবা এমন কোন চাঞ্চল্যকর নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে—সামপ্রতিক কালে বা দূর অতীতে এমন কোনো সংবাদ আমাদের চোখে পড়েনি। তাহলে এ তদন্ত কমিশন কেন গঠন করা হলো? হঠাত্ করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড বা এর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠনের এহেন উদ্যোগ জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। এহেন উদ্যোগে একথা প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যে, এ তদন্ত কমিশন গঠন অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আজ বাংলাদেশের বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির, স্বজনপ্রীতির, দলীয়করণের, সুশাসনের অভাবসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ সম্পর্কে নানা সমালোচনা হচ্ছে। হত্যা, গুমসহ কত অপরাধই না সংঘটিত হচ্ছে? কিন্তু এসবের তেমন কোনো কার্যকর তদন্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়ের তদন্তের প্রয়োজন হলো কেন?
গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে নিয়ে বর্তমান সরকারের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের গর্ব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যেন সরকার অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষের কারণ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে এরই মধ্যে সরকারের একটি মহল প্রকাশ করেছে। দুষ্ট লোক বলে, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয় প্রফেসর ইউনূসের জন্য কাল হয়েছে। নোবেল পুরস্কার প্রফেসর ইউনূসকে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, গ্রামীণ ব্যাংক পেয়েছে জগেজাড়া স্বীকৃতি আর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মান ও সুখ্যাতি। কিন্তু এতে বর্তমান সরকারের একটি অংশের হয়েছে গাত্রদাহ। গত বছরের শুরু থেকেই এ মহলটি প্রফেসর ইউনূস এবং তারই সৃষ্টি এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিষোদগার করে আসছে। এমনও বলতে শুনেছি যে, ‘হোয়াইট ওয়াইন আর স্যান্ডউইচ খেলে’ নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়। এ মহলটি এও বলেছে যে, তিনি কোন যুদ্ধে জয়লাভ করে শান্তি এনেছেন যে, নোবেল পুরস্কার পেলেন?
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামের অধস্তন শ্রেণী বিশেষ করে গ্রামীণ মহিলাদের জীবনযুদ্ধ জয়ের যে কাহিনী সে সম্পর্কে এ মহলটি হয় ওয়াকিবহাল নয় অথবা জেনেও না জানার ভান করছেন। সারা বিশ্ব যখন এর জয়গানে মুখরিত আমাদের দেশের এ বিশেষ মহলটি তখন শুধু এর প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, নানা অপবাদে একে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রয়াস পেয়েছে। আমি মনে করি, এরই ধারাবাহিকতায় এ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের এমন একটি পরীক্ষিত, কার্যকর প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে তার গতিরোধ করা কোনোক্রমেই সঙ্গত হবে না। দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয় ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। নানা সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান অস্বীকার করার মতো বিষয় নয়। স্বভাবতই তিনি আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যাশা করেন এবং কৃতজ্ঞ জাতি এরই মধ্যে তাকে যথাযথ সম্মানের আসনেই অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু সম্মানহানি করার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় আজ তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। ড. ইউনূসের প্রতি অসম্মান জাতির জন্য বেদনাদায়ক। কেননা, সামগ্রিক বিবেচনায় ড. ইউনূসের অবদানকে কোনোক্রমেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। গত বছর নানা অজুহাতে প্রফেসর ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর প্রতিষ্ঠাতাকে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারণের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে এবং এ ধরনের অপসারণের উদাহরণ জাতির জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না। ড. ইউনূসকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
গ্রামীণ ব্যাংক লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি (Micro credit) আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্য বিমোচনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে এ কর্মসূচি আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক এ আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছে। আর এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ইউনূস বিশ্বব্যাপী অর্জন করেছেন বিরল সম্মান। তাই তিনি আমাদের গর্ব।
অতএব বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, দয়া করে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে গ্রামীণ ব্যাংক কোন পথে অগ্রসর হবে সেটা অনুমান করতেই ভয় হয়। গ্রামীণ ব্যাংক একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাংক। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে নানারকম সংঘাত এর ভেতর দ্রুত প্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দেবে। আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দশার খবর কে না জানে? সরকারি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং তার ভাইসেস (vices) যদি গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে, তাহলে তা হবে অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনক। গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান আইন কাঠামোর পরিবর্তন করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হলে এর ভবিষ্যত্ যে বিপন্ন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গ্রামের ঋণ গ্রহিতা দরিদ্র মহিলারা। তারা তাদের মালিকানা ছেড়ে দেবেন না। এ ব্যাংকের যে আইনকানুন, বিধিবিধান রয়েছে এবং যেভাবে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা সন্তোষজনক প্রতীয়মান হয়েছে। এগুলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্যায়ে এসেছে। অতএব কমিশনের দোহাই দিয়ে এর বিধিবিধান ও কাঠামো পরিবর্তন করে একে দুর্বল করার কোনো অর্থ হয় না। এটা সরকারের তথা কারোর জন্য মঙ্গলকর হবে না। গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীব্যাপী বাংলাদেশের একটা Brand Name। এটার কোনো ক্ষতি হোক এমন কোন কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলা মালিকরা নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের এই পরিণতি হোক। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে যারা শিক্ষা ঋণ নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য পেশাজীবী হয়ে উঠেছেন তারা নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, তাদের মায়ের ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে কিংবা মালিকানায় চলে যাক। কারণ তারা নিজেরাই এখন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘নতুন উদ্যোক্তা’ ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে পড়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামোর পরিবর্তন দেশের জন্য ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক হবে না।
অতএব গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকানুন, বিধিবিধান এবং এর কাঠামো সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে গ্রামীণ ব্যাংকের পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর,
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানী
সাধারণত বড় ধরনের কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি, অপকর্ম, বিধি লঙ্ঘন, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র কিংবা সহিংস ঘটনার প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়; ঘটনা তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কর্মজীবনে আমি নিজেও ছাত্রহত্যা, প্রশ্ন ফাঁসসহ বহুবিধ ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিতে কাজ করেছি। ওইসব তদন্ত কমিটি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিবিধানকে সমুন্নত রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত দোষীদের শাস্তি বিধান করা।
গ্রামীণ ব্যাংক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও এর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংক অডিট ও পরিদর্শন করে। গ্রামীণ ব্যাংকে কোনো বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে কিংবা এমন কোন চাঞ্চল্যকর নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে—সামপ্রতিক কালে বা দূর অতীতে এমন কোনো সংবাদ আমাদের চোখে পড়েনি। তাহলে এ তদন্ত কমিশন কেন গঠন করা হলো? হঠাত্ করে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড বা এর বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠনের এহেন উদ্যোগ জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। এহেন উদ্যোগে একথা প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যে, এ তদন্ত কমিশন গঠন অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আজ বাংলাদেশের বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির, স্বজনপ্রীতির, দলীয়করণের, সুশাসনের অভাবসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ সম্পর্কে নানা সমালোচনা হচ্ছে। হত্যা, গুমসহ কত অপরাধই না সংঘটিত হচ্ছে? কিন্তু এসবের তেমন কোনো কার্যকর তদন্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন বিষয়ের তদন্তের প্রয়োজন হলো কেন?
গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূসকে নিয়ে বর্তমান সরকারের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশের গর্ব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি যেন সরকার অসন্তুষ্ট। এ অসন্তোষের কারণ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে এরই মধ্যে সরকারের একটি মহল প্রকাশ করেছে। দুষ্ট লোক বলে, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয় প্রফেসর ইউনূসের জন্য কাল হয়েছে। নোবেল পুরস্কার প্রফেসর ইউনূসকে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি, গ্রামীণ ব্যাংক পেয়েছে জগেজাড়া স্বীকৃতি আর বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে পেয়েছে সম্মান ও সুখ্যাতি। কিন্তু এতে বর্তমান সরকারের একটি অংশের হয়েছে গাত্রদাহ। গত বছরের শুরু থেকেই এ মহলটি প্রফেসর ইউনূস এবং তারই সৃষ্টি এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিষোদগার করে আসছে। এমনও বলতে শুনেছি যে, ‘হোয়াইট ওয়াইন আর স্যান্ডউইচ খেলে’ নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়। এ মহলটি এও বলেছে যে, তিনি কোন যুদ্ধে জয়লাভ করে শান্তি এনেছেন যে, নোবেল পুরস্কার পেলেন?
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে গ্রামের অধস্তন শ্রেণী বিশেষ করে গ্রামীণ মহিলাদের জীবনযুদ্ধ জয়ের যে কাহিনী সে সম্পর্কে এ মহলটি হয় ওয়াকিবহাল নয় অথবা জেনেও না জানার ভান করছেন। সারা বিশ্ব যখন এর জয়গানে মুখরিত আমাদের দেশের এ বিশেষ মহলটি তখন শুধু এর প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, নানা অপবাদে একে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রয়াস পেয়েছে। আমি মনে করি, এরই ধারাবাহিকতায় এ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দেশের এমন একটি পরীক্ষিত, কার্যকর প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে না দিয়ে তার গতিরোধ করা কোনোক্রমেই সঙ্গত হবে না। দারিদ্র্য ও দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী একটি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয় ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। নানা সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান অস্বীকার করার মতো বিষয় নয়। স্বভাবতই তিনি আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য সম্মান ও মর্যাদা প্রত্যাশা করেন এবং কৃতজ্ঞ জাতি এরই মধ্যে তাকে যথাযথ সম্মানের আসনেই অধিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু সম্মানহানি করার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় আজ তিনিও আক্রান্ত হয়েছেন। ড. ইউনূসের প্রতি অসম্মান জাতির জন্য বেদনাদায়ক। কেননা, সামগ্রিক বিবেচনায় ড. ইউনূসের অবদানকে কোনোক্রমেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। গত বছর নানা অজুহাতে প্রফেসর ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারণ করা হয়েছে। মনে রাখা দরকার, ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর প্রতিষ্ঠাতাকে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে অপসারণের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করবে এবং এ ধরনের অপসারণের উদাহরণ জাতির জন্য কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না। ড. ইউনূসকে ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত।
গ্রামীণ ব্যাংক লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি (Micro credit) আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্য বিমোচনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে এ কর্মসূচি আংশিকভাবে বা সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক এ আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছে। আর এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ইউনূস বিশ্বব্যাপী অর্জন করেছেন বিরল সম্মান। তাই তিনি আমাদের গর্ব।
অতএব বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, দয়া করে গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে গ্রামীণ ব্যাংক কোন পথে অগ্রসর হবে সেটা অনুমান করতেই ভয় হয়। গ্রামীণ ব্যাংক একটি নিয়ম-শৃঙ্খলার ব্যাংক। সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে নানারকম সংঘাত এর ভেতর দ্রুত প্রবেশ করার সম্ভাবনা দেখা দেবে। আমাদের দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দশার খবর কে না জানে? সরকারি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং তার ভাইসেস (vices) যদি গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে, তাহলে তা হবে অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যজনক। গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান আইন কাঠামোর পরিবর্তন করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হলে এর ভবিষ্যত্ যে বিপন্ন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গ্রামের ঋণ গ্রহিতা দরিদ্র মহিলারা। তারা তাদের মালিকানা ছেড়ে দেবেন না। এ ব্যাংকের যে আইনকানুন, বিধিবিধান রয়েছে এবং যেভাবে এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা সন্তোষজনক প্রতীয়মান হয়েছে। এগুলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ পর্যায়ে এসেছে। অতএব কমিশনের দোহাই দিয়ে এর বিধিবিধান ও কাঠামো পরিবর্তন করে একে দুর্বল করার কোনো অর্থ হয় না। এটা সরকারের তথা কারোর জন্য মঙ্গলকর হবে না। গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীব্যাপী বাংলাদেশের একটা Brand Name। এটার কোনো ক্ষতি হোক এমন কোন কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের গরিব মহিলা মালিকরা নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের এই পরিণতি হোক। গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের ছেলেমেয়েরা, বিশেষ করে যারা শিক্ষা ঋণ নিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য পেশাজীবী হয়ে উঠেছেন তারা নিশ্চয়ই চাইবেন না যে, তাদের মায়ের ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণে কিংবা মালিকানায় চলে যাক। কারণ তারা নিজেরাই এখন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ‘নতুন উদ্যোক্তা’ ঋণ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে পড়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের আইন কাঠামোর পরিবর্তন দেশের জন্য ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক হবে না।
অতএব গ্রামীণ ব্যাংকের আইনকানুন, বিধিবিধান এবং এর কাঠামো সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখে গ্রামীণ ব্যাংকের পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর,
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন