
॥ মঈনুল আলম ॥
১৯৬৬ সালে তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েম শাসকচক্র আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া গ্রেফতার, মোকদ্দমা, জেল ও জুলুমের কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল।
ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্য আছে : ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ’। বাংলাতে এর অনুবাদ করা হয়, ‘ইতিহাস ঘুরেফিরে আসে’। ৪৬ বছর আগে শেখ সাহেব এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত দলের ওপর বেপরোয়া, জেল-জুলুম এবং নগ্ন নিপীড়নের যে কর্মকাণ্ড চলেছিল, তা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, যেন এখন প্রত্য করছি!
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরাব্যবস্থায় প্রায় শূন্যতা প্রকট হয়ে ওঠে এবং তা এ দেশের মানুষকে দারুণভাবে বিচলিত করে। কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরাশূন্যতা তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্র“য়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে গৃহীত হয়। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এবং তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছয় দফা দাবিনামার অনুকূলে ব্যাপকভাবে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু জনসভা করতে শুরু করেন। এসব দাবির পে জনমতের জোয়ার সৃষ্টি হতে দেখে সরকার প্রমাদ গুনলো। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে ‘অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ’ এবং ‘গৃহযুদ্ধে’র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন।
১৯৬৬ সালের এপ্রিলে খুলনায় এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার পর শেখ মুজিব যশোর হয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। ঢাকার এক ম্যাজিস্ট্রেটের পরোয়ানায় পথেই তাকে গ্রেফতার করে যশোরের মহকুমা হাকিমের সামনে হাজির করা হয়। তিনি অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু মুজিব ঢাকায় পৌঁছে ঢাকার মহকুমা হাকিমের কাছে হাজির হলে জামিন নামঞ্জুর হয়। তবে ঢাকার দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করলেন। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গবন্ধু বাসায় পৌঁছলেন। এক ঘণ্টা পরেই সিলেটের জনসভায় ভাষণ সংক্রান্ত ম্যাজিস্ট্রেটের পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ তাকে প্রেফতার করে সে রাতেই সিলেটে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে গভর্নর মোনায়েম খান প্রকাশ্যে হুমকি উচ্চারণ করলেন, ‘আমি যত দিন গভর্নর আছি, মুজিবুর রহমানকে জেলে থাকতে হবে।’
সিলেটে শেখ মুজিবকে মহকুমা হাকিমের কাছে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। হাজতে রাত কাটানোর পরদিন দায়রা জজের কাছে হাজির করা হলে তিনি জামিন মঞ্জুর করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জেল গেট থেকে বের হতেই ময়মনসিংহে জনসভায় ভাষণ সংক্রান্ত সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেটের এক পরোয়ানায় তাকে গ্রেফতার করে রাতেই ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মহকুমা হাকিম একইভাবে বঙ্গবন্ধুর জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজতে পাঠিয়ে দেন। হাজতে রাত কাটানোর পরের দিন দায়রা জজ জামিনে মুক্তি দিলে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ৮ মে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জের জনসভায় বক্তৃতা করে ঢাকা ফিরে আসেন। ওই রাতেই মুজিব ও তাজউদ্দীনসহ দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তথাকথিত দেশরা আইনের ৩২ ধারায় আওয়ামী লীগের বড়-মাঝারি-ছোট নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করার হিড়িক পড়ে যায়। সরকারের নীলনকশা অনুসারে দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়ে এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।
সরকারের এই ব্যাপক গ্রেফতার, দমন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট প্রতিহত করতে পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ১১ ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশ প্রায় ৮০০ কর্মীকে গ্রেফতার করে।
শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয়। জেলের অভ্যন্তরে আদালত বসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার প্রাক-শুনানি বা শুনানি হতে থাকে। এই জেলে তিনি ২১ মাস আটক ছিলেন।
‘কিন্তু কোনো নিপীড়নই শেখ মুজিবুর রহমানকে কাবু করতে পারেনি, তার অদম্য উৎসাহশীল ব্যক্তিত্বে কোনোরূপ ুণœতা আনতে পারেনি। জেলে একবার পাশের ওয়ার্ডে তিনি একটা আমগাছের চারা দেখতে পান। সেটা এনে নিজের সেলের আঙিনায় রোপণ করেন। জেল সুপারকে তিনি বলেন, ‘এই গাছ বড় হবে, ফল দেবে, সেই আম খেয়ে তবে তো আমি জেল থেকে যাব।’ জেল সুপার তার কথা শুনে অবাক হয়ে যান। (মাহবুব-উল আলম প্রণীত ও ১৯৭৮-এ প্রকাশিত ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’)।
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় শেষ পর্যন্ত রায় হয়নি।
কিন্তু বাঙালিদের বিরুদ্ধে আইয়ুব-মোনায়েম শাসনের অকারণ গ্রেফতার, নগ্ন দমন ও নিপীড়ন অভিযান শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে। এর চাপ প্রতিরোধ করতে অম হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গদি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com
১৯৬৬ সালে তৎকালীন আইয়ুব-মোনায়েম শাসকচক্র আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বেপরোয়া গ্রেফতার, মোকদ্দমা, জেল ও জুলুমের কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল।
ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্য আছে : ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ’। বাংলাতে এর অনুবাদ করা হয়, ‘ইতিহাস ঘুরেফিরে আসে’। ৪৬ বছর আগে শেখ সাহেব এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত দলের ওপর বেপরোয়া, জেল-জুলুম এবং নগ্ন নিপীড়নের যে কর্মকাণ্ড চলেছিল, তা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, যেন এখন প্রত্য করছি!
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরাব্যবস্থায় প্রায় শূন্যতা প্রকট হয়ে ওঠে এবং তা এ দেশের মানুষকে দারুণভাবে বিচলিত করে। কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরাশূন্যতা তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্র“য়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে গৃহীত হয়। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এবং তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছয় দফা দাবিনামার অনুকূলে ব্যাপকভাবে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু জনসভা করতে শুরু করেন। এসব দাবির পে জনমতের জোয়ার সৃষ্টি হতে দেখে সরকার প্রমাদ গুনলো। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে ‘অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ’ এবং ‘গৃহযুদ্ধে’র হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন।
১৯৬৬ সালের এপ্রিলে খুলনায় এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার পর শেখ মুজিব যশোর হয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। ঢাকার এক ম্যাজিস্ট্রেটের পরোয়ানায় পথেই তাকে গ্রেফতার করে যশোরের মহকুমা হাকিমের সামনে হাজির করা হয়। তিনি অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু মুজিব ঢাকায় পৌঁছে ঢাকার মহকুমা হাকিমের কাছে হাজির হলে জামিন নামঞ্জুর হয়। তবে ঢাকার দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করলেন। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গবন্ধু বাসায় পৌঁছলেন। এক ঘণ্টা পরেই সিলেটের জনসভায় ভাষণ সংক্রান্ত ম্যাজিস্ট্রেটের পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ তাকে প্রেফতার করে সে রাতেই সিলেটে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে গভর্নর মোনায়েম খান প্রকাশ্যে হুমকি উচ্চারণ করলেন, ‘আমি যত দিন গভর্নর আছি, মুজিবুর রহমানকে জেলে থাকতে হবে।’
সিলেটে শেখ মুজিবকে মহকুমা হাকিমের কাছে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিলেন। হাজতে রাত কাটানোর পরদিন দায়রা জজের কাছে হাজির করা হলে তিনি জামিন মঞ্জুর করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জেল গেট থেকে বের হতেই ময়মনসিংহে জনসভায় ভাষণ সংক্রান্ত সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেটের এক পরোয়ানায় তাকে গ্রেফতার করে রাতেই ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মহকুমা হাকিম একইভাবে বঙ্গবন্ধুর জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে হাজতে পাঠিয়ে দেন। হাজতে রাত কাটানোর পরের দিন দায়রা জজ জামিনে মুক্তি দিলে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ৮ মে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জের জনসভায় বক্তৃতা করে ঢাকা ফিরে আসেন। ওই রাতেই মুজিব ও তাজউদ্দীনসহ দলের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তথাকথিত দেশরা আইনের ৩২ ধারায় আওয়ামী লীগের বড়-মাঝারি-ছোট নেতা ও কর্মীদের গ্রেফতার করার হিড়িক পড়ে যায়। সরকারের নীলনকশা অনুসারে দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হয়। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়ে এবং তার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।
সরকারের এই ব্যাপক গ্রেফতার, দমন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট প্রতিহত করতে পুলিশ জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে ১১ ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশ প্রায় ৮০০ কর্মীকে গ্রেফতার করে।
শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয়। জেলের অভ্যন্তরে আদালত বসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মুজিবের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার প্রাক-শুনানি বা শুনানি হতে থাকে। এই জেলে তিনি ২১ মাস আটক ছিলেন।
‘কিন্তু কোনো নিপীড়নই শেখ মুজিবুর রহমানকে কাবু করতে পারেনি, তার অদম্য উৎসাহশীল ব্যক্তিত্বে কোনোরূপ ুণœতা আনতে পারেনি। জেলে একবার পাশের ওয়ার্ডে তিনি একটা আমগাছের চারা দেখতে পান। সেটা এনে নিজের সেলের আঙিনায় রোপণ করেন। জেল সুপারকে তিনি বলেন, ‘এই গাছ বড় হবে, ফল দেবে, সেই আম খেয়ে তবে তো আমি জেল থেকে যাব।’ জেল সুপার তার কথা শুনে অবাক হয়ে যান। (মাহবুব-উল আলম প্রণীত ও ১৯৭৮-এ প্রকাশিত ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত’)।
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় শেষ পর্যন্ত রায় হয়নি।
কিন্তু বাঙালিদের বিরুদ্ধে আইয়ুব-মোনায়েম শাসনের অকারণ গ্রেফতার, নগ্ন দমন ও নিপীড়ন অভিযান শেষ পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে। এর চাপ প্রতিরোধ করতে অম হয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গদি থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট
moyeenulalam@hotmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন