বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন : আমাদের করণীয়



॥ ড. ওবায়দুল করিম ॥

প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগে মানুষ প্রকৃতির সাথে অভিযোজন করে নিত অর্থাৎ খাপ খাইয়ে চলত। এখন মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃতির মাঝে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ‘প্রাকৃতিক’ কারণ ছাড়াও দুর্যোগের সামাজিক প্রোপট তৈরি হয়েছে মানুষের অতি ক্রিয়াশীলতার ফলে। দুর্যোগ প্রশমনে প্রাকৃতিক কারণের সাথে সামাজিক কারণগুলোরও অপনোদন করা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক কোনো পরিবর্তন যদি মানুষের সমূহ তির কারণ হয়, তবেই তা দুর্যোগ বলে বিবেচিত হয়। এমনিতে মানুষের তির কারণ হয় না, এমন প্রাকৃতিক ঘটনাকে ‘দুর্যোগ’ বলা যায় না। তাহলে বৃহদাকার ডাইনোসরের অবলুপ্তি কি ‘দুর্যোগ’ ছিল? যদি প্রাণী, মৃত্তিকা, বায়ু ও পানির ভারসাম্য নষ্ট করে থাকে, তবে অবশ্যই তা দুর্যোগ হবে। কেননা এতে জীবমণ্ডলের অংশ হিসেবে মানুষের তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। সভ্যতা নির্মাণে এ অঞ্চল উপযোগী এবং এ কারণে এই অঞ্চলগুলোতে সভ্যতার সৃজন হয়েছিল। ঠিক তেমনি ভূমণ্ডলীয় প্রোপটে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগময় এলাকা হিসেবেও এ অঞ্চল পরিচিত। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এ অঞ্চলের অতি পরিচিত দুর্যোগ। এ ছাড়া মানব আবাস বণ্টনে এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে মানুষের কেন্দ্রীভবন খুবই বেশি। ফলে এ এলাকার দুর্যোগে, যদি সামাজিক ব্যবস্থা দারিদ্র্যপীড়িত হয়, তবে তির পরিমাণ হয় গুরুতর। এ ছাড়া এ অঞ্চলের বিশাল অংশজুড়ে টেকটোনিক ফল্ট বা ভূগর্ভস্থ চ্যুতির অবস্থান হওয়ায় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবেও পরিচিত। এ ছাড়া বিশেষ করে উন্নত ধনী দেশগুলোর কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ দুর্যোগের এক নয়া মাত্রা সৃষ্টি করেছে। দণি-পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিবেশ এলাকার শিফটিং যা এল নিনো ও লা নিনা বলে পরিচিত, তা দণি-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশসহ দণি এশিয়ার আবহাওয়ার পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। আর এসব পরিবর্তনের চেইন ইফেক্ট হচ্ছে দুর্যোগ। এর কারণ এবং প্রশমনের উপায় বহুবিধ। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতো দুর্যোগের ক্রমবৃদ্ধিও সামাজিক ও প্রাকৃতিক একটি দুষ্টচক্রের অধীন হয়ে পড়েছে। এটি এমন যে, মানুষ প্রকৃতির ওপর কাজ করে, প্রকৃতিকে বদলায় এবং সাথে সাথে নিজেকেও। মানুষের প্রয়োজনে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রয়োগে মানুষ প্রকৃতিকে বদলাল এবং বদলাল সাথে সাথে নিজেকে। পৃথিবীতে ৭০০ কোটি জনসংখ্যার বর্তমান হিসাব প্রকৃতিকে বদলানোরই ফল। প্রকৃতিকে পূর্বতন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার প্রযুক্তির প্রয়োগে প্রকৃতির আরো অসম অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিশাল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে মানুষ। এর সম্পূর্ণ বিলোপ নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব নয়, তবে প্রশমনের প্রচেষ্টা আছে, আর সে দিকটাই গুরুত্বের দাবি রাখে। দুর্যোগ প্রশমন করা যায় দু’ভাবে। এক. এর ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকার করে এবং অন্যটি দুর্যোগের কারণ অপনোদন করে। দ্বিতীয়টি দীর্ঘমেয়াদি ও কষ্টসাধ্য। প্রথমটি আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে জ্ঞাত। দ্বিতীয়টি প্রকৃতি, পরিবেশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সংস্কারের সাথে জড়িত। দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনের বা কমানোর বিষয়টি আপৎকালীন ও তাৎণিক বিষয় হিসেবে গণ্য হলেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশ নিরীয় অঞ্চলের দেশ হওয়ায় সাইকোন, কালবৈশাখী এবং ভারতীয় শিকার ইউরেশীয় ও মিয়ানমার প্লেটের চ্যুতির কাছে অবস্থান হওয়ায় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্লেটগুলোর সংঘর্ষ ও কম্পন বিশাল শক্তির আধার হয়ে উঠছে, যা মারাত্মক ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। এমনই যদি হয়, তাহলে দুর্যোগ উত্তরণে জনগণের কর্তব্য সম্পর্কে আমাদের সবার সচেতন হওয়া দরকার। সাইকোনের সঙ্কেত প্রদানকালে দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য কমিউনিটি রেডিও, সাইকোন সেন্টারে আশ্রয়গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় খাবারের আপৎকালীন ব্যবস্থার প্রয়োগে প্রাণহানি ও সম্পদের য়তির পরিমাণ কমানো গেছে। এটা ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এবং কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সিডরের য়তির পরিমাণ হিসাব করলে বোঝা যায়। দুর্যোগের পরের য়তির ঝুঁকি আমরা কিছুটা কমাতে পেরেছি। আমাদের দেশের নগরবাসীর জন্য সম্ভাব্য ভূমিকম্পের য়তি কমানোর জনসচেতনতা এবং দুর্যোগ-উত্তর পরিষেবা বৃদ্ধির ঘটনা এখনো অনুমাননির্ভর। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর বিষয় জনসচেতনতার সাথে সাথে আইনের প্রয়োগনির্ভর। বিল্ডিং কোড না মেনে গড়ে ওঠা শহরের দালান-কোঠার অবকাঠামো ৬-এর ওপর রিখটার স্কেল মাত্রার কম্পন কতটুকু সহ্য করতে পারবে, তা অনুমেয়। এখানে ঝুঁকি কমানোর বিষয়টি সামাজিক ও রাজনৈতিক; শুধু জনসচেতনতানির্ভরশীল নয়। দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর আপৎকালীন পদপে অনেকটা কার্যকর হলেও, ঝুঁকি প্রশমনের সামাজিক-অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক পদপে অনেক েেত্রই কার্যকর হচ্ছে না।
দুর্যোগকে আমরা যেভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকি, সেখানে আছে সংরণবাদী মনোভাব। দুর্যোগের সমকালীন তিকর স্বরূপ হিসেবে সাইকোন, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদিকে সাধারণত বোঝানো হয়। কিন্তু প্রযুক্তির অহরহ ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যে যে তিকর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে, তা দুর্যোগ হিসেবে আজো আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি।
যেমনÑ কম্পিউটার-নির্ভর মানবসমাজের পুনঃপুনঃ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক তিকর সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশাল মানবসমাজ বা সম্পদ যখন অসুস্থ অর্থাৎ উৎপাদক হিসেবে অনুপযোগী হয়ে পড়ে, তখন তা অবশ্যই এক বিরাট দুর্যোগ হিসেবেই চিহ্নিত হবে। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ওই সামাজিক প্রোপটের দুর্যোগ কাটানোর উদ্যোগ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংস্কারের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের মোকাবেলায়ও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এ সম্ভাব্য দুর্যোগে ঝুঁকি মোকাবেলায় এুনি উদ্যোগ নেয়া উচিত।
দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার একটি মৌলিক বিষয়, যা উপেতি থেকেছে বিভিন্ন সময়ে। বর্ষাকালে ঢাকা মহানগরী প্লাবিত হওয়ার কারণও অনেকটা সামাজিক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এবং জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ দরিদ্র হওয়ায় জ্বালানির উৎস হিসেবে লাকড়ি ব্যবহারে বাধ্য হয়। গ্রামাঞ্চলে বন উজাড়ের এটিও একটি কারণ। গাছপালা কমে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিপাতেই নদী-খালের তলা পলিতে ভরতে থাকে। উপচে পড়ে পানি। শুরু হয় বন্যার তাণ্ডব। বন্যা হলে এর তাৎণিক ঝুঁকি মোকাবেলা আমরা হরহামেশাই করছি। যেমন, বিশুদ্ধ পানি পানের সুযোগ, লঙ্গরখানা চালু ইত্যাদি। ঢাকা নগরের অপরিকল্পিত বিকাশ জলাবদ্ধতার সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বন্যা এরই একটি কুফল। আইনি সংস্কার ও এর প্রয়োগ সামাজিক সংস্কারেরই অংশ। বন্যা শুধু প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক দুর্যোগও বটে। সুতরাং এই দুর্যোগের সামাজিক কারণের অপনোদন হওয়া দরকার।
আরেকটি দুর্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে জিএম ফুডের প্রসারে। এটি উন্নয়নশীল দেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহের তাগিদ থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর তিকর দিকের আশঙ্কা যদি কিয়দংশও থাকে, তাহলে স্বাস্থ্যহানির আরেকটি দুর্যোগ অপো করবে মানবজাতির জন্য।
বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের েেত্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য রয়েছে। উন্নত দেশগুলো মূলত মধ্যবিত্তশাসিত সমাজ। সুতরাং উন্নত হওয়ার জন্য একটি শর্ত সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন। আর উন্নত হওয়ার সাথে সাথে সমাজের অন্য সমস্যাবলি, এমনকি দুর্যোগও কমে আসতে থাকে। জাপানে সাম্প্রতিককালের ভূমিকম্পের ব্যাপক তির পরও দেশটির অর্থনীতি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসছে। এর চেয়ে অনেক কম মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে থাকলেও আমাদের অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দেশটির বছর লেগে যাবে। এর কারণ দু’দেশের সমাজকাঠামো ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের পার্থক্য। সুতরাং সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন, দুর্যোগ-ঝুঁকির মোকাবেলায় খুব বেশি প্রয়োজন।
সারা পৃথিবীর অসম অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা পরিবেশদূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অনেকাংশে দায়ী। কার্বন ডাই-অক্সাইডের উদগিরণকে নব্বই সালের আগের মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার দাবি যুক্তরাষ্ট্র উপো করেছিল অনেক আগেই। উন্নত বিশ্বের ‘উন্নয়ন’ প্রক্রিয়া উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আসছে, এটি সবাই জ্ঞাত। বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বের দুর্যোগকে আরো ব্যাপক করছে। নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নশীল বিশ্বের দুর্যোগকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পারে।
দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য সামাজিক পরিবর্তনের উদ্যোগ একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা। এর সাথে তাৎণিক ঝুঁকি হ্রাসের উদ্যোগও প্রয়োজন। এ েেত্র জনসচেতনতা একটি বড় শর্ত। তবে মধ্যবিত্তশাসিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে শিার হার বাড়ে না। কম শিার হারসম্পন্ন সমাজ এ কারণেই জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে না। এই কারণে ম্যাক্রো ও মাইক্রো দুই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর উদ্যোগ প্রয়োজন। 
লেখক : অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন