
বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, যিনি দেশের বিভিন্ন সঙ্কটকালে তার প্রজ্ঞা, মেধা, সাহসিকতা এবং দূরদৃষ্টি নিয়ে বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্প্রতি আবার আমরা তার নির্ভীক ঝাঁজাল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। যদিও ঢাকা শহরের একটি মিলনায়তনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি কথাগুলো বলেছেন। তবুও শক্তিশালী ‘ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া’র কারণে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে তা পৌঁছে গেছে এবং এখনও বহু বহু কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আলোচনার বৃত্তে রয়ে গেছে। আজ থেকে অর্ধশতাধিক বছর আগে কবি জীবনানন্দ দাশ তার সমকাল স্বদেশ এ পৃথিবীতে যে বহুবিদ অবিচার ও অনাচারের অবিশ্বাস্য দাপট দেখেছিলেন, তাতে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তার কবিতার খাতায় কয়েকটি ধ্রুপদী পঙিক্ত লিখে রেখেছিলেন। অন্তহীন বিস্ময় আর বিপন্ন বেদনার সঙ্গে সেখানে তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘অদ্ভুত আঁধার এক এ পৃথিবীতে এসেছে আজ/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/ যাদের হূদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদেরই সুপরামর্শ ছাড়া।’
কবিতার পরবর্তী স্তবকটিতে আরও গভীর বেদনার সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন যে, এখনও যারা মানুষের সুবিবেচনা ও সুবিচারের প্রতি আস্থাশীল, এখনও যারা মহত্ শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সেবাব্রত কিংবা সাধনাকে আঁকড়ে ধরে আছেন; তাদের যাবতীয় শুভবোধ এবং সুনির্মল হূদয় শ্মশান কিংবা ভাগাড়ের শিয়াল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ তার এই কবিতাটি যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত পরাধীন আমলে লিখেছিলেন। সেই সময়ে জীবনের সমুদয় বঞ্চনা, বিকৃতি ও বেদনাবহ পরিস্থিতির জন্য পরাধীনতাকেই চিহ্নিত করা হতো। আর সে কারণেই পরাধীনতার বিরুদ্ধে তীব্র তেজে ঝলসে উঠেছিল সমগ্র জাতি এবং তার ফলস্বরূপ দু-দুটো স্বাধীনতার আলো-বাতাস গায়ে মেখে আমরা বর্তমান সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য দুরভিসন্ধি, দুর্বৃত্তপনাসহ নানান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রমের উপদ্রব থেকে আজও আমরা মুক্তি পাইনি। আজও আমাদের অনেক সুকুমারবৃত্তি স্বপ্ন-প্রত্যাশা এবং অধিকারকে আমাদের চোখের সামনেই পদদলিত কিংবা চূর্ণ-বিচূর্ণ অবস্থায় দেখতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো কবিকে তাই তীব্র ক্ষোভে ঝলসে উঠে উচ্চারণ করতে হয়ে ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো।’ বেদনার আগুনে পোড়া ‘বিপন্নতা’ বুকে নিয়ে কোনো কবিকে লিখতে হয় ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, কোনো বিবেকবান প্রবীণ আইনজীবীকে বিস্ময় বিমূঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করতে হয় ‘কত বড় বেকুবের দেশে আমরা আছি।’
সাম্প্রতিক সময়ের এই ‘বেকুবি’ এবং ‘ক্ষুব্ধতা’র ক্রমপ্রসারণ ঘটছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে। ড. ইউনূস তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরুর অব্যবহিত পর থেকেই দেশ-বিদেশের অজস্র মানুষের কাছে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত হতে থাকেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার প্রধান পরিচয় ছিল অধ্যাপক। কিন্তু ১৯৭৬ সাল থেকেই তিনি ধীরে ধীরে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন ‘ইধহশবত্ ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ড়ত্’ হিসেবে। অবশ্য ড. ইউনূস ‘ইধহশবত্’ পরিচয়ে তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বরং তিনি নিজেকে ‘আশার কর্জদাতা’ হিসেবেই দেখতে বেশি পছন্দ করেন। দুর্ভিক্ষের ছোবল খাওয়া সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সন্নিহিত ‘জোবরা’ গ্রামে অনেক কষ্টে সংগৃহীত মাত্র ২৭ ডলার পুঁজি নিয়ে তার কার্যক্রম শুরু করেন। একেবারে নতুন ধরনের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্বে তাকে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয়। তবে তা সামলে উঠতেও বিশেষ বিলম্ব হয় না। কেননা বরাবরই তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী। কুশলী এবং প্রখর দূরদৃষ্টির অধিকারী। গবেষণাগারে আবিষ্কৃত একটি নতুন তত্ত্ব বা অন্ধ সিদ্ধান্তের অস্থিমজ্জায় কী করে প্রাণের সঞ্চার করতে হয়, কী করে একটি নতুন স্বপ্ন-পরিকল্পনা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হয় সেই উদ্ভাবনী শক্তি যেমন তার কাছে আছে, তেমনি আছে ‘দুর্বলের ভগবান বারেক স্মরিয়া মরিতে নীরবে’ অভ্যস্ত অসহায় মানুষের কাছে আশা ও আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার প্রত্যয় জাগিয়ে তোলার কলাকৌশল। অতএব টাঙ্গাইলের ‘আকুর টাকুর’ অচিরেই হয়ে উঠল গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের এক শক্তিশালী প্রাণকেন্দ্র। নিম্ন আয়ের দুস্থ মানুষেরা হাতের কাছে এক নির্ভরযোগ্য অবলম্বন পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আর এতে বিশেষভাবে উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন গ্রামীণ মহিলারা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে পরনির্ভরতার গোপন ঘানি তারা বহন করে চলছিলেন, তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ‘আত্মনির্ভরশীল পরিচয়ের এক নতুন আলোর ঝলক ছড়িয়ে দেওয়ার পথের ঠিকানাটি তারা যেন হঠাত্ করেই একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলেন। তাই তাদের কর্ম উদ্দীপনাটি হয়ে উঠল সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো। গ্রামীণ স্থবির অর্থনীতিতে সঞ্চারিত এই নতুন গতি অল্প আয়াসেই ছড়িয়ে পড়ল এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষের মধ্যে। প্রথমে দেশের অভ্যন্তরে এবং পরে দেশের বাইরে অনুন্নত, উন্নত অনেক দেশেই ক্ষুদ্র ঋণের সাফল্য বার্তা তার জয়পতাকা উড়াতে লাগল।
তবে গ্রামীণ ব্যাংকের চলার পথের সবটুকুই মসৃণ ছিল না। প্রাপ্ত প্রশংসার তুলনায় যদিও তার সমালোচনার পরিধিটি ক্ষুদ্রই ছিল, তবে তা একেবারে শূন্যও ছিল না। প্রায় শুরু থেকেই দু-দুটো মোক্ষম অভিযোগের জবাব দিয়ে আসতে হচ্ছিল তাকে। এর একটি হল ঋণ আদায় কৌশলের নির্মমতা। অপরটি সুদের উচ্চ হার।
সরকারের নমনীয়তা পক্ষপাতিত্ব অথবা দুর্বলতার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের দেশে ঋণখেলাপির একটা অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ঋণ নিলে তা ফেরত দিতে হয়-তা-ও আবার যথাসময়ে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর বিত্তবান এ কথা যেন বেমালুম ভুলে বসে আছেন। ‘ঋণ নেওয়া সে তো নিজের বিত্ত-বাসনাকে পূর্ণ করবার জন্য, এর মধ্যে আবার ফেরত দেওয়ার প্রশ্নটি আসছে কেন?’ এমন একটা প্রশ্নচিহ্ন এই ঋণখেলাপিদের অনেকেরই চোখেমুখে। প্রাচীন ভারতবর্ষে ‘চার্বাক দর্শন’ নামে একটা ক্ষণবাদী দর্শনের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। জীবনের অনিত্যতা এবং বস্তুগত চিন্তা-চেতনাকে প্রাধান্যদানকারী এই দর্শনের অনুসারীরা ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়ার পক্ষপাতী ছিল। তারা ন্যায়-অন্যায় নিয়ে অনর্থক মাথা না-ঘামিয়ে ভোগাকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল জীবনের সব দাবি মিটিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত যে ভোগের ওপর জীবনের আর কোনো সত্য নেই। দাবি নেই। বাংলাদেশের ঋণখেলাপিরাও সম্ভবত এই দর্শনে বিশ্বাসী। তাই নানা ধরনের আদেশ-নির্দেশ ও ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উচ্চরণের পরেও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে ঋণখেলাপির সংখ্যা কমে না। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না-করার এই অপসংস্কৃতি যেখানে অত্যন্ত জোরদার, সেখানে ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক যথাসময়ে ঋণ শোধের পরিমাণ ও প্রবণতাকে যদি ১০০%-এর কাছাকাছি রাখতে চান-তাহলে কিছু বিপত্তি তো দেখা দিতেই পারে। তবে আশার কথা হল বিত্ত ও ক্ষমতাবান শ্রেণীর মধ্যে সময়মতো ঋণ শোধের প্রবণতা যেখানে নেতিবাচক, সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে মোটেই ততটা হতাশাব্যঞ্জক নয়। তবুও ব্যত্যয় তো ঘটেই এবং তার কারণও বহুবিধ। কোথাও উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, কোথাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোথাও আকস্মিক বিপত্তি আবার কোথাওবা সদিচ্ছা ও কর্মকুশলতার অভাব ইত্যাদি কারণে অনেক সময় ঋণগ্রহীতা তার ঋণের অর্থ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে অসফল গ্রহীতার জন্য বিকল্প সাহায্যের ব্যবস্থা কিংবা ঋণ আদায় কার্যক্রম কিছুটা শিথিল করা যেতে পারত। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন কোনো অজুহাতে একবার নিয়ম ভঙ্গ কিংবা শিথিল করলে কিছুতেই ঋণ আদায় কর্মসূচির শৃঙ্খলা বজায় রাখা যাবে না। ফলে গ্রামীণ ব্যাংক তার ঋণ আদায় কর্মসূচিতে একদিকে যেমন অবিশ্বাস্য সাফল্য দেখিয়েছে, অপরদিকে তেমনি বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বেদনাদায়ক ঘটনারও জন্ম দিয়েছে। আর সে কারণে ‘কাবুলিওয়ালা’ গালিটি তাদেরকে নীরবেই হজম করতে হয়েছে। তবে গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে ঘটনার চেয়ে রটনা অনেক বেশি হয়েছে বলে মনে করে।
গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশি। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ কথা স্বীকার করুক আর না করুক-এটি বাস্তব সত্য। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের নানা ধরনের প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প সুদ ও সুদমুক্ত প্রকল্প রয়েছে। আর এমন প্রকল্পের সুবিধাদি শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য বা গ্রাহকদের জন্যই নির্ধারিত। যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংক একটি অংশীদারিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, তাই এর সামগ্রিক লাভালাভ সদস্যদের জন্যই সংরক্ষিত। গ্রামীণ ব্যাংক এই কথাগুলো তার সদস্যদের বেশ ভালোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। তাই উচ্চ সুদে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় তারা মনে মনে কিছুটা বেদনা অনুভব করলেও ভবিষ্যত্ প্রাপ্তির কথা ভেবে স্বস্তিবোধ করে। তবে ঋণশোধে অপারপ গ্রহীতারা একে কিছুতেই সুনজরে দেখে না। দেখবার কোনো কারণও নেই। তবে তাদের সংখ্যা নেহাতই কম বলে গ্রামীণ ব্যাংকের অগ্রযাত্রায় কোনো ছেদ পড়েনি। ১৯৯৭ সালের এক পুরনো পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের ৩৭৬৭৪টি গ্রামে ২২৩৫৯০৩ জন নারী-পুরুষের মধ্যে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এই ঋণ গ্রামীণ দরিদ্রদের দারিদ্র্যমুক্তি কিংবা ভাগ্যোন্নয়নে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কাজে এসেছে, সে বিষয়ে প্রায় একই সময়ে বিশ্বব্যাংক তাদের নিজস্ব জরিপের মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে যে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের এক-তৃতীয়াংশ এসেছে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করেছে এবং অন্য এক-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্যসীমা পার হওয়ার পথে রয়েছে। এই তথ্য অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংক তার ঋণ আদায় কর্মসূচির প্রায় শতভাগ সাফল্য দেখালেও দারিদ্র্য মুক্তির ক্ষেত্রে তা দেখাতে পারেনি। আর তা সম্ভবও নয়। কেননা দারিদ্র্য একটি দীর্ঘকালীন এবং ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা। ইচ্ছা করলেই সকলে তাকে স্বল্পসময়ের মধ্যে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি ও দিকনির্দেশনা যেমন প্রয়োজন, তেমনই সমভাবে প্রয়োজন সাহস, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তার অভাবটি অত্যন্ত প্রকট। সমাজের উঁচুতলার মানুষেরাই তা তাদের নিজেদের স্বার্থে বহুকাল ধরে জিইয়ে রেখেছে। ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামের ‘এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে’ ভাষা জোগানোর, সাহস, আত্মপ্রত্যয় ও মর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলার কাজটিই করছেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুঁজি জোগানোর পাশাপাশি স্বাবলম্বী ও দারিদ্র্যমুক্ত জীবন গড়ার যে ভরসাটুকু তারা অবলম্বনহীন মানুষকে জুগিয়ে যাচ্ছেন, তার মূল্য সরবরাহকৃত পুঁজির অর্থমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। দারিদ্র্য মুক্তির সঙ্গে শুধু স্বাচ্ছন্দ্যের নয়, আত্মজাগরণ এবং আত্মমর্যাদাবোধের সম্পর্ক যে কত নিবিড়, ড. ইউনূস তা খুব ভালো করেই জানেন এবং বহুবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষা-সম্পদহীন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে তা পৌঁছে দিতেও সমানভাবে সক্ষম। তবে দারিদ্র্য শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, সমগ্র বিশ্বেরই এটি একটি জ্বলন্ত সমস্যা। অসম ধন বণ্টনের কারণে তথাকথিত ধনী দেশগুলোতেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম নয়। তাই বাংলাদেশের মাটিতে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সাফল্যে ক্রমে ক্রমে গোটা বিশ্বই উত্সুক হয়ে ওঠে ড. ইউনূস ও তার নতুন ‘মডেল’ সম্পর্কে। ফলে ডাক আসতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। পাণ্ডিত্য, দূরদৃষ্টি ও সাংগঠনিক দক্ষতার পাশাপাশি বাগ্মিতার ওপরও ড. ইউনূসের অসাধারণ অধিকার। ফলে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ ও মোহিত করতে তাকে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। আর তার ফলে বাংলাদেশ আর ড. ইউনূস প্রায় অনেক বিদেশির কাছেই একটা সমার্থক শব্দে পরিণত হন। যারা অনেক দিন ধরে বিদেশে বসবাস করছেন, অথবা ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াত করেন, তাদের অনেকেই কুণ্ঠাহীন কণ্ঠে জানিয়েছেন যে, ইউরোপ-আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্ম এখন ড. ইউনূসকে দিয়েই বাংলাদেশকে চেনেন। ‘গ্রামীণ’ ‘জোবরা’ ‘আকুর টাকুর’ ইত্যাদি বাংলাসহ ড. ইউনূসের সৌজন্যে পশ্চিমা ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে। এ শুধু ড. ইউনূসের একার নয়, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলারও এক নতুন জয়যাত্রা।
পশ্চিমের পৃথিবী দু’হাত বাড়িয়ে ড. ইউনূসকে কীভাবে বরণ করেছে, তা তার আত্মজীবনীটির প্রকাশ, প্রচার ও সমাদার দেখলেও খুব সহজে উপলব্ধি করা যায়। ফরাসি প্রকাশকের তাগাদায় ১৯৯৭ সালে তার আত্মজীবনীটি প্রথমে ফরাসি ভাষায় প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমের পাঠক সমাজে তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক কৌতূহল ও আলোড়ন। আর তার ফলে অল্পসময়ের মধ্যেই ‘ঠঊজঝ টঘ গঙঘউঊ ঝঅঘঝ চঅটঠঊজঞঊ’ গ্রন্থটি ফরাসি ভাষা থেকে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়ে নানা দেশ ও স্থান থেকে প্রকাশ পায়। ভাষাগুলো হল ডাচ, ইংরেজি (মার্কিন ব্রিটিশ ও দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ) জার্মান, ইতালিয়ান, জাপানি, পর্তুগিজ, হিস্পানি, তুর্কি, গুজরাটি, চীনা, আরবি, কোরিয়ান এবং বাংলা (বাংলাদেশি এবং ভারতীয় সংস্করণ)। ড. ইউনূসের বন্ধু-সহপাঠীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে একটা লেখক ও সাহিত্যিক সত্তা সুপ্ত ছিল। তারই অনবদ্য শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে এই গ্রন্থটিতে। বাংলাদেশের একজন লেখক হিসেবে ড. ইউনূসের এই সম্মান ও সমাদর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির অনেক আগেই ঘটেছে এবং নোবেলজনিত সম্মানের চেয়ে এই বিরল সম্মানের মূল্য কোনো অংশেই কম নয়।
একুশ শতকের গোড়া থেকেই সম্ভাব্য নোবেল বিজয়ী হিসেবে ড. ইউনূসের নাম দেশ-বিদেশে অনেকের মুখেই উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছিল। অবশেষে ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর অসলো থেকে ভেসে এল সেই প্রত্যাশিত সুসংবাদ। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো এল নোবেল পুরস্কার। আমরা একই সঙ্গে ইউনূস-গর্বে, জাতি-গর্বে এবং দেশ-গর্বে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। অনেক হতাশা-নৈরাশ্য, বিফলতা আর বিষণ্নতার মরুভূমি পার হয়ে এক চমত্কার অর্জনের বাঁধভাঙা আনন্দ গোটা জাতিকেই ছুঁয়ে গেল। ফুলেল শুভেচ্ছা আর আবেগের উষ্ণতায় নিত্যনতুনভাবে দেশে-বিদেশে অভিষিক্ত হতে লাগলেন ড. ইউনূস।
কিন্তু এ সুখ তার বেশি দিন সইল না। এক সকালে ঘুম থেকে জেগে আমরা খুব অবাক হয়ে শুনলাম কোনো যৌক্তিক ও বোধগম্য কারণ ছাড়াই ড. ইউনূস রাজরোষের শিকার হয়ে পড়েছেন। ছোটবেলায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘কবির জবানবন্দী’ পড়তে গিয়ে এই রাজরোষের ভয়ঙ্কর দিকটির সঙ্গে সম্ভবত প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এরপর ’৬৯, ’৭১ ও ’৭৫-এ সেই রাজরোষের বীভত্স চেহারা দেখেছি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশেও তাকে অনড় অবস্থানে দেখব, ভাবিনি। আর রাজা যা করেন কিংবা বলেন, তার পারিষদবর্গ তাকে কোথায় পৌঁছে দেন-রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’তে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। তবে সে পরিচয় ছিল পরোক্ষ। ড. ইউনূসকে সামনে রেখে এবার ঘটল তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়। বড় নির্মম, বড় বেদনাদায়ক সে পরিচয়। সেই সঙ্গে পরিচয় ঘটল হলুদ সাংবাদিকতায় সদা আগ্রহী কিছু পত্রিকার। কী কুিসত সব লেখা, কী কদর্য সব রসিকতা, কী বিদঘুটে সব কার্টুন আর কী হিংস্র সব বাক্যবাণ! আর এর সবকিছুই বর্ষিত হচ্ছে এমন এক মানুষের প্রতি-সমগ্র বাংলাদেশের জন্য যিনি বয়ে নিয়ে এসেছেন এক অভাবিত সম্মান! অজস্র অবলম্বনহীন মানুষের বুকে জ্বালিয়েছেন আশার প্রদীপ।
কী নিষ্ঠুর পরিহাস! বিস্ময় আর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে হূদয়। মাথানত হয়ে আসে লজ্জায়। মাঝে মাঝে চিত্কার করে বলতে ইচ্ছা করে-‘হে ঈর্ষা, হে নীচতা, হে ক্ষুদ্রতা, হে মূর্খতা, হে অনুদারতা, হে বহুরূপী মিথ্যা- আর কতদিন তোমরা আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখবে? আর কতদিন আমাদেরকে তোমাদের দাসত্ব করতে হবে?’ ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বিস্ময় ভরা জিজ্ঞাসায় সেই বিহ্বল বেদনাকেই যেন নতুন করে খুঁজে পেলাম। তার জন্য আমাদের অনেক শ্রদ্ধা। অনেক ভালোবাসা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন