আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তাঁর দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে একটি আলটিমেটাম দিয়েছেন। আলটিমেটামটি হলো, 'আগামী ৫ জুনের মধ্যে খালেদা জিয়া যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সংলাপে বসার আমন্ত্রণ না জানান, তাহলে ৬ জুন তিনি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও ইস্তফা দেবেন। সেদিন থেকে তাঁর নতুন রাজনীতি শুরু হবে।' তাঁর এই নতুন রাজনীতি কী হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। নতুন কোনো রাজনৈতিক দল করবেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে।'
ব্যারিস্টার হুদা বিএনপির একেবারে গুরুত্বহীন নেতা নন। দলের প্রথম সারির নেতা বলে তিনি একসময় গণ্য হতেন এবং খালেদা জিয়ার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদেও ছিলেন। তবে মাঝেমধ্যে সাহসী এবং নাটুকে কথাবার্তা বলার অভ্যাস তাঁর আছে। তাতে তাঁর ভোগান্তিও কম হয়নি। দলের হাইকমান্ড, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার পছন্দ নয় এমন কথাবার্তা বলে তিনি একবার মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন, আরেকবার অনুরূপ কিছু কথা বলে দল থেকে বহিষ্কারের নোটিশ পেয়েছিলেন। পরে অনেক দুঃখ প্রকাশ এবং প্রকারান্তরে ক্ষমাটমা চেয়ে দলনেত্রীর অনুকম্পায় দলে থেকে যান।
এবারও তিনি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে খালেদা জিয়াকে যে আলটিমেটাম দিয়েছেন, তাতে দলনেত্রী খুশি হবেন না। বরং ব্যারিস্টার হুদা নিজে দল ছাড়ার আগেই তিনি তাঁকে দলের খোলা দরজা দেখিয়ে দিতে পারেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিএনপি এ ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে কি না তা আমি এখনো জানি না। যদি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়ে থাকে, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আবার তাঁর কথাবার্তাকে খালেদা জিয়া গুরুত্ব না-ও দিতে পারেন।
ব্যারিস্টার হুদা দল ছাড়বেন না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কথা বলেন। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ষোলো আনা; এমনকি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতিও। ২২ মে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, 'জনগণ চায় বিএনপি টিকে থাকুক। এই দলের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত হোক।' আমারও তাই আশা ছিল। কিন্তু দল যে তাঁর এই আশা পূরণ করেনি, সে কথাও তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। তাঁর কথা, 'দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য, আমার দলের রাজনীতি দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশপ্রেমিক সংগঠন হিসেবে বিএনপির বর্তমান কর্মকাণ্ডে দেশবাসী হতাশ। যে সমর্থন বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে পেতে পারে, সেই সমর্থন রাজপথে থেকে আসবে না।'
ব্যারিস্টার হুদা সংলাপের প্রশ্নে নিজের নেত্রীকে যেমন শাসিয়েছেন, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও শাসিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, 'দেশবাসী আশা করেছিল সরকারের প্রধান হিসেবে আলোচনার উদ্যোগ আপনিই নেবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটা আপনি নেননি। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমার নেত্রী যদি আপনাকে সংলাপে ডাকেন, তাহলে আপনি সে ডাকে সাড়া দিয়ে আলোচনায় বসবেন। যদি আপনি সাড়া না দেন, তাহলে ১০ জুন-পরবর্তী সব ঘটনার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নাজমুল হুদার এই বক্তব্যও এক ধরনের আলটিমেটাম। অর্থাৎ দুই নেত্রীকেই তিনি আলটিমেটাম দিয়েছেন। তবে তাঁর নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিশেষভাবে বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী আলোচনার আহ্বান জানালেন কি জানালেন না, সেটা আমার দেশনেত্রীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে না। দেশের স্বার্থে বেগম জিয়াকেই এই আহ্বান জানাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই আমার এই সংবাদ সম্মেলন।'
কেবল দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার জন্য আলটিমেটাম দিয়েই ব্যারিস্টার হুদা ক্ষান্ত হননি, তিনি এ আলোচনার এজেন্ডার প্রস্তাবও দিয়েছেন। এই এজেন্ডা হবে, 'রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি। এক-এগারোপরবর্তী বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বিনা শর্তে প্রত্যাহার। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় বসা। একটি দলীয়করণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশের মূল্যবান জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের স্বার্থে ব্যবহার ও সংরক্ষণ করা।'
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমি বহু বিষয়েই সহমত পোষণ করি না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে একজন ভালো মানুষ- এ কথা বলতে পারি। কথাবার্তায় তিনি অনেক সময় বেহুদা কথা বললেও দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি যে অনেক সময় সাহসের সঙ্গে কথা বলেন এবং সে জন্য ভোগান্তি পোহান- এ কথাও ঠিক। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো তিনি বহুরূপী নন এবং তাঁর মতো মিথ্যা কথা মিষ্টি ভাষায় বলতেও পারেন না। এ জন্য দলনেত্রী খালেদা জিয়ার খুব কাছের লোক তিনি হয়ে উঠতে গিয়েও হতে পারেননি।
দেশের এই রাজনৈতিক ডামাডোলে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে একটি ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সঠিক কথাও অনেক বলেছেন। কিন্তু দলীয় ফোরামে কথা না বলে বা আলটিমেটাম না দিয়ে সহসা একক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি দলীয় নেত্রীকে কেন হুমকি দিয়ে সংলাপের ডাক দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিলেন, তা অনেকের কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
এই সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের পুরো অংশ পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, তিনি মাঝেমধ্যে যতই বেহুদা কথা বলেন বলে অভিযোগ করা হয়, তাঁর বর্তমান সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য হয়তো ততটা বেহুদা নয়। তাঁর একটি বক্তব্যের মধ্যে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকার উদ্দেশ্যটি আঁচ করা যায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'আমি সব কিছু জেনেশুনেই এখানে এসেছি। দলীয় ফোরামে এ ধরনের প্রস্তাব দিলে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না, তাও আমি জানি। তাই দলীয় ফোরামে এ ধরনের কথা বলিনি। এসব কথা বলার জন্য দল আমাকে বহিষ্কার করলে রাজনীতি ছেড়ে দেব না। বরং সেখানেই আমার রাজনীতি শুরু হবে।'
'সেখানেই আমার রাজনীতি শুরু হবে'- ব্যারিস্টার হুদার এই উক্তিটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল করার সম্ভাবনা সম্পর্কেও হ্যাঁ অথবা না, কিছুই বলেননি। বলেছেন, 'সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে।' এই জবাবও অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ। আবার দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকেই মনোনয়ন চাইবেন বলেও জোর গলায় বলেছেন। তাঁর এসব পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাকে কেউ কেউ বেহুদা কথা বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপি-রাজনীতিতে ব্যারিস্টার হুদা এখন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন। কিন্তু তাঁর সংবাদ সম্মেলন ডাকা এবং হুমকির সুরে কথা বলা একেবারে গুরুত্বহীন নয়।
কেন গুরুত্বহীন নয়, এ কথা বুঝতে হলে ব্যারিস্টার হুদার সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে ঢাকার কাগজে প্রকাশিত খবরের একটি অংশের দিকে নজর দিতে হব। খবরের এই অংশে বলা হয়েছে, তিনি একাই সংবাদ সম্মেলন করেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই সংবাদ সম্মেলনে সর্বক্ষণ বিটিভির ক্যামেরার উপস্থিতি। বিএনপির কোনো নেতার সংবাদ সম্মেলনে বিটিভির ক্যামেরার উপস্থিতি একটি বিরল ঘটনা। এই খবর পাঠ করে অনেকের মতো আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে, ব্যারিস্টার হুদা যে এই সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দলনেত্রীকে দলছাড়ার আলটিমেটাম দেবেন এবং নেত্রীর রাজপথের আন্দোলনকে কনডেম করবেন, এ কথা কি সরকারি দলের আগেই জানা ছিল, অথবা তাদের জানিয়েই সংবাদ সম্মেলনটি করা হয়েছে? এই সম্মেলনে বিটিভির উপস্থিতি কী অর্থ বহন করে? আমি সব সময় কনসপিরেসি থিয়োরিতে বিশ্বাস করি না। ব্যারিস্টার হুদাও তাঁর দলের বিরুদ্ধে কোনো কনসপিরেসি করছেন- এ কথা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু তিনি কি নিজের অজান্তে সরকারি দলের কোনো ট্র্যাপে পা দিয়েছেন? অথবা বিএনপির ভেতরেই যাঁরা নেত্রী খালেদা জিয়ার অবাঞ্ছিত জামায়াত-ঘেঁষা নীতি এবং জামায়াতের স্বার্থে হরতালের নামে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা ইত্যাদিতে বিরক্ত কিন্তু নিজেরা মুখ খুলে কথা বলতে পারছেন না, তাঁদের উৎসাহ ও মদদেই কি ব্যারিস্টার হুদার এই একক সংবাদ সম্মেলন? তাঁর নেপথ্যের উৎসাহদাতারা হয়তো আপাতত নেপথ্যে আছেন। ব্যারিস্টার হুদা এখন একাই সংবাদ সম্মেলন করছেন। সময় ও সুযোগ মতো তাঁরাও এসে জুটবেন।
আমার এই অনুমান যদি সঠিক হয় এবং বিএনপির ভেতরের অসন্তোষের খবর যদি সরকারের কানে গিয়ে পেঁৗছে থাকে, তাহলে তাদের উৎসাহিত হওয়ার এবং বিটিভির এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতির একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। নাজমুল হুদা একসময় জামায়াতের মঞ্চে গিয়ে বসেছেন, তাদের পক্ষে কথাও বলেছেন। এখন হয়তো তিনি বুঝেছেন, জামায়াতের মঞ্চ তাঁকে তাঁর বর্তমান পলিটিক্যাল উইলডারনেস থেকে মুক্ত করবে না, বরং তার বিপরীতে দলের ভেতর যে একটা বড় অংশের মধ্যে নীরব ক্ষোভ বইছে, তার মুখপাত্র সাজলে তিনি আবার তাঁর রাজনৈতিক একাকিত্ব ও গুরুত্বহীনতা ঘোচাতে পারেন এবং সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য এটাই উপযুক্ত মুহূর্ত।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ মহল থেকেই জেনেছি, বাইরে প্রকাশ না পেলেও বিএনপির এখন দোমনা নেতা-কর্মীর সংখ্যাই বাড়ছে। ইলিয়াস আলীকে ইস্যু করে বিএনপি সরকার পতনের ডাক দিয়ে মারমূর্তিতে এবং জামায়াতের সমর্থনে রাজপথে নামলেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। বিএনপির যে আন্দোলন করার শক্তি নেই এবং রাজপথের আন্দোলন দ্বারা সরকারের পতন ঘটানো যাবে না, এটা বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীরাও বুঝে ফেলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসার দাবিতে বিএনপি যদি সেই নির্বাচন বর্জন করার অবস্থানে অটল থাকে, তাহলে দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে, যার ফল বিএনপি ভোগ করবে না, সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। গতবার এক-এগারো হওয়াতে বিএনপির সুবিধা হয়নি। সুতরাং বিএনপির অধিকাংশ সংসদ সদস্য চান সংসদে ফিরে যেতে। নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে একটা সম্মানজনক সংলাপ ও মীমাংসা দ্বারা নির্বাচনে যেতে। ব্যারিস্টার হুদা যদি তাঁদের এই মনের কথারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন তাঁর সংবাদ সম্মেলনে; তাহলে বিস্মিত হওয়া কিছু নেই। লক্ষ করার বিষয়, তিনি তাঁর সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়ার বা তাঁর কোহর্টদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সমর্থন করেননি। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছেন। সরকার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখার প্রশ্নে আলোচনায় বসতে রাজি। এই সংবাদ সম্মেলনের পর সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার হুদা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, নির্বাচনের সময় কোন সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সেটা বড় কথা নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না সেটাই নিশ্চিত করা দরকার। এটা দেশের মানুষেরও মনের কথা। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, তা বড় কথা নয়, সেটি অবাধ ও সুষ্ঠু হলো কি না সেটাই বড় কথা। নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক নামের সরকারের অধীনে হয় এবং কারচুপি ও জালিয়াতি অব্যাহত থাকে, তাহলে লাভটা কী?
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একক কণ্ঠে একটি কথা বলেছেন। দলত্যাগের হুমকি দিয়েছেন; কিন্তু এটি তাঁর একার কথা বা বেহুদা হুমকি মনে হয় না। তাঁর কণ্ঠে শক্তি জোগানোর জন্য বিএনপির ভেতরেই একটি শক্তিশালী নীরব গ্রুপ আছে। যারা এখন নীরব, পরে সরব হবে। সম্ভবত ব্যারিস্টার হুদার ভবিষ্যৎ রাজনীতি তাদের নিয়েই। তিনি ডা. চৌধুরী বা কর্নেল অলির মতো নতুন দল করার ভুল করবেন বলে মনে হয় না। মনে হয়, বর্তমান আলটিমেটামে কাজ না হলে তিনি বিএনপি নামের সাইনবোর্ডের আড়ালেই তাঁর নতুন রাজনীতি শুরু করবেন। তাতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কতটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, তা এখনই বলা মুশকিল।
সংলাপে না গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জেদ ধরে বসে থাকলে বিএনপির ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। লাভ হবে জামায়াতের। এমনিতেই বিএনপি দলটির অর্ধাংশের বেশি জামায়াত এখনই গিলে বসে আছে। যাঁরা বেজির সাপ ভক্ষণের দৃশ্য দেখেছেন, তাঁদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান অবস্থানের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের ওপর বিএনপি এখন কোনোভাবে টিকে আছে। নইলে বিএনপি নামের দলের কোনো শক্তিশালী কাঠামো এখন নেই; আন্দোলন করার শক্তি তো দূরের কথা। নির্বাচনে না গেলে বিএনপি দ্রুত জামায়াতের পেটে গিয়ে অস্তিত্ব হারাবে। ব্যারিস্টার হুদার আলটিমেটাম যদি বেহুদা হুমকিও হয়ে থাকে, তাহলেও তাঁকে গুরুত্ব দিলে বেগম জিয়া নিজের নেতৃত্ব ও দলকে বাঁচাতে পারবেন।
লন্ডন, ২৮ মে, সোমবার, ২০১২
সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তাঁর দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে একটি আলটিমেটাম দিয়েছেন। আলটিমেটামটি হলো, 'আগামী ৫ জুনের মধ্যে খালেদা জিয়া যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সংলাপে বসার আমন্ত্রণ না জানান, তাহলে ৬ জুন তিনি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও ইস্তফা দেবেন। সেদিন থেকে তাঁর নতুন রাজনীতি শুরু হবে।' তাঁর এই নতুন রাজনীতি কী হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। নতুন কোনো রাজনৈতিক দল করবেন কি না, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে।'
ব্যারিস্টার হুদা বিএনপির একেবারে গুরুত্বহীন নেতা নন। দলের প্রথম সারির নেতা বলে তিনি একসময় গণ্য হতেন এবং খালেদা জিয়ার সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদেও ছিলেন। তবে মাঝেমধ্যে সাহসী এবং নাটুকে কথাবার্তা বলার অভ্যাস তাঁর আছে। তাতে তাঁর ভোগান্তিও কম হয়নি। দলের হাইকমান্ড, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার পছন্দ নয় এমন কথাবার্তা বলে তিনি একবার মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন, আরেকবার অনুরূপ কিছু কথা বলে দল থেকে বহিষ্কারের নোটিশ পেয়েছিলেন। পরে অনেক দুঃখ প্রকাশ এবং প্রকারান্তরে ক্ষমাটমা চেয়ে দলনেত্রীর অনুকম্পায় দলে থেকে যান।
এবারও তিনি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে খালেদা জিয়াকে যে আলটিমেটাম দিয়েছেন, তাতে দলনেত্রী খুশি হবেন না। বরং ব্যারিস্টার হুদা নিজে দল ছাড়ার আগেই তিনি তাঁকে দলের খোলা দরজা দেখিয়ে দিতে পারেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিএনপি এ ধরনের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে কি না তা আমি এখনো জানি না। যদি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়ে থাকে, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আবার তাঁর কথাবার্তাকে খালেদা জিয়া গুরুত্ব না-ও দিতে পারেন।
ব্যারিস্টার হুদা দল ছাড়বেন না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কথা বলেন। দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য ষোলো আনা; এমনকি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতিও। ২২ মে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, 'জনগণ চায় বিএনপি টিকে থাকুক। এই দলের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত হোক।' আমারও তাই আশা ছিল। কিন্তু দল যে তাঁর এই আশা পূরণ করেনি, সে কথাও তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। তাঁর কথা, 'দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য, আমার দলের রাজনীতি দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি দেশপ্রেমিক সংগঠন হিসেবে বিএনপির বর্তমান কর্মকাণ্ডে দেশবাসী হতাশ। যে সমর্থন বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে পেতে পারে, সেই সমর্থন রাজপথে থেকে আসবে না।'
ব্যারিস্টার হুদা সংলাপের প্রশ্নে নিজের নেত্রীকে যেমন শাসিয়েছেন, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও শাসিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, 'দেশবাসী আশা করেছিল সরকারের প্রধান হিসেবে আলোচনার উদ্যোগ আপনিই নেবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেটা আপনি নেননি। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমার নেত্রী যদি আপনাকে সংলাপে ডাকেন, তাহলে আপনি সে ডাকে সাড়া দিয়ে আলোচনায় বসবেন। যদি আপনি সাড়া না দেন, তাহলে ১০ জুন-পরবর্তী সব ঘটনার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নাজমুল হুদার এই বক্তব্যও এক ধরনের আলটিমেটাম। অর্থাৎ দুই নেত্রীকেই তিনি আলটিমেটাম দিয়েছেন। তবে তাঁর নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিশেষভাবে বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী আলোচনার আহ্বান জানালেন কি জানালেন না, সেটা আমার দেশনেত্রীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে না। দেশের স্বার্থে বেগম জিয়াকেই এই আহ্বান জানাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই আমার এই সংবাদ সম্মেলন।'
কেবল দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসার জন্য আলটিমেটাম দিয়েই ব্যারিস্টার হুদা ক্ষান্ত হননি, তিনি এ আলোচনার এজেন্ডার প্রস্তাবও দিয়েছেন। এই এজেন্ডা হবে, 'রাজবন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি। এক-এগারোপরবর্তী বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বিনা শর্তে প্রত্যাহার। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় বসা। একটি দলীয়করণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। দেশের মূল্যবান জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের স্বার্থে ব্যবহার ও সংরক্ষণ করা।'
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর রাজনৈতিক মতের সঙ্গে আমি বহু বিষয়েই সহমত পোষণ করি না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে একজন ভালো মানুষ- এ কথা বলতে পারি। কথাবার্তায় তিনি অনেক সময় বেহুদা কথা বললেও দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি যে অনেক সময় সাহসের সঙ্গে কথা বলেন এবং সে জন্য ভোগান্তি পোহান- এ কথাও ঠিক। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতো তিনি বহুরূপী নন এবং তাঁর মতো মিথ্যা কথা মিষ্টি ভাষায় বলতেও পারেন না। এ জন্য দলনেত্রী খালেদা জিয়ার খুব কাছের লোক তিনি হয়ে উঠতে গিয়েও হতে পারেননি।
দেশের এই রাজনৈতিক ডামাডোলে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকে একটি ভালো প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সঠিক কথাও অনেক বলেছেন। কিন্তু দলীয় ফোরামে কথা না বলে বা আলটিমেটাম না দিয়ে সহসা একক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি দলীয় নেত্রীকে কেন হুমকি দিয়ে সংলাপের ডাক দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিলেন, তা অনেকের কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
এই সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের পুরো অংশ পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, তিনি মাঝেমধ্যে যতই বেহুদা কথা বলেন বলে অভিযোগ করা হয়, তাঁর বর্তমান সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য হয়তো ততটা বেহুদা নয়। তাঁর একটি বক্তব্যের মধ্যে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকার উদ্দেশ্যটি আঁচ করা যায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, 'আমি সব কিছু জেনেশুনেই এখানে এসেছি। দলীয় ফোরামে এ ধরনের প্রস্তাব দিলে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না, তাও আমি জানি। তাই দলীয় ফোরামে এ ধরনের কথা বলিনি। এসব কথা বলার জন্য দল আমাকে বহিষ্কার করলে রাজনীতি ছেড়ে দেব না। বরং সেখানেই আমার রাজনীতি শুরু হবে।'
'সেখানেই আমার রাজনীতি শুরু হবে'- ব্যারিস্টার হুদার এই উক্তিটি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল করার সম্ভাবনা সম্পর্কেও হ্যাঁ অথবা না, কিছুই বলেননি। বলেছেন, 'সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে।' এই জবাবও অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ। আবার দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকেই মনোনয়ন চাইবেন বলেও জোর গলায় বলেছেন। তাঁর এসব পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা থেকে যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাকে কেউ কেউ বেহুদা কথা বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও আবার কেউ কেউ বলেছেন, বিএনপি-রাজনীতিতে ব্যারিস্টার হুদা এখন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন। কিন্তু তাঁর সংবাদ সম্মেলন ডাকা এবং হুমকির সুরে কথা বলা একেবারে গুরুত্বহীন নয়।
কেন গুরুত্বহীন নয়, এ কথা বুঝতে হলে ব্যারিস্টার হুদার সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে ঢাকার কাগজে প্রকাশিত খবরের একটি অংশের দিকে নজর দিতে হব। খবরের এই অংশে বলা হয়েছে, তিনি একাই সংবাদ সম্মেলন করেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই সংবাদ সম্মেলনে সর্বক্ষণ বিটিভির ক্যামেরার উপস্থিতি। বিএনপির কোনো নেতার সংবাদ সম্মেলনে বিটিভির ক্যামেরার উপস্থিতি একটি বিরল ঘটনা। এই খবর পাঠ করে অনেকের মতো আমার মনেও প্রশ্ন জেগেছে, ব্যারিস্টার হুদা যে এই সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দলনেত্রীকে দলছাড়ার আলটিমেটাম দেবেন এবং নেত্রীর রাজপথের আন্দোলনকে কনডেম করবেন, এ কথা কি সরকারি দলের আগেই জানা ছিল, অথবা তাদের জানিয়েই সংবাদ সম্মেলনটি করা হয়েছে? এই সম্মেলনে বিটিভির উপস্থিতি কী অর্থ বহন করে? আমি সব সময় কনসপিরেসি থিয়োরিতে বিশ্বাস করি না। ব্যারিস্টার হুদাও তাঁর দলের বিরুদ্ধে কোনো কনসপিরেসি করছেন- এ কথা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু তিনি কি নিজের অজান্তে সরকারি দলের কোনো ট্র্যাপে পা দিয়েছেন? অথবা বিএনপির ভেতরেই যাঁরা নেত্রী খালেদা জিয়ার অবাঞ্ছিত জামায়াত-ঘেঁষা নীতি এবং জামায়াতের স্বার্থে হরতালের নামে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা ইত্যাদিতে বিরক্ত কিন্তু নিজেরা মুখ খুলে কথা বলতে পারছেন না, তাঁদের উৎসাহ ও মদদেই কি ব্যারিস্টার হুদার এই একক সংবাদ সম্মেলন? তাঁর নেপথ্যের উৎসাহদাতারা হয়তো আপাতত নেপথ্যে আছেন। ব্যারিস্টার হুদা এখন একাই সংবাদ সম্মেলন করছেন। সময় ও সুযোগ মতো তাঁরাও এসে জুটবেন।
আমার এই অনুমান যদি সঠিক হয় এবং বিএনপির ভেতরের অসন্তোষের খবর যদি সরকারের কানে গিয়ে পেঁৗছে থাকে, তাহলে তাদের উৎসাহিত হওয়ার এবং বিটিভির এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতির একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। নাজমুল হুদা একসময় জামায়াতের মঞ্চে গিয়ে বসেছেন, তাদের পক্ষে কথাও বলেছেন। এখন হয়তো তিনি বুঝেছেন, জামায়াতের মঞ্চ তাঁকে তাঁর বর্তমান পলিটিক্যাল উইলডারনেস থেকে মুক্ত করবে না, বরং তার বিপরীতে দলের ভেতর যে একটা বড় অংশের মধ্যে নীরব ক্ষোভ বইছে, তার মুখপাত্র সাজলে তিনি আবার তাঁর রাজনৈতিক একাকিত্ব ও গুরুত্বহীনতা ঘোচাতে পারেন এবং সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য এটাই উপযুক্ত মুহূর্ত।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ মহল থেকেই জেনেছি, বাইরে প্রকাশ না পেলেও বিএনপির এখন দোমনা নেতা-কর্মীর সংখ্যাই বাড়ছে। ইলিয়াস আলীকে ইস্যু করে বিএনপি সরকার পতনের ডাক দিয়ে মারমূর্তিতে এবং জামায়াতের সমর্থনে রাজপথে নামলেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। বিএনপির যে আন্দোলন করার শক্তি নেই এবং রাজপথের আন্দোলন দ্বারা সরকারের পতন ঘটানো যাবে না, এটা বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীরাও বুঝে ফেলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসার দাবিতে বিএনপি যদি সেই নির্বাচন বর্জন করার অবস্থানে অটল থাকে, তাহলে দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হবে, যার ফল বিএনপি ভোগ করবে না, সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। গতবার এক-এগারো হওয়াতে বিএনপির সুবিধা হয়নি। সুতরাং বিএনপির অধিকাংশ সংসদ সদস্য চান সংসদে ফিরে যেতে। নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে একটা সম্মানজনক সংলাপ ও মীমাংসা দ্বারা নির্বাচনে যেতে। ব্যারিস্টার হুদা যদি তাঁদের এই মনের কথারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন তাঁর সংবাদ সম্মেলনে; তাহলে বিস্মিত হওয়া কিছু নেই। লক্ষ করার বিষয়, তিনি তাঁর সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়ার বা তাঁর কোহর্টদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সমর্থন করেননি। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলেছেন। সরকার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখার প্রশ্নে আলোচনায় বসতে রাজি। এই সংবাদ সম্মেলনের পর সংবাদপত্রে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার হুদা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, নির্বাচনের সময় কোন সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সেটা বড় কথা নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কি না সেটাই নিশ্চিত করা দরকার। এটা দেশের মানুষেরও মনের কথা। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, তা বড় কথা নয়, সেটি অবাধ ও সুষ্ঠু হলো কি না সেটাই বড় কথা। নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক নামের সরকারের অধীনে হয় এবং কারচুপি ও জালিয়াতি অব্যাহত থাকে, তাহলে লাভটা কী?
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একক কণ্ঠে একটি কথা বলেছেন। দলত্যাগের হুমকি দিয়েছেন; কিন্তু এটি তাঁর একার কথা বা বেহুদা হুমকি মনে হয় না। তাঁর কণ্ঠে শক্তি জোগানোর জন্য বিএনপির ভেতরেই একটি শক্তিশালী নীরব গ্রুপ আছে। যারা এখন নীরব, পরে সরব হবে। সম্ভবত ব্যারিস্টার হুদার ভবিষ্যৎ রাজনীতি তাদের নিয়েই। তিনি ডা. চৌধুরী বা কর্নেল অলির মতো নতুন দল করার ভুল করবেন বলে মনে হয় না। মনে হয়, বর্তমান আলটিমেটামে কাজ না হলে তিনি বিএনপি নামের সাইনবোর্ডের আড়ালেই তাঁর নতুন রাজনীতি শুরু করবেন। তাতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কতটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, তা এখনই বলা মুশকিল।
সংলাপে না গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জেদ ধরে বসে থাকলে বিএনপির ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। লাভ হবে জামায়াতের। এমনিতেই বিএনপি দলটির অর্ধাংশের বেশি জামায়াত এখনই গিলে বসে আছে। যাঁরা বেজির সাপ ভক্ষণের দৃশ্য দেখেছেন, তাঁদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের বর্তমান অবস্থানের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। বর্তমান সরকারের নানা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভের ওপর বিএনপি এখন কোনোভাবে টিকে আছে। নইলে বিএনপি নামের দলের কোনো শক্তিশালী কাঠামো এখন নেই; আন্দোলন করার শক্তি তো দূরের কথা। নির্বাচনে না গেলে বিএনপি দ্রুত জামায়াতের পেটে গিয়ে অস্তিত্ব হারাবে। ব্যারিস্টার হুদার আলটিমেটাম যদি বেহুদা হুমকিও হয়ে থাকে, তাহলেও তাঁকে গুরুত্ব দিলে বেগম জিয়া নিজের নেতৃত্ব ও দলকে বাঁচাতে পারবেন।
লন্ডন, ২৮ মে, সোমবার, ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন