তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনও দেড় বছর। কিন্তু এরই মধ্যে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে একের পর এক, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমান দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনা এবং ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ‘গুম’ হলেন বিএনপির মাঝ সারির এক নেতা। এর প্রতিবাদে বিএনপি তথা ১৮ দল হরতাল করল পাঁচ দিন। ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার এক মাস পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। তার পরও গত ২২ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন তিনি আশাবাদী ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পাওয়া যাবেই। অথচ ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে অনেক লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ৩৩ শীর্ষস্থানীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সম্মুখে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা হল। তাদের জামিন প্রত্যাখ্যান করা হল নিম্ন আদালতে। এ ঘটনার রেশ ধরে আদালত ভাঙচুর করার অভিযোগে একশ’ আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। রাজনীতি বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকের প্রয়োজন নেই। একজন সাধারণ মানুষও বোঝেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে আর তা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হবে এবং এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পরস্পর বিপরীতমুখী একটি অবস্থান। সংবিধান অনুসরণ করে সরকার যেখানে বলছে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই, সেখানে বিরোধী দলের দাবি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ নিয়ে জট খুলছে না। এ ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলোর একধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ও আমরা লক্ষ করছি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ঘুরে গেলেন ক’দিন আগে। তিনি বলে গেলেন, একটি নিরপেক্ষ সরকার ও সকল দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনই চায় যুক্তরাষ্ট্র। একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। হিলারি ক্লিনটন আরও একটি কথা ঢাকায় বলে গিয়েছিলেন আর তা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সংলাপ। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। সঙ্কট নিরসনে এই মুহূর্তে সংলাপ জরুরি। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, তা সংলাপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। সংবিধান ইতোমধ্যে সংশোধিত হয়েছে। সংবিধানে এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। তবে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি পদ্ধতি বের করা সম্ভব। ওই পদ্ধতিকে যে-কোনো নামে অভিহিত করা যায়। শুধু যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে তার কোনো মানে নেই। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার স্বার্থে বিএনপি তথা ১৮ দল চাচ্ছে সরকার সংবিধান সংশোধন করুক।
এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না-করেও সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন ‘ফর্মুলা’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এই নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই ‘সংলাপ’ জরুরি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের ‘পদ’ বজায় রেখে (যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সকল দলের সঙ্গে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। হিলারি হরতাল না করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবিদাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা ‘গুম’ করল রাষ্ট্র তা জানবে না তা হতে পারে না। বিএনপি এই ইস্যুতে হরতাল করেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। এটা দুঃখজনক। তবে এই ইস্যুতে হরতাল দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করা। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হনই, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটা বোঝা উচিত কেন বিরোধী দল হরতাল দেয়। সেই ‘পরিস্থিতি’ যাতে সৃষ্টি না-হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। আরও একটা কথা, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তীতে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়াও প্রয়োজন। এটা কি কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড? জনপ্রিয় একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু ‘ভুল সিগন্যাল’ পৌঁছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না-হওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাকের স্বার্থেই আমিনুল হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনোচিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে রাগ দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে বিশ্বজুড়েই ড. ইউনূসের অনেক ‘বন্ধু’ রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কোনো একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখা গেলে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এই বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে। এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। এই দুর্নীতি আমরা রোধ করতে পারছি না। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। ঢাকা শহরে এসে জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রীও বলে গেলেন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কথা। বিএনপিও বলছে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিতে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের স্বার্থেই আমাদের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত। হিলারি ক্লিনটন মূলত এ কথাগুলোই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলে গেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই বিষয়গুলো আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ সরকার না-হলে কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রতিফলিত হবে না। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে হলে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় এসে এ কথাটাই আমাদের বলে গেছেন। সরকার যদি এটা উপলব্ধি করতে না-পারে, তাহলে ভুল করবে। আমাদের কাছে প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকার এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সংবিধানসম্মত ছিল না। যেমন ২০০৮ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের কথা আমরা রাখতে পারি। এই দুটো দেশে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না সংবিধানে। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট মুগাবে (জিম্বাবুয়ে) সাভাঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী ও কেনিয়াতে প্রেসিডেন্ট কিবাকি বিরোধী দলনেতা অডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। আজ গ্রিসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাকিস্তানের দৃষ্টান্তও দিতে পারি। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের সংসদেও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার। আমরা চাই দেশে তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার একটা ঘোষণা সরকার দিক। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস করা সম্ভব। গ্রিস আমাদের জন্য একটা উদাহরণ। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে আমরা এই উদাহরণটা অনুসরণ করতে পারি। গ্রিসের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে সংবিধানই সবকিছু নয়। প্রয়োজনে জাতির স্বার্থে সংবিধানের বাইরে গিয়েও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমাদের রাজনীতিবিদরা গ্রিস বা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি গেল বুধবার বলেছেন সংলাপ হবে, তবে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে নয়। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুও ইঙ্গিত দিয়েছেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো নিয়ে মহাজোটের মাঝে আলোচনা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার। সরকার একটু নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই অনেকেই স্বীকার করবেন যে, ২০০৮ সালের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেই সরকারের অনেক অনিয়ম, বিশেষ করে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের বিতর্কিত ভূমিকা গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সে ধরনের একটি সরকার কেউই চাইবে না। তবে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেই নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, সেটা নিয়েই সংলাপ হতে পারে। এখানে বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে মতবিনিময় হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত একটি মতের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আরও একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে সেই পুরনো ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। যদিও এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত জানি না। তবে নিঃসন্দেহে অভিযোগটি গুরুতর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত দুই শক্তি। এদের বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। এদের রেখেই গণতন্ত্রকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
সংলাপ হোক। সংলাপের এজেন্ডা হওয়া উচিত একটাই-নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো। তার আগে দুটি বড় দলের মধ্যে অর্থাত্ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা খুব জরুরি। সরকারকেই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই রাজনীতি তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে যাক। এক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত না-হলে কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না এবং ‘সংলাপ’-এর মাধ্যমে কোনো ফলাফলও আমরা পাব না।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd(a)yahoo.com
দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনও দেড় বছর। কিন্তু এরই মধ্যে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে একের পর এক, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমান দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনা এবং ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ‘গুম’ হলেন বিএনপির মাঝ সারির এক নেতা। এর প্রতিবাদে বিএনপি তথা ১৮ দল হরতাল করল পাঁচ দিন। ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার এক মাস পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। তার পরও গত ২২ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন তিনি আশাবাদী ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পাওয়া যাবেই। অথচ ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে অনেক লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ৩৩ শীর্ষস্থানীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সম্মুখে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা হল। তাদের জামিন প্রত্যাখ্যান করা হল নিম্ন আদালতে। এ ঘটনার রেশ ধরে আদালত ভাঙচুর করার অভিযোগে একশ’ আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। রাজনীতি বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকের প্রয়োজন নেই। একজন সাধারণ মানুষও বোঝেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে আর তা হচ্ছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হবে এবং এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পরস্পর বিপরীতমুখী একটি অবস্থান। সংবিধান অনুসরণ করে সরকার যেখানে বলছে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই, সেখানে বিরোধী দলের দাবি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ নিয়ে জট খুলছে না। এ ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তিগুলোর একধরনের ‘হস্তক্ষেপ’ও আমরা লক্ষ করছি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ঘুরে গেলেন ক’দিন আগে। তিনি বলে গেলেন, একটি নিরপেক্ষ সরকার ও সকল দলের অংশগ্রহণের নির্বাচনই চায় যুক্তরাষ্ট্র। একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও। হিলারি ক্লিনটন আরও একটি কথা ঢাকায় বলে গিয়েছিলেন আর তা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি সংলাপ। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। সঙ্কট নিরসনে এই মুহূর্তে সংলাপ জরুরি। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, তা সংলাপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা সম্ভব। সংবিধান ইতোমধ্যে সংশোধিত হয়েছে। সংবিধানে এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। তবে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যাপারে একটি পদ্ধতি বের করা সম্ভব। ওই পদ্ধতিকে যে-কোনো নামে অভিহিত করা যায়। শুধু যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে তার কোনো মানে নেই। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার স্বার্থে বিএনপি তথা ১৮ দল চাচ্ছে সরকার সংবিধান সংশোধন করুক।
এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না-করেও সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন ‘ফর্মুলা’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এই নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই ‘সংলাপ’ জরুরি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের ‘পদ’ বজায় রেখে (যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সকল দলের সঙ্গে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। হিলারি হরতাল না করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবিদাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা ‘গুম’ করল রাষ্ট্র তা জানবে না তা হতে পারে না। বিএনপি এই ইস্যুতে হরতাল করেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। এটা দুঃখজনক। তবে এই ইস্যুতে হরতাল দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করা। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হনই, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটা বোঝা উচিত কেন বিরোধী দল হরতাল দেয়। সেই ‘পরিস্থিতি’ যাতে সৃষ্টি না-হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। আরও একটা কথা, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তীতে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়াও প্রয়োজন। এটা কি কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড? জনপ্রিয় একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু ‘ভুল সিগন্যাল’ পৌঁছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না-হওয়া বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাকের স্বার্থেই আমিনুল হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনোচিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে রাগ দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে বিশ্বজুড়েই ড. ইউনূসের অনেক ‘বন্ধু’ রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কোনো একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখা গেলে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এই বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে। এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। এই দুর্নীতি আমরা রোধ করতে পারছি না। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। ঢাকা শহরে এসে জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রীও বলে গেলেন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কথা। বিএনপিও বলছে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিতে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের স্বার্থেই আমাদের বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত। হিলারি ক্লিনটন মূলত এ কথাগুলোই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলে গেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই বিষয়গুলো আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ সরকার না-হলে কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের মনোভাব প্রতিফলিত হবে না। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে হলে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় এসে এ কথাটাই আমাদের বলে গেছেন। সরকার যদি এটা উপলব্ধি করতে না-পারে, তাহলে ভুল করবে। আমাদের কাছে প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকার এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সংবিধানসম্মত ছিল না। যেমন ২০০৮ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের কথা আমরা রাখতে পারি। এই দুটো দেশে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ ছিল না সংবিধানে। কিন্তু রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট মুগাবে (জিম্বাবুয়ে) সাভাঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী ও কেনিয়াতে প্রেসিডেন্ট কিবাকি বিরোধী দলনেতা অডিংগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। আজ গ্রিসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাকিস্তানের দৃষ্টান্তও দিতে পারি। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের সংসদেও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার। আমরা চাই দেশে তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার একটা ঘোষণা সরকার দিক। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস করা সম্ভব। গ্রিস আমাদের জন্য একটা উদাহরণ। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে আমরা এই উদাহরণটা অনুসরণ করতে পারি। গ্রিসের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। আসলে মূল বিষয়টি হচ্ছে সংবিধানই সবকিছু নয়। প্রয়োজনে জাতির স্বার্থে সংবিধানের বাইরে গিয়েও কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমাদের রাজনীতিবিদরা গ্রিস বা কেনিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন কি না, সেটাই দেখার বিষয় এখন। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি গেল বুধবার বলেছেন সংলাপ হবে, তবে তা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে নয়। মহাজোটের অন্যতম শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুও ইঙ্গিত দিয়েছেন একটি নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো নিয়ে মহাজোটের মাঝে আলোচনা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার। সরকার একটু নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই অনেকেই স্বীকার করবেন যে, ২০০৮ সালের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেই সরকারের অনেক অনিয়ম, বিশেষ করে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের বিতর্কিত ভূমিকা গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সে ধরনের একটি সরকার কেউই চাইবে না। তবে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেই নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, সেটা নিয়েই সংলাপ হতে পারে। এখানে বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে মতবিনিময় হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত একটি মতের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আরও একটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে সেই পুরনো ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’। যদিও এ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত জানি না। তবে নিঃসন্দেহে অভিযোগটি গুরুতর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত দুই শক্তি। এদের বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। এদের রেখেই গণতন্ত্রকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
সংলাপ হোক। সংলাপের এজেন্ডা হওয়া উচিত একটাই-নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো। তার আগে দুটি বড় দলের মধ্যে অর্থাত্ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা খুব জরুরি। সরকারকেই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা চাই রাজনীতি তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে যাক। এক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত না-হলে কোনো ফর্মুলাই কাজ করবে না এবং ‘সংলাপ’-এর মাধ্যমে কোনো ফলাফলও আমরা পাব না।
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd(a)yahoo.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন