রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

সরকার নিজেই দেয় না কেন একটি প্রতিবেদন?

মশিউল আলম | তারিখ: ২৮-০৫-২০১২


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুটি পৃথক প্রতিবেদনের সুবাদে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু চিত্র পাওয়া গেল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিবছরই সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশের সর্বশেষ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একইভাবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস হিউম্যান রাইটস’ বা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি সাধারণ শিরোনামে তাদের নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দুটো প্রতিবেদনই সারা বিশ্বের মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে পেতে পারে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনটির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট বেশ দীর্ঘ, ৪৩ পৃষ্ঠা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ অংশটির আকার সে তুলনায় অনেক কম—মাত্র হাজার খানেক শব্দের। কিন্তু উভয় প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা ও কিছু প্রবণতা সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের সরকারসহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভাবমূর্তির পক্ষে ক্ষতিকর।
কিন্তু ভাবমূর্তির প্রসঙ্গটি তত বড় নয়, নাগরিকদের মানবাধিকারের প্রশ্ন যত বড়। অবশ্য মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব যে রাষ্ট্র ও সরকারের, তারা এই প্রশ্নটিকে কতটা বড় মনে করে সেটাও একটা প্রশ্ন। বস্তুত, নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সরকার যতটা না বিচলিত হয়, তার চেয়ে বেশি বিচলিত, ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত হয় যদি কেউ বলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এমনকি তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হলেও সরকার স্বীকার করতে চায় না যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নামে আমাদের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাঝে মাঝেই আবেগাপ্লুত হয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করেন। কিন্তু সরকার তাতে ভ্রূক্ষেপ করে না। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কিছু এসে যায় না। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশন অভিযোগ তুলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করার কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিশনকে সহযোগিতা করছে না। উপায়ান্তর না দেখে কমিশন এখন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে।
একটি-দুটি ঘটনার তদন্তকাজে মানবাধিকার কমিশনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহযোগিতা করছে না বলে কমিশন রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে, কিন্তু দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্রটি কি কমিশনের কাছে আছে? প্রতিবছর কত মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের হাতে ক্রসফায়ার, গুম ইত্যাদি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে, কতজন নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনে মারা যাচ্ছে, গুম বা ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন প্রকৃত ‘ক্রিমিন্যাল’, কতজন নিরীহ সাধারণ মানুষ, কতজন রাজনৈতিক কর্মী—এসব হিসাব কোথায়, কার কাছে পাওয়া যাবে? এসব হিসাব রাখার দায়িত্বটা আসলে কার?
নিশ্চয়ই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নয়। কিন্তু এই দুটি সংস্থাই প্রতিবছর আমাদের সর্বসাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতির একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আর আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সেসব প্রতিবেদনকে ‘সত্য নয়’, ‘ঢালাও’ ইত্যাদি বলে অস্বীকার করার চেষ্টা চলে। এবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনটি সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, ‘তারা তাদের নিজস্ব মতামত দিয়েছে, আমরা তা মানছি না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঢালাওভাবে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা সত্য নয়।’ অবশ্য মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ মন্তব্য করেছেন বলে জানা যায়নি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের সদস্যদের হাতে মোট ৫৪ জন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ২০০৪ সালে র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১১ সালের শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মোট সংখ্যা ৭০০ পেরিয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যদি দাবি করেন, এই হিসাব সত্য নয়, তাহলে তাঁর মন্ত্রণালয়—যার অধীনে পরিচালিত হয় র‌্যাব—কেন নিজেদের হিসাব প্রকাশ করেনি? মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে কতজন মানুষ অপহূত বা গুম হয়েছেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব তারা পায়নি। বাংলাদেশের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর সূত্র উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের হাতে গুম হয়েছেন ৩০ জন মানুষ। আগের বছর, অর্থাৎ ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যে সরকারি বাহিনীর সদস্যদের হাতে গুমের ঘটনা বেড়ে গেছে তিন গুণের বেশি। নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেছেন ১৪০ জন, কারাগারে মারা গেছেন ১০৫ জন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যদের দ্বারা অপহরণ ও গুমের ঘটনাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উদাহরণ হিসেবে বিএনপির নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর চৌধুরী আলমের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এটি ঘটেছে ২০১০ সালে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপিপন্থী দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তাদের বলেছেন, সেনানিবাসের ভেতরে থানায় পুলিশ তাঁকে এমনভাবে প্রহার করেছে যে তিনি কয়েক ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে ছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করছে, র‌্যাবের সদস্যদের হাতে যে ৫৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর একটিরও স্বাধীন তদন্ত হয়নি বা অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন, অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার ইত্যাদি অভিযোগে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদসদ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে খুব কদাচিৎ। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দাবি করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁর এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে কতজন সদস্যের বিরুদ্ধে কী অভিযোগে কী ধরনের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য জানাতে অসুবিধা কোথায়? ক্রসফায়ারে হত্যা বা গুমের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ মারা গেছে নিরাপত্তা হেফাজতে ও কারাগারে বন্দী অবস্থায়; কিন্তু কোনো মানবাধিকারকর্মী বা সংস্থাকে, এমনকি রেড ক্রিসেন্টকেও সরকার কারাগার পরিদর্শন করতে দেয় না—এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল: ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা’ গেছে—এ কথা বলার কোনো উপায় নেই। বরং, খুবই উদ্বেগজনক এক প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে: মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্ত ও বিচার না করার ফলে ‘এ ক্লাইমেট অব ইমপিউনিটি’ বা শাস্তির কোনো ভয় নেই—এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আগের বছরের চেয়ে বেড়ে গেছে এবং তা আরও নতুন নতুন রূপে (নিখোঁজ, গুম) বেড়ে চলেছে।
বিদেশিদের নিন্দা-সমালোচনা বা বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে; কিন্তু শুধু সেই কারণেই নয়, নিজেদের দেশ ও সমাজকে বাসযোগ্য, সভ্য, ন্যায়ভিত্তিক করার চেষ্টা করতে হয় নিজেদের স্বার্থেই। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকব কেন, যদি আমাদের নিজেদের নির্বাচিত সরকার প্রতিবছর দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে একটি করে প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করে? তথ্য অধিকার আইনের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রদানসংক্রান্ত ধারার আলোকে তথ্য কমিশনও কিন্তু পারে এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানাতে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন