মাহবুব হোসেন
অর্থবছর ২০১১-১২ বিদায় নিচ্ছে। এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যা ছাড়াও প্রধান আলোচনা চলছে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কতটা সফল কিংবা ব্যর্থ, তা নিয়ে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো পূর্বাভাস দিয়েছে এ ব্যাপারে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স বা বিবিএসও এ কাজটি করেছে। এ পর্যন্ত যে চিত্র মিলেছে, সেটা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। একই সঙ্গে আলোচনা চলছে আর্থিক খাতে বেশ কিছু অব্যবস্থাপনার চিত্র নিয়ে।
প্রথমেই বলতে হয় শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে। পূর্ববর্তী অর্থবছরে বাজারে ধস নেমেছিল, যা গত বছরেও পুনরুদ্ধার হয়নি। এ নিয়ে বিনিয়োগকারী বিশেষ করে কম পুঁজির মালিকদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে এবং একাধিকবার তার প্রকাশ ঘটেছে। সরকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অনিয়মের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। তাতেও লেনদেনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসেনি।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি উদ্বেগের সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান কমে যাওয়া। এ বছরে ডলারের তুলনায় মুদ্রা মান ১১ শতাংশ কমেছে, যা এক সময়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গিয়েছিল। এক বছরে এতটা অবমূল্যায়ন, বলা যায় রেকর্ড।
আর্থিক অব্যবস্থাপনার আরেকটি নজির হিসেবে উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন বাজেটের কথা তুলে ধরা হয়। এর আকার সরকারের ব্যয় করার ক্ষমতার চেয়ে বেশি ছিল বলে মত রয়েছে এবং বছর শেষ হওয়ার আগেই কাটছাঁট করায় তা সমর্থিত হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ধারণাতীত পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হয় এবং তাতেও গ্রীষ্মকালে এ সংকটের প্রকোপ কমানো যায়নি। রেন্টাল বিদ্যুৎ সরকারের গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। এর ভর্তুকির জোগান দিতে বাজেটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানত ভর্তুকির চাপ কমাতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে এবং লিকুইডিটি সমস্যার কারণে তার প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের ওপর। ক্রাউডিং অ্যাফেক্ট ভালোভাবেই উপলব্ধি করা গেছে এ বছরে_ এ দাবি বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের।
আমাদের দেশে সরকারি বিনিয়োগ দরকারি বলে বিবেচিত হয়। সড়ক, রেলপথ, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বন্দর ইত্যাদি খাতে মানসম্মত বিনিয়োগ হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিতে এমন কিছু খাত রয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করলে তার সুবিধা সবাই ভোগ করে এবং এ কারণে সরকারকেই এ ক্ষেত্রে প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। এমন পদক্ষেপকে বেসরকারি খাত স্বাগত জানায়। এতে ক্রাউডিং-ইনের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং তারা এর সুফল ভোগ করে। সরকার যদি এ ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাংকিং সূত্র থেকে ঋণ নিয়ে থাকে, সেটা গ্রহণযোগ্য হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চলতি বছরে সরকারের যে ঋণ, তা ব্যয়ের মূল খাত ছিল চলতি ব্যয় নির্বাহ।
অর্থনীতির এই যে চিত্র, সেটা উৎসাহব্যঞ্জক নয় এবং তাতে সার্বিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রার বেশ নিচে থাকবে_ এমন শঙ্কা স্বাভাবিক। বাইরের দুনিয়ার সংকেতও আমাদের অনুকূল ছিল না। ইউরোপীয় দেশগুলো আমাদের রফতানি পণ্যের বড় বাজার। তাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে_ এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র বিপরীত। সাম্প্রতিক সময়ে বরং অবনতির খবরই বেশি। এ কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে রফতানি বাজার প্রসারের সম্ভাবনা পূরণ হয়নি। দেশের অভ্যন্তরে ম্যাক্রো অর্থনীতিতে সমস্যার পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে চলমান মন্দার প্রভাবের মধ্যেই বাংলাদেশে চলছে সালতামামি।
এখন দেখা যাক প্রাক্-জরিপ কী বলছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটবে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যা রীতিমতো রেকর্ড। এ সূত্র সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোর। শিল্প খাতে আগে সর্বোচ্চ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ। নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি উৎসাহব্যঞ্জক। বছরজুড়েই বিদ্যুতের সংকট ছিল। অনেক কলকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ দেওয়া যায়নি কিংবা চাহিদার তুলনায় মিলেছে কম। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়েছে বলেও সংবাদপত্রে খবর মিলেছে। তারপরও রেকর্ড প্রবৃদ্ধি শিল্প খাতে। জিডিপির সার্বিক প্রবৃদ্ধিও ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ হবে বলে তাদের আশা। যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ধারণা ছিল, এটা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে পেঁৗছাবে। তারা ৭ শতাংশের টার্গেট নিয়ে চলেছে। তবে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও খারাপ বলা যায় না। তবে শস্য খাতের প্রবৃদ্ধি মাত্র ০ দশমিক ৯ শতাংশ। এ তথ্য বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। গত ২-৩ বছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ থেকে ৫ শতাংশ। এটা কমার আপাতভাবে কোনো কারণ দেখি না। এটা হতে পারে যে, বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সর্বশেষ তথ্য সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। মাঠের চিত্র বলছে, আউশ ও আমনের পর বোরোও খুব ভালো হয়েছে। এখন চাষের জমি বাড়ানোর সুযোগ তেমন নেই। কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে বৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী এবং তাতে কৃষকের সেচের ব্যয়ও খানিকটা কম পড়েছে। আবার রোদেলা আকাশও ভালো ফলনের কারণ। যতটা খবর মিলছে, তাতে ধানে চিটা হওয়া খবর খুব একটা নেই। শুধু ধান নয়, সবজি, ফলমূলও ভালো উৎপাদন হয়েছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধি কেন নামমাত্র ০ দশমিক ৯ শতাংশ হবে_ বোধগম্য নয়।
তবে কৃষি খাতের সমস্যা অন্যত্র। কৃষকের উৎপাদন ব্যয় এবং বাজারে বিক্রি থেকে আয়, এ দুয়ের ব্যবধান গত কয়েক বছরে কৃষকের অনুকূলে ছিল। কৃষকরা উৎপাদন যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি ভালো দামও পেয়েছে। কিন্তু এ বছরের চিত্র ভিন্ন। আগামী কয়েক মাসে দাম না বাড়লে কৃষকরা হতাশ হবে। এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশের অনেক কৃষক এখন খাদ্যশস্য ধরে রাখার ক্ষমতা অর্জন করেছে। এক সময় যারা মাঠে থাকা অবস্থাতেই এমনকি লোকসান দিয়ে হলেও ফসল বিক্রি করে দিত, এখন তারা বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করে। গোলায় ধান ভরা থাকলে তারা সমস্যায় পড়ে ঠিকই। কিন্তু প্রয়োজনে নতুন গোলা তৈরি করাও তেমন ব্যয়বহুল নয়। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এবং প্রবাস থেকে পরিবারের সদস্যদের পাঠানো অর্থ এ ক্ষমতা অর্জনের পেছনে কাজ করছে। কৃষিতে ০ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরেই জিডিপিতে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষিতে চূড়ান্ত হিসাব করা হলে জিডিপির চিত্র আরেকটু ভালো হতে পারে।
লেখার শুরুতে আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরেছি। এ সময়ে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এর বড় কারণ। আরও অনেক ধরনের পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়, যা অপরিহার্য। বিশ্ববাজারে দাম যা-ই হোক না কেন, আমাদের সেটা কেনার বিকল্প নেই। কারণ দেশের বাজারে তার চাহিদা কমে না। তবে আমাদের রিজার্ভের জন্য স্বস্তির খবর_ খাদ্যশস্য আমদানি করতে না হওয়া। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে এখন টালমাটাল অবস্থা। এ অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ যে নিজেকে সামলে চলতে পারছে, তা থেকে স্পষ্ট যে, আমাদের সহ্য ও ধারণক্ষমতা বেড়েছে। আমরা যেমন ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিয়ে উন্নয়নের ধারা এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারছি; তেমনি অর্থনীতিতে ঝড়ঝাপটাও মোকাবেলা করতে শিখেছি।
শিল্পে রেকর্ড প্রবৃদ্ধির কারণ কী_ এটা বড় প্রশ্ন। তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে রফতানি আয়ের প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ। এ বছর এ খাতের প্রবৃদ্ধি ২০-২২ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত বছর ছিল ৪২ শতাংশ। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রকৃত আয়ে প্রবৃদ্ধি আরও কম হবে। রফতানিমুখী প্রধান শিল্পের প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়ার পরও শিল্প খাতে কেন রেকর্ড প্রবৃদ্ধি? এর কারণ সম্ভবত অভ্যন্তরীণ বাজারের সম্প্রসারণ। কৃষকের আয় গত কয়েক বছরে বেড়েছে_ সেটা বলেছি। এ কারণে তারা বস্ত্র, জুতা, গৃহে ব্যবহার্য প্লাস্টিক সামগ্রী এবং এ ধরনের আরও কিছু পণ্য কেনায় অর্থ ব্যয় করতে পারছে। নির্মাণ শিল্পেও সুলক্ষণ। গ্রাম ও শহর সর্বত্রই ঘরবাড়ির চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। টিনের ঘরের স্থান নিচ্ছে পাকা দালান। আবাসন খাতের তুলনামূলক ভালো অবস্থা নির্মাণসামগ্রী তৈরির শিল্প খাত যেমন ইট, সিমেন্ট, রড, টাইলস, রঙ প্রভৃতি উপকরণ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। শ্রমবাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। নির্মাণ শিল্পে যুক্ত শ্রমিকরা এখন ভালো আয় করছে। দিনমজুরদের আয় বেড়েছে। এ কারণে তারাও শিল্পপণ্য কেনার জন্য বেশি ব্যয় করতে পারছে। এভাবেই অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ছে।
আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যা ঠিক পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে প্রতিদিনই অনেক নতুন প্রাইভেট গাড়ি নামছে। এজন্য চালক দরকার, মেরামতের প্রতিষ্ঠান দরকার। পরিবহন খাত স্বল্প শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ভালো সুযোগ সৃষ্টি করেছে। হাইস্কুল থেকে যারা ঝরে পড়ছে, তারা অনেকে ড্রাইভারের পেশায় আসছে।
সার্বিক বিবেচনায় আমরা বলতে পারি, অর্থনীতির চিত্র আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনার সঙ্গে ঠিক মিলছে না। বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। অর্থনীতি নিয়ে আলোচনায় হতাশার চিত্র বেশি ফুটে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা খানিকটা ভিন্ন। তবে এটাও বলব যে, আমাদের নীতি ও কৌশল আরও ভালো হলে, অবকাঠামো সুবিধা প্রসারিত হলে, মানবসম্পদ খাতে বিনিয়োগ থেকে যথাযথ সুফল মিললে এবং অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টানা গেলে অর্থনীতির চিত্র প্রকৃতই উৎসাহব্যঞ্জক ও সহজে দৃশ্যমান হবে।
ড. মাহবুব হোসেন :অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন