আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বর্তমান সরকারের নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে মাঝে মাঝে কঠোর সমালোচনাও করি, কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করি যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এখনও ‘শিবরাত্রির সলতে।’ এই সলতেটি নিভে গেলে সামনে আবার দীর্ঘ অন্ধকার। আমাদের অনেক প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী এখন এন্তার ভাল ভাল কথা বলছেন বটে, কিন্তু দেশের ও গণতন্ত্রের বিপদ মুহূর্তে কেউ অক্সফোর্ডে, কেউ হার্ভার্ডে ছোটেন নানারকম অধ্যয়ন ও গবেষণার অজুহাতে। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য কেউ থাকেন না। সাধারণ মানুষের রক্তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেই তারা আবার গণতন্ত্র সম্পর্কে দেশের মানুষকে ‘ছবক’ দেয়ার জন্য দেশে এসে উপস্থিত হন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন এক দারুণ ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। এই রাজনীতির প্রকাশ্য শত্রুর চাইতে মিত্রবেশী শত্রুর সংখ্যা বেশি। দেশের ভেতরে এবং বাইরেও। আমরা যারা হাসিনা সরকারের ভুলভ্রান্তিগুলোর কঠোর সমালোচনা করি। তা এই সরকারের পতন কামনা থেকে করি না। করি এ জন্য যে, নিজেদের ভুলভ্রান্তির জন্য যদি এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে ‘মহাবীর’ তারেক এবং তার জামায়াতী আত্মীয়দের (তারেকের নিজ বর্ণনামতে) যদি আবার ক্ষমতায় বসার সুযোগ ঘটে, তাহলে বর্তমানের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে বাংলাদেশের তুলনায় মনে হবে স্বর্গোদ্যান।
শেখ হাসিনাকে তাই জোর হাতে বলি, জেদ নয়, ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিন। রাজা ক্যানিউটের মতো চাটুকার সভাসদদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। বোকা মিত্রের চাইতে বুদ্ধিমান শত্রুকে গুরুত্ব দিন। মন্ত্রিসভায় যেসব বেকুব সদস্য আছে, তাঁদের কম কথা বলতে বলুন, অথবা অপসারণ করুন। সমুদ্রজয়ের চাইতে দেশের মানুষের মন জয়ের ওপর গুরুত্ব দিন। ছাত্রলীগ, যুব লীগের দ্বারা ঘনঘন সংবর্ধনা নেয়া বন্ধ করুন। অন্য সব কিছুর আগে বিদ্যুত, পানি, গ্যাসের সঙ্কট হ্রাস, সড়ক দুর্ঘটনায় নিত্য প্রাণ বলির সংখ্যা কমানোকে প্রায়োরিটি দিন।
আরও বলি, দেশে গুম, হত্যা, ধর্ষণসহ সন্ত্রাস বেড়েছে এই সত্যকে স্বীকৃতি দিন। প্রয়োজনে মন্ত্রী বদল এবং পুলিশ ও র্যাবে ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে সন্ত্রাসরোধে সরকারের আগ্রহ ও ক্ষমতার পরিচয় দিন। আগে দলের দুর্নীতিবাজদের কঠোর হাতে শাস্তি দিন। বাম্পার ধান উৎপাদনের প্রচার চালিয়ে লাভ নেই। অন্যান্য দ্রব্যমূল্য না কমলে কৃষক যদি তার ফসল বেঁচে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য কিনতে না পারে, তাহলে এই কৃষি সাফল্য তাদের জন্য কোন লাভ বয়ে আনবে না। দেশের সব শিশুর হাতে বিনামূল্যে এবং সঠিক সময়ে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দিয়েছেন, এটা সরকারের একটা ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে অধিকাংশ প্রাইমারী স্কুলের মাথার ওপর খড়ের চালাও আছে কিনা তা আগে সরকারকে দেখতে হবে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়তে না দিয়ে সরকার ঝড়ে, বন্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাইমারী স্কুলগুলো মেরামত করুন। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করার ব্যবস্থা করুন। প্রাথমিক শিক্ষকদের ট্রেনিং, দক্ষতা বৃদ্ধি ও বেতন বৃদ্ধির ওপর জোর দিন। দেশে আইনের শাসনের দুর্বল ভিত্তি শক্ত করা হোক। চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের ক্ষমাভিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে যেন বিতর্কিত করে তোলা না হয়, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
তবে এসব কিছু করার আগে সরকারের নিজের ভিত্তি শক্ত করা দরকার। একটি যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা না থাকলে আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মসূচী যতই ভাল হোক, তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। সেনাপতি যতই দক্ষ হোন, আনাড়ি সেনাবাহিনী নিয়ে যেমন যুদ্ধ জয় করা যায় না, তেমনি প্রধানমন্ত্রী যতই অভিজ্ঞ ও দক্ষ হোন, আনাড়ি মন্ত্রী নিয়ে তিনি দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারবেন না। এটা শত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার যে পারছে না, তার প্রমাণ গত সাড়ে তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট পেয়েছেন। তবু তিনি কি কেবল জেদের বশেই মন্ত্রিসভা রদবদল করা থেকে বিরত রয়েছেন? হয়ত এই রদবদল তিনি এমন এক সময় করবেন, যখন সঙ্কটের নদী পাড়ি দেয়ার আর সময় থাকবে না।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘যুদ্ধ জয় করা সহজ, কিন্তু এই জয়ের সাফল্যকে ধরে রাখা কঠিন কাজ।’ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর-নির্বাচনে শেখ হাসিনা যখন বিশাল জয়ের অধিকারী হন, তখন এই কথাটাকেই শিরোনাম করে আমি একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম ঢাকার একটি দৈনিকে। লিখেছিলাম, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা রণাঙ্গনে জিতেছি, কিন্তু রাজনৈতিক জয় সম্পূর্ণ করতে পারিনি। মিলিটারি ভিক্টোরিকে আমরা পলিটিক্যাল ভিক্টোরিতে রূপান্তর করতে পারিনি। তারই পরিণতি ’৭৫-এর আগস্ট ও নবেম্বরের নিদারুণ ট্র্যাজেডি।
এই উদাহরণ টেনে ২০০৮ সালে নির্বাচনে শেখ হাসিনার ল্যান্ডসøøাইড ভিক্টোরি সম্পর্কে লিখেছিলাম, শত্রুরা ভোটের যুদ্ধে হেরেছে। রাজনৈতিক যুদ্ধে হারেনি। তাদের অস্ত্র বল, অর্থবল বেশি। পেছনে আছে মস্ক, মিলিটারি এবং ডলার ও পেট্রো ডলারের মদদ। এই সম্মিলিত এবং সহিংস শত্রুপক্ষের শক্তিকে অবজ্ঞা করা বিরাট ভুল হবে। সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে এক ফ্রন্টে নয়, এবার বহু ফ্রন্টে প্রচ- যুদ্ধ চালাতে হবে। তিনি যেন ভুল না করেন। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে যেন এমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যে মন্ত্রিসভা সব ব্যাপারে শুধু তাঁর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজেরা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং প্রবল শক্তিশালী শত্রুপক্ষের মোকাবেলায় রণকৌশল নির্ধারণ করতে পারেন।
মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, শেখ হাসিনা তাঁর ত্রিশ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দ্বারা কি ধরনের শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করেন তা দেখার জন্য। মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম যখন ঘোষিত হলো, তখন সেই তালিকার অধিকাংশ সদস্যের নাম দেখেও বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়নি। সামনের প্রচ- যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এমন সহকর্মী বেছে নিয়েছেন! দুঃখে, হতাশায় অভিভূত হয়ে এই ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘আশাভঙ্গ হয়নি, তবে আশাহত হয়েছি।’
তারপর সাড়ে তিনবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কামনা করেছি, আমার মনের আশাহত অবস্থা যেন সত্যি সত্যি আশাভঙ্গে পরিণত না হয়। আশাভঙ্গ হয়েছে বলব না। তবে আশাহত অবস্থা থেকে মুক্তি পাইনি। এ সরকারের সাফল্য অনেক। অধিকাংশই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। জাতীয় জীবনে তার সুফল অবশ্যই বর্তাবে। কিন্তু এই সাফল্যের অধিকাংশের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতায়। আর বেশিরভাগ মন্ত্রী এই সাফল্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসার কীর্তন গায়ক; সাফল্যের ভাগিদার নন। কথায় বলে ঢোলের বাদ্য থামলেই মিষ্টি। মন্ত্রিসভার এই কীর্তন গায়কদের কীর্তন বন্ধ হলেই মাত্র দেশবাসী এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বস্তি পাবেন।
এটা বলা বাহুল্য হবে না যে, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় শেখ হাসিনার মতো সাহসী রাজনৈতিক নেত্রী এখন নেই। যার জীবননাশের জন্য যত হামলা হয়েছে, বিশ্বের কোন অকমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক দেশের নেতার ওপর তত হামলা হয়নি। তাঁর জীবননাশ অবথা তাঁর সরকারের পতন ঘটানোর জন্য (অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ধ্বংস করার জন্য) দেশী- বিদেশী মদদপুষ্ট যত শক্তিশালী জোট তৈরি হয়েছে, তত শক্তিশালী জোট বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেও তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু মিত্র বাছাইয়ে ভুল করেননি। আমার ভয়, শেখ হাসিনা মিত্র বাছাইয়ে ভুল করেন এবং তাঁকে এবং গণতান্ত্রিক বাংলার অস্তিত্বকে ধ্বংস করার জন্য একটার পর একটা যে শক্তিশালী ফ্রন্ট তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে, তাদের শক্তির যথার্থ পরিমাপ করে তাদের মোকাবিলা করার মতো দক্ষ সরকার গঠনকে গোড়া থেকেই গুরুত্ব দেননি ছোট মুখে বড় কথা বলছি, তার উচিত এখনই মন্ত্রিসভায় শক্ত হাতে রদবদল করা। কসমেটিক সার্জারি নয়, পুরো সার্জারি করা। জনগণের মনে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যে, সরকার শক্তিশালী হয়েছে। সরকার শক্তিশালী হলে প্রশাসনও শক্তিশালী হতে বাধ্য এবং শক্তিশালী সরকার প্রায়োরিটির ভিত্তিতে জনজীবনের আশু সমস্যাগুলো সমাধানে সক্ষম হবে। জনগণের মনে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারলে বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা নয়, জনগণের প্রোটেস্ট ভোটের ফলেই আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
বিএনপি-জামায়াতের চাইতেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সুশীল চেহারাধারী যে দ্বিতীয় ফ্রন্টটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, তাদের কার্যকলাপকে আমি বেশি ভয় করি। ২০০১ সালেও এদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা গেছে, তখন এই সুশীল জোটের কম্বিনেশন ছিল, একটি সুশীল সমাজ নামধারী এলিট চক্র, তাদের ইংরেজী, বাংলা দুটি মুখপাত্র, জনগণের কাছে তখনও শ্রদ্ধার আসনে উপবিষ্ট কিছু রাজনৈতিক নেতা বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং তাদের দ্বারা বেষ্টিত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। এই জোটের পেছনে নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছেন কয়েকটি শক্তিশালী এনজিও এবং পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক। এই ফ্রন্টের অঘোষিত মুখপাত্র হিসাবে ড. কামাল হোসেন, প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ প্রমুখকে দেখা গেছে। ড. ইউনূস একটু নেপথ্য ভূমিকায় ছিলেন।
এক এগারোর সময়ও এই ফ্রন্ট তৎপর হয়েছিল। সবচাইতে বেশি এগিয়েছিলেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাঁর গলায় নোবেল পুরস্কারের মাদুলি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু শেখ হাসিনার তখনকার প্রবল জনপ্রিয়তার জোয়ারে তাঁরা সুবিধা করতে পারেননি। এবার (২০১৪ সালের সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনের আগে) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের অনেকটা অনুকূল। হাসিনা সরকারের নানা ব্যর্থতা, বিশেষ করে শেয়ার বাজারের ধস প্রতিরোধের ব্যাপারে, ইলিয়াস অপহরণ, সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ব্যাপারে রহস্য উদ্ঘাটনে অক্ষমতা, সড়ক দুর্ঘটনা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি হ্রাস করার ব্যাপারে কোন সাফল্য দেখতে না পারা এই সরকারের অন্য সাফল্যগুলো ঢেকে দিয়েছে এবং পশ্চিমা মদদপুষ্ট এলিট ক্লাসের দ্বারা তৈরি হাসিনা-বিরোধী দ্বিতীয় ফ্রন্ট আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে মাথা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
এই দ্বিতীয় ফ্রন্টের আসল উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে আরেকদিন সবিস্তারে আলোচনা করব। আজ শুধু এটুকু বলতে চাই, এরা এখন দলে আরও ভারি হয়েছেন। আগে এক নোবেল লরিয়েট এই ফ্রন্টে ছিলেন, এখন এক ‘নাইটহুড’ বিদেশী মুরুব্বিদের নির্দেশেই এই ফ্রন্টে এসে যুক্ত হয়েছেন। বাজারে গুজব, নোবেল লরিয়েটের অনুরোধেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাইটহুডকেও তাঁর কাছে ডেকে নিয়েছিলেন, কেবল একা নোবেল লরিয়েটকে ডাকলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে নোবেল লরিয়েট ধরা পড়ে যাবেন। তার উদ্দেশ্যটিও মানুষ সহজেই বুঝবে। ফলে নাইটহুডকে সঙ্গী করা, তাঁর ভাবখানা, ‘দত্ত কারও ভৃত্য নয়, সঙ্গে এসেছি ধরনের।’
বিএনপি ও জামায়াতের সরকারবিরোধী তৎপরতা প্রকাশ্য, কিন্তু এই দ্বিতীয় ফ্রন্টের তৎপরতা অপ্রকাশ্য এবং এলিটসুলভ নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ঢাকা। হাসিনা- সরকারকে এই ফ্রন্টটির তৎপরতা সম্পর্কেই বেশি সতর্ক হতে হবে। এই ফ্রন্টের ইংরেজী, বাংলা দু’টি মুখপত্রই ধীরে ধীরে ভোল পাল্টাতে শুরু করেছে। ‘বদলে দাও, বদলে যাও’ শীর্ষক মুখরোচক সেøাগানের আড়ালে এরা ফলা বিস্তার করছে। এরা সরাসরি শত্রুতা করেন। বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে পটু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফিফ্থ কলাম বা পঞ্চম বাহিনী নামে একটা কথা তৈরি হয়েছিল, এই পঞ্চম বাহিনী ছিল মিত্র বেশি আরও ভয়ঙ্কর শত্রু।
বাংলাদেশের এই ফিফ্্থ কলামিস্ট বা পঞ্চম বাহিনীর কার্যকলাপ বোধে সরকার সময়মতো সতর্ক না হলে ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
কথায় বলে, ‘বকাউল্লা বকতে পারে, শোনা উল্লা না শুনলে করার কী থাকে?’ আমরাও আওয়ামী লীগকে কেবল বলতে পারি, সতর্ক করতে পারি। তারা শুনবে কিনা, সতর্ক হবে কিনা সেটা তাদের ব্যাপার। তবে দেশ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা দ্রুত বাড়ছে। আত্মসন্তোষ ও আত্মপ্রসাদের সর্বনাশা কুহক থেকে প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে বেরিয়ে আসা দরকার। যুদ্ধের মাঠে দ্বিতীয় ফ্রন্টের শত্রুরাও এখন তার বিরুদ্ধে তৎপর।
লন্ডন, ২৯ মে, মঙ্গলবার, ২০১২ ॥
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বর্তমান সরকারের নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে মাঝে মাঝে কঠোর সমালোচনাও করি, কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করি যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনা এখনও ‘শিবরাত্রির সলতে।’ এই সলতেটি নিভে গেলে সামনে আবার দীর্ঘ অন্ধকার। আমাদের অনেক প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী এখন এন্তার ভাল ভাল কথা বলছেন বটে, কিন্তু দেশের ও গণতন্ত্রের বিপদ মুহূর্তে কেউ অক্সফোর্ডে, কেউ হার্ভার্ডে ছোটেন নানারকম অধ্যয়ন ও গবেষণার অজুহাতে। দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য কেউ থাকেন না। সাধারণ মানুষের রক্তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলেই তারা আবার গণতন্ত্র সম্পর্কে দেশের মানুষকে ‘ছবক’ দেয়ার জন্য দেশে এসে উপস্থিত হন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এখন এক দারুণ ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। এই রাজনীতির প্রকাশ্য শত্রুর চাইতে মিত্রবেশী শত্রুর সংখ্যা বেশি। দেশের ভেতরে এবং বাইরেও। আমরা যারা হাসিনা সরকারের ভুলভ্রান্তিগুলোর কঠোর সমালোচনা করি। তা এই সরকারের পতন কামনা থেকে করি না। করি এ জন্য যে, নিজেদের ভুলভ্রান্তির জন্য যদি এই সরকার আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে ‘মহাবীর’ তারেক এবং তার জামায়াতী আত্মীয়দের (তারেকের নিজ বর্ণনামতে) যদি আবার ক্ষমতায় বসার সুযোগ ঘটে, তাহলে বর্তমানের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে বাংলাদেশের তুলনায় মনে হবে স্বর্গোদ্যান।
শেখ হাসিনাকে তাই জোর হাতে বলি, জেদ নয়, ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিন। রাজা ক্যানিউটের মতো চাটুকার সভাসদদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। বোকা মিত্রের চাইতে বুদ্ধিমান শত্রুকে গুরুত্ব দিন। মন্ত্রিসভায় যেসব বেকুব সদস্য আছে, তাঁদের কম কথা বলতে বলুন, অথবা অপসারণ করুন। সমুদ্রজয়ের চাইতে দেশের মানুষের মন জয়ের ওপর গুরুত্ব দিন। ছাত্রলীগ, যুব লীগের দ্বারা ঘনঘন সংবর্ধনা নেয়া বন্ধ করুন। অন্য সব কিছুর আগে বিদ্যুত, পানি, গ্যাসের সঙ্কট হ্রাস, সড়ক দুর্ঘটনায় নিত্য প্রাণ বলির সংখ্যা কমানোকে প্রায়োরিটি দিন।
আরও বলি, দেশে গুম, হত্যা, ধর্ষণসহ সন্ত্রাস বেড়েছে এই সত্যকে স্বীকৃতি দিন। প্রয়োজনে মন্ত্রী বদল এবং পুলিশ ও র্যাবে ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে সন্ত্রাসরোধে সরকারের আগ্রহ ও ক্ষমতার পরিচয় দিন। আগে দলের দুর্নীতিবাজদের কঠোর হাতে শাস্তি দিন। বাম্পার ধান উৎপাদনের প্রচার চালিয়ে লাভ নেই। অন্যান্য দ্রব্যমূল্য না কমলে কৃষক যদি তার ফসল বেঁচে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য কিনতে না পারে, তাহলে এই কৃষি সাফল্য তাদের জন্য কোন লাভ বয়ে আনবে না। দেশের সব শিশুর হাতে বিনামূল্যে এবং সঠিক সময়ে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দিয়েছেন, এটা সরকারের একটা ঐতিহাসিক সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে অধিকাংশ প্রাইমারী স্কুলের মাথার ওপর খড়ের চালাও আছে কিনা তা আগে সরকারকে দেখতে হবে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়তে না দিয়ে সরকার ঝড়ে, বন্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাইমারী স্কুলগুলো মেরামত করুন। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নত করার ব্যবস্থা করুন। প্রাথমিক শিক্ষকদের ট্রেনিং, দক্ষতা বৃদ্ধি ও বেতন বৃদ্ধির ওপর জোর দিন। দেশে আইনের শাসনের দুর্বল ভিত্তি শক্ত করা হোক। চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের ক্ষমাভিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে যেন বিতর্কিত করে তোলা না হয়, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
তবে এসব কিছু করার আগে সরকারের নিজের ভিত্তি শক্ত করা দরকার। একটি যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন মন্ত্রিসভা না থাকলে আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মসূচী যতই ভাল হোক, তা বাস্তবায়ন করা যাবে না। সেনাপতি যতই দক্ষ হোন, আনাড়ি সেনাবাহিনী নিয়ে যেমন যুদ্ধ জয় করা যায় না, তেমনি প্রধানমন্ত্রী যতই অভিজ্ঞ ও দক্ষ হোন, আনাড়ি মন্ত্রী নিয়ে তিনি দেশকে সুশাসন উপহার দিতে পারবেন না। এটা শত আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সরকার যে পারছে না, তার প্রমাণ গত সাড়ে তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট পেয়েছেন। তবু তিনি কি কেবল জেদের বশেই মন্ত্রিসভা রদবদল করা থেকে বিরত রয়েছেন? হয়ত এই রদবদল তিনি এমন এক সময় করবেন, যখন সঙ্কটের নদী পাড়ি দেয়ার আর সময় থাকবে না।
বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘যুদ্ধ জয় করা সহজ, কিন্তু এই জয়ের সাফল্যকে ধরে রাখা কঠিন কাজ।’ ২০০৮ সালের ডিসেম্বর-নির্বাচনে শেখ হাসিনা যখন বিশাল জয়ের অধিকারী হন, তখন এই কথাটাকেই শিরোনাম করে আমি একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম ঢাকার একটি দৈনিকে। লিখেছিলাম, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা রণাঙ্গনে জিতেছি, কিন্তু রাজনৈতিক জয় সম্পূর্ণ করতে পারিনি। মিলিটারি ভিক্টোরিকে আমরা পলিটিক্যাল ভিক্টোরিতে রূপান্তর করতে পারিনি। তারই পরিণতি ’৭৫-এর আগস্ট ও নবেম্বরের নিদারুণ ট্র্যাজেডি।
এই উদাহরণ টেনে ২০০৮ সালে নির্বাচনে শেখ হাসিনার ল্যান্ডসøøাইড ভিক্টোরি সম্পর্কে লিখেছিলাম, শত্রুরা ভোটের যুদ্ধে হেরেছে। রাজনৈতিক যুদ্ধে হারেনি। তাদের অস্ত্র বল, অর্থবল বেশি। পেছনে আছে মস্ক, মিলিটারি এবং ডলার ও পেট্রো ডলারের মদদ। এই সম্মিলিত এবং সহিংস শত্রুপক্ষের শক্তিকে অবজ্ঞা করা বিরাট ভুল হবে। সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনাকে এক ফ্রন্টে নয়, এবার বহু ফ্রন্টে প্রচ- যুদ্ধ চালাতে হবে। তিনি যেন ভুল না করেন। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে যেন এমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যে মন্ত্রিসভা সব ব্যাপারে শুধু তাঁর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজেরা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং প্রবল শক্তিশালী শত্রুপক্ষের মোকাবেলায় রণকৌশল নির্ধারণ করতে পারেন।
মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, শেখ হাসিনা তাঁর ত্রিশ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দ্বারা কি ধরনের শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করেন তা দেখার জন্য। মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম যখন ঘোষিত হলো, তখন সেই তালিকার অধিকাংশ সদস্যের নাম দেখেও বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয়নি। সামনের প্রচ- যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এমন সহকর্মী বেছে নিয়েছেন! দুঃখে, হতাশায় অভিভূত হয়ে এই ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘আশাভঙ্গ হয়নি, তবে আশাহত হয়েছি।’
তারপর সাড়ে তিনবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কামনা করেছি, আমার মনের আশাহত অবস্থা যেন সত্যি সত্যি আশাভঙ্গে পরিণত না হয়। আশাভঙ্গ হয়েছে বলব না। তবে আশাহত অবস্থা থেকে মুক্তি পাইনি। এ সরকারের সাফল্য অনেক। অধিকাংশই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। জাতীয় জীবনে তার সুফল অবশ্যই বর্তাবে। কিন্তু এই সাফল্যের অধিকাংশের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতায়। আর বেশিরভাগ মন্ত্রী এই সাফল্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসার কীর্তন গায়ক; সাফল্যের ভাগিদার নন। কথায় বলে ঢোলের বাদ্য থামলেই মিষ্টি। মন্ত্রিসভার এই কীর্তন গায়কদের কীর্তন বন্ধ হলেই মাত্র দেশবাসী এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেও স্বস্তি পাবেন।
এটা বলা বাহুল্য হবে না যে, সারা দক্ষিণ এশিয়ায় শেখ হাসিনার মতো সাহসী রাজনৈতিক নেত্রী এখন নেই। যার জীবননাশের জন্য যত হামলা হয়েছে, বিশ্বের কোন অকমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক দেশের নেতার ওপর তত হামলা হয়নি। তাঁর জীবননাশ অবথা তাঁর সরকারের পতন ঘটানোর জন্য (অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ধ্বংস করার জন্য) দেশী- বিদেশী মদদপুষ্ট যত শক্তিশালী জোট তৈরি হয়েছে, তত শক্তিশালী জোট বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেও তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধু মিত্র বাছাইয়ে ভুল করেননি। আমার ভয়, শেখ হাসিনা মিত্র বাছাইয়ে ভুল করেন এবং তাঁকে এবং গণতান্ত্রিক বাংলার অস্তিত্বকে ধ্বংস করার জন্য একটার পর একটা যে শক্তিশালী ফ্রন্ট তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে, তাদের শক্তির যথার্থ পরিমাপ করে তাদের মোকাবিলা করার মতো দক্ষ সরকার গঠনকে গোড়া থেকেই গুরুত্ব দেননি ছোট মুখে বড় কথা বলছি, তার উচিত এখনই মন্ত্রিসভায় শক্ত হাতে রদবদল করা। কসমেটিক সার্জারি নয়, পুরো সার্জারি করা। জনগণের মনে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যে, সরকার শক্তিশালী হয়েছে। সরকার শক্তিশালী হলে প্রশাসনও শক্তিশালী হতে বাধ্য এবং শক্তিশালী সরকার প্রায়োরিটির ভিত্তিতে জনজীবনের আশু সমস্যাগুলো সমাধানে সক্ষম হবে। জনগণের মনে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে না পারলে বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা নয়, জনগণের প্রোটেস্ট ভোটের ফলেই আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
বিএনপি-জামায়াতের চাইতেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সুশীল চেহারাধারী যে দ্বিতীয় ফ্রন্টটি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, তাদের কার্যকলাপকে আমি বেশি ভয় করি। ২০০১ সালেও এদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করা গেছে, তখন এই সুশীল জোটের কম্বিনেশন ছিল, একটি সুশীল সমাজ নামধারী এলিট চক্র, তাদের ইংরেজী, বাংলা দুটি মুখপাত্র, জনগণের কাছে তখনও শ্রদ্ধার আসনে উপবিষ্ট কিছু রাজনৈতিক নেতা বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং তাদের দ্বারা বেষ্টিত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন। এই জোটের পেছনে নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছেন কয়েকটি শক্তিশালী এনজিও এবং পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক। এই ফ্রন্টের অঘোষিত মুখপাত্র হিসাবে ড. কামাল হোসেন, প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ প্রমুখকে দেখা গেছে। ড. ইউনূস একটু নেপথ্য ভূমিকায় ছিলেন।
এক এগারোর সময়ও এই ফ্রন্ট তৎপর হয়েছিল। সবচাইতে বেশি এগিয়েছিলেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাঁকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাঁর গলায় নোবেল পুরস্কারের মাদুলি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু শেখ হাসিনার তখনকার প্রবল জনপ্রিয়তার জোয়ারে তাঁরা সুবিধা করতে পারেননি। এবার (২০১৪ সালের সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনের আগে) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের অনেকটা অনুকূল। হাসিনা সরকারের নানা ব্যর্থতা, বিশেষ করে শেয়ার বাজারের ধস প্রতিরোধের ব্যাপারে, ইলিয়াস অপহরণ, সাগর-রুনি হত্যাকা-ের ব্যাপারে রহস্য উদ্ঘাটনে অক্ষমতা, সড়ক দুর্ঘটনা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি হ্রাস করার ব্যাপারে কোন সাফল্য দেখতে না পারা এই সরকারের অন্য সাফল্যগুলো ঢেকে দিয়েছে এবং পশ্চিমা মদদপুষ্ট এলিট ক্লাসের দ্বারা তৈরি হাসিনা-বিরোধী দ্বিতীয় ফ্রন্ট আরও বেশি শক্তি সঞ্চয় করে মাথা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
এই দ্বিতীয় ফ্রন্টের আসল উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে আরেকদিন সবিস্তারে আলোচনা করব। আজ শুধু এটুকু বলতে চাই, এরা এখন দলে আরও ভারি হয়েছেন। আগে এক নোবেল লরিয়েট এই ফ্রন্টে ছিলেন, এখন এক ‘নাইটহুড’ বিদেশী মুরুব্বিদের নির্দেশেই এই ফ্রন্টে এসে যুক্ত হয়েছেন। বাজারে গুজব, নোবেল লরিয়েটের অনুরোধেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাইটহুডকেও তাঁর কাছে ডেকে নিয়েছিলেন, কেবল একা নোবেল লরিয়েটকে ডাকলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে নোবেল লরিয়েট ধরা পড়ে যাবেন। তার উদ্দেশ্যটিও মানুষ সহজেই বুঝবে। ফলে নাইটহুডকে সঙ্গী করা, তাঁর ভাবখানা, ‘দত্ত কারও ভৃত্য নয়, সঙ্গে এসেছি ধরনের।’
বিএনপি ও জামায়াতের সরকারবিরোধী তৎপরতা প্রকাশ্য, কিন্তু এই দ্বিতীয় ফ্রন্টের তৎপরতা অপ্রকাশ্য এবং এলিটসুলভ নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ঢাকা। হাসিনা- সরকারকে এই ফ্রন্টটির তৎপরতা সম্পর্কেই বেশি সতর্ক হতে হবে। এই ফ্রন্টের ইংরেজী, বাংলা দু’টি মুখপত্রই ধীরে ধীরে ভোল পাল্টাতে শুরু করেছে। ‘বদলে দাও, বদলে যাও’ শীর্ষক মুখরোচক সেøাগানের আড়ালে এরা ফলা বিস্তার করছে। এরা সরাসরি শত্রুতা করেন। বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে পটু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফিফ্থ কলাম বা পঞ্চম বাহিনী নামে একটা কথা তৈরি হয়েছিল, এই পঞ্চম বাহিনী ছিল মিত্র বেশি আরও ভয়ঙ্কর শত্রু।
বাংলাদেশের এই ফিফ্্থ কলামিস্ট বা পঞ্চম বাহিনীর কার্যকলাপ বোধে সরকার সময়মতো সতর্ক না হলে ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
কথায় বলে, ‘বকাউল্লা বকতে পারে, শোনা উল্লা না শুনলে করার কী থাকে?’ আমরাও আওয়ামী লীগকে কেবল বলতে পারি, সতর্ক করতে পারি। তারা শুনবে কিনা, সতর্ক হবে কিনা সেটা তাদের ব্যাপার। তবে দেশ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা দ্রুত বাড়ছে। আত্মসন্তোষ ও আত্মপ্রসাদের সর্বনাশা কুহক থেকে প্রধানমন্ত্রীর অবিলম্বে বেরিয়ে আসা দরকার। যুদ্ধের মাঠে দ্বিতীয় ফ্রন্টের শত্রুরাও এখন তার বিরুদ্ধে তৎপর।
লন্ডন, ২৯ মে, মঙ্গলবার, ২০১২ ॥
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন