ড. আবু আহমদ তাওসিফ :
গত ২৫ ও ২৭ মে'-১২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় সাদাসিধে কথা : রাজনীতি নিয়ে আমার ভাবনা, বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে...শিরোনামে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেবের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখার শুরুতে জনাব জাফর ইকবাল সাহেব আকর্ষণ সৃষ্টির প্রণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ‘‘আমার এই লেখাটি কারোরই খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, কারণ যে বিষয় নিয়ে লিখছি আমি তার বিশেষজ্ঞ নই। প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে আমি লিখছি কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরও আমি একটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি: সবকিছুই কি বিশেষজ্ঞদের চোখে দেখতে হয়? একটা বিষয় সাধারণ মানুষ কেমন করে দেখে, সেটাও কি অন্যদের জানার কৌতূহল হওয়া উচিত না?’’ জাফর ইকবাল সাহেব সাধারণ মানুষ কেমন করে দেখে তিনিও সেভাবে দেখতে চেয়েছেন কথাটি ঠিক নয় বরং তিনি একজন রাজনীতিবিদের মতই বলতে চেয়েছেন বিশ্লেষণ করেছেন কূটনৈতিক কায়দায়। তার লেখায় সাধারণ মানুষের ভাবনা ফুটে উঠেনি। জনাব ইকবাল সাহেব নিঃসন্দেহে জানেন সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা কি। একটু থাকার জায়গা, একমুঠো খাবার, শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার আর জীবনের নিরাপত্তা। এর বেশি কিছু আমার দেশের বৃহত্তর গরিব জনগোষ্ঠী কামনা করে না। জনাব জাফর ইকবাল সাহেব বলবেন কি বর্তমান মহাজোট সরকার এর কোনটিতে সফল হয়েছে? অবশ্য এর উত্তর আপনাদের নিকট পাওয়া যাবে না। এদেশের জনগণ জনাব জাফর ইকবাল সাহেবদের পরিচয় আদর্শ ভাবনা সবই জানে। ডিজিটাল সরকারের আকর্ষণীয় স্লোগানের রচয়িতা আজ মনে হয় খুব শান্তিতে নেই। মহাজোট সরকারের ব্যর্থতার মহাপ্রলয়ে মনে হয় দারুণ উদ্বিগ্ন! জনাব জাফর ইকবাল সাহেবদের নিকট আমাদের নতুন প্রজন্মেরও অনুরোধ থাকবে নিরপেক্ষতার ভেক দিয়ে জনগণকে আর নতুন প্রজন্মকে আর বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না। এদেশের জনগণ আপনাদের সবাইকে খুব ভালোভাবেই চেনে। আপনি সাদাসিধে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে...তাহলে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে! আসলে জাফর ইকবাল সাহেব বলতে চেয়েছেন, বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে তাহলে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এই সরল কথাটি অন্যভাবে কঠিনভাবে বুঝাতে চেয়েছেন। দেশের মানুষকে এত বোকা মনে করাই সবচেয়ে বড় বোকামি জনাব ইকবাল সাহেব। আজ আপনি অনেকটাই বিএনপির উপদেষ্টা সেজেছেন! আচ্ছা আমাদের এই বুদ্ধিজীবীদের এই জ্ঞানটুকু কি নেই যে বেগম খালেদ জিয়া যিনি বাংলাদেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী, সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন তাকে নিজ দল সংরক্ষণের জ্ঞান দেয়া অনেকটাই মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’’ এই প্রবাদের মতই নয় কি? আর বেগম খালেদা জিয়ার স্মরণশক্তিও এত লোপ পায়নি আপনাদের সব কর্মকান্ড তিনি ভুলে গেছেন। চারদলীয় জোটের সময় জাফর ইকবাল গংদের দেশকে অকৃতকার্য রাষ্ট্র প্রমাণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেশবাসী ভুলে যায়নি।
এরপর তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেশের এত রকম সমস্যা তার সবকিছু ম্যানেজ করে কোনো সরকার পাঁচ বছর টিকে থাকতে পারলেই আমি তাকে পাস মার্ক দিয়ে দিই।’’ জাফর ইকবাল সাহেব শুধুমাত্র কোন সরকারের টিকে থাকতে পারলেই তাকে পাস মার্ক দিয়ে দিচ্ছেন। গণতন্ত্র কি শুধুমাত্র শক্তি দিয়ে টিকে থাকা? তাহলে স্বৈরাচারী এরশাদ তো জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দশ বছর টিকে ছিলো, তাহলে এরজন্য এরশাদ কে জনাব ইকবাল সাহেব কি ডাবল এ প্লাস দিবেন। কিন্তু আমার মনে হয় এ প্লাস আর গোল্ডেন এ ঠিক করতে হবে এদেশের আপামর আমজনতার দৃষ্টিতে। কারণ গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের সরকার। আমরা যারা বড় বড় কথা বলছি, সরকারকে এ প্লাস আর গোল্ডেন এ মার্ক দিচ্ছি তারা কতদিন উপবাস ছিলাম? কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় নিজের সন্তান বিক্রির জন্য যে মা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। যে মানুষটি নিজের শরীরের রক্ত বিক্রি করে সন্তানের পড়ালেখার টাকা যোগান দেয়। যে মায়ের সন্তান গুম কিংবা খুন হওয়ায় রাত জেগে জেগে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে আহাজারি করে। তাদের অবস্থা বিবেচনায় এনে সরকারকে প্লাস মাইনাস মার্ক দিতে হবে। জনাব ইকবাল সাহেবরা তাদের কথা একবারও ভেবেছেন কি? মনে রাখবেন দেশ পরিচালনা পদার্থ বিজ্ঞান আর গণিতের সূত্রের মত নয়। মানুষের জীবন Theoretical কোন বিষয় নয়, এটি Practical বিষয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই নিজেদের সর্বজান্তা মনে করেন অন্যদের ভাবেন অজ্ঞ আর সবাইকে ভাবেন ছাত্রতুল্য। জনাব ইকবাল সাহেবও দেখছি এই ব্যাধিতে দারুণ আক্রান্ত।
তিনি লিখেছেন ‘‘তবে আমার দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে আমি এই সরকারকে শুধু এ প্লাস নয় গোল্ডেন এ প্লাস দিয়ে দেব যদি তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা ঠিকঠিকভাবে করতে পারে। ’’ জনাব জাফর ইকবাল সাহেব আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অযাচিত উত্তেজনা আর অতিউৎসাহী হয়ে বাহবাহ কুড়ানোর হীন প্রয়াসে সরকারকে শুধু এ প্লাস নয় গোল্ডেন এ দেয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন। তাহলে আপনি কি বলবেন শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারেনি বিধায় তিনি ফেল করেছেন? অথবা আপনার মত শিক্ষকের দৃষ্টিতে তিনি শূন্য পেয়েছেন?
না! শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চাননি এটি বললে হয়ত তার উপর অবিচার করা হবে। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এ কথা সত্য, কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। এর কারণ সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাংলাদেশ: এ লিগ্যাসি অব ব্লাড বইতে এইভাবেই তা বর্ণনা করেন-‘‘আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাস, দলের হিংসাত্মক কর্মকান্ড, হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদিতে চতুর্দিক থমথমে হয়ে উঠলো তাছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই ব্যর্থ হলেন। দলের অভ্যন্তরীণ ও নিজ আত্মীয়স্বজনের বেপরোয়া ভাব ছিল সবচেয়ে আলোচনা ও সমালোচনার ব্যাপার। তাছাড়া সদ্যোজাত বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি ও অবকাঠামো এবং ক্রমাবনতিশীল আইনশৃক্মখলার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তেলের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করেছিলো তারই ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিকে এক বিপর্যয়কর আবর্তে টেনে নেয়। এর সঙ্গে ভয়াবহ খরা এবং অভূতপূর্ব বন্যায় ফসল নষ্ট ও ফসল ডুবে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশে খাদ্যসমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে’’। গোটা পরিস্থিতিতে বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর মতই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে গোটা সংগঠন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে মাওলানা ভাসানীসহ জাতীয় সকল নেতা প্রবল বিরোধিতা করেন। শেষ অবদি শেখ মুজিবুর রহমান এই বিচারের কাজ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। বলা যায় তিনি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ও সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে বাবার সমাধানকৃত যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি জাগিয়ে তুলে মূলত বাবার সাথে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন কি? আর ইন্ধনদাতা জাফর ইকবাল আর শাহরিয়ার কবিরদের মত কিছু অতি উৎসাহী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নামক পরজীবীরা। এখন দেখার ব্যাপার এই প্রতিযোগিতার ফলাফল কি দাঁড়ায়। সম্ভবত শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিযোগিতায় তার বাবাকে অতিক্রম করতে পারবে না। এই বইতে বলা হয়েছে ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের অভিনয় বিশেষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সরকার শেষ পর্যন্ত এ অভিযানের সমাপ্তি টানলেন। কিন্তু ততক্ষণে দেশের অভ্যন্তরে বিশৃক্মখলা চরমে পৌঁছে গেছে, দেশ নিমজ্জিত হয়েছে গভীর সংকটে’’।
জনাব জাফর ইকবাল সাহেব আপনাদের মত সুযোগসন্ধানী বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন- ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু কোনো নতুন ইস্যু নয়। বাস্তবত ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরই এ বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও তৎকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করলেও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি। শুধু তাই নয়, এর তালিকা প্রক্রিয়া শুরু করে তারা তালিকাভুক্ত ১৯৫ পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের বিচার না করে তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছিল। যদিও তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল যে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। সে বিচার হয়নি, তারপরও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের আটক করা হয়েছিল তাদেরও ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে। এ কাজ শেখ মুজিব তাদের মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে করেননি। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমা ঘোষণা ছিল রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারভুক্ত, তবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তিনি এ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন নিজে এই কাজের কৃতিত্ব গ্রহণের জন্য। এক্ষেত্রে সব থেকে ‘চমৎকৃত' হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কর্তৃক ১৯৭১ সালের সব থেকে বড় ও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে শুধু মাফ করে দেয়া নয়, ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে ইসলামী সম্মেলনের সময় তাকে পরম বন্ধু হিসেবে আলিঙ্গন করে তার গালে চুমু খাওয়া এবং পরে তাকে মহাসম্মানিত রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাজসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা। এরপর বাস্তবত আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো নৈতিক অথবা আইনগত ভিত্তি থাকেনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তারা জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নিলেও এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে তারা এ উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সততার জন্য বিখ্যাত নন। কাজেই সুযোগ বুঝে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে অনেক গালভরা কথা বললেও আওয়ামী লীগ সরকারের এই নেতিবাচক কার্যকলাপের বিরোধিতা না করে নিজেরাও এর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক ফালতু কথাই তাদের বলতে হচ্ছে। (সূত্র, কালের কণ্ঠ, ০১/০৭/২০১০)
জনাব জাফর ইকবাল সাহেব আপনি জানেন না কেন ১৯৭২ সালে ২রা জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লীতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ত্রিপক্ষীয় সিমলায় চুক্তি অনুষ্ঠিত হয়। এতে এতদিন ধরে মোকাবিলা ও সংঘর্ষের কারণে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বিঘ্নিত হচ্ছিল, সেজন্য তাঁরা সম্পর্ক গড়ে তোলা ও উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার সঙ্কল্পের কথা চুক্তিতে বলা হয়। ১৯৭২ সালে দালাল আইন জারির পর হতে ১৯৭৩ সনের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ ৩৭,৪৭১ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এতসব আইনগত বিধান, ছাড়া ও ক্ষমতা দেয়া সত্ত্বেও এদের মধ্যে ১৯৭৩ সনের অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাত্র ২৮৪৮টি মামলার নিত্তি হয়। তার মধ্যে মাত্র ৭৫২ ব্যক্তি দন্ডিত হয়। অবশিষ্ট ২০৯৬ ব্যক্তি খালাস পান। অর্থাৎ অভিযোগকৃত ও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের তিন- চতুর্থাংশই অভিযোগ হতে অব্যাহতি পান। যদিও সরকার আইনগত ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, তবুও ২২ মাসে ২৮৪৮টি মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হলে মাসে ১৩০টি এবং দিনে ৩/৪টির বেশি বিচার নিত্তি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জনাব ইকবাল সাহেব বলছেন, আজ যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। বলুনতো তৎকালীন সময়ে শেখ মুজিব যে বিচারের আয়োজন করেছিলো সেখানে আজকের গ্রেফতারকৃতদের কেউ ছিলো কি? ইতিহাস কিছু সময় জোর করে বিকৃত করা যায়, কিন্তু ইতিহাস পাল্টানো যায় না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ দালাল আইনে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করে বলেন- দলমত নির্বিশেষে সকলেই যাতে আমাদের মহান জাতীয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ গড়ার শপথ নিতে পারে সরকার সেজন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ দালাল আদেশে আটক ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যাতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর অনতিবিলম্বে জেল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন এবং আসন্ন ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের উৎসবে যোগদান করতে পারেন বঙ্গবন্ধু সেজন্য তাদের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সাধারণ ক্ষমায় যারা মুক্তি পাবেন তাদের বিজয় দিবসের উৎসবে একাত্ম হতে এবং দেশ গঠনের পবিত্র দায়িত্ব ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার শপথ গ্রহণের আহবান জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তিনি এ উদ্যোগের পেছনে দেশ গঠনের পবিত্র দায়িত্ব পালন ও জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, বহু রক্ত, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর চোখের পানির বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। যে কোনো মূল্যে এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এবারের বিজয় দিবস বাঙালির ঘরে ঘরে সুখ, শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে। (সূত্র: বাংলাদেশের রাজনীতিতে আ. সমাজের ভূমিকা পৃ.২৪৮)
জনাব জাফর ইকবাল সাহেব কিসের লোভে আপনি ভুলে গেলেন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, জাতি গড়ার কারিগর, জাতির বিবেক। অবশ্য কেউ কেউ প্রথম আলোর অনলাইনে আর অন্যান্য ব্লগে আপনার এই একমুখী লেখার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অথবা সরকার থেকে অন্য কিছু পাওয়ার খায়েশ হিসেবে দেখছেন! আবার অনেকে আপনার একপেশে রাজনৈতিক নেতার মত লেখাতে বিস্ময়প্রকাশ করেছেন! ইকবাল সাহেব নিশ্চয় আপনার লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্য পড়ে ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন এই লেখা আপনার ইমেজকে কোনপর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে।
জনাব জাফর ইকবাল সাহেব বল্গাহীনভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইতে গিয়ে ইতিহাসকে প্রচন্ডভাবে পাশ কাটিয়ে অসত্য আর আবেগের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি এই কথা খুব ভালো জানেন আবেগ আর জিঘাংসা দিয়ে বিচার করা যায় না। তবুও এই দেশকে আবার বিভক্তির দিকে নেয়ার জন্য সেই কাজটি কেন করছেন বলবেন কি? কেন জাতির ঐক্যে ও গলায় ছুরি দিয়ে আপনারা অন্য দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন?
জনাব জাফর ইকবাল সাহেব লিখেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন করে?’’ অর্থাৎ জাফর ইকবাল সাহেব ঘুরিয়ে না বলে সাদাসিধেভাবেই বলুন- শিবিরের বিরুদ্ধে জাফর ইকবালের প্রথম অভিযোগ, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন এই দেশে তারা শহীদমিনারে ফুল দিতে যায় না, রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় না, কারো ভাষণ শুনে রক্ত গরম করে না’’ জাফর ইকবালের দৃষ্টিতে এসব শুধু অপরাধ, স্বাধীন দেশে দুঃসাহসও বটে! এত দুঃসাহস তাদের হয় কি করে? মহামান্য (?!) সুশীল জাফর ইকবাল আরো কিছু দুঃসাহসের কথা কিন্তু আপনি বলেননি! শিবির শহীদমিনারে ফুল দিতে যেমন যায় না তেমন মেয়েদের ওড়না-শাড়ী ধরে টান মারে না, ইভটিজিং করে না, এসিড মারে না, ধর্ষণ করে না, শিক্ষক ও ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করে না, ছাত্রীদের সাথে অশ্লীলভাবে নাচানাচি করে না- এসবও জাফর ইকবাল সাহেবদের নিকট নিশ্চয় অপরাধ! পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্র সংগীত যেমন গায়না তেমনি ফেনসিডিল মদ পান করে না, হেরোইন, ইয়াবা খায় না, দেহ ব্যবসা করে না, ছাত্রীদের জোর করে নেতাদের কাছে পাঠায় না- এসব অপরাধের কথাও বলা উচিত ছিল! কারো ভাষণ শুনে রক্ত যেমন গরম করে না, তেমনি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইও করে না- এসবের কথা বলবেন না! আপনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি এসব করতে বলে? এসব যারা করে তাদেরকেই আপনার পছন্দ? এসব করে না বলেই শিবিরকে অপছন্দ? কথাটি এত ঘুরিয়ে বলার দরকার কি? সাদাসিধেভাবে বলে দিলেই হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিবির আজ মেধাবী ছাত্রদের সাহসী ঠিকানা, আশার আলো, প্রেরণার বাতিঘর। এদেশ মাতৃকা ও মানুষের পরম বন্ধু। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বেও অতন্ত্র প্রহরীর ভূমিকায় রত। এই জন্যই ইকবাল সাহেবদের এত কষ্ট আর গাজ্বালা।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ দেখুন জাফর ইকবাল কি অসত্য তথ্য দিলেন? জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘‘একদিন এক অনুষ্ঠানে একজন রাজাকারদের বিদ্রূপ করে বক্তৃতা করেছে পরের দিন খবর পেলাম শিবিরের ছেলেরা তার পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। দেশের বাইরে থাকতেই এই পদ্ধতির খবর পেয়েছিলাম, দেশে ফিরে এসে এই প্রথম আমার নিজের চোখে রগ কাটার ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হলো।’’ এই দুই লাইনের ভিতর কন্ট্রাডিকশান দেখুন। প্রথম বলেছে ‘‘খবর পেলাম’’ অর্থাৎ চোখে দেখেনি। পরের লাইনে বলছে ‘‘আমার নিজের চোখে রগ কাটার ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হলো’’ অর্থাৎ রগ কাটার সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এখন কোন্টি সত্য? খবর পেয়েছেন না চোখে দেখেছেন? খবর পেলে চোখে দেখার কথা নয়, চোখে দেখলে খবর পাওয়া অবান্তর। জাফর ইকবাল যেভাবে বলছেন তাতে বুঝা যাচ্ছে শাবিতেই রগকাটার ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু বাস্তব তথ্য হলো শাবিতে রগ কাটার কোন ঘটনাই এ পর্যন্ত ঘটেনি বলে জানিয়েছেন শাবি'র আরেক শিক্ষক। তাহলে এই মিথ্যা তিনি কি কারণে বললেন? প্রকাশ্য একটি মিথ্যা যিনি বলতে পারেন তিনি আরো কতো মিথ্যা বলে যাচ্ছেন তার কি কোন ইয়াত্তা আছে?
শিবিরের রগ কাটার কথা পত্রপত্রিকায় অনেকবার পড়েছি। কিন্তু কেউ নিজের চোখে শিবির কারো রগ কেটেছে এমন দাবি এ পর্যন্ত কাউকে করতে দেখিনি। শিবির রগ কেটেছে এমন কারো ছবিও আমরা দেখিনি। কারো কোন আত্মীয়ের রগ শিবির কেটেছে এই রকম সাক্ষ্যও কেউ দিয়েছে এমন কোন তথ্য পত্রপত্রিকায় আমরা পড়িনি। কিন্তু জাফর ইকবাল নাকি নিজের চোখে দেখেছেন। শিবিরের উচিত হবে এই বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বলা। কার রগ কে কখন কিভাবে কাটতে জাফর ইকবাল দেখেছেন তা বিস্তারিত প্রকাশ করার দাবি জানানো উচিত। তবে রগ যে স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে জাফর ইকবালের পছন্দের দল ছাত্রলীগ কাটে তা গত সাড়ে তিন বছরে অনেকবার এ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। পত্রপত্রিকায় ছবিসহ এসেছে। সাড়ে তিন বছরে ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় পঁচিশজন মেধাবী ছাত্রকে খুন, সন্ত্রাস, শিক্ষক লাঞ্ছিতকরণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, ভর্তিবাণিজ্য, লুটপট, টাকা নিয়ে বিরোধী ছাত্রদের ক্লাসপরীক্ষা দেয়ার সুযোগ, আভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে জাতিকে মেধাশূন্য করার ইতিহাসের বর্বর অত্যাচার চালালেও তখন জাফর ইকবালের চেতনা কোথায় ছিল তা জানা যায়নি।
জাফর ইকবালের ভাষায়, ‘‘নতুন প্রজন্ম হচ্ছে জামায়াত শিবিরকে ঘৃণা করে।’’ কথাটি আসলে কতটুকু সত্য। নতুন প্রজন্ম যদি জামায়াত-শিবিরকে ঘৃণাই করবে তাহলে জাফর ইকবাল সাহেব এত টেনশানে আছেন কেন? তার তো খুশি হওয়ার কথা। নিশ্চিন্ত থাকার কথা। শিবিরকে নিয়ে তার এত ভয় কেন? ‘‘বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা’’ শিবিরে যোগ দিচ্ছে এ কথা তো জাফর ইকবাল শুরুতেই বলেছেন। ঘৃণা করলে কি কেউ ওই সংগঠনে যোগ দেয়? যারা যোগ দিচ্ছে তারা কি পুরাতন প্রজন্ম? নতুন প্রজন্ম যদি শিবিরকে ঘৃণা করবে তাহলে কোন্ প্রজন্ম এখন শিবিরে যোগ দিচ্ছে? আপনার গবেষণায় কি বলে? আসলে আপনাদের গবেষণা আপনাদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আসলে আজকের সারা দুনিয়াই ইসলামের দিকে বহমান স্রোতের মতো ধাবিত হচ্ছে। জনাব ইকবাল সাহেবদের আপসোস! নতুন প্রজন্মের জন্য এত সত্য-অসত্য মিলিয়ে লেখা-লেখি করি বলি তাও নতুন প্রজন্ম শিবিরের দিকেই ঝুকছে!!
জাফর ইকবালের আসল টেনশান কোথায়? জামায়াত এ দেশের রাজনীতির জন্য একটি ফ্যাক্টর। দলীয় শৃক্মখলার দিক দিয়ে জামায়াত একনম্বর আর ভোটের দিক দিয়ে বাংলাদেশের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি। আর যে কেয়ার টেকার সরকার ফর্মূলা ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম দিয়েছে তার ছায়াতলে ঘুরেফিরে সবাইকে আসতে হচ্ছে। তাছাড়া বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা আসলে জামায়াতের আসল অবস্থান জানে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর ছাত্রলীগ যুবলীগ আওয়ামী লীগ মিলে জামায়াত-শিবিরকে এখনো কাবু করতে পারেনি তাদের দৃষ্টিতে। আর আওয়ামী লীগের চরম ব্যর্থতার ফলে তারা বুঝে গিয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, জামায়াত-বিএনপি এক থাকলে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের মতোই চরম বিপর্যয়ে পড়তে যাচ্ছে। এ ভয়ে শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। আর জাফর ইকবালরা জামায়াত-বিএনপি আর শিবির-ছাত্রদলের ভিতর বিভক্তি তৈরির প্রজেক্ট হাতে নিয়ে মাঠে নেমেছেন। প্রথম আলোর শিরোনামে, ‘‘বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে...’’ বাক্য অসমাপ্ত রেখেছেন। পুরো বাক্যটি আসলে হবে ‘‘বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে তাহলে আওযামী লীগের চরম পরাজয় অনিবার্য।’’ জাফর ইকবালদের মূল টেনশান এটিই। সাদাসিধেভাবে এটি না বলে ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে বলেছেন। আর ওই পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগের আদর্শিক পরাজয় অনিবার্য!!!
dr.abuahmadsawsif@gmail.com
লেখক-কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন