রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

নিয়ম ভেঙে বদলি-পদায়ন কেন?


আবু সাঈদ খান
ডাক্তার-শিক্ষক-কর্মচারীদের কেবল নিয়মে বেঁধে গ্রামে রাখাই একমাত্র উপায় নয়। গ্রামের চাকরিকে আরও লোভনীয় করে তোলা দরকার। সে ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় বেতন বেশি হবে, ভালো বাসস্থান থাকবে, দ্রুত পদায়নের সুযোগ থাকবে। এভাবে গ্রামকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের গ্রাম ও উন্নয়ন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে শহর। সবকিছুই শহরকেন্দ্রিক। বিকেন্দ্রীকরণ একটি বুলি, যা মাঝে মধ্যে নেতারা বলেন। আবার পকেটে পুরে রাখেন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সত্যিকার বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া। এ অনুযায়ী রাজধানী থেকে সরকারের দফতরগুলো যতদূর সম্ভব বিভাগীয় শহরে নিয়ে যেতে হবে
ক্ষমতার দাপটে কী না হয়_ যোগ্যতা না থাকলেও চাকরি পাওয়া যায়, যোগ্য ও বয়োজ্যেষ্ঠদের টপকে পদোন্নতি লাভ করা যায়। নিয়মনীতি ভেঙে বদলিও হওয়া যায়। আর যখন তদবিরে নামেন ক্ষমতার বরপুত্ররা, তখন নথিপত্র সব উল্টেপাল্টে যা খুশি তাই করা যায়। এমনই সংবাদ দিয়েছে গত ২৬ মের সমকাল। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত 'গ্রামের ডাক্তার শহরে' শিরোনামে বলা হয়েছে যে, নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে তদবিরের মাধ্যমে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তাররা শহরের হাসপাতালে বদলি হয়েছেন। অথচ ২০১০ সালের শেষ দিকে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া ডাক্তারদের জন্য মন্ত্রণালয়ে যে নীতিমালা আছে তাতে বলা হয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্তদের কমপক্ষে দু'বছর গ্রামে থাকতে হবে। তা সত্ত্বেও দু'বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেবল চট্টগ্রাম বিভাগেই কমপক্ষে ৫০ জন ডাক্তার শহরের হাসপাতালে বদলি হয়েছেন এবং সেখানে তাদের পদায়নও হয়েছে। সারাদেশের সর্বমোট কতজন ডাক্তারকে নিয়ম ভেঙে গ্রাম থেকে শহরে বদলি করা হয়েছে_ তা জানা নেই। তবে
চিত্র অভিন্ন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন তাদের বদলি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য চারবার চিঠি লিখেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। কী করে হবে? স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসৎ কর্মকর্তা এবং সরকার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এ কর্মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। থাকতে পারে আরও লম্বা হাতের কারসাজি।
জানা যায়, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ ছিল_ যেন গ্রাম থেকে ডাক্তারদের শহরে বদলি না করা হয়। কিন্তু গ্রামদেশে প্রচলিত সেই কথাই সত্য হয়ে উঠছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়ে তদবিরবাজদের কথা অনুসারে কাজ চলছে, যা কোনো ক্রমেই শুভ লক্ষণ নয়।
গ্রামই হচ্ছে দেশের প্রাণ, সেখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র শতকরা ৭০ জন বাস করে। অথচ শিক্ষা-স্বাস্থ্য উন্নয়ন বরাদ্দের খুব সামান্য অংশ গ্রামে যায়। গ্রামগুলোর জন্য উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সই হাতের কাছে সর্বোচ্চ চিকিৎসা কেন্দ্র। সে কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসাসেবা ও সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে আমরা কমবেশি অবহিত রয়েছি। ডাক্তাররা সাধারণত এই কমপ্লেক্সগুলোয় অবস্থান করতে চান না। চাকরির জন্য কমপ্লেক্সগুলোয় যেতে বাধ্য হলেও বসবাসের জন্য তারা বেছে নেন নিকটবর্তী শহর। দেরিতে যাওয়া আর কাজ না শেষ করে ফেরা অনেকেরই অভ্যাস। তারপরও রয়েছে অনুমোদিত-অননুমোদিত ছুটি। সেখানে রোগীদের এসে শুনতে হয়_ ডাক্তার নেই, এক্স-রে মেশিন খারাপ, এটা নষ্ট, সেটা নষ্ট। কেউ কেউ এতে ক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু বেশিরভাগই অদৃষ্টকে দায়ী করে ফিরে যায়। এই যখন হাল, তখন যদি ক্ষমতার বরপুত্রের তদবিরে চাকরিবিধি ভঙ্গ করে বদলি চলতে থাকে। তবে মানুষের দুর্ভোগ কত গুণ বাড়বে, তা সহজবোধ্য।
এ ক্ষেত্রে যারা বদলি হয়েছেন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে শাস্তি হিসেবে অতিরিক্ত এক বছর গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক করা হলে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের কাজে উৎসাহী হতো না। তবে ওই চিকিৎসকদের চেয়ে বেশি দায়ী সেসব কর্মকর্তা, যারা নিয়ম ভঙ্গ করে তাদের বদলি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেই ক্ষমতা কি ক্ষমতাধরদের আছে?
কেবল চিকিৎসা নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাম চরম অবহেলার শিকার। গ্রামের বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মাত্র ২০০ টাকা বাড়ি ভাড়া আর অনুরূপ মেডিকেল ভাতা দেওয়া হয়। প্রতিবাদ জানাতে এসে জামালপুরের এক মুক্তিযোদ্ধা-শিক্ষক লাশ হয়ে ফিরেছেন। লাঠিপেটা আর গরম জলে ঝলসে গেছে অনেক শিক্ষকের দেহ। গ্রামের স্কুলগুলোয় লাইব্রেরি নেই, ল্যাবরেটরি নেই, নেই ক্রীড়া-বিনোদনের আয়োজন। শিক্ষকদের অদক্ষতা ও দায়িত্বে অবহেলাও শিক্ষার মানকে করছে নিম্নমুখী। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত জনগণ কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে_ সেটিই আজ বড় প্রশ্ন।
ডাক্তার-শিক্ষক-কর্মচারীদের কেবল নিয়মে বেঁধে গ্রামে রাখাই একমাত্র উপায় নয়। গ্রামের চাকরিকে আরও লোভনীয় করে তোলা দরকার। সে ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় বেতন বেশি হবে, ভালো বাসস্থান থাকবে, দ্রুত পদায়নের সুযোগ থাকবে। এভাবে গ্রামকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের গ্রাম ও উন্নয়ন সম্পর্কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে শহর। সবকিছুই শহরকেন্দ্রিক। বিকেন্দ্রীকরণ একটি বুলি, যা মাঝে মধ্যে নেতারা বলেন। আবার পকেটে পুরে রাখেন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সত্যিকার বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া। এ অনুযায়ী রাজধানী থেকে সরকারের দফতরগুলো যতদূর সম্ভব বিভাগীয় শহরে নিয়ে যেতে হবে। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। অর্থায়ন, পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদই হবে সরকারের শক্তিশালী প্রশাসনিক ইউনিট। এভাবেই বদলে ফেলতে হবে রাষ্ট্রযন্ত্র। প্রশাসন যত জনগণের কাছে যাবে, ততই তা হবে জবাবদিহিমূলক। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, যদি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় উপজেলা চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত থাকতেন তবে কি বদলির অনুমোদন মিলত? সঙ্গত কারণেই জনপ্রতিনিধির জনগণের কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন আছে; সেটি আমলাদের নেই। তারা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আমাদের প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা আমলাতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা। একটি ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দেশ চালাতে জনগণের বুদ্ধির চেয়ে আমলাদের বুদ্ধিই বেশি দরকার। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি যে, এসব অসাধারণের চেয়ে সাধারণ মানুষের প্রচেষ্টাতেই দেশ শক্তি-সমৃদ্ধির পথে এগোচ্ছে।
১৬ কোটি নর-নারীর মুখে আহার তুলে দিচ্ছেন গ্রামবাংলার কৃষক। সাম্প্রতিক বিশ্বমন্দার করাল থাবা থেকে বাংলাদেশ নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল, তার পেছনেও কৃষি খাতের অবদানই প্রধান। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনটি খাতের প্রধান ভূমিকার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তা হচ্ছে কৃষিতে ভালো ফলন, প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্ট খাত। এটি সবারই জানা যে, গ্রামবাংলার তরুণরাই মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্সের জোগান দেয়। আর গার্মেন্টের প্রাণশক্তি যে শ্রমিক, তারা গ্রামের প্রান্তিক চাষি ও মজুরের সন্তান। কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক, আর গার্মেন্ট কর্মী_ দেশের উন্নয়নের তিন নায়কের শিকড় পল্লীতেই। পল্লীই আমাদের প্রেরণার উৎস।
একাত্তরে শহর থেকে আসা রাজনীতিক-ছাত্রকর্মীদের আশ্রয় মিলেছিল কৃষকের ঘরে। প্রতিটি কৃষকগৃহ পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। সেদিন কৃষক-তরুণরা হালের গুটি ছেড়ে অস্ত্র হাতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আজকের তরুণরাও বসে নেই। আজও তারা আপন চেষ্টায় গ্রামকে বদলে ফেলেছে। হালের বদলে কলের লাঙল, সেচযন্ত্র বসিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছে। যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে নিজেদের মতো করে বসিয়েছে ইঞ্জিনের নৌকা, সড়কপথের জন্য নছিমন-করিমন। এ যানবাহনে যান্ত্রিক ত্রুটি আছে। গ্রামের মেধাবী যুবকের হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি তুলে দিলে তারা সে ত্রুটিও দূর করতে পারত। আনতে পারত আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু সেই সুযোগ ও অর্থ গ্রামবাসীর কাছে নেই। রাষ্ট্র গ্রাম থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় হচ্ছে শহরে। সেখানে ব্যয়ের চেয়ে অপচয় বেশি। গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে জনস্বার্থ ভূলুণ্ঠিত। দায় নেই, ধরার ব্যবস্থা নেই, কারণ দেশের মালিক এই ব্যবস্থা থেকে বহু দূরে। তাই বিকেন্দ্রীকরণ আর জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রশাসনের মাধ্যমে সে দেশটা বদলে দেওয়া যায়, গ্রামকে করা যায় আকর্ষণীয়।
সেই গ্রাম আমরা চাই_ যেখানে সবুজ থাকবে, সুলভ হবে শিক্ষা-চিকিৎসাসেবাসহ আধুনিক জীবনের সব উপকরণ। ইটের পিঞ্জরে দমবন্ধ হয়ে ছটফট করতে থাকা মানুষগুলো গায়ের মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য চিকিৎসকরাও সেখানে যেতে চাইবেন। চাকরি শেষে গ্রামে ফিরবে, যেমনটা আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় দেখতে পাই। সেই গ্রামে চাকরির জন্য ডাক্তার-শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিযোগিতা করবেন। এমন দৃশ্যের অবতারণা কি অসম্ভব কিছু?
তবে তার আগে নিয়ম ভঙ্গ করে যারা শহরে বদলি হচ্ছেন, কাজে অবহেলা করছেন, তাদের এবং তাদের প্রশ্রয়দাতাদের কঠোর শাস্তি চাই। কঠোরতর শাস্তি দেওয়া হোক, যেন বিধি ভঙ্গের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন