রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

সরকারের এ কোন অন্তর্জলি যাত্রা?


॥ গোলাপ মুনীর ॥


যেকোনো একটি দেশের সরকারের অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে নিজ দেশের ভাবমর্যাদা দেশের বাইরে সমুন্নত রাখা। এ জন্য সরকারে যারা আছেন, সরকার যারা চালান, তাদের বরাবর সজাগ থাকতে হয়, এমন কিছু দেশে যেন না ঘটেÑ যা দেশের ভাবমর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারের মধ্যে সে ধরনের সচেতনতা কতটুকু কাজ করে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। আমাদের কূটনৈতিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে এমন সব লজ্জাজনক কাজ করেন, যার নাম পর্যন্ত মুখে আনতে কষ্ট হয়। এদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা পর্যন্ত সরকার নেয় না। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের দুর্নীতির অভিযোগ যখন দেশের বাইরে এবং ভেতর থেকে ওঠে, তখন দেশের ভাবমর্যাদার অধোগতি না ঘটে পারে না। পদ্মা সেতু প্রকল্পে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে জোরালো দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক সাহায্য বন্ধ করে দেয়। সে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না। বরং আরো মর্যাদাশীল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হলো। বস্তাভর্তি ঘুষের টাকা মন্ত্রীর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিল তার এপিএসÑ এমন অভিযোগের বেলায় মন্ত্রীর কিছু হলো না। বরং লোকদেখানো তদন্তের মাধ্যমে বলা হলো, এ ঘুষের ঘটনার সাথে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা নেই। জনগণ বুঝল, আওয়ামী লীগের জন্য সাত খুন মাফ। কার্যত দেখল, এ সরকারের আমলেই রাষ্ট্রপতি বেশ কয়েকজন ফাঁসির আসামির মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছেন দলীয় বিবেচনায়। এসবই আমাদের জাতীয় ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করায় বিজারক হিসেবে কাজ করে। কারণ, বাংলাদেশের ভেতরে আজ কী চলছে বাইরের কারো কাছে তা অজানা নয়। তাদের কাছে আজ অজানা নয়Ñ বাংলাদেশে আজ সুশাসন নির্বাসিত। খুন, হত্যা, গুম, অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অসহিষ্ণু রাজনীতির চর্চা এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার এখানে ভূলুণ্ঠিত। সরকারি দল ও বিরোধী দল দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। জাতীয় ঐক্যের লেশমাত্র এখানে উপস্থিত নেই। নীতিহীনতা রাজনীতির এক প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাই এখানে একের পর এক রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্কট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনে কারো কোনো উদ্যোগ নেই। সাংঘর্ষিত রাজনীতির তীব্রতা এতটা বেড়েছে যে, তা কার্যত দুঃসহ পর্যায়ে নেমে এসেছে। সামনে এখন শুধু অপেক্ষা করছে কোনো এক অজানা বিপর্যয়।
সরকারের আচার-আচরণ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সময়ের সাথে শুধু বাড়ছেই। এই তো গত শনিবার প্রথম আলোর এক খবরে দেখলাম, সরকারের আচরণে ুব্ধ দেশের মানবাধিকার কমিশন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তে অসহযোগিতা করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতায় ুব্ধ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সঙ্ঘটিত তিনটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও একজনের নিখোঁজের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া দেশের বেশ ক’টি মানবাধিকার সংস্থা দেশে সঙ্ঘটিত হত্যা, খুন, গুম ও অপহরণের ব্যাপারে সময়ে সময়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে। কিন্তু এসব বন্ধ করতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তবে বিরোধী দল দমনে সরকারের উৎসাহে বিন্দুমাত্র কমতি নেই। সভা, সমাবেশ ও মিছিলে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও ধরপাকড় অভিযানে পুলিশ সদা তৎপর। সরকারি দলের এমপিদের জনতার ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালাতে দেখা যাচ্ছে। দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। এসব বন্ধে সরকারের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন নেই। এসব খবর কি বিদেশীরা প্রতিদিনই পাচ্ছে না? এসব ঘটনা কি জাতীয় ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছে না? নিশ্চয়ই করছে। করছে বলেই বিদেশের পত্রপত্রিকায় আজ বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সাময়িকী ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা দেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন। গত শুক্রবার পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে রাজনৈতিক উত্তেজনা, দুর্নীতি, খুন, অপহরণ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে দু’টি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একটির শিরোনাম : “বাংলাদেশ’স টক্সিক পলিটিক্স : ইট ইজ আপ টু ইন্ডিয়া টু স্টপ শেখ হাসিনা রুইনিং বাংলাদেশ।” এর সার কথা : ‘বাংলাদেশের বিষাক্ত রাজনীতি’, ‘বাংলাদেশ ধ্বংসে শেখ হাসিনাকে থামাতে চাবিকাঠি ভারতের হাতেই’। দ্বিতীয় প্রতিবেদনের শিরোনাম : ‘পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ : প্রাইম মিনিস্টার সেটস দ্য কান্ট্রি অন অ্যা ডেঞ্জারাস পাথ’। এর অর্থ হচ্ছে : ‘বাংলাদেশের রাজনীতি : প্রধানমন্ত্রী দেশকে বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাচ্ছেন।’
রিপোর্ট দু’টির শিরোনাম পড়লেই যেকোনো বাংলাদেশী উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন হতে প্রায় ১৮ মাস বাকি। আর এখনই রাজপথে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেছে। বিরোধী দলের নেতাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তাদের খুন ও গুমের জন্য পুরনো দ্বন্দ্বকে দায়ী করা হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচন কার তত্ত্বাবধানে হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। এরই মধ্যে পর্যবেক্ষক মহল আগামী নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে। বাংলাদেশে খাদ্য, জ্বালানি তেল, লোডশেডিং ও নতুন নতুন সড়ক নির্মাণে সরকারের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে ুব্ধ। মাস খানেক আগে এক তরুণ রাজনীতিককে গুম করা হয়েছে। খুব সম্ভবত তাকে খুন করা হয়েছে। এর আগে অন্য দু’জনকে হত্যা করা হয়েছে। চলতি মাসে সিনিয়র কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ৩৩ জন বিরোধীদলীয় নেতাকে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে। খালেদা জিয়ার দাবি, বিএনপির তিন হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়, আরো কলঙ্কিত বিষয় রয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এক সৌদি কূটনীতিক খুন হয়েছেন। এক ট্রেড ইউনিয়নকর্মী নির্যাতিত ও খুন হয়েছেন। দুর্নীতির অনুসন্ধান করার পর এক সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে জানুয়ারিতে ক্যুর গুজব ছড়ানো হয়।
এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের অন্যতম সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসকে হেনস্তা করা হয়েছে। মতিভ্রমের শিকার শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করেন। সরকার তার ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য আরেক দফা কমিশন গঠন করেছে। ড. ইউনূস এই কমিশন গঠন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বস্তুত সরকার গ্রামীণ ব্যাংককে কব্জা করতে চাইছে।
রিপোর্ট মতে, সরকারের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি এত ব্যাপক যে, তা দাতাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাপান তার উপ-প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি ব্যক্ত করেছে। সাম্প্রতিক এক দুর্নীতির ঘটনায় রেলমন্ত্রীর সহকারীর বস্তাভর্তি টাকা পাওয়ার পরে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু অল্প সময় পরেই তাকে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়Ñ বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে সংশয় থেকে গেছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলতি সপ্তাহে হিলারি কিনটনের হুঁশিয়ারি পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে অংশগ্রহণমূলক। নির্বাচন আয়োজন করতে হবে নিরপেক্ষভাবে, যাতে বিরোধী দল অংশ নিতে পারে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে যত একরোখা মনে হচ্ছে, জনগণ তত তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি সংবিধান পাল্টে দিয়েছেন। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ইতঃপূর্বে তিনি আন্দোলন করেছেন, সেটাই এখন বাদ দিয়েছেন। তিনি সম্ভবত আগামী নির্বাচনে ভালোভাবে জয়ের বিকল্প পথ খোলা রাখতে চাইছেন। অন্য দিকে খালেদা জিয়া রাজপথে বিক্ষোভ ও অনশন করছেন, জুনে গণ-আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। এর দুঃখজনক পরিণাম হবে রাজনীতিতে আরো মেরুকরণ এবং সঙ্ঘাত সৃষ্টি।
এতক্ষণ ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনের কথাগুলো তুলে ধরা হলো, তা কিন্তু এ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি-মহল বারবার বলছে। কিন্তু সরকার অনড়। গতকালও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনেই হবে। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তো শুরু থেকেই বলে আসছেনÑ যে নামেই হোক, আগামী নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থানের সরল অর্থÑ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিপজ্জনক পথেই।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন এমনই সঙ্কটে, তখন গত শুক্রবারের কাগজে দেখা গেল বাংলাদেশ সম্পর্কিত আরো তিনটি রিপোর্ট। একটি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের, দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং অন্যটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের। এ সব রিপোর্টের বিষয়বস্তুও আমাদের ভাবিত করে বৈকি!
সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। বিশেষ করে ‘এলিট ফোর্স’ র‌্যাবের হাতে নিহত হওয়া বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ টেনে গত বৃহস্পতিবার লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি এই উদ্বেগ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০১১ সালে ৫৪টিরও বেশি বেআইনি হত্যাকাণ্ড হলেও সেগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত করা বা বিবেচনায় আনা হয়নি। রিপোর্টে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ, র‌্যাব সদস্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাউকে আটক করে নিয়ে যায় ও আটক ব্যক্তি পরে মারা যায়। র‌্যাব এ ধরনের ঘটনা একনাউন্টার বলে দাবি করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ মারা যাওয়ার ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অপর দিকে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। নিরাপত্তাবাহিনীগুলো হত্যা, গুম, দমনপীড়ন, হেফাজতে মৃত্যু, বিনা কারণে আটক অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী। প্রায় ২০০ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রণীত রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে ৩৪ পৃষ্ঠার বিশদ বিবরণ রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসন খর্ব হওয়ায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতি প্রকাশ পায় এ রিপোর্টে। এতে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরাসরি অভিযুক্ত করা হয়। বিচার বিভাগকে রাজনীতিকায়নের ফলে বিরোধী নেতা-কর্মীদের সুবিচার পাওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হচ্ছে। সরকার নাগরিকদের ব্যক্তি-অধিকারের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সরকার সীমিত করছে। রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত সঙ্ঘাত একটি সমস্যা। নিরাপত্তাবাহিনী সাংবাদিকদের হয়রানি করছে। সমাবেশ-র‌্যালির স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে সরকার। সরকারের ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে রয়ে গেছে। শিশু পাচার বাড়ছে। শিশু ও প্রতিবন্ধীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, শ্রমিকদের অধিকার সীমিত।
এ দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বাংলাদেশে গুম, হত্যা, খুন বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছেÑ আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে মানবাধিকার নিশ্চিত করাসংক্রান্ত তার নির্বাচনী ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিত র‌্যাব নির্যাতনকারী সদস্যদের বিচার করার বদলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা অস্বীকার করেছেন, এমনকি অভ্যন্তরীণ তদন্তে অন্যায়ের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও। ক্রসফায়ারের ছদ্মাবরণে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অনুশীলন র‌্যাবের কাছ থেকে পুলিশ ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেফতার, এমনকি গুমের নতুন অভিযোগও বাড়ছে। রিপোর্টে বলা হয়Ñ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন আন্তর্জাতিক মানের শর্ত পূরণ করা হয়নি। এভাবে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের রিপোর্টে উঠে আসার পাশাপাশি অন্যান্য মহলেও আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও ইলিয়াস আলীর গুমের ইস্যুটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ইলিয়াস আলীসহ অন্যান্য গুম, অপহরণ ও হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের ওপর অবিলম্বে জোরালো চাপ সৃষ্টির জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যরা। গত ২৪ মে সন্ধ্যায় এ বিষয়ে আলোচনায় কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টি উভয় দলের পার্লামেন্ট সংসদ সদস্যরা অংশ নেন। লেবার পার্টির গ্যারি সাসলিফ বলেনÑ গত ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী তার ড্রাইভার আনসারসহ গুম হন। বাংলাদেশের সাবেক এমপি এবং বিরোধী দল বিএনপির একজন তরুণ নেতা ইলিয়াস আলীর গুমের বিষয়ে ব্রিটেনের বাংলাদেশী সম্প্রদায় খুবই উদ্বিগ্ন। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, অস্ত্রের মুখে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্য একটি গাড়িতে বন্দুকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। ইলিয়াস আলীর আগেও অনেকে গুম হয়েছেন। এসব গুম সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী আকারে। ইলিয়াস আলীর গুমের প্রতিবাদের সময়েও মৃত্যু ও গুমের ঘটনা ঘটেছে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি আলী মোকাদ্দস ও মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ নামে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র গুম হয়েছেন। ২ এপ্রিল ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনায়েদ আহমেদ নামে দু’জন বিএনপি কর্মীকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ তুলে নেয়। উল্লিখিত এ চারজনের কোনো খবর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ৪ এপ্রিল আমিরুল ইসলাম নামে এক পোশাক শিল্প শ্রমিক নেতা গুম হন। একদিন পর তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ক্রামগত রাজনৈতিক অপহরণ ও হত্যার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান এ কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারের কী করা উচিত, তা বের করার জন্যই আমাদের আজকের এ আলোচনা। আমাদের সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কী করেছে এবং কূটনৈতিকভাবে কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারে কি না, সে বিষয়ে আমি জানতে চাচ্ছি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে যেসব নিখোঁজ ও গুমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের বিষয়েও আমাদের তথ্য চাওয়া উচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে। অন্যান্য দলের পার্লামেন্ট সদস্যরাও পার্লামেন্টে একই সুরে কথা বলেন।
বাংলাদেশে আজকের এই সময়ে যা ঘটছে, তা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। এ লেখায় দেশের বাইরের যে কয়েকটি রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হলো, এতে বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যে চিত্র তুলে ধরা হলো, তা কি অস্বীকার করার কোনো অবকাশ আছে? কোন অভিযোগটা সরকার অস্বীকার করবে? তারপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বলবেন, এসব প্রতিবেদনে যা উল্লেখ রয়েছে তা সত্য নয়। এগুলো সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছেÑ বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে, তা দেশের বাইরে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। কারণ, দেশে সুশাসন নেই। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও দুয়েক দিন আগে বললেন, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, সবখানে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ দেশে আইনের শাসন নেই।
বিরোধী দলের ৩৩ জন প্রথম সারির নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠিয়ে আওয়ামী নেতারা বললেনÑ অন্যায় করে কেউ পার পাবেন না। সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। কথায় কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। সেই সাথে আরো দাবি করেন, এ দেশে একমাত্র আওয়ামী লীগ আইনের শাসন চায়। আসলে ইংরেজি ভাষায় ‘রুল অব ল’ বা ‘রুল বাই ল’ বলতে আমরা যা বুঝি, আইনের শাসন তাই। আইনের শাসন হচ্ছে একটি লিগ্যাল ম্যাক্সিম প্রতিষ্ঠিত ন্যায়নীতি ও প্রতিজ্ঞা। অন্য ভাষায় ‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্রপজিশন’। আইনের শাসনের মূল কথা : ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন : নো ওয়ান ইজ অ্যাবাব দ্য ল।’ আইনের শাসন যেখানে প্রতিষ্ঠি হয়, সেখানে সরকারি সিদ্ধান্ত নেয়া ও বাস্তবায়ন হয় বৈধ ন্যায়নীতির ওপর ভিত্তি করে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলে গেছেন : The rule of law is better than that of any individual Ñ কোনো ব্যক্তির শাসনের চেয়ে আইনের শাসন অধিকতর ভালো। তিনি আরো বলেছেন : Law should govern Ñ শাসন হবে আইনের।
আওয়ামী লীগ নেতারাই ভেবে দেখুন, আপনারা যে আইনের শাসনের দাবি করছেন, তাতে আইনের শাসনের সর্বজনস্বীকৃত এসব উপাদানগুলোর উপস্থিতি আছে কিনা? জানি না, এর নির্দোষ জবাব যেমনি আপনাদের কাছে নেই, তেমনি দেশের ভেতরে ও বাইরে আজ আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে যেমন মৌল অভিযোগ উঠেছে, তারও নির্দোষ জবাব সরকারের কাছে নেই। আমরা শুধু বলতে পারি, তা অস্বীকার করি কী করে? সরকার যদি অন্তত মনে মনে এসব অভিযোগ স্বীকার করে এ থেকে বেরিয়ে আসার একটি নীরব প্রয়াস চালায়, তবেই হয়তো আমরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা আবারো উজ্জ্বল করার একটা উপায় মিলাতে পারব। তা না হলে অনিবার্য জাতীয় বিপর্যয়।
বিপর্যয় যে সমাসন্ন তার আলামতও স্পষ্ট হচ্ছে। নইলে হাসানুল হক ইনুর মতো গণবিচ্ছিন্ন দলের নেতা বলতেন না খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার কথা। তার বক্তব্য সমালোচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে পরদিন তিনি রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে বললেনÑ খালেদা জিয়াকে মাইনাস করবই। জানি না, সরকারের এ কোন অন্তর্জলি যাত্রা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন