ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
কেমন সরকারের অধীনে আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন হবে সে আলোচনাই এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক নাকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে বলয়েই এ সংক্রান্ত আলোচনা আবর্তিত হ”িছল। এ দুই রকমের সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হওয়ায় এ সরকারের সঙ্গে সবার পরিচয় থাকে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ২০ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ ব্যব¯’াটিও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কিছুটা আ¯’া গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে না চাওয়ায় আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ আরও কিছু দল নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জোরালো আন্দোলন করে। এ আন্দোলনের একপর্যায়ে সাংবিধানিকতা বজায় রাখার স্বার্থে বিএনপি সরকার ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে সে স্বল্পায়ুর সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধানকে সাংবিধানিক ভিত্তি দিলে তখন থেকে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবম সংসদ নির্বাচন আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি। এ অভিনব প্রকৃতির জর“রি সরকারটির জš§ হয় কিছু মের“দণ্ড-দুর্বল রাজনীতিক, কয়েকজন উ”চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা এবং জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনকারী কতিপয় বিদেশী কূটনীতিকের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এ সরকারকে সাংবিধানিক বিধি, আয়ুষ্কাল এবং কর্মকাণ্ডের পরিমাপকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায় না। তবে রাজনীতির ব্যাকরণ ভেঙে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুর“ করে মহাজোট সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এখন ফখর“দ্দীন সরকারের অমানবিক অপকর্মগুলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে চাপানোর জন্য ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে অভিহিত করছেন।
যা হোক গত ২০-২২ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এ স্বল্পায়ুর সরকারটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করে। তবে রাজনীতিকদের উচিত ছিল সাংবিধানিক ভিত্তি পাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম ও গতিবিধি লক্ষ্য করে এর যেসব দুর্বলতা পরিলক্ষিত হ”িছল সেগুলো দূর করতে এ ব্যব¯’ার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। এ লক্ষ্যে কাজ করলে তারা যেসব কাজ করতে পারতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ”েছ :
ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রথমে সুযোগ পাওয়ার কথা এবং যেহেতু ওই অব¯’ানে কোন বিচারপতি থাকবেন সে বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অংক কষাকষির কারণে বিচারাঙ্গনে রাজনৈতিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। শুর“ হয় বিচারপতিদের পদোন্নতির রাজনীতি, সে কারণে এরা এ পদে যাতে বিচারপতিদের সঙ্গে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সম্মানিত বরেণ্য শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান সুশীল সমাজের সদস্যদেরও গণ্য করার ব্যব¯’া নিতে পারতেন;
খ. এ অ¯’ায়ী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বিধান করতে পারতেন;
গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টারা ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা গ্রহণ করায় রাজনৈতিক দলের নেতারা ওপরে নিরপেক্ষ পরিচয়ধারী কিš‘ ভেতরে নিজ আদর্শে বিশ্বাসী বর্ণচোরা ব্যক্তিত্বদের তালিকাভুক্ত করার সুযোগ যাতে না পান সেজন্য দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা না নেয়ার বিধান চালু করতে পারতেন;
ঘ. এ সরকার দৈনন্দিন র“টিন কাজ ছাড়া যাতে সাহাবুদ্দীন সরকারের শিক্ষা সংস্কার কমিটি বা হাবিবুর রহমান সরকারের মতো নবম বা দশম শ্রেণীতে ধর্ম বিষয়ে পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে জড়িত হয়ে এখতিয়ারবহির্ভূত দায়িত্ব পালন না করে, সে ব্যাপারে ব্যব¯’া গ্রহণ করতে পারতেন; এবং
ঙ. তিন মাস একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কম সময় মনে হলে এ সময় সামান্য বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন।
কিš‘ দুঃখের বিষয় ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন শুর“ হলে এ ব্যব¯’ার নানা ত্র“টি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ সরকার ব্যব¯’ার কোন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে উ”চ আদালতের একটি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, অ্যামিকাস কিউরি এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের পরামর্শ উপেক্ষা করে এ সরকার তড়িঘড়ি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া বাতিল করে। যেসব সমস্যার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া প্রবর্তন করা হয়েছিল, ওই সমস্যাগুলো সমাধান না করে, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না করে এ ব্যব¯’া বাতিল করে দেয়ায় দলীয় ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যব¯’া করা হয়। এর ফলে বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ মনে করে, মন্ত্রী ও এমপিরা নিজ পদে থাকা অব¯’ায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ দেশে এখনও তৈরি হয়নি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং ওই আন্দোলন হরতাল, রোডমার্চ, সমাবেশ-মহাসমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে চলমান রয়েছে, আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিরোধী দল তাদের দাবি মেনে নিতে সরকারকে ১০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকার দাবি না মানলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করার হুমকি দিয়েছে। এ অব¯’ায় কোন সংলাপ না হওয়ায় এবং সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অব¯’ান গ্রহণ করায় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরি¯ি’তির সঙ্গে ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময়কার পরি¯ি’তির অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। ওই সময় সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায়নি, কিš‘ আওয়ামী লীগ-জামায়াতের কঠোর আন্দোলনের চাপে অনেক দেরি করে হলেও একপর্যায়ে আরেকটি নির্বাচন করে সংবিধানের সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এখনও কি পরি¯ি’তি সে রকম? এখনও সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চাইছে না, আর বিরোধী দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যা”েছ এবং সে আন্দোলনের অংশ হিসেবে যুগপৎ নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মুক্ত ও অবাধ সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুর“ত্ব অনুধাবন করাতে সমর্থ হয়েছে। এ কারণে ১০ জুনের আলটিমেটাম শেষে হয়তো বিরোধী দল আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যাবে। তবে সরকারও পরি¯ি’তি পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছে যে, পুলিশের পিটুনি আর মামলা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন থেকে হয়তো ফেরানো যাবে না। বিরোধী দলের আলটিমেটাম নিকটবর্তী হওয়ায় সরকারের বক্তব্যে ইদানীং কিছুটা হলেও নমনীয়তা লক্ষ্য করা যা”েছ।
সরকারি দলের নেতারা প্রথমে বলেছিলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছেন, কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমাদের দেশেও তেমনিভাবেই অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সুকৌশলে অ-তত্ত্বাবধায়ক, অসাংবিধানিক ফখর“দ্দীন-মইনউদ্দিন জর“রি সরকারের কুকর্মের দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপিয়ে এ সরকারকে ‘দানব’ বলে অভিহিত করে এর সমালোচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিš‘ সরকারি দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ দলীয় সরকারের চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তারা মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও এ দেশে তৈরি হয়নি। এ কারণে বিরোধী দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে যে আন্দোলন করা হ”েছ সে আন্দোলন নাগরিক সমাজের সমর্থন পা”েছ। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিরোধীদলীয় আলটিমেটাম শেষ হওয়ার প্রাক্কালে সরকারদলীয় নেতারা কিছুটা নমনীয় সুরে কথা বলছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অনড় অব¯’ান থেকে সরে এসে এখন তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ করতে চাইছেন।
এ বিষয়ে ২৭ মে ১৪ দলীয় বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যব¯’ার রূপরেখা নিয়ে আলোচনার পথ সব সময় খোলা রয়েছে, তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যব¯’া নিয়ে নয়।’ সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্যে যেমন সমঝোতার সুর ধ্বনিত হয়; তেমনি আবার যখন তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা যে এখনই চূড়ান্ত করতে হবে তা আমি মনে করি না। এ নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সময় রয়েছে’, তখন মনে হয় তার এ বক্তব্য সহিংসতা ও সংঘাতকে প্রশ্রয় দি”েছ। কারণ, যে ইস্যু নিয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন চলছে, দেয়া হ”েছ হরতাল, রোডমার্চ, মহাসমাবেশ, আলটিমেটাম ও পরবর্তী সময়ে আসছে আরও কঠোর কর্মসূচি, সে ইস্যুটি যদি দ্র“ত সমাধান করা যায় তাহলে এটাই কি সবার জন্য ভালো নয়? সরকারি দল চাইছে বিরোধী দলকে চাপে রেখে তাদের দিয়ে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করাতে। কারণ, বিরোধী দল কোন প্রস্তাব উত্থাপন করার পর সরকারি দলের পক্ষে তা নাকচ করা বা তাকে ভিন্ন রূপ দিয়ে পাস করানোর মতো সংসদীয় শক্তি রয়েছে। বিরোধী দলও সহজে সরকারি দলের ফাঁদে পা দিতে চাইছে না। তারা বলছে, সমস্যাটি সরকারি দল তৈরি করেছে, কাজেই এর সমাধান-উদ্যোগও সরকারি দলকেই নিতে হবে। কারণ এ উদ্যোগকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার শক্তি একমাত্র সরকারি দলেরই রয়েছে।
সরকারি দল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বলে আলোচনা করতে চাইলে সমস্যার সমাধান হবে না এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলও আকৃষ্ট হবে না। তাদের ঝেড়ে কাশতে হবে। এ সম্ভাব্য আলোচনার আগে একটি মাত্র বিষয় তাদের পরিষ্কার করতে হবে, আর তা হল তাদের উল্লিখিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারদলীয় নাকি নির্দলীয় হবে। যদি সরকার এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্দলীয় চরিত্র প্রদানে রাজি হয়, তাহলে আর এ বিষয়ে সংলাপে বিরোধী দলের রাজি না হওয়ার কোন কারণ থাকবে না। আর এ নিয়ে সংলাপ করতে পারলে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে এ সরকারের বাকি বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সে বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে পারবে। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে তা হ”েছ এ সরকারের সদস্যদের নির্বাচিত হতে হবে নাকি নির্বাচিত না হলেও চলবে; এর প্রধান উপদেষ্টা কে কী প্রক্রিয়ায় মনোনীত হবেন; এর সদস্য সংখ্যা কত হবে; তারা কিভাবে মনোনীত হবেন; এর আয়ুষ্কাল ও কর্মপরিধি কেমন হবে; সরকারের মন্ত্রী-নেতারা এতে জড়িত থাকবেন কিনা প্রভৃতি। সময় থাকলেও এ আলোচনা যত দ্র“ত হবে, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল। কারণ বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দল আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েই যাবে, আর আন্দোলন কর্মসূচি মানেই পুলিশের পিটুনি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা, গ্রেফতার এবং এসবের মধ্য দিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব দেখতে চায় না, তারা চায় উভয় দল সমঝোতার ভিত্তিতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কর“ক। এ সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যে দল যত গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে, নাগরিক সমাজে সে দলের তত বেশি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। আর মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হলে এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে সে দল নির্বাচনে ততই এগিয়ে যেতে পারবে। সরকারের নাম কী হবে, তাতে কিছুই এসে যায় না। সম্ভাব্য সরকারের নাম যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয় তাতে কেউই কোন আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না, যদি ওই সরকার নির্দলীয় চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ধশযঃবৎসু@মসধরষ.পড়স
কেমন সরকারের অধীনে আসন্ন দশম সংসদ নির্বাচন হবে সে আলোচনাই এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এতদিন তত্ত্বাবধায়ক নাকি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে বলয়েই এ সংক্রান্ত আলোচনা আবর্তিত হ”িছল। এ দুই রকমের সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল। দলীয় সরকারের অধীনে দেশ পরিচালিত হওয়ায় এ সরকারের সঙ্গে সবার পরিচয় থাকে। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ২০ বছরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ ব্যব¯’াটিও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কারণ সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সর্বসম্মত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কিছুটা আ¯’া গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার অসাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে না চাওয়ায় আওয়ামী লীগ জামায়াতসহ আরও কিছু দল নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য জোরালো আন্দোলন করে। এ আন্দোলনের একপর্যায়ে সাংবিধানিকতা বজায় রাখার স্বার্থে বিএনপি সরকার ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করে সে স্বল্পায়ুর সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের বিধানকে সাংবিধানিক ভিত্তি দিলে তখন থেকে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে নবম সংসদ নির্বাচন আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়নি। এ অভিনব প্রকৃতির জর“রি সরকারটির জš§ হয় কিছু মের“দণ্ড-দুর্বল রাজনীতিক, কয়েকজন উ”চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা এবং জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনকারী কতিপয় বিদেশী কূটনীতিকের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। এ সরকারকে সাংবিধানিক বিধি, আয়ুষ্কাল এবং কর্মকাণ্ডের পরিমাপকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলা যায় না। তবে রাজনীতির ব্যাকরণ ভেঙে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুর“ করে মহাজোট সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এখন ফখর“দ্দীন সরকারের অমানবিক অপকর্মগুলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘাড়ে চাপানোর জন্য ওই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে অভিহিত করছেন।
যা হোক গত ২০-২২ বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ায় এ স্বল্পায়ুর সরকারটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করে। তবে রাজনীতিকদের উচিত ছিল সাংবিধানিক ভিত্তি পাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যক্রম ও গতিবিধি লক্ষ্য করে এর যেসব দুর্বলতা পরিলক্ষিত হ”িছল সেগুলো দূর করতে এ ব্যব¯’ার প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। এ লক্ষ্যে কাজ করলে তারা যেসব কাজ করতে পারতেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ”েছ :
ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রথমে সুযোগ পাওয়ার কথা এবং যেহেতু ওই অব¯’ানে কোন বিচারপতি থাকবেন সে বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অংক কষাকষির কারণে বিচারাঙ্গনে রাজনৈতিক দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। শুর“ হয় বিচারপতিদের পদোন্নতির রাজনীতি, সে কারণে এরা এ পদে যাতে বিচারপতিদের সঙ্গে সর্বজনশ্রদ্ধেয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সম্মানিত বরেণ্য শিক্ষাবিদ, খ্যাতিমান সুশীল সমাজের সদস্যদেরও গণ্য করার ব্যব¯’া নিতে পারতেন;
খ. এ অ¯’ায়ী সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বিধান করতে পারতেন;
গ. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টারা ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা গ্রহণ করায় রাজনৈতিক দলের নেতারা ওপরে নিরপেক্ষ পরিচয়ধারী কিš‘ ভেতরে নিজ আদর্শে বিশ্বাসী বর্ণচোরা ব্যক্তিত্বদের তালিকাভুক্ত করার সুযোগ যাতে না পান সেজন্য দলগুলোর কাছ থেকে তালিকা না নেয়ার বিধান চালু করতে পারতেন;
ঘ. এ সরকার দৈনন্দিন র“টিন কাজ ছাড়া যাতে সাহাবুদ্দীন সরকারের শিক্ষা সংস্কার কমিটি বা হাবিবুর রহমান সরকারের মতো নবম বা দশম শ্রেণীতে ধর্ম বিষয়ে পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে জড়িত হয়ে এখতিয়ারবহির্ভূত দায়িত্ব পালন না করে, সে ব্যাপারে ব্যব¯’া গ্রহণ করতে পারতেন; এবং
ঙ. তিন মাস একটি মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কম সময় মনে হলে এ সময় সামান্য বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন।
কিš‘ দুঃখের বিষয় ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন শুর“ হলে এ ব্যব¯’ার নানা ত্র“টি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ সরকার ব্যব¯’ার কোন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে উ”চ আদালতের একটি রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশের ওপর ভিত্তি করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজ, অ্যামিকাস কিউরি এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের পরামর্শ উপেক্ষা করে এ সরকার তড়িঘড়ি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া বাতিল করে। যেসব সমস্যার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যব¯’া প্রবর্তন করা হয়েছিল, ওই সমস্যাগুলো সমাধান না করে, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না করে এ ব্যব¯’া বাতিল করে দেয়ায় দলীয় ব্যব¯’ার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যব¯’া করা হয়। এর ফলে বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজ মনে করে, মন্ত্রী ও এমপিরা নিজ পদে থাকা অব¯’ায় দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হওয়ার মতো পরিবেশ দেশে এখনও তৈরি হয়নি। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং ওই আন্দোলন হরতাল, রোডমার্চ, সমাবেশ-মহাসমাবেশ, মানববন্ধন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে চলমান রয়েছে, আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান বিরোধী দল তাদের দাবি মেনে নিতে সরকারকে ১০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সরকার দাবি না মানলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করার হুমকি দিয়েছে। এ অব¯’ায় কোন সংলাপ না হওয়ায় এবং সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দল পরস্পরবিরোধী অব¯’ান গ্রহণ করায় দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও সংঘাতের আশংকা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরি¯ি’তির সঙ্গে ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময়কার পরি¯ি’তির অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। ওই সময় সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায়নি, কিš‘ আওয়ামী লীগ-জামায়াতের কঠোর আন্দোলনের চাপে অনেক দেরি করে হলেও একপর্যায়ে আরেকটি নির্বাচন করে সংবিধানের সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এখনও কি পরি¯ি’তি সে রকম? এখনও সরকার কিছুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চাইছে না, আর বিরোধী দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে না। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে যা”েছ এবং সে আন্দোলনের অংশ হিসেবে যুগপৎ নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মুক্ত ও অবাধ সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুর“ত্ব অনুধাবন করাতে সমর্থ হয়েছে। এ কারণে ১০ জুনের আলটিমেটাম শেষে হয়তো বিরোধী দল আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির দিকে এগিয়ে যাবে। তবে সরকারও পরি¯ি’তি পর্যালোচনা করে বুঝতে পেরেছে যে, পুলিশের পিটুনি আর মামলা দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্দলীয় সরকারের আন্দোলন থেকে হয়তো ফেরানো যাবে না। বিরোধী দলের আলটিমেটাম নিকটবর্তী হওয়ায় সরকারের বক্তব্যে ইদানীং কিছুটা হলেও নমনীয়তা লক্ষ্য করা যা”েছ।
সরকারি দলের নেতারা প্রথমে বলেছিলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়েছেন, কাজেই এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, আমাদের দেশেও তেমনিভাবেই অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সুকৌশলে অ-তত্ত্বাবধায়ক, অসাংবিধানিক ফখর“দ্দীন-মইনউদ্দিন জর“রি সরকারের কুকর্মের দায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপিয়ে এ সরকারকে ‘দানব’ বলে অভিহিত করে এর সমালোচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। কিš‘ সরকারি দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ দলীয় সরকারের চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তারা মনে করে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও এ দেশে তৈরি হয়নি। এ কারণে বিরোধী দল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে যে আন্দোলন করা হ”েছ সে আন্দোলন নাগরিক সমাজের সমর্থন পা”েছ। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিরোধীদলীয় আলটিমেটাম শেষ হওয়ার প্রাক্কালে সরকারদলীয় নেতারা কিছুটা নমনীয় সুরে কথা বলছেন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অনড় অব¯’ান থেকে সরে এসে এখন তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে সংলাপ করতে চাইছেন।
এ বিষয়ে ২৭ মে ১৪ দলীয় বৈঠকের পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যব¯’ার রূপরেখা নিয়ে আলোচনার পথ সব সময় খোলা রয়েছে, তবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যব¯’া নিয়ে নয়।’ সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্যে যেমন সমঝোতার সুর ধ্বনিত হয়; তেমনি আবার যখন তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা যে এখনই চূড়ান্ত করতে হবে তা আমি মনে করি না। এ নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট সময় রয়েছে’, তখন মনে হয় তার এ বক্তব্য সহিংসতা ও সংঘাতকে প্রশ্রয় দি”েছ। কারণ, যে ইস্যু নিয়ে মাসের পর মাস আন্দোলন চলছে, দেয়া হ”েছ হরতাল, রোডমার্চ, মহাসমাবেশ, আলটিমেটাম ও পরবর্তী সময়ে আসছে আরও কঠোর কর্মসূচি, সে ইস্যুটি যদি দ্র“ত সমাধান করা যায় তাহলে এটাই কি সবার জন্য ভালো নয়? সরকারি দল চাইছে বিরোধী দলকে চাপে রেখে তাদের দিয়ে এ বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করাতে। কারণ, বিরোধী দল কোন প্রস্তাব উত্থাপন করার পর সরকারি দলের পক্ষে তা নাকচ করা বা তাকে ভিন্ন রূপ দিয়ে পাস করানোর মতো সংসদীয় শক্তি রয়েছে। বিরোধী দলও সহজে সরকারি দলের ফাঁদে পা দিতে চাইছে না। তারা বলছে, সমস্যাটি সরকারি দল তৈরি করেছে, কাজেই এর সমাধান-উদ্যোগও সরকারি দলকেই নিতে হবে। কারণ এ উদ্যোগকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেয়ার শক্তি একমাত্র সরকারি দলেরই রয়েছে।
সরকারি দল ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বলে আলোচনা করতে চাইলে সমস্যার সমাধান হবে না এবং এ ব্যাপারে বিরোধী দলও আকৃষ্ট হবে না। তাদের ঝেড়ে কাশতে হবে। এ সম্ভাব্য আলোচনার আগে একটি মাত্র বিষয় তাদের পরিষ্কার করতে হবে, আর তা হল তাদের উল্লিখিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারদলীয় নাকি নির্দলীয় হবে। যদি সরকার এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্দলীয় চরিত্র প্রদানে রাজি হয়, তাহলে আর এ বিষয়ে সংলাপে বিরোধী দলের রাজি না হওয়ার কোন কারণ থাকবে না। আর এ নিয়ে সংলাপ করতে পারলে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে এ সরকারের বাকি বৈশিষ্ট্য কেমন হবে সে বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে পারবে। এর মধ্যে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে তা হ”েছ এ সরকারের সদস্যদের নির্বাচিত হতে হবে নাকি নির্বাচিত না হলেও চলবে; এর প্রধান উপদেষ্টা কে কী প্রক্রিয়ায় মনোনীত হবেন; এর সদস্য সংখ্যা কত হবে; তারা কিভাবে মনোনীত হবেন; এর আয়ুষ্কাল ও কর্মপরিধি কেমন হবে; সরকারের মন্ত্রী-নেতারা এতে জড়িত থাকবেন কিনা প্রভৃতি। সময় থাকলেও এ আলোচনা যত দ্র“ত হবে, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল। কারণ বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দল আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েই যাবে, আর আন্দোলন কর্মসূচি মানেই পুলিশের পিটুনি, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা, গ্রেফতার এবং এসবের মধ্য দিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষ সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব দেখতে চায় না, তারা চায় উভয় দল সমঝোতার ভিত্তিতে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কর“ক। এ সমঝোতা প্রক্রিয়ায় যে দল যত গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে, নাগরিক সমাজে সে দলের তত বেশি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। আর মুক্ত ও অবাধ নির্বাচন হলে এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে সে দল নির্বাচনে ততই এগিয়ে যেতে পারবে। সরকারের নাম কী হবে, তাতে কিছুই এসে যায় না। সম্ভাব্য সরকারের নাম যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয় তাতে কেউই কোন আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না, যদি ওই সরকার নির্দলীয় চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ধশযঃবৎসু@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন