বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

নজর“লকে কেন প্রয়োজন




সৌমিত্র শেখর
বারবার কেন ফিরে আসে জ্যৈষ্ঠ, কেন ফিরে আসে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ের কথাÑ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন কাজী নজর“ল ইসলাম? এ শুধু মাস ফিরে আসা নয়, বৃষ্টি-বাদল আর ঝঞ্ঝার আগমন সমারোহ, তা-ও নয়; এ হল অবিনাশী চেতনার বিদ্যুৎরেখার ঝলকানিÑ নজর“ল যার নাম। কী হবে এ ধরনের নিবন্ধ লিখে? দৈনিক পত্রিকার পাতায় এত বার্ষিক স্মরণ-সংখ্যা! যেহেতু শ্রদ্ধার সঙ্গে যা দান করা হয় তা-ই শ্রাদ্ধ, তাই এ ধরনের সংখ্যাকে আমি শ্রাদ্ধ-সংখ্যা বলি। শ্রাদ্ধ-সংখ্যাগুলো গতানুগতিক মনে হয় কারও কাছে। পত্রিকার লাখো বিক্রীত কপির মধ্যে এ লেখাগুলোর পাঠক হাতেগোনা, তা-ও মানি। এগারোই জ্যৈষ্ঠের দিনেও ক’জন বাঙালি মনে করি নজর“লকে? তবে কি নজর“ল আছেন শুধু আনুষ্ঠানিকতায় আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বইয়ের পাতায়?
নজর“লকে নিয়ে হুজুগ উঠেছিল একদিন, নজর“ল যখন জীবিত ও কর্ম¶ম তখনই। নজর“ল তা জানতেন। তাই তার একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন : ‘যুগের না হই হুজুগের কবি’। সে হুজুগ আজও চলছে; তবে অন্যভাবে। নজর“লের সময়কার হুজুগটা ছিল বৈরী অবস্থার মধ্যে। ‘গুর“’ তাকে বলছেন, তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাছতে যেও নাÑ সাহিত্যের মধ্যে ঢুকিও না স্থ‚ল বিষয়। প্রাচীনপন্থী সাহিত্যিকরা বলছেন, গতানুগতিকতাকে ধ্বংস করে এ কোন সৃষ্টিছাড়ার উদ্ভব হল! ওদিকে ধর্মবিচারে হিন্দুরা বলছেন নেড়ে আর মুসলিমরা তাকে বলছেন কাফের কাজী। সমকালীন এ বৈরী-বা¯—বতায় নজর“ল ‘সৃষ্টিসুখের উল­াসে’ নতুন পথের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যের ধারাকে।
নজর“ল যে সময়ে লিখেছেন, সে সময়টা ছিল আবদ্ধ পরিপার্শ্বে ঔপনিবেশিক প্রাচীরঘেরা। ফলে মুক্তপ্রাণ নজর“ল সাহিত্যেই শুধু থাকলেন না, এলেন রাজনীতিতেও। বন্ধন ছিন্ন করাই যার আজš§ বাসনা, তিনি বৃত্তবদ্ধ থাকবেন কেন? লেখার ‘অপরাধে’ জেলে গেলেও জেল থেকে ফিরে এসে লেখাকে ‘গুডবাই’ তিনি জানাননি। তিনি জানতেন, যে কারণে তিনি জেলে গেছেন তা শাসক ব্রিটিশদের কাছে অপরাধতুল্য হতে পারে, কিন্তু তার কাছে সেটা সত্য-জ্ঞাপন। আর কবিরাই তো সত্য-জ্ঞাপন করবেন, যে কোন অবস্থাতেই। তিনি নিজেকে ‘কবি’ বলে গর্ববোধ করতেন। তার লেখা চিঠিগুলো পড়লে এই গর্বের উষ্ণতা মেলে। রাজনীতিতে এসে সত্যি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন পুরো ব্যবস্থাকে। বাংলাদেশের একটি অঞ্চল থেকে নির্বাচনেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় মানুষ নির্বাচিত করেননি নজর“লকে। নির্বাচনে তিনি জামানত হারিয়েছিলেন। বলা হয়, গণমানুষ সব সময় ঠিক কাজটি করে। এ ¶েত্রেও কি করল? তারা কি নজর“লকে জানিয়ে দিল, তোমার কাজ শিল্প-সাহিত্যে, রাজনীতিতে নয়। নজর“ল এ থেকে শি¶া নিয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে তিনি ধীরে ধীরে সরে গেলেন। রাজনীতি ছাড়লেন, কিন্তু চেতনা ছাড়লেন না। চেতনাটাই আসল। মাটির নিচের ফল্গুধারার মতো, যেটা বয়ে চলে নীরবে, লোকচ¶ুর আড়ালেÑ অনš—কাল। নজর“ল-চেতনাটা কী? তার লেখা পড়লে এই চেতনার আভা পেতে মোটেই কষ্ট হয় না। সাম্য-মৈত্রী-¯^াধীনতার যে আপ্ত অভিধা আমাদের জানা, তার সঙ্গে ‘মানবতা’ জুড়ে দিলেই নজর“ল-চেতনাকে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়। এ¶েত্রে নজর“লের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ পাঠ ও বিশে­ষণ করাই যথেষ্ট।
কিন্তু সে পাঠ ও বিশে­ষণ করা হল না। নজর“ল শারীরিকভাবে জরাগ্র¯— হলেন অল্প বয়সে এবং এর কিছুকাল পরেই ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে সৃষ্টি হল ¯^াধীন দেশ ভারত ও পাকি¯—ান। পাকি¯—ান আমলে সরকারি পর্যায়ে নজর“ল চর্চার ¯^রূপটা দেখলে নজর“ল-চেতনার অপমান কোন অবধি করা হয়েছিল, তা স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়। নজর“লের লেখার পূর্ণ উদ্ধৃতি না দিয়ে তার লেখা থেকে ধর্মীয় বিশেষ অংশগুলো নানাভাবে ব্যবহার করে প্রকৃত অর্থে নজর“লকে খÊিতই করা হয়। নজর“ল কবিতায় লেখেন ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’Ñ কিন্তু পাকি¯—ান আমলে তা করা হয় ‘সজীব করিব গোর¯—ান’। এ শুধু মামুলি শব্দ পরিবর্তন নয়, নজর“ল-চেতনার অবমাননা। তিনি বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িকতায়, উদার দেশপ্রেমে আর মুক্ত মানবতায়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৩ অগ্রহায়ণ লেখা এক চিঠিতে নজর“ল বলেছেন : ‘আমি মুসলমানÑ কিন্তু আমার কবিতা সকল দেশের, সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দু-কবি, মুসলমান-কবি ইত্যাদি বলে বিচার করতে গিয়েই এত ভুলের সৃষ্টি! আমি আপাতত শুধু এইটুকুই বলে রাখি যে, আমি শরিয়তের বাণী বলিনিÑ আমি কবিতা লিখেছি। ধর্মের বা শাস্ত্রের মাপকাঠি দিয়ে কবিতাকে মাপতে গেলে ভীষণ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। ধর্মের কড়াকড়ির মধ্যে কবি ও কবিতা বাঁচেও না, জš§ও লাভ করতে পারে না।’ (রচনাবলি, ১৯৯৬, চতুর্থ খÊ; পৃ. ৩৭১) 
পাকি¯—ান আমলে নজর“লকে নিয়ে হুজুগ সৃষ্টি হয়েছে এবং যারা এ হুজুগ সৃষ্টি করেছিলেন তারা নজর“লের এই কথা বা এ ধরনের বক্তব্যকে মোটেই মান্য করেননি। পাকি¯—ান আমলে সৃষ্ট নজর“ল-হুজুগ অনেকটাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিজাত। নজর“লের সমকালে তিনি যে হুজুগ তুলেছিলেন তার মধ্যে কোন কোটারি উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল সৃজনবেদন, গতানুগতিকতাকে পাল্টে দিয়ে নতুন পথ তৈরির আগ্রহ। কিন্তু পাকি¯—ান আমলে উদ্দেশ্যটাই মুখ্য। কুউদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বিবেচনা করে তার সমাš—রালে মুসলিম কবি নজর“লকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করা হল। কিন্তু নজর“ল ধর্মের পরিচয় কোন পর্যš— ব্যবহার করতে চাইতেনÑ যে উদ্ধৃতি ওপরে উলে­খ করা হল, তার বিচার উদ্দেশ্যবাদীরা করেননি। নজর“লের ¯^াভাবিক অবস্থা থাকলে এর প্রতিবাদ করতেন নিশ্চয়ই।
প্রতিবাদ কি হয়নি এর? নজর“ল অসুস্থ হলেও তিনি যে চেতনার জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, সে আগুন কি সবখানে ছড়িয়ে যায়নি? গেছে। বৃত্তে থেকেই বৃত্ত ভেঙেছে মানুষ। ¯^াধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় তার প্রমাণ। ‘নমঃ নমঃ নমো বাঙলা দেশ মম/চির-মনোরম চিরমধুর/বুকে নিরবধি বহে শত নদী/চরণে জলধির বাজে নূপুর।’ নজর“ল ইসলাম এই গান লিখে নিজে একে ‘¯^দেশী গান’ বলে উলে­খ করেছেন তার রচনায়। এখানে ধর্ম মুখ্য নাকি মুখ্য ¯^দেশ বাংলার রূপৈশ্বর্য? যারা নজর“লকে বিশেষ ধর্মের নকিব বলে অভিহিত করেন তারা এই গানকে কী বলবেন? আসলে এই ‘নমঃ নমঃ নমো’ তো হিন্দুর মন্ত্র নয়, এ হল ¯^দেশের প্রতি সর্বাঙ্গ প্রণিপাতের বিনম্র ধ্বনি। পুরো গানে বাংলাদেশের যে রূপ বর্ণনা করা হয়েছে, এত একনিষ্ঠতায় অনেক কবিই গান লিখতে পারেননি। সব মানুষ সর্বদা নজর“লের লেখা পড়েন, এ কথা সত্য নয়। ইচ্ছে থাকলেও সাধারণ মানুষের নজর“লের রচনা না পড়ার বা¯—ব কারণ আছে। সব সময় না পড়লেও নজর“ল-চেতনার যে আবহ, তার প্রভাবমুক্ত ক’জন সাধারণ মানুষ? সমস্যা শি¶িতজনের মধ্যে। যারা ইচ্ছে করে নজর“লকে খÊিত করতে চান, তাদের মধ্যে। তবে ইতিহাস সা¶্য দেয়, নজর“লকে খÊিত করার যতবার অপপ্রয়াস গৃহীত হয়েছে, ততবারই তা প্রতিহত হয়েছে নজর“ল-চেতনার দ্বারাই। তাই দৈনিক পত্রিকার এ ধরনের সংখ্যাকে আমি শ্রাদ্ধ-সংখ্যা বলি আর যে নামেই ডাকি না কেন, এর পাঠক-সংখ্যা অংকের বিচারে যত কমই হোক না কেন, সার্বিক বিচারে নজর“ল-চেতনা প্রসারে এর ভ‚মিকাও অসামান্য। নজর“ল নিজেও একাধিক পত্রিকা বের করেছিলেন। তিনিও জানতেন সেগুলোর পাঠক-সংখ্যা অংকের বিচারে বেশি নয়। কিন্তু শত দীপশিখা যেমন অনাবিল দীপাবলি ছড়ায়, তেমনি চারদিকে শুভকর্মের যত বেশি আয়োজন তা ততই বিভ্রাšি—র অমানিশা দূর করে আলোকিত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সহায়ক সুনিশ্চয়।
সম্প্রতি নজর“ল-বিষয়ে আবার হুজুগের যে ঢেউ পরিদৃষ্ট হচ্ছে তা নজর“ল-চেতনার সম্পূরক কতটুকু, ভেবে দেখা প্রয়োজন। নজর“ল মানেই নির্দিষ্ট কিছু কবিতা বা গান নয়; নজর“ল মানেই এগারোই জ্যৈষ্ঠ বা বারোই ভাদ্র নয়। এমনকি নজর“ল ইসলাম আজ কোন ব্যক্তিমাত্রও নন। নজর“ল একটি আদর্শের নাম, মহান চেতনার প্রকাশ। তিনি একটি প্রবন্ধে (‘আমার সুন্দর’) লিখেছেন : ‘কোনোদিন আমার নেতা হবার লোভ হয়নি, আজও সে লোভ হয় না। আমার কেবলই যেন মনে হত, আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি। জাতি-ধর্ম-ভেদ আমার কোনোদিনও ছিল না, আজও নেই।’ কবিতায় যিনি বলেন : ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান’Ñ প্রবন্ধ বা গদ্যেও তিনি প্রকারাš—রে একই কথা বলেছেন। মানুষের সমমর্যাদার ধারণাটিই প্রশ্নবিদ্ধÑ জাতীয় পরিমÊলে এবং আš—র্জাতিক পরিসরেও। এই জিজ্ঞাসা থেকে পরিত্রাণের উপায় সন্ধানের জন্যই নজর“লকে প্রয়োজন। তার কবিতা, গানের পাশাপাশি প্রবন্ধ, অভিভাষণ ও চিঠিপত্রসমূহ এ¶েত্রে গভীর একনিষ্ঠতাসহ অধ্যয়নের দাবি রাখে।
ড. সৌমিত্র শেখর : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ংপঢ়পফঁ@মসধরষ.পড়স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন