সৈয়দ আবুল মকসুদ
রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পাবলিকের, অর্থাৎ ভোটারদের কোনোরকম কুটুম্বিতা নেই। ভোটারদের সবারই বাপ-মা আছেন। অনেকের আছেন শ্বশুর-শাশুড়ি। কারও সৎ শ্বশুর-শাশুড়ি, কারও চাচা-মামা, ফুফা-খালু। কারও বেয়াই, ভায়রা, জেটেস ও শালা-শালী। ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সে রকম কোনো আত্মীয়তা বা কুটুম্বিতার সম্পর্ক নেই। যখন যাকে উপযুক্ত ও যোগ্য মনে করেন, তখন ভোটাররা তাঁকে ভোট দেন। অনন্তকালের জন্য তাঁরা কাউকে নির্বাচিত করেন না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন তাঁরা। তবে আবার এবং বারবার পুনর্নির্বাচনের সুযোগও থাকে।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনে মানুষ সামনের দিনগুলোতে কী করবে, তার নানা রকম ছক কাটে। যার ঘরে সেয়ানা মেয়ে আছে, সে চায় আগামী বছর তাকে একটি রোজগেরে ছেলের হাতে তুলে দিতে। যার নিজস্ব বাড়িঘর নেই, সে চায় তার সাধ্যমতো একটি বাড়ি বানাতে। কেউ ভূমিহীনদের কোটায় কাঠা দুই খাস জমির বরাদ্দ চায়। কেউ গুলশান, বারিধারা, উত্তরা বা তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বরাদ্দ চেয়ে সফল হয়। কেউ অন্য কোনো জরুরি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে পাবলিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাবতে থাকে একটি নতুন নির্বাচনের কথা। যে সরকার তারা আগেরবার নির্বাচিত করেছিল, তাকেও তারা পুনর্বার নির্বাচন করে রেখে দিতে পারে, তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। সেটা একেবারেই পাবলিকের ব্যাপার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের হাত নেই। তারা দুটি পক্ষ মাত্র। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে পক্ষ তিনটি: সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক।
পাবলিক বা জনগণের একটি সামষ্টিক সত্তা রয়েছে। একটি সমষ্টিগত মন রয়েছে। সেই মনের আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একবার তারা চায় এই দল ক্ষমতায় যাক, কখনো চায় এই দল ক্ষমতা থেকে সরে যাক। অন্য কেউ ক্ষমতায় আসুক। সে যে-ই হোক। সে রকমই তারা চেয়েছিল ১৯৫৪-তে, সত্তরে, একানব্বইয়ে, ছিয়ানব্বইতে, ২০০১-এ এবং হালে ২০০৮-এ। ২০১৪ সালের জন্য নিশ্চয়ই ভোটাররা মন ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু পাবলিক বড় চাপা স্বভাবের। মুখ খুলে আগে কিছু বলে না।
এ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে যাঁরা ক্ষমতায় গেছেন গণরায় নিয়ে, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন জিনিসটা হলো সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি কায়দা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন হয় সরকারে যাওয়ার জন্য যেমন, তেমনি সরকার থেকে সরে যাওয়ার জন্যও। যদিও সেটা বড়ই বেদনাদায়ক ব্যাপার। সত্যিকারের গণতন্ত্রে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যতই কাকুতিমিনতি কর কেউ বলুক, অথবা আবদার করুক ‘আর একটা টার্ম’ থাকতে দাও; পাবলিক তা শোনে না। জোর করে, ষড়যন্ত্র করে, ‘আর একটা টার্ম’ থাকার চেষ্টা যে সরকারই করেছে তারা আর গণতন্ত্রী থাকেনি। পাবলিকের ইচ্ছা পূরণের নাম গণতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের খায়েশ পূরণকে গণতন্ত্র বলে না। তার নাম স্বৈরতন্ত্র।
ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল নয়, পাবলিকও জানে, ২০১৪-এর জানুয়ারিতে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। সরকার বলছে, কেন নির্বাচন করব না, এক শ বার করব। এবং সংবিধান অনুযায়ী করব। সংবিধানে যা লেখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নির্বাচন করব। বিরোধী দল তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পাবলিক সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো টেলিভিশনে কথা বলতে পারে না, তাই তাদের বয়ানটা জানা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখ-মুখ দেখে আঁচ করা যায়।
সরকার সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়াচড়া করতে চায় না। সেই নড়ন-চড়ন হবে নাকি ‘অসাংবিধানিক’। তাদের সেই যুক্তিও শিরোধার্য। আসলেই তো সংবিধানের বাইরে এক চুল যাওয়াও ঘোরতর অপরাধ। যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সাবালক হয়ে ওঠেনি এমন কোনো কিশোর বা কিশোরী যদি সরকারকে প্রশ্ন করে: ২০০৮ সালে আপনারা যে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন তা কীভাবে করলেন? কোন সংবিধানের অধীনে করেছেন? সেটা যদি বর্তমান সংবিধান না হয়ে থাকে, তা হলে সেই নির্বাচনের বৈধতা কোথায়? কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও মৃত্যুশয্যা থেকেও প্রশ্ন তুলতে পারেন; সরকার মহোদয় বলুন, যে সংবিধান আপনাকে অস্তিত্ব দান করেছে, সেই সংবিধানকে আপনি অসম্মান করতে পারেন না। তাতে আপনি নিজেকেই অসম্মান করছেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধান থেকে আপনি সুবিধা নিয়েছেন। এখন ওই সংবিধানকে আপনি খিস্তিখেউড় করছেন। এ কোন ধরনের নৈতিক অবস্থান? যাকে গ্রামের লোকে বলে: গাঙ পার হইলে মাঝি হয় হালা (শালা অর্থাৎ স্ত্রীর ছোট ভাই)।
টিভির পর্দা থেকে শোনা গেছে, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে। এই কথা শুনে পাবলিকের পিলে চমকে উঠলেও, এই ঘোষণায় বিন্দুমাত্র দোষ নেই। একেবারে খাঁটি সংবিধানসম্মত কথা। এবং এই ঘোষণার পর পাবলিক সেই অনাগত নির্বাচনের ফলাফলটাও পুরোপুরি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের বরাত ছাড়াই যদি কল্পনা করে, তা হলে তা সংক্ষেপে হবে এ রকম: ১৪ দলীয় মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ আসন এবং ১৮ দলীয় পাতিজোট ১৭ এবং স্বতন্ত্র একজন।
ব্যক্তির বা কলাম লেখকদের অনুমানের মতোই পাবলিকের সব অনুমান যে নির্ভুল তা নয়। কিন্তু পাবলিকের পিলে চমকানোর কারণ কী? কারণ তাদের ইম্পিরিক্যাল মাইন্ড বা বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মন। তারা গত তিন বছরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা তিনশ বছরের অভিজ্ঞতার সমান। তাদের কোনো পুঁথিগত ও পত্রিকাগত বিদ্যার পুঁজি নেই, যা আছে তা সবই তাদের নিজের অভিজ্ঞতা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কী বলল, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কী কী লিখল, দ্য ইকোনমিস্ট কী বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দিল, তার কোনো মূল্য নেই বাংলার পাবলিকের কাছে। কোথায় কোন মতলবে কে কী করছে তা তারা জানে, কে কী করতে পারে, তাও তারা জানে।
বাংলাদেশের পাবলিকের কাছে এই দেশ তাদের অতি প্রিয় মাতৃভূমি। কিন্তু অনেকের কাছেই বাংলাদেশ একটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো যদি আগামী নির্বাচনের আগে আগে বাংলাদেশেও ওই একই দশা হয়, তা ঠেকায় কার বাবার সাধ্য? যদি দৈববাণীর মতো ঘোষিত হয়: নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকব, সেটাই বা ঠেকাবে কে? রাজধানীর ব্যাপারে যা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?
সেই পরিস্থিতি হওয়ার আগে একটি নিখুঁত সাংবিধানিক পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের সব বড়-মাঝারিকে জামাই আদরে কাশিমপুর প্রাসাদে রাখার পর, খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা মারার ‘অপরাধে’ সাজা হিসেবে মাইনাস করে দিয়ে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা অগ্রিম নির্বাচন দেওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগাম নির্বাচন দেওয়া দোষের নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কেবিনেট সহকর্মীরা পদত্যাগ করবেন এবং বশংবদ একদল লোক বা ভাঁড়দের নিয়ে গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকার করবে অতি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তো আছেই। এ ব্যাপারে প্রধান ডিপ্লোম্যাট ও ডিপুটি প্রধান ডিপ্লোম্যাটদের পটাতে পারলেই হলো। দেশে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার থাকলেই হলো। হামিদ কারজাই রয়েছেন, নুরি আল মালিকিও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষতি কী?
সরকার যদি অতি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বলে, তোমরা নির্বাচন নির্বাচন করে চেঁচাচ্ছ, এই নাও, দিয়ে দিলাম একেবারে আগাম নির্বাচন। বিরোধীদের সবাই কাশিমপুর প্রাসাদে থাকার ফলে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলারও কেউ থাকবে না যে: তোমরা বরং আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাক। আমাদের প্রস্তুতি নেই। দাঁড়া করানোর মতো প্রার্থীও নেই। তোমরাই থাক ক্ষমতায়, এত তাড়াহুড়োর কী আছে!
কষ্ট করে এখন আর কোনো ব্যারিস্টারকে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙার দরকার নেই। কোনো দল ভাঙার চেয়ে দলের মেরুদণ্ড ভাঙা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একদিকে সব নেতা কারাগারে, অন্যদিকে এক ব্যারিস্টার বাইরে। কার মনে কী আছে তা ৫ তারিখের পর বোঝা যাবে। বিএনপির যাঁরা কাশিমপুর ফটকে ঢুকতে রাজি হবেন না, তাঁদের যদি কিছু আশ্বাস ও উপহার দিয়ে ঠান্ডা রাখা যায়, তার চেয়ে সহজ উপায় আর হতে পারে না। যদি কাউকে কাউকে বলা হয়, তোমাদের অমুক অমুককে নির্বাচন করিয়ে সংসদে আনব এবং মতৈক্যের সরকার করে দুটো মন্ত্রিত্বও দেব, তাতে গররাজি হবেন এমন মানুষ বাংলার মাটিতে একুশ শতকে বিরল। জোটের এক নেতা মাইনাস ওয়ানের কথা মুখ ফসকে বলেননি। তিনি জেনেশুনেই বলেছেন।
যুগে যুগে পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলায়, কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর মন বদলায় না হাজার বছরেও। কিছুটা হতাশা ও না-পাওয়ার ব্যথায় বিমর্ষ কিছু ছদ্মবাম বা কমিউনিস্ট তাদের নেতাদের মাঠে নামিয়ে, তাঁদের কয়েকটি আসন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, একটি বহুদলীয় নির্বাচন করার চেষ্টাও যে সফল হবে তা মনে হয় না। মাঝখান থেকে তাঁরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর করে কোমরের ব্যথা বাধাবেন। পাবলিক ছদ্মবামদের মতো চালাক নয় বটে, কিন্তু তারা গোঁজামিল জিনিসটা বোঝে। এবং দেশের সঙ্গে ও গণতন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁদের খুব সহজেই চিনে ফেলেন।
পরীক্ষায় যেমন প্রশ্নপত্রে কয়েকটি বিকল্প থাকে, তেমনি সরকারের পরিকল্পনারও কয়েকটি বিকল্প আছে বলে পাবলিক মনে করছে। সবগুলো বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথটিই পাবলিক পছন্দ করে। সেই সহজ পথটি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। কথাটা নির্মম মনে হলেও এবং তা সাহস করে বলাও মুশকিল, তা হলো, আগামী অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি পরাজিতও হয় তা হবে দলের জন্য গৌরবের। তাতে প্রমাণিত হবে আওয়ামী লীগ সাচ্চা গণতন্ত্রী দল। আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় তেলেসমাতির নির্বাচনে, যেমন নির্বাচন করেছিলেন একাত্তরে টিক্কা এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদ, আওয়ামী লীগ যদি ২২০ আসন পায় তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী। একেবারে রীতিমতো বিষপানে আত্মহত্যা।
বিএনপি যদি মনে করে যে বাংলাদেশের সব লোক তাদের লেজ ধরেই বসে থাকবে—তা এক বড় নির্বুদ্ধিতা। আওয়ামী লীগকে জনগণ ক্ষমতা থেকে সরালে তাদেরই যে পাবলিক ক্ষমতায় বসাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কোন অবস্থায় কারা কখন সামনে চলে আসেন, রাজনীতিতে সে সম্পর্কে আগাম বলা সম্ভব নয়। পাবলিকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সুতরাং একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে একটি পালাবদল ঘটবে। বাংলাদেশের পাবলিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের খাস তালুকের প্রজা নয়। তারা কারও গোলামি করা পছন্দ করে না। তারা প্রত্যেকেই মাত্র একবার বিশ্বাস করে—দুবার নয়। কিন্তু কিছুটা দয়াপরবশ বা নিরুপায় হয়ে তারা দুই দলকে দুবার বিশ্বাস করেছিল। আর করবে না।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা শুধু বিধাতাই বলতে পারেন। আমাদের মতো পাবলিক আশা করে, যা কিছুই হোক, ভালোয় ভালোয় হোক। লগি, বৈঠা ও কাটা রাইফেলের এস্তেমাল চাই না। বাস ও গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলুক, তা দেখতে চাই না। রাস্তার মধ্যে পেটের দায়ে দলীয় কর্মীর প্রক্সি দেওয়া তরুণের লাশ পড়ে থাকুক তাও কাম্য নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কী বলল, তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের পাবলিক কী বলে এবং আমাদের বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি-বিবেক কী বলে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনে মানুষ সামনের দিনগুলোতে কী করবে, তার নানা রকম ছক কাটে। যার ঘরে সেয়ানা মেয়ে আছে, সে চায় আগামী বছর তাকে একটি রোজগেরে ছেলের হাতে তুলে দিতে। যার নিজস্ব বাড়িঘর নেই, সে চায় তার সাধ্যমতো একটি বাড়ি বানাতে। কেউ ভূমিহীনদের কোটায় কাঠা দুই খাস জমির বরাদ্দ চায়। কেউ গুলশান, বারিধারা, উত্তরা বা তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বরাদ্দ চেয়ে সফল হয়। কেউ অন্য কোনো জরুরি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে পাবলিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাবতে থাকে একটি নতুন নির্বাচনের কথা। যে সরকার তারা আগেরবার নির্বাচিত করেছিল, তাকেও তারা পুনর্বার নির্বাচন করে রেখে দিতে পারে, তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। সেটা একেবারেই পাবলিকের ব্যাপার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের হাত নেই। তারা দুটি পক্ষ মাত্র। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে পক্ষ তিনটি: সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক।
পাবলিক বা জনগণের একটি সামষ্টিক সত্তা রয়েছে। একটি সমষ্টিগত মন রয়েছে। সেই মনের আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একবার তারা চায় এই দল ক্ষমতায় যাক, কখনো চায় এই দল ক্ষমতা থেকে সরে যাক। অন্য কেউ ক্ষমতায় আসুক। সে যে-ই হোক। সে রকমই তারা চেয়েছিল ১৯৫৪-তে, সত্তরে, একানব্বইয়ে, ছিয়ানব্বইতে, ২০০১-এ এবং হালে ২০০৮-এ। ২০১৪ সালের জন্য নিশ্চয়ই ভোটাররা মন ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু পাবলিক বড় চাপা স্বভাবের। মুখ খুলে আগে কিছু বলে না।
এ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে যাঁরা ক্ষমতায় গেছেন গণরায় নিয়ে, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন জিনিসটা হলো সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি কায়দা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন হয় সরকারে যাওয়ার জন্য যেমন, তেমনি সরকার থেকে সরে যাওয়ার জন্যও। যদিও সেটা বড়ই বেদনাদায়ক ব্যাপার। সত্যিকারের গণতন্ত্রে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যতই কাকুতিমিনতি কর কেউ বলুক, অথবা আবদার করুক ‘আর একটা টার্ম’ থাকতে দাও; পাবলিক তা শোনে না। জোর করে, ষড়যন্ত্র করে, ‘আর একটা টার্ম’ থাকার চেষ্টা যে সরকারই করেছে তারা আর গণতন্ত্রী থাকেনি। পাবলিকের ইচ্ছা পূরণের নাম গণতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের খায়েশ পূরণকে গণতন্ত্র বলে না। তার নাম স্বৈরতন্ত্র।
ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল নয়, পাবলিকও জানে, ২০১৪-এর জানুয়ারিতে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। সরকার বলছে, কেন নির্বাচন করব না, এক শ বার করব। এবং সংবিধান অনুযায়ী করব। সংবিধানে যা লেখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নির্বাচন করব। বিরোধী দল তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পাবলিক সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো টেলিভিশনে কথা বলতে পারে না, তাই তাদের বয়ানটা জানা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখ-মুখ দেখে আঁচ করা যায়।
সরকার সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়াচড়া করতে চায় না। সেই নড়ন-চড়ন হবে নাকি ‘অসাংবিধানিক’। তাদের সেই যুক্তিও শিরোধার্য। আসলেই তো সংবিধানের বাইরে এক চুল যাওয়াও ঘোরতর অপরাধ। যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সাবালক হয়ে ওঠেনি এমন কোনো কিশোর বা কিশোরী যদি সরকারকে প্রশ্ন করে: ২০০৮ সালে আপনারা যে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন তা কীভাবে করলেন? কোন সংবিধানের অধীনে করেছেন? সেটা যদি বর্তমান সংবিধান না হয়ে থাকে, তা হলে সেই নির্বাচনের বৈধতা কোথায়? কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও মৃত্যুশয্যা থেকেও প্রশ্ন তুলতে পারেন; সরকার মহোদয় বলুন, যে সংবিধান আপনাকে অস্তিত্ব দান করেছে, সেই সংবিধানকে আপনি অসম্মান করতে পারেন না। তাতে আপনি নিজেকেই অসম্মান করছেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধান থেকে আপনি সুবিধা নিয়েছেন। এখন ওই সংবিধানকে আপনি খিস্তিখেউড় করছেন। এ কোন ধরনের নৈতিক অবস্থান? যাকে গ্রামের লোকে বলে: গাঙ পার হইলে মাঝি হয় হালা (শালা অর্থাৎ স্ত্রীর ছোট ভাই)।
টিভির পর্দা থেকে শোনা গেছে, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে। এই কথা শুনে পাবলিকের পিলে চমকে উঠলেও, এই ঘোষণায় বিন্দুমাত্র দোষ নেই। একেবারে খাঁটি সংবিধানসম্মত কথা। এবং এই ঘোষণার পর পাবলিক সেই অনাগত নির্বাচনের ফলাফলটাও পুরোপুরি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের বরাত ছাড়াই যদি কল্পনা করে, তা হলে তা সংক্ষেপে হবে এ রকম: ১৪ দলীয় মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ আসন এবং ১৮ দলীয় পাতিজোট ১৭ এবং স্বতন্ত্র একজন।
ব্যক্তির বা কলাম লেখকদের অনুমানের মতোই পাবলিকের সব অনুমান যে নির্ভুল তা নয়। কিন্তু পাবলিকের পিলে চমকানোর কারণ কী? কারণ তাদের ইম্পিরিক্যাল মাইন্ড বা বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মন। তারা গত তিন বছরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা তিনশ বছরের অভিজ্ঞতার সমান। তাদের কোনো পুঁথিগত ও পত্রিকাগত বিদ্যার পুঁজি নেই, যা আছে তা সবই তাদের নিজের অভিজ্ঞতা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কী বলল, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কী কী লিখল, দ্য ইকোনমিস্ট কী বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দিল, তার কোনো মূল্য নেই বাংলার পাবলিকের কাছে। কোথায় কোন মতলবে কে কী করছে তা তারা জানে, কে কী করতে পারে, তাও তারা জানে।
বাংলাদেশের পাবলিকের কাছে এই দেশ তাদের অতি প্রিয় মাতৃভূমি। কিন্তু অনেকের কাছেই বাংলাদেশ একটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো যদি আগামী নির্বাচনের আগে আগে বাংলাদেশেও ওই একই দশা হয়, তা ঠেকায় কার বাবার সাধ্য? যদি দৈববাণীর মতো ঘোষিত হয়: নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকব, সেটাই বা ঠেকাবে কে? রাজধানীর ব্যাপারে যা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?
সেই পরিস্থিতি হওয়ার আগে একটি নিখুঁত সাংবিধানিক পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের সব বড়-মাঝারিকে জামাই আদরে কাশিমপুর প্রাসাদে রাখার পর, খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা মারার ‘অপরাধে’ সাজা হিসেবে মাইনাস করে দিয়ে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা অগ্রিম নির্বাচন দেওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগাম নির্বাচন দেওয়া দোষের নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কেবিনেট সহকর্মীরা পদত্যাগ করবেন এবং বশংবদ একদল লোক বা ভাঁড়দের নিয়ে গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকার করবে অতি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তো আছেই। এ ব্যাপারে প্রধান ডিপ্লোম্যাট ও ডিপুটি প্রধান ডিপ্লোম্যাটদের পটাতে পারলেই হলো। দেশে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার থাকলেই হলো। হামিদ কারজাই রয়েছেন, নুরি আল মালিকিও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষতি কী?
সরকার যদি অতি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বলে, তোমরা নির্বাচন নির্বাচন করে চেঁচাচ্ছ, এই নাও, দিয়ে দিলাম একেবারে আগাম নির্বাচন। বিরোধীদের সবাই কাশিমপুর প্রাসাদে থাকার ফলে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলারও কেউ থাকবে না যে: তোমরা বরং আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাক। আমাদের প্রস্তুতি নেই। দাঁড়া করানোর মতো প্রার্থীও নেই। তোমরাই থাক ক্ষমতায়, এত তাড়াহুড়োর কী আছে!
কষ্ট করে এখন আর কোনো ব্যারিস্টারকে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙার দরকার নেই। কোনো দল ভাঙার চেয়ে দলের মেরুদণ্ড ভাঙা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একদিকে সব নেতা কারাগারে, অন্যদিকে এক ব্যারিস্টার বাইরে। কার মনে কী আছে তা ৫ তারিখের পর বোঝা যাবে। বিএনপির যাঁরা কাশিমপুর ফটকে ঢুকতে রাজি হবেন না, তাঁদের যদি কিছু আশ্বাস ও উপহার দিয়ে ঠান্ডা রাখা যায়, তার চেয়ে সহজ উপায় আর হতে পারে না। যদি কাউকে কাউকে বলা হয়, তোমাদের অমুক অমুককে নির্বাচন করিয়ে সংসদে আনব এবং মতৈক্যের সরকার করে দুটো মন্ত্রিত্বও দেব, তাতে গররাজি হবেন এমন মানুষ বাংলার মাটিতে একুশ শতকে বিরল। জোটের এক নেতা মাইনাস ওয়ানের কথা মুখ ফসকে বলেননি। তিনি জেনেশুনেই বলেছেন।
যুগে যুগে পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলায়, কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর মন বদলায় না হাজার বছরেও। কিছুটা হতাশা ও না-পাওয়ার ব্যথায় বিমর্ষ কিছু ছদ্মবাম বা কমিউনিস্ট তাদের নেতাদের মাঠে নামিয়ে, তাঁদের কয়েকটি আসন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, একটি বহুদলীয় নির্বাচন করার চেষ্টাও যে সফল হবে তা মনে হয় না। মাঝখান থেকে তাঁরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর করে কোমরের ব্যথা বাধাবেন। পাবলিক ছদ্মবামদের মতো চালাক নয় বটে, কিন্তু তারা গোঁজামিল জিনিসটা বোঝে। এবং দেশের সঙ্গে ও গণতন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁদের খুব সহজেই চিনে ফেলেন।
পরীক্ষায় যেমন প্রশ্নপত্রে কয়েকটি বিকল্প থাকে, তেমনি সরকারের পরিকল্পনারও কয়েকটি বিকল্প আছে বলে পাবলিক মনে করছে। সবগুলো বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথটিই পাবলিক পছন্দ করে। সেই সহজ পথটি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। কথাটা নির্মম মনে হলেও এবং তা সাহস করে বলাও মুশকিল, তা হলো, আগামী অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি পরাজিতও হয় তা হবে দলের জন্য গৌরবের। তাতে প্রমাণিত হবে আওয়ামী লীগ সাচ্চা গণতন্ত্রী দল। আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় তেলেসমাতির নির্বাচনে, যেমন নির্বাচন করেছিলেন একাত্তরে টিক্কা এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদ, আওয়ামী লীগ যদি ২২০ আসন পায় তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী। একেবারে রীতিমতো বিষপানে আত্মহত্যা।
বিএনপি যদি মনে করে যে বাংলাদেশের সব লোক তাদের লেজ ধরেই বসে থাকবে—তা এক বড় নির্বুদ্ধিতা। আওয়ামী লীগকে জনগণ ক্ষমতা থেকে সরালে তাদেরই যে পাবলিক ক্ষমতায় বসাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কোন অবস্থায় কারা কখন সামনে চলে আসেন, রাজনীতিতে সে সম্পর্কে আগাম বলা সম্ভব নয়। পাবলিকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সুতরাং একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে একটি পালাবদল ঘটবে। বাংলাদেশের পাবলিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের খাস তালুকের প্রজা নয়। তারা কারও গোলামি করা পছন্দ করে না। তারা প্রত্যেকেই মাত্র একবার বিশ্বাস করে—দুবার নয়। কিন্তু কিছুটা দয়াপরবশ বা নিরুপায় হয়ে তারা দুই দলকে দুবার বিশ্বাস করেছিল। আর করবে না।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা শুধু বিধাতাই বলতে পারেন। আমাদের মতো পাবলিক আশা করে, যা কিছুই হোক, ভালোয় ভালোয় হোক। লগি, বৈঠা ও কাটা রাইফেলের এস্তেমাল চাই না। বাস ও গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলুক, তা দেখতে চাই না। রাস্তার মধ্যে পেটের দায়ে দলীয় কর্মীর প্রক্সি দেওয়া তরুণের লাশ পড়ে থাকুক তাও কাম্য নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কী বলল, তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের পাবলিক কী বলে এবং আমাদের বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি-বিবেক কী বলে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন