বদিউর রহমান
বেশি সিরিয়াস লেখা নাকি ভালো নয়। হালকা রসালো লেখার মাধ্যমে যদি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা যায় এবং পাঠককেও আনন্দ দেয়া যায়, তা নাকি লেখকের সার্থকতা। এমন কথা কোন পÊিত ব্যক্তি থেকে শোনার পর আমারও তেমন লেখার খায়েশ হয়, কিন্তু হালকা-রসালো কথার মাধ্যমে সিরিয়াস ভাব প্রকাশ করার যে কৌশল এবং দ¶তা প্রয়োজন তা রপ্ত করতে অনেক সময় লাগে। তারপরই মুনশিয়ানা জাহির করা সম্ভব। এতদসত্তে¡ও প্রবাদে আছে, গাইতে গাইতে গায়েন আর লিখতে লিখতে লেখক। আজ বড় বেশি মনে পড়ে কবির সেই হƒদয়গ্রাহী ঘোষণাÑ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জš§ভ‚মি। কবি কি বুঝেছিলেন যে আমাদের দেশ দশকের পর দশক ‘রানী শাসিত’ থাকবে? সেজন্যই কি আমার জš§ভ‚মিকে রানী বলেছিলেন? নাকি কবি ইতিহাস থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে, অন্য দেশের রাজারা আমাদের দেশকে দখল করে উপভোগ করার জন্য রানীর মর্যাদায় রেখেছিলেন? আসলে কবিরা মনের খেয়ালে কী উদ্দেশ্যে কখন কী লেখেন তা তারাই ভালো বোঝেন, কিন্তু পরে আমাদের বিদগ্ধ পÊিত ব্যক্তি, গবেষক এবং ‘আলতু ফালতু’ গুণীজনরা যে যার মতো করে সময় এবং ¶মতার ভাব বুঝে তার কবিতার এবং কাজের কত যে প্রশংসা করেন, সমালোচনা করেন, আর ব্যাখ্যা দেন তার ইয়ত্তা নেই।
ভালো, এসব না হলে তারাই বা বাঁচবেন কী নিয়ে আর বিখ্যাত হবেন কী করে? পেশাগতভাবে যে যার কর্ম নিয়ে সমাজে টিকে থাকতে চায়, টিকে থাকেও। কবি লেখক, সুশীল-আঁতেল, কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকÑ সবাই ¯^-¯^ কর্মে ব্য¯—। তবে আমার বিশ্বাস, মূলত তিনটি শ্রেণী দেশের জন্য বা¯—ব অবদান রাখেন। এক. কৃষক-শ্রমিক যারা মাঠে আর কলকারখানায় প্রত্য¶ উৎপাদনে ব্য¯— অর্থাৎ যে কোন বা¯—ব অর্থকড়ি উৎপাদনশীলতার অংশীদাররা, দুই. এই উৎপাদনের উদ্যোক্তা এবং বিপণনকারী যেমন ব্যবসায়ী আর শিল্পপতিরা, তিন. রাজনীতিকরা, যারা দেশ পরিচালনায় নীতিনির্ধারণে সব কর্মকাÊের মূল নিয়ামক শক্তি। আর বাকিরা এদের কাজকর্ম নিয়ে কথা বলে, লিখে, প্রশংসা করে, সমালোচনা করে, প্রচার করে, নিজেরাও একটা শ্রেণী বা গোষ্ঠী হিসেবে সমাজে টিকে থাকে, বিখ্যাত হয়। বড় অবদান রাখা ¯^ীকৃত শ্রেণী রাজনীতিকদের নিয়েই কিন্তু অন্য সবার আলোচনা-সমালোচনা বেশি। আর বড় মাপের ¯^ীকৃত শ্রেণী হিসেবেই এ রাজনীতিকদের ‘হামবড়া’ ভাব এবং দুর্নীতি-সন্ত্রাসের ¯^রূপটাও যেন মানুষের চোখে পড়ে বড় বেশি। শ্রেষ্ঠ রং সাদার উপরের দাগ যেন বড় প্রকট।
‘সকল দেশের রানী’ এ দেশটি বিশেষত রাজনীতিকদের অপকর্মে এক সময়ে যেন ‘বাজিকরের খপ্পরে’ পড়ে গেল। টেন্ডারবাজি কে করছেÑ রাজনীতিক অথবা তাদের আÊাবাচ্চারা; সন্ত্রাস কে পালন করছেÑ তাও ‘গুণধর’ রাজনীতিকরাই; শি¶াঙ্গনে খুনাখুনি, মারামারি কাদের অবদান, তাও এ রাজনীতিকদেরই চেলাচামুÊাদের। অতএব এদের ঘিরেই সব কাজ। অন্যকিছু কাজ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের হলেও সেগুলো পরিমাণগত ও গুণগত মানে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক গÊির সঙ্গে সংশিষ্টতা বিবেচনায় সংঘটিত কর্মকাÊের তুলনায় নস্যি। দৃশ্যমান বড় সব ঘটন, অঘটন, হামলা-মামলা সবই তো রাজনীতিকেন্দ্রিক। হত্যাকাÊে বলা হোক আর মিটিং-মিছিলেই বলা হোক, আন্দোলনে-অবরোধে বলা হোক আর হরতাল-ধর্মঘটেই বলা হোক, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতেই বলা হোক আর মা¯—ানি-সন্ত্রাসেই বলা হোকÑ সবই ধরতে গেলে রাজনীতিকেন্দ্রিক, হয় সরাসরি রাজনৈতিক ডাকে নচেৎ রাজনৈতিক ইন্ধনে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÊ, জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকাÊ থেকে শুর“ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া-আহসানউলাহ মাস্টার হত্যাকাÊ, ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমাবাজি, অন্য অনেক আলোচিত হত্যাকাÊ, রাজপথে মিছিল-মিটিং-বোমাবাজি-অগ্নিসংযোগ, লাগাতার হরতাল, ধর্মঘট, শি¶াঙ্গনে সন্ত্রাস, অস্থিরতা, ইলিয়াস গুমÑ সবটাতেই প্রত্য¶ বা পরো¶ভাবে রাজনীতি জড়িত। ফলে দেশের উন্নয়নে রাজনীতিকদের প্রশংসা যেমন প্রাপ্য, তেমনি অপশাসন আর দুঃশাসনের জন্য তাদের দায় এবং সমালোচনা এড়ানোরও কোন সুযোগ নেই। দোষ-গুণ সব মিলিয়েই তারপরও রাজনীতিকরাই আমাদের শেষ ভরসাস্থল। এর কোন বিকল্প আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই রাজনৈতিক সরকার বিকল্পহীন।
কিন্তু হালে আমাদের কিছুসংখ্যক রাজনীতিকের কথাবার্তা আমাদের যেন এমন ¯^ীকৃত ভরসাস্থলের অব¶য় নিয়ে ভাবিয়ে তোলে। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, আমরা অনিচ্ছা সত্তে¡ও কষ্ট পাইÑ এভাবে চলতে থাকলে সত্যি সত্যি রাজনীতি আমাদের শেষ ভরসাস্থলরূপে টিকে থাকবে তো? আগে একবার দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে এক বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘কম খাওয়া’ তত্ত¡ আর এক অর্থমন্ত্রীর ‘বাজারে কম যাওয়ার তত্ত¡’ আমাদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। জনগণের সঙ্গে প্রহসনেরও একটা মাত্রা থাকে। নিজেদের ব্যর্থতা ¯^ীকার করে নমনীয় হওয়ার পরিবর্তে তাদের রূঢ় আচরণ আমাদের কষ্ট দিয়েছিল। তারও আগে আরেক ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘আলাহর মাল আলাহ নিয়ে গেছেন’ শুনে তো আমরা আর আজরাইলকে কিছু বলা থেকেই বিরত হয়ে গিয়েছিলাম। কোন সময়ের এক প্রধানমন্ত্রীর মুখে সংসদেই ‘চুপ-বেয়াদব’ আর আরেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে ‘নিশি কুটুম্ব’ শুনে আমরা আমাদের নেতৃত্বের ‘ওজন’ মাপার চিš—া করেছিলাম। তারপর সংসদেই খি¯ি— খেউর আর নিষিদ্ধ পলীর উলেখে কোন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের ‘উপহার’ তো সরাসরি সম্প্রচারে আমরা দেখলাম, আমাদের বাচ্চারাও সংসদ সদস্যদের কাছে থেকে সংসদীয় ভাষার নমুনা দেখলেন। আমরা কেবল দেখেই যাচ্ছি, আমরা কেবল শুনেই যাব। আমাদের চোখ দুটো স্রষ্টা এখনও খোলা রেখেছেন, আমাদের কান দুটোও এখনও শ্রবণশক্তির যোগ্য রেখেছেন তিনি। কিন্তু যারা বলছেন, তারা কি তাদের কানে তাদের বক্তব্য পরেও আর শুনতে পান না, তারা কি পরেও আর পুনঃসম্প্রচারে তাদের কাÊ দেখতে পান না? তারা হয়তো নিজেদের কাÊ-বক্তব্য দেখেনও না, শুনেনও না। অতএব এক বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়তো তখন ¶োভে আর অš—র্জ্বালায় বলে ফেলবেনÑ দেশ এখন ‘বাজিকরের খপ্পরে’।
এতদিন হয়তো আমরা ভালোই ছিলাম, দেশ বাজিকরের খপ্পরে ছিল। আদৌ দেশ বাজিকরের খপ্পরে ছিল কিনা তা নিয়ে প¶ে-বিপ¶ে কম লেখালেখি হয়নি, আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। যার যার দৃষ্টিভঙ্গিতে, হোক তা নির্দলীয় কিংবা দলীয়, হোক তা নৈর্ব্যক্তিক কিংবা ব্যক্তিক (ঙনলবপঃরাব ড়ৎ ংঁনলবপঃরাব), যথেষ্ট বিশেষণ হয়েছে। কেউ কেউ বাজিকরের খপ্পরের বক্তাকেও বেশ ‘নিয়েছেন’। আর রাজনীতিকরা তো দলীয় বিবেচনায় সব সময় একচোখা, ¯^ার্থের বেলায়ই শুধু তারা হয়ে যান এক এবং নির্দলীয় বা সর্বদলীয়। ¶মতাসীনরা র“ষ্ট হলেন, আর বিরোধীরা বক্তব্যটাকে লুফে নিলেন। এক সময় সময়ের কারণে বাজিকরের খপ্পরের খবর শেষ হল, শুধু মাঝে মাঝে উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহƒত হতে থাকল।
কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের বক্তব্যগুলো যেন ছোট গল্প, শেষ হয়েও হয় না শেষ। তারা একেকজন একেক সময়ে চমক সৃষ্টি করেন। দলের বড় পদধারী, মন্ত্রিত্বেও বেশ প্রভাবশালী, পদবিতেও সম্ভ্রাš— শ্রেণীর একজন যখন সীমাš— হত্যা নিয়ে মশকারা করে ফেলেন, তখন যেন মনে হয় ফেলানীর ঝুলš— লাশ কাঁটাতারে ঝুলে আসলেই ধন্য হয়েছে, প্রতিবেশী বড় দেশ যেন ‘ঠিক’ কাজটিই করেছে। এরশাদের মন্ত্রী ছিলেন, বড় আমলাও ছিলেন, এখন আওয়ামী বড় মন্ত্রী, তিনি যখন ‘রাবিশ’ বলতে বলতে রাবিশকেই অপমান করে ফেলেন তখন আমরা বোকা বনে যাই। আসলে আমরা তো বোকাই, না হলে তো আমরাও তাকে বারবার ‘রাবিশ মন্ত্রী’ বলে সম্মান করতে পারতাম। আমরা যে তাকে ওই ‘সম্মান’ এখনও দিচ্ছি না, সেজন্য তিনি যেন আমাদের ¶মা করেন। এবার আবার সেই সম্ভ্রাš— মন্ত্রী নোবেল পুরস্কারের নতুন যোগ্যতা জানালেন আমাদেরÑ একটু চিপস-স্যান্ডউইচ আর ‘সাদা পানি’ খেলে নাকি তেমন কিছু পাওয়া যায়। তাই যদি হয়, তিনি পান না কেন? তিনি কি চিপস-স্যান্ডইউচ আর ‘সাদা পানি’ বিদেশী শহরে খান না, না খেতে পারেন না? শাšি—তে নোবেল পুরস্কার শাšি— চুক্তি ¯^া¶রকারী এক নেতা যদি পেয়ে যেতেন তাহলে হয়তো এত কথা হতো না, কোথাকার কোন এক ইউনূস পেলেন বলেই তো এত উষ্মা, নাকি?
হায়রে সম্ভ্রাšে—র নমুনা, হায়রে আমার বড় দলের বড় পদধারীর ‘ওজন’ আর ‘র“চি’। কোন চানাচুরও হয়তো এর চেয়ে বেশি সম্ভ্রাš— হতে পারে। আরেকজনের দয়ায় মন্ত্রী হওয়ার আগে আরেক মন্ত্রী আর আমি এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় লিখতাম। তিনি কেমন ছিলেন তা তো তখন অনুমান করতে পেরেছি। মন্ত্রী হয়ে তো এক দেশীয় পণ্যের এমন সুনাম গাইলেন যে ওই পণ্যওয়ালারা তাকে ‘বিজ্ঞাপনে’ ব্যবহার করবেন অনেকবার। মনে হতো, তিনিও যেন ধন্য হলেন। এখন দেখি তিনিও বড় মাপের দু’ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তামাশা করেন, উপদেশ দেন। অবশ্যই ওই দু’ব্যক্তিত্বের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু এ মন্ত্রী সাহেব কোন ধৃষ্টতায় এভাবে বললেন? তিনি কি ‘জাতে’ উঠে ‘কাউকে’ বেশি তুষ্ট করতে চাচ্ছেন? সব দেখে আরেক বিজ্ঞ ব্যক্তি, এরশাদের আমলের অ্যাটর্নি জেনারেল, বড় দু’নেতার ‘উকিল’ বলেই ফেললেনÑ বোঝেন, আমরা কত বড় বেকুবের দেশে আছি। এসব দেখেশুনে কেন জানি কেবল ভয় হয়, কবির ‘সকল দেশের রানী’ থেকে বাজিকরের খপ্পরে পড়ে বেকুবের দেশ হয়ে ওই মন্ত্রীদের জন্য আবার কোথায় যেতে হয়।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন