রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

লাঞ্ছিত গণতন্ত্র ও বিদেশি পরামর্শ


 ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ  

দে শের রাজনৈতিক মঞ্চ এখন যেভাব মুখরিত তাতে মুক্তমনের দেশপ্রেমিক মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পারে না। সরকারি এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতির মধ্যে চলমান দূরত্ব ও সাংঘর্ষিক অবস্থা প্রতিদিন এতটা বাড়ছে যে, কোনো পক্ষের প্রতিই মানুষ আর ভরসা রাখতে পারছে না। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতাউত্তরকাল থেকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই করেছে পূর্ব বাংলার মানুষ। আমাদের পূর্বসূরি রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। ব্যক্তিগত ও দলীয় চাওয়া পাওয়ার চেয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে মানুষের মুক্তি খুঁজেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রণোদনায়ও অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সময়ের বাস্তবতায় বেশিদূর এগোয়নি। তাই সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধদশক না যেতেই গণতন্ত্রের টিম টিমে শিখাটি বলা যায় নির্বাপিতই হয়ে গেল। তার বদলে যা বক্তৃতার শব্দমালায় রাজনীতিকরা ছড়াতে লাগলেন তা গণতন্ত্রের নকল। কাঁচের শোকেসে সাজানো গণতন্ত্রের রেপ্লিকা। রাজনীতিতে দুর্নীতি, পরমত অসহিষ্ণুতা, কঠিন দলতন্ত্র, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া ও কুক্ষিগত করার কালো প্রবণতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্রমে ফিকে করে দিচ্ছে। এভাবে আমাদের রাজনীতির সুবিধাবাদী চরিত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনাকে লাঞ্ছিত করছে প্রতিদিন।
রাষ্ট্র পরিচালক ও বিরোধী রাজনীতিকদের আচরণ দেখে তাদের দলপ্রেম ও গোষ্ঠীপ্রেম যতটা স্পষ্ট হয়—দেশপ্রেমের চেতনার জায়গাটি ততটাই অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে। আর দেশপ্রেমহীন রাজনীতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না—মানুষের মুক্তিতো নয়ই। গণতান্ত্রিক চেতনা নেই বলে বিরোধী দল ও সরকার এবং সরকারি দলের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য ক্রমে প্রলম্বিত হয়। এ সময়ের প্রধান বিরোধী দল দীর্ঘ সময় সরকারে থেকে দুর্নীতি, দলতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র শক্তিশালী করতে যতটা ঘর্মাক্ত ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ততটাই ছিল নির্লিপ্ত। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র না থাকায় জবাবদিহিতার বালাই ছিল না। গণতন্ত্র শব্দটিকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকাকেই আরাধ্য বিবেচনা করেছে। তাই জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপি সে সময়ের বাস্তবতায় একটি আধুনিক রাজনীতির প্রত্যয় জাগিয়ে তারুণ্যকে আকৃষ্ট করলেও পরের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের হাতে এর স্বাভাবিক বিকাশ থেমে গেল। গণতন্ত্রের টুটি চেপে ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা করতে বিএনপি নেতৃত্ব ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’ বলে এক অদ্ভুত জিকির তুললো। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়েতে ইসলামীকে বন্ধু বানিয়ে—সরকার পরিচালনার ভাগীদার করে কলঙ্কিত করলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কোনো দল এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে না।
আওয়ামী লীগের প্রতি অনেক প্রত্যাশা এদেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের। অন্তত ঐতিহ্য ও আদর্শের শক্তি আছে এই দলটির ভেতর। গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যদিয়েই দলটির জন্ম। গণতান্ত্রিক লাড়াইয়ের গৌরবও কম নয় দলটির। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যায় নিহত চার নেতা-উত্তর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কী মেধাবী ছন্দে হাঁটতে পেরেছে? বিরোধী দলে থেকে এবং সরকার পরিচালনায় এসে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে কী হেঁটেছে? ভালো মন্দ মিশিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জিয়াউর রহমানের যেটুকু স্বপ্ন ছিল তা কি ধারণ করতে পেরেছেন তাঁর  উত্তরসূরিরা? নানা অঘটনঘটনপটিয়সী সুবধাবাদী বারোভাজা নেতৃত্বের জালে জড়িয়ে দলটি গণতন্ত্রকে লাঞ্ছিত করেছে বারবার। আওয়ামী লীগের কাছে অভিন্ন ছন্দ আশা করেনি মানুষ। কিন্তু মেধাবী রাজনীতিক শূন্যতা আত্মবিশ্বাসী হতে দেয়নি এযুগের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। তাই মানসিকতা ও আচরণে আওয়ামী লীগ সরকারকে মানুষ বিএনপি সরকারের চেয়ে আলাদা করে দেখতে পারছে না। দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের তাদের ভাগ্যবিধাতা এসব রাজনৈতিক নেতৃত্ব বক্তৃতার শব্দেই শুধু গণতন্ত্রকে আটকে রেখেছেন। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করেছেন দলতন্ত্র আর গোষ্ঠীতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক চেতনাহীনতার কারণে আওয়ামী লীগ বিএনপির অপশাসন থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। প্রশাসনিক ও দলীয় দুর্নীতি থেকে মুক্ত করতে পারেনি সরকার ও দলটিকে। এক এগারোও দলের নেতৃত্বকে কিছু শেখাতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। গণতান্ত্রিক চেতনা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিধায় নির্বাচনে গণমানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনকে শ্রদ্ধা দেখাতে পারেনি। কেবল আত্মম্ভরিতা আর বাগাড়ম্বরের বাড়বাড়ন্ত প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে তিন বছর পার হতে চললো সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে প্রতিদিন। ঘুষ, দুর্নীতি আর দলীয় পেশীশক্তির দখলদারিত্বে বিপন্ন হচ্ছে মানুষ। সরকার পরিচালক আর দলীয় নেতাদের বাগাড়ম্বর ছাড়া বিদ্যুত্ ব্যবস্থার উন্নতির বদলে কেবল অবনতির ছোবল মানুষকে আহত করছে। জনজীবনের অস্বস্তি ছাড়াও দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিল্প ও কৃষি উত্পাদন। শিল্প ও গৃহস্থালীতে গ্যাস সরবরাহে ব্যর্থ সরকার। বিদেশি সংস্থাগুলো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে সরকারকে। মুখ থুবড়ে পড়ছে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অথচ কোনোরকম অবগুণ্ঠন না দিয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের সফলতার জয়গান গাচ্ছেন। দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র না থাকায় জবাবদিহিতার সুযোগ নেই। তাই সরকারি কি বিরোধী দলীয় কোনো রাজনীতিকই দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না।
আমাদের রাজনীতির সংকীর্ণতা, সুবিধাবাদ ও ব্যর্থতা বিশ্বময় দেশকে লাঞ্ছিত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। সমপ্রতি দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে এ সত্যটিই স্পষ্ট হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক এই প্রভাবশালী সাময়িকী সরকারি আচরণের সারবত্তা থেকে রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে সুযোগ পেয়ে যা বলার নয় তাও বলেছে। প্রকাশিত রিপোর্টটির কোনো কোনো অংশ দেশের জন্য অসম্মানের বলেও সচেতন মানুষ মনে করে। রিপোর্টটি শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ বলার কোনো সুযোগ নেই। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মানসিকতা আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে কার্যকর থাকে বলে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন সরকারকে ঘায়েল করতে কোনো পক্ষের প্রভাব এর পেছনে কাজ করতে পারে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথাও কেউ কেউ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। অবশ্য এভাবে ভাবার যুক্তি আছে। এদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সত্য আড়াল করার কিছু নেই। এদেশে আইন সব সময় নিজের পথে স্বাধীনভাবে চলতে পারে তা সাধারণ মানুষ অন্তত বিশ্বাস করে না। কিন্তু ইকনমিস্টের ঢালাও মন্তব্যে মনে হবে দেশে কোনো আইনের শাসন নেই। এ মন্তব্য নিশ্চয়ই দেশবাসী সত্য বলে মানবে না। সরকারের এবং সরকার প্রধানের মন্তব্যে বা নীতি নির্ধারণে অনেক অনমনীয়তা আছে। রাজনৈতিক সহনশীলতার মধ্যদিয়ে এবং গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতা কমিয়ে আনার কিছু কিছু পদক্ষেপ সরকার পক্ষ নিতে পারে। সে পথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তার সরকার তেমনভাবে ভাবছে বলে মনে হয় না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও অগণতান্ত্রিক গোয়ার্তুমি করছে নিজ পক্ষে অনড় থাকায়। এতে নিঃসন্দেহে দেশে রাজনৈতিক সংকট বাড়ছে। কিন্তু এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একটি দায়িত্বশীল কাগজ যখন ঢালাওভাবে লিখে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে ধ্বংস করছে’ তখন তা বিরোধী রাজনৈতিক দলের মেঠো বক্তৃতার মত শোনায়। ইকোনমিস্ট যখন শেখ হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য দিল্লির কাছে অনুরোধ করে তখন কেউ যদি মন্তব্য করে তারা বিএনপি জামায়াতের বক্তৃতা শুনছে তবে খুব অন্যায় বলা যাবে না। আবার রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই বিএনপির উল্লসিত মন্তব্য শুরু হলে অনেকে নিশ্চয়ই মুখ চাওয়া চাওয়ি করেছে। যেমন বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের ডেকে বলে দিলেন এতদিন আমরা যা বলেছি ইকোনমিস্ট এখন তাই লিখেছে। এসব লেখালেখিতে নষ্ট রাজনীতির একপক্ষ উল্লসিত আর অন্যপক্ষ ক্ষুব্ধ হতে পারে কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষ অপমানিত হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে নিজ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য তারা এসব অপরিণামদর্শী সুবিধাবাদী রাজনীতিকদেরই দায়ী করতে চায়। আমাদের রাজনৈতিক দীনতা ও ব্যর্থতার কারণেই বিদেশিরা অযাচিতভাবে পরামর্শক হয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধস্নাত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটু বেশি নাক গলিয়ে ফেলেন। এ বাস্তবতা অত্যন্ত বেদনার সাথে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করে।
এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্যায় আর স্বেচ্ছাচারের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের বিশ্বাস রাজনীতিকদের ওপর দেশবাসীর প্রবল চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া তাদের সুপথে আনা সম্ভব নয়—সম্ভব নয় গণতন্ত্রী করা। আজকের সুবিধাবাদী ও অমেধাবী রাজনীতির দাপটে যখন গণতন্ত্র বিপন্ন তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দলান্ধ নন দলমত নির্বিশেষে এমন দেশপ্রেমিক মানুষদেরই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা মনে করি ক্ষুদ্র লোভের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেমের শক্তি অনুভব করতে পারলেই মানুষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব।  যেহেতু ক্ষমতা কেন্দে র কাছে থাকা রাজনীতিবিদরা এখন আর ক্ষুদ্র দলীয় গণ্ডির বাইরে যেতে পারছেন না, তাদের কর্মে আর আচরণে দেশপ্রেমের লেশ খুঁজে পাওয়া যায় না তাই সুযোগমত মুরুব্বিয়ানা ফলাতে পরামর্শক হয়ে আসেন বিদেশিরা। অথবা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য নষ্ট রাজনীতির মানুষেরাই ডেকে আনেন বিদেশি প্রচার মাধ্যমকে। মাতৃভূমির বুকের ওপর কদর্য পা রেখে প্রভাবিত করেন বিকৃত খবর প্রচারে। আমরা মনে করি সুবিধাবাদী রাজনীতির বলয় মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের পথে না হাঁটতে পারা পর্যন্ত এই ফাঁস আমাদের গলায় আটকেই থাকবে।
n লেখক :অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawazju@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন