শুক্রবার, ২৫ মে, ২০১২

প্রধানমন্ত্রী, দেশটা কি ঠিকমতো চলছে?

ছাত্রলীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসোহরাব হাসান | তারিখ: ২৬-০৫-২০১২ছাত্রলীগের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বাংলাদেশে কী নেই? আমাদের মাটির নিচে প্রচুর জ্বালানিসম্পদ এবং মাটির ওপরে অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ১৬ কোটি মানুষ আছে। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি বাটেক্সপোর ভূতাত্ত্বিকেরা সিলেটের কৈলাসটিলা ও হরিপুরে তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করেছেন। এ জন্য কোনো বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়নি। তাঁরা আশা করছেন, কৈলাসটিলায় ভূপৃষ্ঠের তিন হাজার ২০০ থেকে চার হাজার মিটার গভীরে পাঁচটি স্তরে মোট ১০ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেলের মজুদ আছে। এর মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখ ব্যারেল উত্তোলনযোগ্য। হরিপুরে ভূপৃষ্ঠের দুই হাজার ৬০০ মিটার নিচে তেলের স্তরের অবস্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে মজুদের পরিমাণ দুই কোটি ৮০ লাখ ব্যারেল উত্তোলনযোগ্য। এই সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে অন্তত কয়েক বছরের জ্বালানি চাহিদা মেটানো যাবে।
নিশাত মজুমদার পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেছেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি নারী, যিনি এই বিরল গৌরবের অধিকারী। আমরা এভারেস্ট-কন্যা নিশাত মজুমদার এবং বাটেক্সপোর তরুণ ভূতত্ত্ববিদদের অভিনন্দন জানাই। জ্বালানিসংকটে জর্জরিত বাংলাদেশকে অমিত সম্ভাবনার কথা শোনালেন তাঁরা। সেই সঙ্গে শঙ্কাও আছে, দেশের এই মূল্যবান সম্পদ যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়। ভয়টি এই কারণে যে আশির দশকে এই দুটি ক্ষেত্র আমাদের ভূতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করলেও তৎকালীন এরশাদ সরকার সেখান থেকে তেল উত্তোলনের চেষ্টা না করে বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অতীতে সামরিক শাসকদের দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী অনেক সিদ্ধান্তের কারণে জনগণকে অনেক ক্ষতি ও ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে।

২.
দেশের দুই শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া (যাঁরা পালাক্রমে গত দুই দশক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার আসন অলংকৃত করে আছেন) একে অপরের বিচারের জন্য হুমকি দিচ্ছেন। একই দিনের পত্রিকায় তাঁদের রণহুংকারের বিবরণ ছাপা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার দুর্নীতির বিচার না হলে অন্যদেরও করা যাবে না।’ বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতিতে জড়িত, আমাদের হাতে প্রমাণ আছে। সময়মতো প্রমাণ দেওয়া হবে। দেশে না হলে আন্তর্জাতিকভাবে এসব দুর্নীতির বিচার করা হবে।’ (প্রথম আলো, ২১ মে, ২০১২)
প্রধানমন্ত্রী এখন দেশ চালাচ্ছেন। সরকার চালাচ্ছেন। কেউ দুর্নীতি করলে তার বিচার করা সরকারের দায়িত্ব। যত দূর জানি, বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুর্নীতির একাধিক মামলা বিচারাধীন। অতএব তাঁর দুর্নীতির বিচার না করার প্রশ্ন কেন এল? প্রধানমন্ত্রী কেন ‘তাঁর দুর্নীতির বিচার না হলে অন্যদের করা যাবে না’ বলে দেশবাসীকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন? এর অর্থ কী, সত্যি সত্যি কোনো শক্তি খালেদা জিয়ার বিচার না করার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে?
বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিচার দেশে না হলে আন্তর্জাতিকভাবে করার ঘোষণা দিয়েছেন। কী করে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিচার আন্তর্জাতিকভাবে করবেন? আমরা যত দূর জানি একমাত্র যুদ্ধাপরাধের বিচারই আন্তর্জাতিকভাবে বা আন্তর্জাতিক আদালতে হয়ে থাকে। বিরোধী দলের নেত্রী ইঙ্গিত দিচ্ছেন— প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের এক পা বিদেশে, কখন কী হয়। ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকলে যদি এক পা বিদেশে থাকা হয়, বিরোধী দলের নেতার দুই ছেলেও সপরিবারে বিদেশে আছেন। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, তারও এক পা বিদেশে? এসব হুমকি-পাল্টাহুমকি কিংবা ব্যক্তিগত কুৎসা রাজনীতির ভাষা নয়। দয়া করে এগুলো বন্ধ করুন।
আর বিচারাধীন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীরও বেশি কথা বলা উচিত নয়। বিচার হয় আদালতে। রাজনীতির মাঠে নয়। বরং রাজনীতির মাঠে বিচারের আওয়াজটা জোরেশোরে হলে আদালতের বিচারটা বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের মনে নানা সন্দেহ দেখা দেয়। আপনারা দুই নেত্রী মিলেই তো স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়েছিলেন এবং একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের কথাও বলেছিলেন। ১৯৯২ সালে গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গণ-আদালত গঠিত হলে তৎকালীন বিএনপি সরকার প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করার ওয়াদা করেছিল। সেই ওয়াদা তারা রাখেনি। গণ-আদালত গঠনের দায়ে জাহানারা ইমামসহ ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে দেশদ্রোহ মামলা হয়েছিল। এখন জামায়াত খালেদা জিয়ার আশ্রয়ে আছে আর এরশাদ শেখ হাসিনার মহাজোটে থেকে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন।

৩.
ছাত্রলীগের সংবর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘এখনো সময় আছে ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করে গণতন্ত্রের পথে আসুন। সবকিছু সহ্য করছি বলে এটা আমাদের দুর্বলতা মনে করা ঠিক নয়। যারা পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে, বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগ করে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, এসব নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কীভাবে সঠিক পথে আনতে হয়, তা আমাদের জানা আছে। সেটা আমরা করতে চাই না। আমরা চাই তারা সঠিক পথে চলুক।’ (প্রথম আলো, ১৮ মে ২০১২)
বাংলাদেশের মানুষ ‘সঠিক পথ’ নিয়ে বরাবর বিভ্রান্তিতে থাকে। সরকার যেমন বিরোধী দলকে সঠিক পথে আনতে চায়, তেমনি বিরোধী দলও সরকারকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে কম তৎপর নয়। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তারা দেশবাসীকে ছয় দিনের হরতাল উপহার দিয়েছে। স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যরাতে পরীক্ষার হলে বসতে বাধ্য করেছে। দুই পক্ষের ‘পাতানো খেলায়’ এখন দেশবাসীর জীবন দুর্বিষহ।
প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে চান। খুবই ভালো কথা। বিরোধী দল যদি সংঘাত ছেড়ে শান্তির পথে আসে, তাহলে দেশের মানুষও খুশি হবে। কিন্তু সরকার কি সত্যি সত্যি চায় দেশে শান্তি আসুক, মানুষ স্বস্তিতে থাক? হরতালের নামে বিরোধী দল যেমন জনগণের শান্তি ও স্বস্তি হরণ করছে, তেমনি সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারি দলের ক্যাডাররা কি জনগণের ওপর জবরদস্তি চালাচ্ছে না? দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরোধী দলের সমর্থক ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির প্রায় উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তার পরও জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, কুয়েট, চুয়েট অশান্ত কেন? কেন সেখানে উপদলীয় কোন্দলে মেধাবী ছাত্র জুবায়েররা খুন হন? তাঁর খুনিরা কেন ধরা পড়ে না? কেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছাত্রলীগের মাস্তানদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়? ছাত্র হয়ে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার কুশিক্ষা তারা কোথা থেকে পেল? প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বই তুলে দিয়েছেন। আর তাঁরা সেই বই ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। সম্প্রতি ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের পর পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে রামদা, চাপাতিসহ শতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে।
প্রধানমন্ত্রী যখন বিরোধী দলকে সঠিক পথে আনার কথা বলেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, সরকার কতটা সঠিক পথে আছে? যখন আমরা একজন সাংসদকে বিক্ষোভরত জনতাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়তে দেখি, তখন মনে হয় সরকার ঠিকমতো চলছে না। যখন দুর্নীতির দায়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন আটকে যায়, তখন মনে হয় দেশটা ঠিকমতো চলছে না। যখন দেখি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যা চলে তখন মনে হয় দেশটা ঠিকমতো চলছে না। যখন মহাজোটের দুই সাংসদ একে অপরকে সন্ত্রাসী, ভূমি দখলকারী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেন, তখন ভাবি, কোথাও বড় রকমের গোলমাল আছে। অভিযোগ আছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সাংসদ ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দিন আহমদ যুবলীগের এক কর্মীর কাছে দুই লাখ টাকা উৎকোচ নিয়েও তাঁকে চাকরি দেননি। আরও বেশি টাকা যিনি দিয়েছেন, তিনি চাকরি পেয়েছেন। এর আগে টাঙ্গাইলের আরেকজন সাংসদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ অভিযোগ করেছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। গাইবান্ধা-৫ আসনের সাংসদ ফজলে রাব্বি মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সরকারি দলের সাংসদ মানে কি টাকার খেলা? টিআর-কাবিখার গম আত্মসাৎ করা?
প্রধানমন্ত্রী যখন দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে তাঁর সাফল্য দাবি করেন, তখন বাস্তব অবস্থাটা কী? আমরা বিরোধী দল, নাগরিক সমাজের কাউকে সাক্ষ্য মানছি না। তাহলে প্রধানমন্ত্রী বলবেন, ওরা তো আওয়ামী লীগকে দেখতে পারে না। সমালোচনা করবেই। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠতম সদস্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কী বলছেন? তিনি বলেছেন, ‘দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি। বিচার, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর আদায়কারী সংস্থা থেকে শুরু করে থানা পর্যন্ত এই দুর্নীতি বিস্তৃত।’ ...থানার মূল ব্যক্তি হলেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু পুরো থানাতেই চলে ঘুষ। ( ২০ মে ২০১২ ইত্তেফাক)।
অথচ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার প্রকাশ করেছিল, তাতে পাঁচ অগ্রাধিকারের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। এখানে আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রথম পাঁচ অগ্রাধিকারে দ্বিতীয় ধারাটি হুবহু তুলে ধরছি।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা: দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দপ্তরে গণ-অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী, তিন বছর পাঁচ মাস পর দেখছি এসব প্রতিশ্রুতির কিছুই পূরণ হয়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী দূরের কথা, একমুখী কার্যক্রমও দেখছি না। দেশে ঘুষ দুর্নীতি সমানে চলছে, কালোটাকার দৌরাত্ম্য বাড়ছে। আর গণ-অধিকার এখন গণনিগ্রহে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এসেছিলেন চাকরি ও বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি জানাতে। তাঁরা ফিরে গেলেন পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, বিরোধী দলকে সঠিক পথে আনা যে খুব কঠিন কাজ নয়, তার প্রমাণ আমরা গত দুই সপ্তাহেই পেয়েছি। যাঁরা এত দিন সরকার পতনের আন্দোলন করবেন বলে মাঠ গরম করছিলেন, তাঁরা এখন কারাগারে। কেউ কেউ জামিন পাওয়ার জন্য উচ্চ ও নিম্ন আদালতে দৌড়াদৌড়ি করছেন।
কঠিন হলো নিজের দল ও সরকারকে সঠিক পথে আনা। সেই কাজে প্রধানমন্ত্রী কতটা সফল হয়েছেন?
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন