রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

শত শত কোটি মহাবশ্বি

অনুবাদ : এনামুল হক
এই বিশ্ব সৃষ্টি করতে গিয়ে ঈশ্বরের কোন পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার কাজ করেছিল কিনা সেটা সত্যই আমাকে কৌতূহলী করে তোলে।’ কথাটা আলবার্ট আইনস্টাইনের। আমাদের মহাবিশ্ব সম্ভাব্য একমাত্র মহাবিশ্ব কিনা এমন প্রশ্নকে তিনি এভাবে তাঁর স্বভাবসুলভ কাব্যিক ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রসঙ্গটা এখানে আদৌ বড় নয়। কারণ আইনস্টাইনের প্রশ্নটা ঈশ্বর বা ধর্মসম্পর্কিত ছিল না। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র থেকে এক ও অনন্য মহাবিশ্বই কি বেরিয়ে আসে যেমনটা হলো নীহারিকা এবং গ্রহ-নক্ষত্রে পরিপূর্ণ আমাদের এই মহাবিশ্ব? নাকি আরও মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে যেগুলোতে আছে নানা ধরনের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য?
তিনটি স্বতন্ত্র ঘটনার ব্যাখ্যাদাতারা বলেন, আমাদের মহাবিশ্ব থেকে আলাদা অন্যান্য মহাবিশ্বও আছে। সেগুলোর বেশিরভাগই ভিন্ন ধরনের বস্তকণিকা দ্বারা গঠিত ও ভিন্ন ভিন্ন শক্তি দ্বারা পরিচালিত। বিস্ময়কর রকমের বিশাল এক বিশ্বব্রহ্মা-ে এমন সব মহাবিশ্ব গিজ গিজ করছে। এই সুবিশাল বিশ্বব্রাহ্ম-ই হলো বহুমহাবিশ্ব। পদার্থবিজ্ঞনের গত কয়েক দশকের অগ্রগতি থেকে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যেসব ধারণার আবির্ভার ঘটেছে এ হলো তারই একটি। এই ধারণাটিকে কেন্দ্র করে দুটি শিবিরের মধ্যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে। এক পক্ষের বক্তব্যে হলো বহুমহাবিশ্ব সম্পর্কিত এই ধারণাটি বাস্তব জগত সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির পরবর্তী ধাপ। আবার অন্যপক্ষের বক্তব্য হলো বহুমহাবিশ্ব সম্পর্কিত ধারণাটি নিতান্তই বাজে কথা; তাত্ত্বিকরা তাদের কল্পনায় গাঁজার দম চড়িয়ে এই হাস্যকর ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছেন। 
কাজেই কোন ব্যাখ্যাটি সঠিক? এবং কেনই বা সেটিকে সঠিক বলে গ্রাহ্য করতে হবে? সে প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের প্রথমে মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা প্রয়োজন। 

মহাবিস্ফোরণের সন্ধানে 
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর যাবতীয় গবেষণাকর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্ম ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতত্ত্ব প্রকাশ করেন। এটি ছিল মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অনুধাবন করতে তাঁর দশ বছরের সাধনার পরিণতি। তত্ত্বটি গাণিতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ চমৎকার দৃষ্টান্ত। সেখানে কিছু সমীকরণ দেয়া আছে যা থেকে গ্রহ উপগ্রহের গতি থেকে শুরু করে নক্ষত্রের আলোর আবক্র গমনপথ পর্যন্ত সবকিছুর বিস্ময়কর নির্ভুল ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। 
এর কয়েক বছরের মধ্যে বাড়তি কিছু গাণিতিক বিশ্লেষণে উপসংহার টানা হয় যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়ে চলেছে। প্রতিটি নীহারিকা একে অপরকে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এটা আইনস্টাইনের তত্ত্বেরই কথা। আইস্টাইন প্রথম প্রথম তার নিজের তত্ত্বের এই চমকপ্রদ অন্তর্নিহিত অর্থটির প্রবল বিরোধিতা করলেও ১৯২৯ সালে গভীর মহাকাশ নিয়ে বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবেলের পর্যবেক্ষণ থেকে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। অচিরেই বিজ্ঞানীরা যুক্তি দেখাতে থাকেন যে মহাকাশ যদি এমন প্রসারিত হতে থাকে তাহলে অতীতে মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই আরও অনেক ছোট ছিল। আমরা এখন যা কিছু দেখছি সেই প্রতিটি গ্রহ, প্রতিটির নক্ষত্র, প্রতিটি নীহারিকা এমনকি খোদ মহাশূন্য পর্যন্ত সবকিছু সৃষ্টির জন্য দায়ী উপাদানগুলো সূদূর অতীতের কোন এক সময় অসীম ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যে ঘনীভূত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীকালে তা বাইরের দিকে স্ফিত হতে থাকে এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের পরিচিত মহাবিশ্বের রূপ ধারণ করেছে।
এভাবেই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের জন্ম হয়। পরবর্তী কয়েক দশকে তত্ত্বটি বিপুল পর্যবেক্ষণগত সমর্থন লাভ করে। তথাপি বিজ্ঞানীরা সচেতন ছিলেন যে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের গুরুতর কিছু ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতা আছে। আর সবকিছুর মধ্যে এতে বিস্ফোরণের ব্যাপারটাই বাদ পড়ে গেছে। অর্থাৎ বিস্ফোরণ কিভাবে ঘটেছে তার ব্যাখ্যা মেলেনি। সেকেন্ডেরও অতি ক্ষুদ্র মুহূর্তে মহাবিশ্বের কিভাবে উৎপত্তি হয়েছিল আইনস্টাইনের সমীকরণে তার চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তবে মহাবিশ্বেও আদিমতম মুহূর্তের চরম পরিবেশে প্রয়োগ করা হলে সেই সমীকরণের কোন কার্যকারিতা থাকে না ঠিক যেমন ক্যালকুলেটরে ১ কে শূন্য দিয়ে ভাগ করার চেষ্টা করা হলে ‘মরর’ মেসেজ এসে থাকে। কাজেই খোদ বিস্ফোরণের চালিকাশক্তি হিসাবে কোনটি কাজ করেছিল মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বে তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

মহাজাগতিক জ্বালানি
১৯৮০’র দশকে পর্দাথবিজ্ঞানী এলান গুথ বিগব্যাংতত্ত্বের এক বর্ধিত সংস্করণ হাজির করেন। মহাজাগতিক স্ফীতিতত্ত্ব নামক এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় মহাবিস্ফোরণতত্ত্বের ঘাটতিগুলো দূর করার চেষ্টা করা হয়। গুথের ব্যাখ্যার মূল কথা হলো একটা প্রকল্পিত মহাজাতিক জ্বালানি মহাবিস্ফোরণের ইন্ধন জুগিয়েছিল। সেই জ্বালানি যদি ক্ষুদ্র অঞ্চলে ঘনীভূত অবস্থায় থাকে তাহলে মহাশূন্য ক্ষণিকের জন্য কল্পনাতীত প্রচ- গতিতে বাইরের দিকে প্রসারিত হবে। এ সময় একটা বড় আকারের বিস্ফোরণ ঘটবে। একটা চাদরকে অতিরিক্ত টানটান অবস্থায় প্রসারিত করলে যেমন এর বনুনের বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে তেমনি মহাবিশ্ব প্রচ- গতিতে প্রসারিত হওয়ার কারণে এর তাপমাত্রার সূক্ষ্ম তারতম্যের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়। ১৯৯০-এর দশকের প্রথমদিকে নাসার কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মহাকাশে তাপমাত্রার এই তারমত্য অর্থাৎ কোথাও কিছুটা শীতলতর আবার কোথাও কিছুটা উষ্ণতর স্থান নির্ণয় করা হয়। এই তারতম্য নির্ণয় করার জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল নাসার টিমলিডার জন ম্যথার ও জর্জ স্মুটকে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এই ক্ষেত্রে যে গাণিতিক বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছিল তাতে আরও একটি বিষয় প্রকাশ পায়। সেটা হলো মহাকাশ প্রসারিত হতে থাকায় মহাজাগতিক জ্বালানিও নিজের ঘাটতি পূরণ করে চলে। আর সে কাজটা এতই দক্ষতার সঙ্গে করে যে এর সবটাই খরচ করে ফেরা কার্যত অসম্ভব ব্যাপার। এখানেই এসে যায় বহু মহাবিশ্বের বিষয়টা। তার মানে বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ এক ও অনন্য ঘটনা না হওয়ারই সম্ভাবনা। বরং প্রকৃত ব্যাপারটি এই যে, মহাজাগতিক জ্বালানি আমাদের প্রসারমাণ মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে মহাবিস্ফোরণের ইন্ধনশক্তি হিসাবেই শুধু কাজ করেনি, উপরন্তু আরও অগণিত বিস্ফোরণের ইন্ধন হিসেবেও কাজ করেছে এবং প্রতিটি বিস্ফোরণ থেকে আলাদা আলাদা প্রসারমাণ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে আমাদের মহাবিশ্বটি হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু মহাবিশ্বের এক বিশাল সমষ্টির অংশমাত্র মহাজগতের অসংখ্য প্রসারমাণ বুদবুদের মধ্যে একটি মাত্র প্রসারমাণ বুদবুদ।
বলাই বাহুল্য, এটা একটা সম্ভাবনামাত্র। এই ব্যাখ্যা সঠিক হলে মহাজগত সম্পর্কিত অনেক ধারণাই বদলে ফেলতে হবে। এক সময় আমাদের ধারণা ছিল এই পৃথিবীটা সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। পরবর্তীকালে আমরা জানতে পারি যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুুরপাক খেয়ে চলা বেশ কয়েকটি গ্রহের একটি হলো আমাদের এই পৃথিবী। আরও অনেক পরে আমাদের জানা হয় যে, সূর্যটা রয়েছে মিলকিওয়ে নামক এক নীহারিকার উপকণ্ঠে। আর জানা হয় যে, আমাদের নীহারিকায় যে হাজার হাজার কোটি নক্ষত্র আছে তার একটি হলো আমাদের এই সূর্য। এরপর আমরা জানতে পারি যে, মহাবিশ্বে অবস্থিত শত শত কোটি নীহারিকার একটি হলো আমাদের মিলকিওয়ে। এখন মহাবিশ্বের স্ফীতিতত্ত্ব বলছে যে, শত শত কোটি নীহারিকা, নক্ষত্র ও গ্রহ-উপগ্রহে পরিপূর্ণ আমাদের মহাবিশ্ব সুবিশাল বহুমহাবিশ্বের বুকে অবস্থিত অসংখ্য মহাবিশ্বের একটি মহাবিশ্ব মাত্র। 
অথচ বহুমহাবিশ্বেও তত্ত্বের পথিকৃত আঁন্দ্রেই লিন্ডে ও আলেকজান্ডার ভিলেনকিন সেই ১৯৮০’র দশকে প্রথম এই ধারণা ব্যক্ত করার সময় পদার্থবিজ্ঞানী সম্প্রদায় সেটিকে পাত্তাই দিতে চাননি। অন্যান্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে সেগুলো আমাদের দৃশ্যমান জগতের বাইরেই থাকবে। আমরা শুধু এই মহাবিশ্বকেই দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারি। বাহ্যত অন্য মহাবিশ্বগুলো আমাদের প্রভাবিত করতে পারবে না এবং আমরাও সেগুলোকে প্রভাবিত করতে পারব না।

ডার্ক এনার্জির রহস্য
মহাবিশ্বের প্রসার ঘটে চলেছে এ এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার। তবে এই সম্প্রসারণের একটা দিক প্রায় সবাই স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নিয়েছিল। সেটা হলো একটা বলকে উপরের দিকে ছুড়ে দেয়া হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে যেমন এর উর্ধমুখী যাত্রা মন্থর হয়ে যায় তেমনি প্রতিটি নীহারিকার পারস্পরিক মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানের কারণে মহাশূন্যের বিস্তার নিশ্চয়ই মন্থর হয়ে পড়ছে।
১৯৯০-এর দশকে দু’জন বিজ্ঞানী মহাজাগতিক বিস্তারের গতি মন্থর হয়ে পড়ার হার পরিমাপ করে দেখার উদ্যোগ নেন। বছরের পর বছর ধওে ধৈর্যের সঙ্গে দূরের নীহারিকাগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের আর কালের প্রবাহে কিভাবে বদলে গেছে সে সম্পর্কিত উপাত্ত সংগ্রহ করেন। উপাত্তগুলোর বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। তারা দেখতে পান যে, সম্প্রসারণ মন্থর হওয়া তো দূরের কথা বরং মহাবিশ্ব প্রায় ৭শ’ কোটি বছর আগে মাত্রাতিরিক্ত গতিতে সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করেছে এবং তখন থেকে তার সম্প্রসারণের গতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। ব্যাপারটা এমন যেন একটা বল উপরের দিকে আলতো করে ছুড়ে দেয়া হলো। বলটা প্রথমে মন্থর গতিতে উপরের উঠার পর ক্রমাগত দ্রুত থেকে দ্রুততর অধোমুখে ধাবিত হতে লাগল।
সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এই মহাজাগতিক গতিবৃদ্ধির হেতু খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন। নীহারিকাগুলোর পরস্পর থেকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে সরে যাওয়ার জন্য কোন শক্তি দায়ী? কোন শক্তি ওদের একে অপরের থেকে এভাবে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে? এ ব্যাপারে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উত্তর এসেছে আইনস্টাইনের এক পুরনো ধারণা থেকে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলতে আমরা এমন এক শক্তিকে জানতেই অভ্যস্ত যার কাজ শুধু একটাই বস্তুকে পরস্পরের দিকে টেনে ধরা। কিন্তু আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অন্য একটা কিছুও করতে পারে। এই শক্তি বস্তুসমূহকে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়েও দিতে পারে। সেটা কিভাবে? বেশ তো, চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মতো পরিচিত বস্তুর কথাই ধরা যাক। এরা যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রয়োগ করছে তা নিশ্চয়ই পরস্পরকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু আইনস্টানেই সমীকরণে দেখা যায় যে, মহাশূন্যে যদি অন্য কিছু থেকে থাকে অর্থাৎ দলা দালা পদার্থ নয় বরং অদৃশ্য এনার্জি, মহাশূন্যের সর্বত্র একইভাবে ছড়িয়ে থাকা অদৃশ্য কুয়াশার মতো জিনিস তাহলে সেই কুয়াশার মতো এনার্জি যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রয়োগ করবে তা অবশ্যই হবে বিকর্ষণমূলক। মহাশূন্যে পূর্ণ হয়ে থাকা কুয়াশার মতোই এই অদৃশ্য এনার্জির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এই বিকর্ষণ ক্ষমতাই প্রতিটির নীহারিকাকে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে মন্থর না করে ত্বরান্বিত করে তোলে। এই যে অদৃশ্য এনার্জি এটাকেই এখন বলা হয় ডার্ক এনার্জি। তবে এখানে একটা ফ্যাকরা আছে। মহাজাগতিক সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করে তোলার জন্য মহাবিশ্বের আনাচে-কানাচে সর্বত্র কি পরিমাণ ডার্ক এনার্জি ছড়িয়ে থাকা দরকার তা নির্ণয় করতে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন একটা সংখ্যার সন্ধান পেয়েছেন, যার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেননি। এমনকি কাছাকাছি ব্যাখ্যায়ও নয়। সেটা হলো ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব। সেই ঘনত্ব অসাধারণ ক্ষুদ্র। দশমিকের পর ১২২টা শূন্যের শেষে ১৩৮ বসালে যা দাঁড়ায় তা একই সঙ্গে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র থেকে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু পারেননি। চেষ্টা বহুবার চালানো হয়েছে। তারা উত্তর খুঁজে পাননি। অবশ্য ইলেকট্রন ও কোয়ার্কের মতো পদার্থকণিকার ভরের মতো অনেক কিছুর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যাইনি। তথাপি বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে বাস্তব জগতের মৌলিক গঠন সম্পর্কিত কোন কিছুই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বাইরে থাকবে না। যাই হোক, ডার্ক এনার্জির পরিমাণ নির্ণয়ে শোচনীয় ব্যর্থতা থেকে কিছু কিছু পদার্থবিজ্ঞানী সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ অবলম্বন করছেন। এমনি একটি পথের প্রবক্তাদের দাবি বহু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে। 

(বাকি অংশ আগামীকাল)

(শেষাংশ)
বহু মহাবিশ্বই সমাধান
বিজ্ঞানীদের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিগত পদক্ষেপের শিকড়টা সন্ধান করতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৬০০-এর প্রথমভাগে যখন স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি ভিন্ন সংখ্যা উপলব্ধিতে আনার প্রচেষ্টায় আচ্ছন্ন ছিলেন। সেটা হলো সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যেকার দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল। কেপলার এই দূরত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও পারেননি। আমাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দূরত্বের কারণটা পরিষ্কার। আমরা জানি, অসংখ্য গ্রহ আছে যেগুলো বিভিন্ন দূরত্ব থেকে তাদের জনক নক্ষত্রকে পরিক্রমণ করে চলেছে। কাজেই সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে এই দূরত্বের বিশেষত্ব খুঁজে বের করার জন্য কেপলারের এই সাধনার কোন কারণ ছিল না। পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র কোন নির্দিষ্ট দূরত্বকে বিশেষ বলে চিহ্নিত করে না। সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের বিশেষত্ব শুধু এইটুকু যে, ওই দূরত্বের কারণে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ও তা টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে। সূর্য থেকে পৃথিবী আরও দূরে বা আরও কাছে থাকলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকত না। অথচ কেপলার এই দূরত্বের মৌলিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়ার জন্য শত রকমের চেষ্টা করে অনর্থক হয়রান হয়েছেন।
ডার্ক এনার্জির পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা হয়তো কেপলারের মতোই ভুল করছেন। আমাদের মহাজগত সৃষ্টির সর্বোত্তম তত্ত্বটি হলো স্ফীতিতত্ত্ব। এই তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য মহাবিশ্বের আবির্ভাবের কথা বলে। অগণিত গ্রহ যেমন ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে থেকে তাদের নিজ নিজ নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে তেমনি হয়তো অনেক মহাবিশ্বই রয়েছে যেগুলোর ডার্ক এনার্জির পরিমাণ একেকটির একেক রকম। তাই যদি হয়, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের কাছে ডার্ক এনার্জির একটি নির্দিষ্ট মূল্যের ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করা একটি নির্দিষ্ট গ্রহের দূরত্বের ব্যাখ্যা লাভের চেষ্টার মতোই ভ্রান্তিকর।
ডার্ক এনার্জির অন্যান্য সম্ভাবনা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে পারি। যেসব মহাবিশ্বের বিপুল পরিমাণ ডার্ক এনার্জি আছে যেখানে পদার্থপুঞ্জ যখনই দলা বেঁধে নীহারিকায় পরিণত হবার চেষ্টা করে তখনই ডার্ক এনার্জির বিকর্ষণের ধাক্কা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, পদার্থপুঞ্জ ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যায়। এ কারণে আর নীহারিকা গঠিত হতে পারে না। আবার যেসব মহাবিশ্বে ডার্ক এনার্জির পরিমাণ এতই সাম্যন্য যে সেগুলোর বিকর্ষণ শক্তি পরিবর্তিত হয়ে আকর্ষণ শক্তিতে পরিণত হয়। তার ফলে সেই মহাবিশ্বগুলো নিজ থেকে এত দ্রুত চুুপসে আসে যে, এখানেও নীহারিকা গঠিত হতে পারে না। আর নীহারিকা ছাড়া নক্ষত্র ও গ্রহ- উপগ্রহও থাকতে পারে না। কাজেই এসব মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীর মতো প্রাণের অস্তিত্বের কোন সম্ভাবনা নেই।
সে জন্যই আমরা নিজেদেরকে অন্য মহাবিশ্বে না দেখে এই মহাবিশ্বে দেখতে পাই, ঠিক যে কারণে আমরা নিজেদেরকে নেপচুনে নয় বরং পৃথিবীতে দেখি। কারণ পৃথিবীর পরিবেশ আমাদের মতো প্রাণেরই উপযোগী। আমরা অন্যান্য মহাবিশ্বকে দেখতে না পেলেও তাদের অস্তিত্বের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব আছে। ওগুলো ডার্ক এনার্জির রহস্যের সমাধান এনে দিতে এবং আমাদের কাছে ডার্ক এনার্জির পরিমাণকে বোধগম্য করে তুলতে পারবে।

স্ট্রিং থিওরি
বহু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব প্রমাণের তৃতীয় উপায় হলো স্ট্রিং থিওরি। এটা হলো আইনস্টাইনের একীভূত তত্ত্বের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা অর্থাৎ সকল পদার্থ ও শক্তিকে একটি একক গাণিতিক পর্দায় সেলাই করে গেঁথে ফেলতে পারা। গোড়াতে ১৯৬০ দশকের শেষদিকে এই তত্ত্বটি প্রণীত হয়। সেখানে বলা আছে যে, প্রতি মৌল কণার গভীর অভ্যন্তরে এনার্জির একটি ক্ষুদ্র স্পন্দনরত, সুতোর মতো সূক্ষ্ম তন্তু বা আঁশ রয়েছে। ভায়োলিনের তারের কম্পনের বিভিন্ন প্যাটার্ন থেকে যেমন বিভিন্ন সূর বেরিয়ে আসে, তেমনি এসব ক্ষুদ্র সুতোর বিভিন্ন কম্পন থেকে উৎপত্তি হয় বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণার।
স্ট্রিং থিওরির সমীকরণগুলোর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ থেকে অসংখ্য সমাধান বেরিয়ে আসে। প্রতিটি সমাধান সম্ভাব্য ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নির্দেশক। অসংখ্য সমাধান মানেই হলো অসংখ্য মহাবিশ্ব। আজ এই বিশ্লেষণ থেকে সম্ভাব্য মহাবিশ্বের যে সংখ্যা বেরিয়ে আসে এক কথায় তা প্রায় ধারণাতীত। সংখ্যাটা হলো এর পিছনে ৫০টা শূন্য যোগ করলে যা হয় সেটা।
তবে স্ফীতি তত্ত্ব ও স্ট্রিং তত্ত্ব একসঙ্গে যুক্ত করে মহাবিশ্বের সংখ্যা যা দাঁড়ায় সেটা আমাদের কল্পনাকে হার মানাবে। অসাধারণ কিছু দাবি করলে তার সমর্থনে অসাধারণ প্রমাণেরও দরকার হয়। কাজেই বহু মহাবিশ্বের যে অস্তিত্ব আছে তার প্রমাণ কি? অন্যান্য মহাবিশ্ব যেহেতু আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরে, তাই মনে হতে পারে এর জবাব হবেÑকোন প্রমাণ নেই। তবে সে কথা এত চটজলদি বলার উপায় নেই। এমন অনেক কিছু আছে যার প্রমাণ হয়তো সংগ্রহের পর্যায়ে রয়েছে। যদিও এর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো অধরাই থেকে যায়। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কথাই ধরা যাক। ব্ল্যাক হোলের ভিতর থেকে কোন কিছুই এমনকি আলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারে না। যে কারণে এমন অঞ্চল আমাদের দৃষ্টির অগম্য। আমরা এগুলোকে দেখতে পারি না। তার পরও ব্ল্যাক হোলের ভিতর কি ঘটে বিজ্ঞানীরা সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে বেশ আস্থার সঙ্গেই বলে থাকেন। এর যৌক্তিকতা হলো এই যে, একবার কোন তত্ত্বের সাহায্যে আমাদের দৃশ্যমান কোন কিছুর ব্যাপারে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হলে আমাদের দৃশ্যমান নয় এমন কিছুর ব্যাপারে ওই তত্ত্বের সাহয্যে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই আস্থা অর্জন করতে পারি। কথাটা বহু মহাবিশ্বের বেলায়ও সমান সত্য। আপেক্ষিক তত্ত্বের ভিত্তিতে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী যেমন সঠিক প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বহু মহাবিশ্ব সম্পর্কিত পূর্বাভাসগুলো সম্পর্কে আমাদের আস্থাও কালের প্রবাহে বৃদ্ধি পাবে।
আজ মহাবিশ্বের স্ফীতি তত্ত্বে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ডার্ক এনার্জির মাধ্যমে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত হওয়ার সঠিত ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। তবে স্ট্রিং থিওরি এখনও পর্যন্ত প্রকল্পিত পর্যায়েই রয়ে গেছে। বহু মহাবিশ্বের আরও প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমাদের প্রসারমান মহাবিশ্বের সঙ্গে এর প্রতিবেশীদের সম্ভাব্য সংঘর্ষ থেকে পাওয়া যেতে পারে। এমন মহাজাগতিক সংঘর্ষ থেকে মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনে তাপমাত্রার তারতম্যের বাড়তি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে যা একদিন ধরা পড়বে অত্যাধুনিক টেলিস্কোপে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন