শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

বিভাজিত শক্তিকে শাসন করা খুব সহজ

আবদুল মান্নান


ইংরেজরা ভারত উপমহাদেশেকে ২শ’ বছর শাসন ও শোষণ করতে একটা অস্ত্র খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে আর সেটা হচ্ছে বিভাজনের রাজনীতি। ভারতবর্ষ অসংখ্য ভাষা, কৃষ্টি আর ধর্মের দেশ। জাত পাতের বিভাজনও অনেক ক্ষেত্রে বেশ প্রকট ছিল। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করে তাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ইংরেজরা সফল হয়েছিলেন। তাদের ২শ’ বছরের শাসনের নীতি ছিল ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ (উরারফব ধহফ জঁষব)। এক সময় কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ এক সাথে ভারত স্বাধীন করার আন্দোলনে নিয়োজিত ছিল। অনেকটা চালাক ইংরেজদের প্ররোচনায় মুসলীম লীগ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত দ্বিখণ্ডিত করার কর্মসূচী হাতে নিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব আর ভারত ভাগ সবই ছিল ইংরেজদের কূটবুদ্ধির ফলশ্রুতি। বর্তমানে উপমহাদেশের সব পারস্পরিক সমস্যার মূল জন্মদাতা ওই ইংরেজ শাসকরাই। ব্রিটেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্টভাষী রবিন কুক (১৯৯৭-২০০১) অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় এই সত্যটি তার দায়িত্ব পালনকালেই প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তানের পাশতুন নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান (১৯১৭-২০০৬) ১৯৮৬ সালে Facts are Facts নামে ভারত ভাগের ওপর এক অসাধারণ গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যাতে তিনি ভারত ভাগের অনেক অকথিত কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে জিন্নাহ আর মুসলীম লীগ ইংরেজদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। ইংরেজরা তাদের ‘ভাগ করো আর শাসন করো’ নীতিটাকে কৌশলে একটু পরিবর্তন করে তাতে যোগ করে ‘তোমরা বিভাজিত হও আমরা শাসন করি’ (You divide and we rule)। বিভাজনের দায়িত্বটা তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারা ইংরেজদের হতাশ করেননি। ইংরেজরা উপমহাদেশ ছেড়েছে ১৯৪৭ সালে। সেই অবধি তাদের রেখে যাওয়া মতবাদ এদেশের রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে এই মতবাদকে খুবই যতেœর সাথে লালন করে এদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল যার নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বাধীন হয়েছে সেই আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনসহ আওয়মী লীগপন্থী অনেক পেশাজীবী সংগঠন। কোন্দল, আন্তঃদলীয় কলহ, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়িতে এই দলের কিছু অর্বাচীন নেতা-নেত্রীর জুড়ি নেই। তাদের এই বিভাজিত হওয়ার দর্শনের প্রথম শিকার হয় তারা নিজে এবং সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত প্রগতিশীল শক্তি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার পারদর্শিতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো এত সুচারুভাবে অন্য কোন দল বা গোষ্ঠী দেখাতে পারবে না। অথচ ঠিক উল্টোটা ঘটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে। আদর্শভিত্তিক দল বলে যা বুঝায় তা বিএনপি কখনও ছিল না। এটি কিছু দলছুট, অতিবাম অতি ডান সুবিধাবাদীদের একটা ক্লাব হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। যখন তাদের সামনে যে কোন মূল্যে আওয়ামী লীগ ঠেকানোর একটা বিকল্প আসে তখন তারা সব ভেদাভেদ ভুলে একজোট হতে কোন ধরনের সময়ক্ষেপণ করে না এবং দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে সফল হয়। দু’একটা উদহারণ দেওয়া যেতে পারে। 
১৭ জুন ২০১০ সালে চট্টগ্রামে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নাগরিক কমিটির ব্যানারে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর আগে তিন তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে মনে করা হতো একজন জননেতার প্রতিকৃতি। কিন্তু শেষের দিকে তার কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের কারণে তিনি নিজেই তার পরাজয় নিশ্চিত করে এনেছিলেন। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের এই নির্বাচনে দেওয়ার মতো কোন প্রার্থীই ছিল না। তারা বগলদাবা করলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সৃষ্ট মুজিব কোট পরা একজন ওয়ার্ড কমিশনার। তাদের মূল শক্তি কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের চরম বিভক্তি। সেই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে সহজে তারা এই মুজিব কোট পরা ওয়ার্ড কমিশনারকেই মেয়র পদে জিতিয়ে আনল । বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যে বেহাল দশা তাতে আগামীতে ভাল কিছু হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হয়েছে অন্যান্য স্থানের স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। অথচ দলের অন্তর্কোন্দলের অর্ধেকও যদি কমত তা হলে অনেক আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল । 
দলীয় কোন্দলের কারণে শুধু যে স্থানীয় সরকার বা কোন কোন ক্ষেত্রে উপনির্বাচনে আওয়মী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে তাই নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল ধারার পেশাজীবীদের অনেক সংগঠনের নির্বাচনেও তাদের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে স্রেফ কোন্দল, অনৈক্য আর কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে। দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি, সুপ্রীমকোর্ট বার নির্বাচনসহ অনেক পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন এখানে উল্লেখ্য। তবে সবচাইতে লক্ষণীয় পরাজয়গুলো ঘটেছে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধিবদ্ধ পর্ষদগুলোতে এবং এই পরাজয়ের পেছনে মূল কারণ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের মধ্যে চরম অনৈক্য এবং ক্ষুদ্র স্বার্থে অন্তর্দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পর্ষদে নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রগতিশীল শিক্ষক নেতারা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তাদের হারের মূল কারণ নিজেদের মধ্যে চরম অনৈক্য। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ পর্ষদের নির্বাচন। প্রায় সবই আওয়ামীপন্থী নীল দল শোচনীয়ভাবে হেরেছে। হারার কারণ একই, অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে উপাচার্য তার কর্মকা- চালাতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরাজয়ের পেছনে যাদের অবদান তারা হয়ত ঢেঁকুর তুলবেন এই বলে যে, যাক প্রশাসনকে একটা শিক্ষা দেওয়া গেল। কিন্তু পুরো বিষয়টা যে একটি আত্মঘাতী হয়েছে তা কী তারা ভেবে দেখেছেন? দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তারা মূল দল হতে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে একটা আলাদা দল করবেন। এই কাজটি তারা ইতোপূর্বেও করেছেন এবং তাতে সব সময় লাভবান হয়েছে প্রতিপক্ষ । এই বিশ্ববিদ্যালয় আবার দীর্ঘদিন ধরে এদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের একটা অভয়াশ্রম। এই বিভাজন সৃষ্টিকারীদের আত্মঘাতী কার্যকলাপের কারণে অতীতে সব সময় অভয়াশ্রম আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। দেশে যখন বহু প্রত্যাশিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ চলছে প্রগতিশীলদের ঘোষণা দিয়ে এমন বিভাজন কাদের স্বার্থ রক্ষা করবে? 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শরিফ এনামুল কবিরকে চলে যেতে হলো । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি আবার বিচিত্র। উপাচার্যপন্থী আর উপাচার্যবিরোধী। সকলে নাকি আবার বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। একপক্ষ চায় উপাচার্য থাকুক, অন্যপক্ষ তার বিদায়ের জন্য সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে তার দফতরের সামনে বসে পড়লেন। শেষতক উপাচার্যকে যেতে হলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সীমা নেই। তবে সবচাইতে মারাত্মক অভিযোগ তিনি তার পদ ধরে রাখার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন। এটি যদি তিনি করে থাকেন তবে কাজটিকে কখনও নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ড. আনোয়ার হোসেনকে সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছেন। তার মতো একজন ব্যক্তিকেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলে খোলা মনে গ্রহণ করেছেন তা নয়। আমি আমার অন্য আর একটা লেখায় বলেছিলাম, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মাঝ হতে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করলে সব চাইতে ভাল হয়। চ্যান্সেলর যেটি ভাল মনে করেছেন তাই তিনি করেছেন। তবে এতে সমস্যার পুরো সমাধান হবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। এই মুহূর্তে আমরা ড. আনোয়ার হোসেনের সাফল্য কামনা করতে পারি। 
বিভাজন যে শুধু পেশাজীবীদের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ তা নয়। সরকারী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ তো এখন একটি দানব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী দলটি এখন দল, উপদল, কোন্দলে বিভক্ত। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পাঁচ ছয়ভাগে বিভক্ত। তাদের কোন প্রতিপক্ষ না থাকাতে তার নিজেরা নিজেদের মধ্য হতে প্রতিপক্ষ বানায় এবং একে অপরের মাথা ফাটায়। এতে খুশি হয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে ঘাপটি মেরে বসে আছে তারা বলে ‘বাহ বেশ বেশ’। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি করছেন। এটি একটি ন্যায্য দাবি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা না হলে দেশের রাজনীতিতেও কিভাবে গণতন্ত্র চর্চা হবে? তবে বাস্তবটা হচ্ছে এই মুহূর্তে যদি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া হয় এবং তা যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় তা হলে ছাত্রলীগের পরাজয় অবধারিত। তার একমাত্র কারণ ওই আন্তর্কলহ এবং কোন্দল আর তার ওপর যোগ হয়েছে তাদের ভয়াবহ ইমেজ সঙ্কট। 
সব ঠিক থাকলে আর বছর দেড়েক পর সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার এসব বিভাজিত শক্তি নিয়ে কিভাবে সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে মোকাবেলা করবে? বিভাজিত শক্তি তো কখনও শক্তভাবে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারে না। এই মূল্যবান কথা ক’টি বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, সেই ১৮৫৮ সালে যখন তার দেশ ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জ্বলছিল । 

লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক 
২৫ মে ২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন