মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে যেভাবে বিবেক-বুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায় উপলব্ধি করার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে, তা অন্য কোন সৃষ্টির নেই। আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তারই ইবাদাত করার জন্য। মানুষের কল্যাণ করা, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান, ন্যায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। দুইজনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হলে তা ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ নিত্তি করে দেয়া মুমিনের আলামত। যারা সত্যবাদী ও সঠিক বিচারকার্য সম্পাদন করেন, আল্লাহপাক তাদেরকে ভালবাসেন। হাদীস শরীফের ভাষ্যানুযায়ী হাশরের ময়দানে ৭ শ্রেণীর লোক আল্লাহ্র আরশের ছায়াতলে স্থান পাবেন, তন্মধ্যে ন্যায়পরায়ণ বিচারক রয়েছেন। সেই কঠিন বিচারের দিন আল্লাহ্র আদালতে বিশেষ সম্মানের অধিকারী (আরশের ছায়াতলে আশ্রয়ী) হতে হলে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে দুনিয়াতে এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। একদা রাসূল (সা.)'র নিকট এক ইহুদী জনৈক সাহাবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে এলেন। তখন সঠিক তদন্তপূর্বক মহানবী (সা.) যে রায় দিয়েছেন সেটা ইহুদি ব্যক্তির পক্ষে গিয়েছিল। ইসলামের নবী সেদিন স্বীয় সাহাবীর বিরুদ্ধে রায় দিতে কার্পণ্য করেননি। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবীকরীম (সা.) একদা চুরির বিচারকার্য সম্পাদনের সময় বলেছেন, আমার কলিজার টুকরা ফাতেমাও (রা.) যদি এমন অপরাধ করতো তাহলে আমি তারও হাত কর্তনের নির্দেশ দিতাম।'
আমাদের দেশে ইদানীং উচ্চ আদালত থেকে নিয়ে বিচার ব্যবস্থার ওপর নানা অভিযোগ শুনা যাচ্ছে। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ মেনে, আল্লাহর আদালতে হাজিরার কথা স্মরণ করে চলতে পারি তাহলে দুনিয়া আখিরাতে সবারই মঙ্গল বয়ে আনবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাকে ‘বিভীষিকাময়' বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। এসব রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সরকারি বাহিনী বিপুলসংখ্যক নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। অনেক নাগরিককে গুম করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুসহ নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্রের উলঙ্গ শক্তি প্রদর্শনে নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে আইনশৃক্মখলা বাহিনী এবং সরকারদলীয় ক্যাডাররা। অবৈধভাবে নির্বিচারে গ্রেফতার প্রতিদিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাওয়ার পথও বন্ধ করা হয়েছে। বিচার বিভাগকে ক্রমবর্ধমান এবং অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের মাধ্যমে সরকারবিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০১১ সালের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বুধবার ও বৃহস্পতিবার রিপোর্ট তিনটি প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে নানা উপায়ে। নারী, শিশু, সংখ্যালঘু, গার্মেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসহ প্রত্যেক শ্রেণী-পেশার মানুষের ওপরই নেমে এসেছে অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে এসব রিপোর্টে। বলা হয়েছে, এখানে ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বিচার বিভাগ সম্পর্কে বলা হয়, আইনে আছে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় তারা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত করা হয়েছে। ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশন ওইসব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা বলেন, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। বছরজুড়ে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে আগের সরকারের আমলে করা মামলা থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের রেহাই দেয়া হয়েছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির ২০১১ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃক্মখলা বাহিনীর সদস্যরা গত বছর ৫৪ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। বিনা বিচারে আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। রিপোর্টে বলা হয়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১১ সালে অসংখ্য নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ গবেষক আববাস ফয়েজের কথায়, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের বিচার পাওয়ার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি যাদের বিচার চলছে, তারা যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেন বা তারা যেন নির্যাতনের শিকার না হন, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি।' (দৈনিক আমার দেশ ২৬ মে ২০১২)।
বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে যেভাবে জেল-জুলুম, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতা অপব্যবহার করে রিমান্ডের নামে মানুষের উপর অত্যাচার নির্যাতন চলছে তা মোটেই কাম্য নয়। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যেভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ, তেমনিভাবে ইসলাম ধর্মেও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া নিষিদ্ধ। পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়, একথা আমরা শুধু মুখেই বলে থাকি।
হযরত ওরওয়া ইবনে হেশাম ইবনে হাকীম (রা.)-এর বর্ণনা, আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আমি এরশাদ করতে শুনেছি-দুনিয়াতে যারা মানুষকে না-হক কষ্ট দেয়, হাশরের ময়দানে আল্লাহপাক তাদের ওপর কঠোর আযাব নাযিল করবেন। হযরত আয়েশার (রা.) বর্ণনা, তিনি নবী করীমকে (সা.) বলতে শুনেছেন-কোমলতার সাথে যা করা হয়, তাতে একটা স্বতন্ত্র সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়ে যায়। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা (রা.) একবার একটি উটে আরোহণ করে কোথাও যাচ্ছিলেন। উটটি কিছুতেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছিল না। হযরত আয়েশা (রা.) হাতের ছড়ি দ্বারা আঘাত করে করে সেটিকে অগ্রসর করতে চেষ্টা করছিলেন। এ অবস্থা দেখে হযরত নবী করীম (সা.) হযরত আয়শাকে (রা.) ডেকে বলেছিলেন, আয়শা! এর প্রতি কোমল ব্যবহার করো। দয়ার নবী একটি পশুর সাথে ভাল ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। আর আমরা মানুষ হয়ে মানুষের সাথে কতইনা দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছি। সাধারণ একটি বিষয় নিয়ে আপন ভাইকে হামলা মামলা দিয়ে কষ্ট দিচ্ছি। মিথ্যা মামলা দিয়ে, জুলুম-নির্যাতন করছি এমনকি খুন করতেও পিছপা হচ্ছি না।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত হাদীসে রাসূল (সা.) গ্রন্থে উল্লেখিত চল্লিশ হাদীসের মধ্যে ২০নং হাদীসে হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত যে, শাসকের পক্ষে ক্ষমা তার শাসন ক্ষমতার স্থায়িত্বের উছিলা হয়ে থাকে। একই গ্রন্থের ৩৪নং হাদীসে ‘সেবকগণই জাতির প্রকৃত নেতা' বলা হয়েছে। আর বর্তমানে শাসকগণই শোষকের ভূমিকা পালন করছে। রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করছে। আমাদের দেশে বর্তমানে জনতার উপর যে হারে নির্যাতন চলছে, তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। যারা জনগণের নিরাপত্তাবিধানকারী তাদের হাতেই আজ মানুষ বেশি নির্যাতনের শিকার। শাসক শ্রেণী ও র্যাব-পুলিশের হাতে মানুষ নির্মমতার শিকার। বিচারকদের নিকটও অনেকেই সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। মানুষকে অন্যায়ভাবে যারা কষ্ট দেয়, নির্যাতন করে তাদেরও একদিন আল্লাহর আদালতে বিচার হবে।
এ জন্য আমাদের দেশের বিচারকদের উচিত বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা। কারণ ক্ষমতা ও বিবেক আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। যারা এই নেয়ামতের অপব্যবহার করবেন, নিশ্চয় তাদের জন্য আহকামুল হাকিমীন মহান আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালার মুখোমুখি হতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ইশারায় যারা (সত্য গোপন করে) বিচারকার্য পরিচালনা করেন তাদের সম্পর্কে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন, ক্রোধ ঈমানকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দেয় যেমন ভয়ঙ্কর তিক্ত কোনো ফল মধুর স্বাদ বিনষ্ট করে।(বায়হাকী)।
পরিশেষে আমাদের সকলকেই একথা মনে রাখা উচিত যে, আল্লাহপাক কাফেরের প্রতিও সদয় দৃষ্টি দেন কিন্তু আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত (প্রশাসক-বিচারক) ব্যক্তির প্রতি কখনো সদয় হন না। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সত্য ও ন্যায়ের পথে সঠিক বিচার, সঠিক সাক্ষ্য দেয়ার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন