মোঃ শরীফুল ইসলাম খান
উ”চ মাধ্যমিকে বাংলা পাঠ্যবইয়ের বিলাসী গল্পের একটি লাইন প্রায়ই মনে পড়ে। জীবনের ধূসর লগ্নে তা হুবহু মনে করতে পারি কিনা জানি না। যতদূর মনে পড়ে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘২৬ বছর সংসার জীবনযাপন করিয়াও একে অন্যকে চিনিতে পারে নাই।’ বহু বছর পর একটি জাতীয় দৈনিকে পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, ‘৯২ বছর বয়স্কা জনৈকা বৃদ্ধা (দেশ ও নাম মনে নেই) ৭৪ বছর সংসার জীবনযাপন করার পর তার প্রথম স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিকের সঙ্গে নতুন করে সংসার জীবনে আবদ্ধ হন।’ ৭৪ বছর সংসার অতিবাহিত করে তিনি বুঝতে পারেন তার সাবেক স্বামী তার জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না। সেই কারণে তার একাকিত্ব মোচনে তাকে ৭৪ বছর পর অন্য কাউকে বেছে নিতে হল। উপরের গল্প ও সংবাদের উদ্ধৃতি সংসার জীবনকে ঘিরে কোন দোদুল্যমানতা তৈরির জন্য নয়। কবি, সাহিত্যিক, মনোবিজ্ঞানী আজও যে জায়গাটিতে অহরহ অনুসন্ধান করে বেড়া”েছন, তা হ”েছ মানুষের মন। এ মন কখন কী চায় তা আজও রহস্যের বেড়াজালে রয়ে গেছে। আর তাই তাকে পুরোপুরি বোঝার জন্য কাজ করে যা”েছ বিজ্ঞান। শুনতে পাই ভবিষ্যতে এমন যন্ত্র আবিষ্কার হবেÑ যা মানুষের ভেতরকার চিন্তা-চেতনাকে প্রকাশ করবে। তার আগ পর্যন্ত মানুষের ই”ছা, অনি”ছা, ক্রোধ, ভালোবাসা এগুলোর বহিঃপ্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম ও বাহন হ”েছÑ ভাষা; আর সেই ভাষার যথাযথ প্রয়োগের জন্য বাক্য চয়ন অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ। একজন মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, তার ভেতরের যে আমি তার বহুল অংশ পরিস্ফুটিত হয়ে আসে তার বাক্য দিয়ে। আমরা একজন মানুষ কতটা মার্জিত ও র“চিবোধসম্পন্ন, তিনি কী করতে চান, কী করতে পারবেন তার অধিকাংশই নির্ণয় করি তার কথাবার্তার ধরন ও বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে। বাক্যের গুর“ত্ব অন্য আরেকটি কারণে। এ বিশ্ব সংসারের অনেক কিছুই ভুল ছিল বলে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের আওতায় আনা যায়। পরিবেশ দূষণের মারাÍক প্রতিক্রিয়াকেও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঠেকানো যায়। কিš‘ বাক্য একবার মুখ থেকে বের হয়ে গেলে তা বাতাসে মিলিয়ে যায়, কোন চেষ্টাতেই নির্গত বাক্য ফিরিয়ে এনে তাকে নতুন করে সাজানো বা সংশোধন করা যায় না। বিজ্ঞান এখনও তা পারেনি। অশালীন বাক্য প্রয়োগ করে পরে হয়তো দুঃখ প্রকাশ করা যায়, সংসদে এক্সপাঞ্জ করা যায়, কিš‘ হারিয়ে যায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা। যদিও ব্যক্তি ধারণা করে, আমরা এগুলো এক সময় ভুলে যাই, আবার তাদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করি। আসলে আমরা তা ভুলি না। অন্য কোন উপায়ান্তর না দেখে বা কখনও তাঁবেদারির মজ্জাগত কারণে আমরা ভুলে যাওয়ার বা মর্যাদা দেয়ার ভান করি মাত্র।
আমাদের সামাজিক বলয়ের বেশির ভাগ লোকই অপ্রাপ্তির মহাফোকরে দিন দিন কথাবার্তা, চালচলনে বেপরোয়া হয়ে পড়ছি। সমবেদনা, সংবেদনশীলতা, সহ্য ক্ষমতা এগুলো আমাদের একেবারেই নেই বরং অশোভন আচরণ এখন আমাদের মার্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে এখন আর এহেন ক্ষেত্র নেই, যেখানে বিভক্তি নেই আর এ বিভক্ত বলয়ে ভাগাভাগি হয়ে নিজেরা অশালীন, অসভ্য উক্তিতে দূরত্ব তৈরি করছি একে অন্যের সঙ্গে। একটু নজর দিলে দেখব রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশ, সার্জেন্ট, ট্রাফিক, হাসপাতালে আয়া, নার্স, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, করপোরেটের ব্যক্তিরা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক বলয়ের অন্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাগ দমন করি অসভ্য, নোংরা ও কুর“চিপূর্ণ বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে, যা আমাদের সমাজের সব স্তরকে করে ফেলছে র“চিহীন। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সারা জাতি, কেউ কাউকে মানছি না, বিশ্বাস করছি না। সেই ধারায় ভেঙে যা”েছ নদী ভাঙনের মতো সমাজের সব কূল। পরিশীলিত জাতি হিসেবে আমাদের তৈরি হওয়ার পথ করে ফেলছি কষ্টসাধ্য, সভ্যতার অগ্রগতি থেকে রয়ে যা”িছ দূরেÑ বহু দূরে। বিধ্বস্ততায় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে নামছি ধ্বংসযজ্ঞে। যে কোন ইস্যুতেই ভাঙছি নিজেদের গাড়ি নিজেরা। নিজেরা পোড়া”িছ নিজেদের, যখন বোধোদয় ঘটবে তখন নিঃশেষ হয়ে যাবে হয়তো অনেক কিছু। তাই আর দেরি না করে রাজনীতিকদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে পুরো জাতিকে সু¯’তায়।
আমরা জানি, যে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সচেতনতা, প্রণোদনা, আইন-কানুন এগুলো সাধারণ জনগণের আওতাভুক্ত নয়। সরকার একমাত্র যন্ত্র, যে এগুলো প্রয়োগ করে জনগণের সুষ্ঠু জীবন ধারণের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে। সরকার ও সরকারি দলকে নিজেদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে লাগাম ধরে রাখতে হবে। সরকারকে এ লাগাম ধরে রাখায় সর্বাধিক সহায়তা করার নৈতিক দায়িত্ব বিরোধী দলের।
রাজনীতিতেই যদি চলতে থাকে অশোভন কথার ফুলঝুরি, চলে দ্বৈত-বাক্য সংঘাত, তাহলে দেশের আর অন্য কোন কাঠামোতে শোভন কিছু প্রত্যাশা করার কোন সুযোগই নেই। সুন্দর গোছানো বাক্য দিয়ে অনেক নেতিবাচক বিষয়কেও ইতিবাচক বোধে আনা যায়। নির্দিষ্ট ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা চলতে পারে কিš‘ খারাপ বাক্য অনেক ইতিবাচক বিষয়কেও প্রশ্নবোধক করে তোলে এবং অযথা দ্বন্দ্ব তৈরি করে। রাজনীতিতে বাক্যের অশালীনতার প্রকোপ বাড়ার অন্যতম যে কারণÑ আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রত্যাশিত ভালো মানুষ এখন আর সম্পৃক্ততা রাখতে চান না। এখন রাজনীতিতে যারা সম্পৃক্ত ও সো”চার তাদের বেশির ভাগই সামাজিক বলয়ে অপ্রত্যাশিত পরিচিতিতে বেড়ে ওঠা। আরেক শ্রেণী রয়েছেন যারা রাজনীতি ভালো বোঝেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথিতযশা কিš‘ তাদের বাক্য এক, কর্ম আরেক। বাক্য দিয়ে দেশ ও জাতির স্বপ্ন বুনেন আর ক্ষমতাপুষ্ট হয়ে কর্ম দিয়ে অকাতরে করেন জনতার স্বপ্ন চুরি। নিজেরাও করেন, নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে অন্যকে দিয়েও করান। রাজনীতির এ হীন ও অপসংস্কৃতির কারণে সাধারণত সুধীজন ও সুশীল মানসিকতার বেশির ভাগই রাজনীতির বাইরে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজ পরিবর্তনে বরেণ্য ব্যক্তিদের কোণঠাসা অব¯’া অবলোকন করা ছাড়া অন্য কোন অব¯’ান নেয়ার সাহস ও মানসিকতা দিন দিন ফুরিয়ে যা”েছ আমাদের। সেই ফোকরে রাজনীতি চলে যা”েছ নোংরামির সর্বশেষ পর্যায়ে। হজম করার সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতির যে নজিরটি এরই মধ্যে ¯’াপন করে ফেলেছি আমরা তা হ”েছ, ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ব বরেণ্য এবং দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বাক্যবাণে মানসিক নিপীড়ন করা।
প্রায়ই আমাদের সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে অযাচিত বাক্যাবলী ব্যবহƒত হয় সেটা অনভিপ্রেত। সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনা তৈরির নজির সারাবিশ্বে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও (৩০ মার্চ ২০১২) তুরস্কের পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যরা স্কুল সংস্কার আইন পাস করা নিয়ে হাতাহাতি করেছেন। আমাদের সংসদে বেশির ভাগ অশ্রাব্য কথাবার্তা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিদ্বেষের মাত্রা যে বর্বরতার দিকে দেশ ও জাতিকে ঠেলে দি”েছ তার ফলাফল সারাজাতি ভোগ করছে। সেদিনও সামান্য পায়ে পাড়া দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্ররা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার ভোগান্তির শিকার হয়েছে সাধারণেরা। কথা কাটাকাটি, অশ্রাব্য গালাগালি মানুষের মধ্যে জানোয়ারের উš§াদনা এনে দেয় আর সেই উš§াদনায় সভ্যতা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। সোজা হয়ে তা দাঁড়াতে পারে না।
সাধারণেরা সাধারণ। এদের সোজা পথে আনা খুব কঠিন কিছু নয়। এ দেশে এখনও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রয়োজনে কড়া কিছু আইন তৈরি করে এবং সর্বতোভাবে তা প্রয়োগ করে জনগণকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসা যাবে। রাজনীতিবিদরা দেশের মূল চালিকাশক্তি। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সব হিসাব-নিকাশে এরা রাজ-রাজা। তাই সর্বাগ্রে রাজনীতিবিদদেরই বাক্য সংযম প্রয়োজন। বাক্য দূষণের ধ্বংস ভীষণ, তা উপলব্ধি করতে না পারলে হিন্দি ছবির অশ্লীল দৃশ্য থেকে বা”চাদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য আমরা যেমন টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে ফেলি, তেমনিভাবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজš§।
মোঃ শরীফুল ইসলাম খান : ব্যাংকার
ংযধৎরভশযধহ৬৪@মসধরষ.পড়স
উ”চ মাধ্যমিকে বাংলা পাঠ্যবইয়ের বিলাসী গল্পের একটি লাইন প্রায়ই মনে পড়ে। জীবনের ধূসর লগ্নে তা হুবহু মনে করতে পারি কিনা জানি না। যতদূর মনে পড়ে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, ‘২৬ বছর সংসার জীবনযাপন করিয়াও একে অন্যকে চিনিতে পারে নাই।’ বহু বছর পর একটি জাতীয় দৈনিকে পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানতে পারি, ‘৯২ বছর বয়স্কা জনৈকা বৃদ্ধা (দেশ ও নাম মনে নেই) ৭৪ বছর সংসার জীবনযাপন করার পর তার প্রথম স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিকের সঙ্গে নতুন করে সংসার জীবনে আবদ্ধ হন।’ ৭৪ বছর সংসার অতিবাহিত করে তিনি বুঝতে পারেন তার সাবেক স্বামী তার জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না। সেই কারণে তার একাকিত্ব মোচনে তাকে ৭৪ বছর পর অন্য কাউকে বেছে নিতে হল। উপরের গল্প ও সংবাদের উদ্ধৃতি সংসার জীবনকে ঘিরে কোন দোদুল্যমানতা তৈরির জন্য নয়। কবি, সাহিত্যিক, মনোবিজ্ঞানী আজও যে জায়গাটিতে অহরহ অনুসন্ধান করে বেড়া”েছন, তা হ”েছ মানুষের মন। এ মন কখন কী চায় তা আজও রহস্যের বেড়াজালে রয়ে গেছে। আর তাই তাকে পুরোপুরি বোঝার জন্য কাজ করে যা”েছ বিজ্ঞান। শুনতে পাই ভবিষ্যতে এমন যন্ত্র আবিষ্কার হবেÑ যা মানুষের ভেতরকার চিন্তা-চেতনাকে প্রকাশ করবে। তার আগ পর্যন্ত মানুষের ই”ছা, অনি”ছা, ক্রোধ, ভালোবাসা এগুলোর বহিঃপ্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম ও বাহন হ”েছÑ ভাষা; আর সেই ভাষার যথাযথ প্রয়োগের জন্য বাক্য চয়ন অত্যন্ত গুর“ত্বপূর্ণ। একজন মানুষের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, তার ভেতরের যে আমি তার বহুল অংশ পরিস্ফুটিত হয়ে আসে তার বাক্য দিয়ে। আমরা একজন মানুষ কতটা মার্জিত ও র“চিবোধসম্পন্ন, তিনি কী করতে চান, কী করতে পারবেন তার অধিকাংশই নির্ণয় করি তার কথাবার্তার ধরন ও বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে। বাক্যের গুর“ত্ব অন্য আরেকটি কারণে। এ বিশ্ব সংসারের অনেক কিছুই ভুল ছিল বলে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের আওতায় আনা যায়। পরিবেশ দূষণের মারাÍক প্রতিক্রিয়াকেও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঠেকানো যায়। কিš‘ বাক্য একবার মুখ থেকে বের হয়ে গেলে তা বাতাসে মিলিয়ে যায়, কোন চেষ্টাতেই নির্গত বাক্য ফিরিয়ে এনে তাকে নতুন করে সাজানো বা সংশোধন করা যায় না। বিজ্ঞান এখনও তা পারেনি। অশালীন বাক্য প্রয়োগ করে পরে হয়তো দুঃখ প্রকাশ করা যায়, সংসদে এক্সপাঞ্জ করা যায়, কিš‘ হারিয়ে যায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা। যদিও ব্যক্তি ধারণা করে, আমরা এগুলো এক সময় ভুলে যাই, আবার তাদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করি। আসলে আমরা তা ভুলি না। অন্য কোন উপায়ান্তর না দেখে বা কখনও তাঁবেদারির মজ্জাগত কারণে আমরা ভুলে যাওয়ার বা মর্যাদা দেয়ার ভান করি মাত্র।
আমাদের সামাজিক বলয়ের বেশির ভাগ লোকই অপ্রাপ্তির মহাফোকরে দিন দিন কথাবার্তা, চালচলনে বেপরোয়া হয়ে পড়ছি। সমবেদনা, সংবেদনশীলতা, সহ্য ক্ষমতা এগুলো আমাদের একেবারেই নেই বরং অশোভন আচরণ এখন আমাদের মার্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে এখন আর এহেন ক্ষেত্র নেই, যেখানে বিভক্তি নেই আর এ বিভক্ত বলয়ে ভাগাভাগি হয়ে নিজেরা অশালীন, অসভ্য উক্তিতে দূরত্ব তৈরি করছি একে অন্যের সঙ্গে। একটু নজর দিলে দেখব রাস্তায় কর্তব্যরত পুলিশ, সার্জেন্ট, ট্রাফিক, হাসপাতালে আয়া, নার্স, ডাক্তার, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, করপোরেটের ব্যক্তিরা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক বলয়ের অন্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাগ দমন করি অসভ্য, নোংরা ও কুর“চিপূর্ণ বাক্য প্রয়োগের মাধ্যমে, যা আমাদের সমাজের সব স্তরকে করে ফেলছে র“চিহীন। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সারা জাতি, কেউ কাউকে মানছি না, বিশ্বাস করছি না। সেই ধারায় ভেঙে যা”েছ নদী ভাঙনের মতো সমাজের সব কূল। পরিশীলিত জাতি হিসেবে আমাদের তৈরি হওয়ার পথ করে ফেলছি কষ্টসাধ্য, সভ্যতার অগ্রগতি থেকে রয়ে যা”িছ দূরেÑ বহু দূরে। বিধ্বস্ততায় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে নামছি ধ্বংসযজ্ঞে। যে কোন ইস্যুতেই ভাঙছি নিজেদের গাড়ি নিজেরা। নিজেরা পোড়া”িছ নিজেদের, যখন বোধোদয় ঘটবে তখন নিঃশেষ হয়ে যাবে হয়তো অনেক কিছু। তাই আর দেরি না করে রাজনীতিকদেরই ফিরিয়ে আনতে হবে পুরো জাতিকে সু¯’তায়।
আমরা জানি, যে কোন পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সচেতনতা, প্রণোদনা, আইন-কানুন এগুলো সাধারণ জনগণের আওতাভুক্ত নয়। সরকার একমাত্র যন্ত্র, যে এগুলো প্রয়োগ করে জনগণের সুষ্ঠু জীবন ধারণের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে। সরকার ও সরকারি দলকে নিজেদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে লাগাম ধরে রাখতে হবে। সরকারকে এ লাগাম ধরে রাখায় সর্বাধিক সহায়তা করার নৈতিক দায়িত্ব বিরোধী দলের।
রাজনীতিতেই যদি চলতে থাকে অশোভন কথার ফুলঝুরি, চলে দ্বৈত-বাক্য সংঘাত, তাহলে দেশের আর অন্য কোন কাঠামোতে শোভন কিছু প্রত্যাশা করার কোন সুযোগই নেই। সুন্দর গোছানো বাক্য দিয়ে অনেক নেতিবাচক বিষয়কেও ইতিবাচক বোধে আনা যায়। নির্দিষ্ট ইস্যুতে বাকবিতণ্ডা চলতে পারে কিš‘ খারাপ বাক্য অনেক ইতিবাচক বিষয়কেও প্রশ্নবোধক করে তোলে এবং অযথা দ্বন্দ্ব তৈরি করে। রাজনীতিতে বাক্যের অশালীনতার প্রকোপ বাড়ার অন্যতম যে কারণÑ আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রত্যাশিত ভালো মানুষ এখন আর সম্পৃক্ততা রাখতে চান না। এখন রাজনীতিতে যারা সম্পৃক্ত ও সো”চার তাদের বেশির ভাগই সামাজিক বলয়ে অপ্রত্যাশিত পরিচিতিতে বেড়ে ওঠা। আরেক শ্রেণী রয়েছেন যারা রাজনীতি ভালো বোঝেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথিতযশা কিš‘ তাদের বাক্য এক, কর্ম আরেক। বাক্য দিয়ে দেশ ও জাতির স্বপ্ন বুনেন আর ক্ষমতাপুষ্ট হয়ে কর্ম দিয়ে অকাতরে করেন জনতার স্বপ্ন চুরি। নিজেরাও করেন, নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে অন্যকে দিয়েও করান। রাজনীতির এ হীন ও অপসংস্কৃতির কারণে সাধারণত সুধীজন ও সুশীল মানসিকতার বেশির ভাগই রাজনীতির বাইরে মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজ পরিবর্তনে বরেণ্য ব্যক্তিদের কোণঠাসা অব¯’া অবলোকন করা ছাড়া অন্য কোন অব¯’ান নেয়ার সাহস ও মানসিকতা দিন দিন ফুরিয়ে যা”েছ আমাদের। সেই ফোকরে রাজনীতি চলে যা”েছ নোংরামির সর্বশেষ পর্যায়ে। হজম করার সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতির যে নজিরটি এরই মধ্যে ¯’াপন করে ফেলেছি আমরা তা হ”েছ, ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্ব বরেণ্য এবং দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বাক্যবাণে মানসিক নিপীড়ন করা।
প্রায়ই আমাদের সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে অযাচিত বাক্যাবলী ব্যবহƒত হয় সেটা অনভিপ্রেত। সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনা তৈরির নজির সারাবিশ্বে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেও (৩০ মার্চ ২০১২) তুরস্কের পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যরা স্কুল সংস্কার আইন পাস করা নিয়ে হাতাহাতি করেছেন। আমাদের সংসদে বেশির ভাগ অশ্রাব্য কথাবার্তা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিদ্বেষের মাত্রা যে বর্বরতার দিকে দেশ ও জাতিকে ঠেলে দি”েছ তার ফলাফল সারাজাতি ভোগ করছে। সেদিনও সামান্য পায়ে পাড়া দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছাত্ররা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার ভোগান্তির শিকার হয়েছে সাধারণেরা। কথা কাটাকাটি, অশ্রাব্য গালাগালি মানুষের মধ্যে জানোয়ারের উš§াদনা এনে দেয় আর সেই উš§াদনায় সভ্যতা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। সোজা হয়ে তা দাঁড়াতে পারে না।
সাধারণেরা সাধারণ। এদের সোজা পথে আনা খুব কঠিন কিছু নয়। এ দেশে এখনও ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। প্রয়োজনে কড়া কিছু আইন তৈরি করে এবং সর্বতোভাবে তা প্রয়োগ করে জনগণকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসা যাবে। রাজনীতিবিদরা দেশের মূল চালিকাশক্তি। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সব হিসাব-নিকাশে এরা রাজ-রাজা। তাই সর্বাগ্রে রাজনীতিবিদদেরই বাক্য সংযম প্রয়োজন। বাক্য দূষণের ধ্বংস ভীষণ, তা উপলব্ধি করতে না পারলে হিন্দি ছবির অশ্লীল দৃশ্য থেকে বা”চাদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য আমরা যেমন টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে ফেলি, তেমনিভাবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজš§।
মোঃ শরীফুল ইসলাম খান : ব্যাংকার
ংযধৎরভশযধহ৬৪@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন